"রুইয়াতে বারী তায়ালা সম্পর্কেঃ আখিরাতে মুমিনদের জন্য আল্লাহ্ ‘আযযা ও জাল্লাহুর দর্শন সত্য। এটি ঐ মাসআলা, যাকে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আত ব্যতীত, ইসলামী অন্যান্য ফিরকা এবং দার্শনিক পণ্ডিতগণ কেউই জায়েয বলেননি ।তাদের অস্বীকার করার কারণ হলােঃ গায়েব বা অদৃশ্যকে, হাজির বা দৃশ্যের উপর কিয়াস বা ধারণা করা, যা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। দৃষ্ট বস্তু যখন তুলনাহীন ও সাদৃশ্যবিহীন হয়, তখন সে সম্পর্কিত দর্শনও তুলনাবিহীনই হবে । এ বিষয়ের উপর ইমান আনা প্রয়োজন , কিন্তু তার কাইফিয়াত বা স্বরূপ কী, সে ব্যাপারে মশগুল বা লিপ্ত না হওয়াই উচিত । বর্তমানে এই সত্যটি বিশিষ্ট আওলীয়াদের উপর প্রকাশ করা হয়েছে । তারা যা কিছু দর্শন করেন , যদিও তা রুইয়াতে হক বা বাস্তব দর্শন নয়, তবুও তা- অদর্শনও নয়। বরং অবস্থা এই যে , যেমন হাদীছ পাকের ইরশাদ ‘যেনো তুমি যাতে হক তায়া'লাকে দেখছো।' । কেয়ামতের দিন সমস্ত মুমিন হক সুবহানুহু ওয়া তায়ালাকে স্বীয় বাহ্যিক চক্ষু দ্বারা অবলাকেন করবে। কিন্তু অনুধাবন করতে সক্ষম হবেনা। যেমন , কোরআন পাকের ইরশাদ ‘দৃষ্টি সমূহ তাঁকে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেনা। বস্তুতঃ, তারা কেবল দুটি বিষয় হৃদয়ংগম করতে পারবে ; প্রথমতঃ দর্শনকারী ‘ইলমুল ইয়াকীন বা বিশ্বাস জ্ঞান লাভ করবে এবং দ্বিতীয়তঃ উক্ত দর্শন দ্বারা আনন্দ ও সন্তুষ্টি এবং তার স্বাদ গ্রহণ করবে । এই দুইটি বস্তু ব্যতীত, দর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যাপারই তিরোহিত হবে । এই বিষয়টি ইলমে কালামের মধ্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং জটিল । জ্ঞান এ বিষয়ের প্রমাণের এবং এর চিত্রবলী অংকনে অক্ষম। যে সমস্ত আলেম ও সূফী শুধুমাত্র নবীগণের অনুসারী, তারা নবুয়তের নূর হতে সংগৃহীত নূরে ফিরাসাত বা অন্তর্দৃষ্টির নূর দ্বারা তাঁকে দর্শন করেছেন । একইভাবে , ইলমে কালামের বা কথাশাস্ত্রের অন্যান্য বিষয়গুলিও। জ্ঞান যা প্রমাণের অক্ষম ও হতবাক হয়, সেখানে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আলেমগণ ফিরাসাতের নূর দ্বারা তা অবলোকন করেন । কিন্তু সুফীদের ব্যাপার হলাে নূরে ফিরাসাতের সঙ্গে তাদের কাশফ এবং শুহুদও হাসিল হয়ে থাকে।
কাশফ এবং ফিরাসাতের মধ্যে পার্থক্যঃ কাশফ এবং ফিরাসাতের মধ্যে তদ্রুপ পার্থক্য, যদ্রুপ পার্থক্য অনুমান এবং অনুভবের মধ্যে । ফিরাসাত বা অন্তর্দৃষ্টি,নজরিয়াত (যার জন্য দলিল প্রমাণের আবশ্যক হয়, এমন বস্তু)-কে, অনুমানের বস্তুতে পরিণত করে এবং কাশফ তাকে , অনুভবের বস্তুতে পরিণত করে । ঐ সমস্ত মাসআলা, যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আলেমগণ বলছেন কিন্তু তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীগণ যারা জ্ঞানে প্রাধান্য দিয়েছেন - তারা তাকে অস্বীকার করেছেন । এ সমস্ত একই ধরনের । তারা সেটা ফিরাসাতের নূর দ্বারা জেনেছেন এবং সঠিক কাশফের মাধ্যমে দর্শন করেছেন । যদি এ ব্যাপারগুলো কোথাও বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা যায়, তবে চিত্রাঙ্কন এবং উপদেশ দেওয়াই সার হবে । বাস্তব দলিল প্রমাণাদি দ্বারা এ ব্যাপারটি সঠিক প্রতিপন্ন করা খুবই কঠিন । কেননা , জ্ঞানের চিন্তা এবং দৃষ্টি - তার প্রতিষ্ঠায় এবং চিত্রাঙ্কনে অন্ধ মাত্র। এ সমস্ত ব্যাপারে যারা মনে কর যে , তারা দলিল প্রমাণাদির সাহায্যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করবে এবং বিরোধী পক্ষের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে , তা আদৌ সম্ভব নয়। কেননা , তাদের বিরোধীপক্ষ এসব দেখে মনে করবে যে, তাদের দলিলগুলি যেমন দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ, তেমনি তাদের বিষয়গুলিও ভ্রান্তিপূর্ণ এবং দুর্বল ও অসম্পূর্ণ।
যেমন , আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আলেমগণ ‘ইসতাতাআঁত মা'আল ফে'ল বা ‘কর্ম সম্পাদনে শক্তি থাকা'কে স্থির করেছেন । এটি এমন একটি হক ও সহীহ্ মাসআলা- যা ‘নূরে ফিরাসাত' ও ‘কাশফে সহীহ' দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে । কিন্তু একথা প্রমাণের জন্য তারা যে দলিল প্রমাণাদি উপস্থাপিত করেন, তা একবারেই দুর্বল এবং অসম্পূর্ণ। এই বিষয়টি প্রমাণের জন্য তারা যে সমস্ত দলিল পেশ করেন , তার মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী দলিল হলাে দুইটি যামানা বা কালের মধ্যে কোনাে পার্থক্য না থাকা। কেননা , জাওহার (যা কোনাে সাহায্য ব্যতিরকে নিজ নিজেই অস্তিত্ত্ববান) এর বিপরীতে ‘আরজ (যা অন্য বস্তুর কারণে স্থিতিশীল); উভয়ই কালের মধ্যে একই সাথে স্থিতি হয়, যা আদৌ সম্ভবপর নয়। বস্তুতঃ বিরোধীপক্ষ এই দলিলকে দুর্বল এবং অসম্পূর্ণ মন করেছেন । কাজেই তারা উক্ত বিষয়টিকেও ত্রুটিপূর্ণ মনে করেছেন। কিন্তু তাঁরা একথা বুঝতে পারেননা যে,এই মাসআলাটি এবং অন্যান্য বিষয়াদিও যা আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের অনুসারী আলেমগণ বর্ণনা করেছেন ; তা নূরে ফিরাসাতের মাধ্যমে , নবুয়তের নূর থেকে সংগৃহীত হয়েছে । কিন্তু এটা আমাদেরই দুর্বলতা যে , আমরা নিছক অনুমান এবং আল্লাহ্ প্রদত্ত দর্শনকে বিপক্ষদলের সম্মুখে দলিল হিসেবে প্রকাশ করি এবং ভনিতা দিয়ে তা প্রতিষ্ঠার জন্যও চেষ্টা করি। এর ফলে বড় জোর এই হতে পারে যে, আমাদের অনুমান এবং আল্লাহ্প্রদত্ত দর্শন, বিপক্ষদলের জন্য দলিল হিসবে গৃহীত হবে না। যদি তাই হয়, তবে আমাদের জন্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া ব্যতীত আর কিছুই করণীয় নেই । যে ব্যক্তি পূর্ণ মুসলমানের ন্যায় উত্তম আকীদায় বিশ্বাসী, সে একথা অকপট কবুল করবে । অপরপক্ষে, যে ব্যক্তি ভাগ্যহীন সে তা অস্বীকার করবে ।
মাতুরীদিয়া মতবাদের ফযীলত সম্পর্কেঃ আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আলমেদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম শায়েখ আবু মানসুর মাতুরীদি র. এর (শায়েখ আবু মানসুর মোহাম্মদ ইবন মোহাম্মদ ইবন মাহমুদ আল-হানাফী; আল-মাতুরীদি, আল-সমরখান্দী-রহ, মাতুরীদিয়া মতবাদের জনক। মাতুরীদি ফিরকা সুন্নী-মতবাদের একনিষ্ঠ অনুসারী একটি দল। মুতাযিলা ও অন্যান্য মুক্ত-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরোধিতার উদ্দেশ্যে এই দলের সৃষ্টি হয়। শায়েখ আবু মাননুর রহ. ইমাম আবুল হাসান আল-আশারী রহ. এর সমসাময়িক ছিলেন । তিনি হিজরী ৩৩৩ সনে সমরখন্দে মৃত্যুবরণ করেন।) তরীকাহ কতোই না উত্তম। তিনি কেবলমাত্র উদ্দেশ্য বর্ণনা করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন । এই মতবাদের আলেমগণ দার্শনিক সূক্ষ্মতত্ত্ব বর্ণনা করা থেকে নিজেদেরকে সযত্নে দূরে রেখেছেন । উলামায়ে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের মধ্যে শায়েখ আবুল হাসান আল আশআরী র. (ইমাম আবুল হাসান আলী আশআরী -আশআরী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইলমে কালামের জনক। তিনি ২৬০ হিজরীতে বসরায় জন্ম গ্রহণ করেন। ৪০ বৎসর বয়স পর্যন্ত তিনি মুতাযিলী সম্প্রদায়ের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ও প্রচারক ছিলেন । পরবর্তীকালে শাফি’ই মাজহাবের অনুসারী হিসাব দ্বীন মাসআলা-মাসায়েল , দার্শনিক ভংগিতে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়ােগ করেন । তিনি প্রায় তিন শত গ্রন্থ রচনা করেন । তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অনেক বড় বড় ইমাম ছিলেন ।
যেমন -ইমাম বাকেলানী , ইবন ফুরাক, ইসফারাইনী, আল-কুশায়েরী , জুওয়াইনী এবং ইমাম গাযযালী রহ। তিনি হিজরী ৩২৪ সনে বাগদাদে ইনতিকাল করেন।) প্রথম ব্যক্তি ,যিনি সূক্ষ্ম দার্শনিক ভঙ্গিতে দলিল প্রমাণাদির সাহায্যে বক্তব্য পেশ করতেন । তিনি ইচ্ছা পোষণ করতেন যে , আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা'আতের আকীদাসমূহ দার্শনিক তত্ত্বের সাহায্য সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন । কাজটি খুবই কঠিন । বরং এ ধরনের কাজ বিরুদ্ধবাদীদেরকে আরো সাহসী করে তোলে,ফলে তারা দ্বীনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে আশোভন উক্তি করে । সলফে সালেহীনদের তরীকাও পরত্যিাগ করে । আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে হকপন্থীদের আকীদার উপর সুদৃঢ় রাখুন, যারা নবুয়তের নূরে নূরান্বিত ছিলেন। হজরত রসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উপর পূর্ণ দরূদ ও সালাম।
_______________
কিতাব: মাবদা ওয়া মা'আদ
কৃত: হজরত মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: ড. আ ফ ম আবু বকর সিদ্দীক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন