ইয়াযিদ সম্পর্কে আলিমগণের অভিমত একটি পর্যালােচনা
ইয়াযিদের ফাসিক হবার ব্যাপারে আলিমগণ একমত পােষণ করেছেন। অল্প কয়েকজন আলিম এক্ষেত্রে ভিন্নমত দিয়েছেন। ইয়াযিদের ব্যাপারে আলিমগণের মতপার্থক্য প্রথমত দু'ভাগে ভাগ করা যায় :
১. ইয়াযিদকে কাফির বলা প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে আলিমগণের মতভেদ নিম্নরূপ :
ক. ইয়াযিদ কাফির ইয়াযিদের কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে তাকে সরাসরি কাফের বলেছেন ইবন আকিল ও আল্লামা আলুসি (رحمة الله)।
❏ তাফসিরে রুহুল বয়ানে আল্লামা আলুসি র, উল্লেখ করেছেন, ইয়াযিদের কাছে যখন হুসাইন (رضي الله عنه)সহ শহিদগণের শিরগুলাে বর্শায় বিদ্ধ করে নিয়ে আসা হলাে, তখন সে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিল। যার শেষ পঙক্তি ছিল নিম্নরূপ :
نَعَبَ الغُرَابُ فَقُلتُ أَو لاَ تَقُل + فَقَدِ اقتَضَیتُ مِنَ الرَّسُولِ دُیُونِی
কাক ডাকল কা-কা করে বললাম, তুমি বলাে আর নাই বলাে, আমি তাে রসুলের কাছ থেকে আমার পাওনা আদায় করে নিয়েছি।
❏ আল্লামা আলুসি এরপর বলেন,
يَغنِي أَنَّهُ قَتَلَ بِمَن قَتَلَهُ رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ تَعَالَى عَلَيهِ وَسَلَّمَ يَومَ بَذرِ کَجَدِهِ عُتبَةَ وَخَالِهِ وَلَدِ عُتبَةَ وَغَيرِهِمَا وَهَذَا كُفرُ صَرِيحُُ فَإِذَا صَحَّ عَنهُ فَقَد كَفَرَ بِهِ
“ইয়াযিদ বুঝাতে চেয়েছে, বদরের দিন রসুলুল্লাহ (ﷺ)এর সাথে যুদ্ধ করতে এসে তার বাবার নানা উতবা ও উতবার ছেলে তার বাবার] মামা ও অন্যরা নিহত হয়েছিল। তাদের হত্যার বদলায় সে এ হত্যা করেছে। এটা স্পষ্ট কুফরি। এটা সত্যি হলে সে কুফরি করেছে।
❏ তিনি আরও বলেছেনঃ
الَّذِي يَغلِبُ عَلَى ظَنِّي أَنَّ الخَبِيثَ لَم يَكُن مُصَدِّقًا بِرِسَالَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ تَعَالَی عَلَيهِ وَسَلَّمَ وَأَنَّ مَجمُوعَ مَا فَعَلَ مَعَ أَهلِ حَرَمٍ اللّٰهِ تَعَالَى وَأَهلِ حَرَمِ نَبِيِّهِ عَلَيهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ وَعِترَتِهِ الطَّيِّبِينَ الطَاهِرِينَ فِي الحَيَاةِ وَبَعدَ المَمَاتِ وَمَا صَدَرَ مِنهُ مِنَ المَخَازِي لَيسَ بِأَضعَفِ دَلاَلَةٍ عَلَى عَدَمِ تَصدِيقِهِ مِن إِلقَاءِ وَرَقَةِ مِنَ المُصحَفِ الشَّرِيفِ فِي قَذِرِ، وَلاَ أَظُنُّ أَنَّ أَمرَهُ كَانَ خَافِيَّا عَلَى أَجِلَّةِ المُسلِمِينَ إِذ ذَاكَ وَلَكِن كَانُوا مَغلُوبِينَ مَقهُورِينَ لَم يَسَعهُم إِلَّا الصَّبرُ لِيَقضِيَ اللّٰهُ أَمرًا كَانَ مَفعُولًا، وَلَو سُلِّمَ أَنَّ الخَبِيثَ کَانَ مُسلِمًا فَهُو مُسلِمُُ جَمَعَ مِنَ الكَبَائِرِ مَا لاَ يُحِيطُ بِهِ نِطَاقُ البَيَانِ، وَأَنَا أَذهَبُ إِلَى جَوَازِ لَعنِ مِثلِهِ عَلَى التَّعيِينِ وَلَو لَم يَتَصَوَّر أَن يَكُونَ لَهُ مَثَلُ مِنَ الفَاسِقِينَ، وَالظَّاهِرُ أَنَّهُ لَم يَتِبُ، وَاختِمَالُ تَوبَتِهِ أَضعَفُ مِن إِيمَانِهِ، وَيَلحَقُ بِهِ اِبنُ زِیَادِ وَاِبنُ سَعدٍ وَجَمَاعَةُُ فَلَعنَةُ اللّٰهِ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيهِم أَجمَعِينَ، وَعَلَى أَنصَارِهِم وَأَعوَانِهِم وَشِيعَتِهِم وَمَن مَالَ إِلَيهِم إِلَى يَومِ الدِّينِ مَا دَمَعَت عَينُ عَلَی أَبِی عَبدِ اللّٰهِ الحُسَینِ
‘আমার নিশ্চিত ধারণা এই খবিস ইয়াযিদ আসলে মহানবি (ﷺ)এর রিসালাতেই বিশ্বাস করত না। আল্লাহর হারাম অর্থাৎ মক্কার এবং তার নবি (ﷺ)এর হারাম অর্থাৎ মদিনার অধিবাসীদের সাথে, মহানবি (ﷺ)এর পবিত্র ও সম্মানিত পরিবারবর্গের সাথে জীবিত ও মৃত অবস্থায় সে যে আচরণ করেছে এবং তার ভেতর থেকে যেসব অবমাননাকর কার্যকলাপ প্রকাশিত হয়েছে, এগুলাে তার ইমানহীনতার বড় প্রমাণ। [তার উদাহরণ সেই ব্যক্তির মতাে, যে পবিত্র কুরআনের পাতা আবর্জনার ভেতর ছুড়ে ফেলে। তার কর্মকাণ্ড তৎকালীন মুসলিমদের কাছে অজ্ঞাত ছিল তাও আমার মনে হয় না। কিন্তু তারা পরাভূত ও পরাক্রান্ত অবস্থায় ছিল। ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের আর কিছু করার সামর্থ্য ছিল না, যাতে যা হবার, আল্লাহ সেটা করে ফেলেন। এটা যদিও মেনে নেয়া হয় যে, এই খবিসটি মুসলমান ছিল, তবে বলতে হবে সে ছিল এমন মুসলমান, যার ভেতরে জায়গা করে নেয়া কবিরা গুনাহগুলাের কথা বলে শেষ করা যায় না। আমার মতে, এমন ফাসিককে নির্দিষ্ট করে লানত দেয়া জায়েয। অবশ্য এমন ফাসেক যে কেউ হতে পারে, তা কল্পনাতেও আসে না। স্পষ্টত সে তাওবা করেনি। তার তাওবার সম্ভাবনা তার ইমানের সম্ভাবনার চেয়েও ক্ষীণ। তার সাথে ইবন যিয়াদ, ইবন সাদ ও একটি দল রয়েছে। এদের সবার উপর মহান আল্লাহর লানত। যারা তাদের মদদদাতা সহায়তাকারী, যারা তাদের সমর্থক, যারা তাদের প্রতি আকৃষ্ট, কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহর লানত, ততদিন পর্যন্ত লানত, যতদিন একটি চোখ হলেও আবু আব্দুল্লাহ আল হুসাইন (رضي الله عنه)র জন্য অশ্রু ঝরাবে।'
(আল্লামা মাহমুদ আলুসি, রুহুল মাআনি ফি তাফসিরিল কুরআনির আযিম, বৈরুত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবি, তাবি, খ, ২৬, পৃ. ৭৩)
❏ তিনি অন্যত্র বলেছেন, আর শিয়াদের হেয় করার জন্য ইয়াজিদের পক্ষ নেয়া মূর্খতা। কেবল কোনাে বেদআতির পক্ষেই ইয়াযিদকে ভালােবাসা ও তাকে সম্মানিত করা সম্ভব। ইয়াযিদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এমনই যে তার ভক্তরাও ইমানহীন হতে বাধ্য। ইবন আসাকির আদ দিমাশকি এমত শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন, ইয়াযিদের সামনে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শির মােবারক রাখার পর সে নিম্নোক্ত কবিতা আবৃত্তি করেছিল,
لَيتَ أَشيَاخِي بِبَذرِ شَهِدُوا + جَزَعَ الخَزرَجِ فِي وَقعِ الأَسَل
لعبت هاشم بالملك فلا + ملك جاء ولا وحي نزل
বদরে নিহত হওয়া আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি দেখত
বর্ষাবৃষ্টির সময় খাযরাজদের আতঙ্ক। হাশেমিরা রাজত্ব নিয়ে খেলাধুলা করেছে; কোন ফেরেশতা আসেনি, কোন ওহিও নাযিল হয়নি।'
❏ ইবন আসাকির এরপর বলেছেন,
فإن صحت عنه فهو كافر بلا ريبٍ
‘সে যদি সত্যিই একথা বলে থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে কাফির।
(ইবনুল ইমাদ আল হাম্বলি, শাযারাতুয যাহাবি ফি আখবারি মান যাহাব, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ২০১২ খ্রি., খ. ১, পৃ. ১৪৩)
❏ আল্লামা ইয়াফেঈ হারামকে হালাল মনে করার দিক থেকে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারীকে কাফির বলার পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন,
وأما حكم من قتل الحسين أو أمر بقتله ممن استحل ذلك فهو كافر وإن لم يستحل فهو فاسق فاجر
‘যে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করেছে অথবা তাঁকে হত্যার আদেশ দিয়েছে, তার ক্ষেত্রে হুকম হলাে সে এটা হালাল মনে করলে কাফির এবং যদি হালাল মনে না করে থাকে, তবে ফাসিক ও পাপিষ্ঠ।
(ইমাম আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবন আসআদ আল ইয়াফেঈ, মিরআতুল জিনান ওয়া ইবরাতুল ইয়াকজান ফি মারিফাতি মা ইউতাবারু মিন হাওয়াদিস্যি যামান, বৈরুত: দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৭ খ্রি., খ, ১, পৃ. ১১০)
খ. ইয়াযিদ কাফির নয় বেশিরভাগ আলিম এ মত পােষণ করেন। তাঁদের দলিল হলাে, কুফর সন্দেহাতীতভাবে সাব্যস্ত হবার মতাে প্রমাণাদি আমাদের হাতে নেই। তাই ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়, এমন বিষয় না পাওয়া পর্যন্ত তাকে মুসলিম হিসেবেই ধরতে হবে।
❏ যারা কাফির বলেন না, তাদের আরেকটি যুক্তি হলাে, উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারীকে তাে কাফির বলা হয় না। তাহলে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারীকে কাফির বলা হবে কেন? কারণ নবিগণকে হত্যা করলেই কেবল তাকে কাফির বলা যায়। এর জবাবে রমাদান আফেন্দি বলেন,
تكفير قاتل الحسين ليس كقتل الصحابي بل لإهانته لإهل بيت النبي عليه الصلاة والسلام ولم يوجد ذلك في عثمان رضي الله عنه
হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারীকে তাকফির করার ক্ষেত্রে দেখা যায় এটা কেবল কোন সাহাবী হত্যার মতাে ঘটনা নয়। বরং এখানে মহানবি (ﷺ)এর আহলুল বায়তকে লাঞ্ছিত করার জন্যই তাকে তাকফির করা হচ্ছে, যা উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনায় পাওয়া যায় না।'
(রমাদান আফেন্দি, শারহু রামাদান আফেন্দি আলা শারহিস সাদ আলাল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাহ, তুরস্ক: মাকতাবাতু সিদা, তাবি, পৃ. ৪৯৯)।
__________
পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ
কৃতঃ (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ, আব্দুল্লাহ যােবায়ের)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন