পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের দৃষ্টিতে উচ্চস্বরে জিকির
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বহু উলামা ফোকাহাগণ উচ্চস্বরে জিকির করার পক্ষে ফাতওয়া প্রদান করেছেন। তিনাদের সকলে দৃষ্টিতে উচ্চস্বরে জিকির বা তাকবীর বলা মুস্তাহাব। যেমন উচ্চ আওয়াজে জিকির প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত মুফাচ্ছির আল্লামা ইসমাঈল হাক্বী হানাফী(رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন:
الذكر برفع الصوت جائز بل مستحب إذا لم يكن عن رياء ليغتنم الناس
-"উচ্চ আওয়াজে জিকির করা জায়েয বরং মুস্তাহাব, যখন ইহা লােক দেখানাের উদ্দেশ্যে না হবে .. (তাফছিরে রুহুল বয়ান,২য় খন্ড,১৭২ পৃ:)
√√√√ ইমাম শরফুদ্দীন নববী রহ: এর অভিমত:
উচ্চম্বরে জিকির অভিমত উচ্চস্বরে জিকির প্রসঙ্গে শারিহে মুসলীম ইমাম শরফুদ্দিন নববী(رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন,
هذا دليل لما قاله بعض السلف أنه يستحب رفع الصوت بالتكبير والتمر عقب المكتوبة وممن استحبة من المتأخرين بن حزم الظاهري ونقل بن بطال
-" (উচ্চস্বরে জিকির করা) এই হাদিস দ্বারা (ইবনে আব্বাস এর হাদিস) দলিল হয়। এজন্যেই কোন কোন সালাফগণ বলেছেন, ফরজ নামাজের পর উচ্চস্বরে তাকবীর, জিকির করা মুস্তাহাব। শেষ যুগের ইমামদের মধ্যে যারা এরূপ মুস্তাহাব জানতেন তারা হল ইবনে হাজেম জাহেরী ও ইবনে বাত্তাল ইহা নকল করেছেন।" (ইমান নববী: শরহে মুসলীম, ৫ ম খন্ড, ৮৪ পৃ:)।
√√√√ ইমাম বদরুদ্দীন আইনি রহ: এর দৃষ্টিতে উচ্চ সুরে জিকির:
উচ্চস্বরে জিকির সম্পর্কে শারিহে বুখারী ইমাম বদরুদ্দিন আইনী(رحمة الله) তদীয় কিতাবে বলেন:
استدل به بعض السلف على استحباب رفع الصوت بالتكبير والذكر عقيب المكتوبة ، وممن استحبه من المتأخرين: ابن حزم ، وقال ابن بطال: أصحاب المذاهب المتبعة وغيرهم متفقون على عدم استحباب رفع الصوت بالتكبير ، والذكر ،
-"কোন কোন সালাফ ফরজ নামাজের পর উচ্চস্বরে জিকির ও তাকবীরের বিষয়ে এই হাদিস দলিল পেশ করেন। পরবর্তী উলামাদের যারা ইহাকে মুস্তাহাব বলেছেন তাদের মধ্যে ইবনে হাজেম(رحمة الله) একজন। ইমাম ইবনে বাত্তাল(رحمة الله) বলেছেন: মাজহাব আনুহগ্যশীলরা ও অন্যান্যরা একমত হয়েছে যে, উচ্চস্বরে ও তাকবীর বলা মুস্তাহাব। (ইমাম আইনী: উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী, ৬ ষ্ঠ খন্ড)।
√√√√√√ ইমাম ইবনু হাজর আসকালানী রহ: এর দৃষ্টিতে উচ্চ সুরে জিকির:
হাফিজুল হাদিস ও শারিহে বুখারী ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী(رحمة الله) বলেছেন,
, والجمهور على ذلك وفيه دليل على جواز الجهر بالر عقب الصلاة
-"অধিকাংশরা এই বিষয়ের উপর রয়েছে যে, এই হাদিস দ্বারা নামাজের পর উচ্চস্বরে জিকির করা মুস্তাহাব।" (ইমাম আসকালানী: ফাতহুল বারী শরহে বুখারী, ২য় খন্ড, ৩২৫ পৃ:)
উচ্চ আওয়াজে জিকির প্রসঙ্গে ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ ফোকাহায় কেরামের অভিমত,
وأما التسبيح والتهليل لا بأس بذلك ، وإن رفع صوته ، كذا في الفتاوی الكبرى .
অর্থাৎ, তাসবীহ ও তাহলীল বলার মধ্যে কোন ক্ষতি নেই যদিও ইহা উচ্চ আওয়াজে হয়। যেমনটি ফাতওয়ায়ে কুবরা কিতাবে আছে।" (ফতােয়ায়ে আলমগিরী, ৫ ম খন্ড, ৩১৬ পৃ:)।
√√√√√ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ: এর দৃষ্টিতে উচ্চ সুরে জিকির:
فقال بعض أهل العلم: إن الجهر أفضل لأنه أكثر عملا ولتعدي فائدته إلى السامعين
-"অনেক আহলে ইলিমগণ বলেছেন উচ্চ আওয়াজে জিকির উত্তম। কেননা ইহা অধিক পরিমানে আমলের দ্বারা শ্রোতাগণ ফায়দা হাছিল করেন। (ফতোয়ায়ে শামী,২য় খন্ড,৪৩৪পৃ:; ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, ৩য় খন্ড ১০৪ পৃ:)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী(رحمة الله) এই মর্মে আরাে বলেন:
وفي حاشية الحموي عن الإمام الشعراني: أجمع العلماء سلفا وخلفا على استحباب ذكر الجماعة في المساجد وغيرها إلا أن يشوش جهرهم على تائم أو مصل أو قاري إلخ
-"হাশিয়ায়ে হামাভী গ্রন্থে ইমাম শারানী(رحمة الله) থেকে উল্লেখ রয়েছে, পূর্বসূরী ও পরবর্তী উলামাদের মাঝে ইজমা বা ঐক্যমত হয়েছে যে, মসজিদের ভিতরে বা বাহিরে জিকিরের জামাত করা মুস্তাহাব। তবে ঘুমন্ত ব্যক্তি নামাজী ও কোরআন তেলাওয়াতকারীর যদি বিরক্তি না করে।(ফতোয়ায়ে শামী ২য় খন্ড,৪৩৪ পৃ:)
আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী(رحمة الله) এই মর্মে আরাে বলেন:-
فقد روي أنه كان في غزاة ولعل رفع الصوت يجر بلاء والحزب ځذعة ولهذا نهى عن الجرس في المغازي ، وأما رفع الصوت بالذكر فجائژ كما في الأذان والخطبة والجمعة والحج
"আর বর্ণিত আছে যে, নিশ্চয় রাসূলে পাক (ﷺ) কোন যুদ্ধে ছিলেন, সম্ভবত তখন উচ্চস্বরে জিকির বা তাকবীর যুদ্ধের জন্য ক্ষতিকারক ছিল তাই যুদ্ধক্ষেত্রে এরুপ উচ্চ আওয়াজ করতে নিষেধ করেছেন। অন্যথায় উচ্চস্বরে জিকির করা জায়েয যেমনটি আযান, খুতবায়, জুময়ায় ও হাজ্বের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।(ফতোয়ায়ে শামী,৬ষ্ঠ খন্ড,৩৯৮ পৃ:)।
শায়েখ আব্দুল হাক্ব মুহাদ্দেছ দেহলভী(رحمة الله) উচ্চস্বরে জিকির অস্বীকার কারীকে মূর্খ বলেছেন।
√√√√√ আল্লামা ইমাম তাহতাবী রহ: এর দৃষ্টিতে উচ্চ সুরে জিকির:
ويستفاد من الحديث الأخير جواز رفع الصوت بالذكر والتكبير عقب المكتوبات بل من السلف من قال باستحبابه وجزم به ابن حزم من المتأخرين
-" (হযরত ইবনে যুবাইর রা:) এর বর্ণিত হাদিসের শেষাংশ দ্বারা প্রমাণিত হয়, ফরজ নামাজের পর উচ্চস্বরে তাকবীর ও জিকির করা জায়েয। বরং সালাফদের অনেকে এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। পরবর্তী উলামাদের মধ্যে ইবনে হাজম(رحمة الله) দৃঢ়তার সাথে একমত পােষন করেছেন। (হাশিয়াতুত তাহতাভী আলা মাকিল ফালাহ,১ম খন্ড,৩১২ পৃ:)
আল্লামা আহমদ তাহতাভী(رحمة الله) আরাে বলেছেন,
قال في الفتاوى لا يمنع من الجهز بالذكر في المساجد احترازا عن الدخول تحت قوله تعالى: { ومن أظلم ممن مع مساجد الله أن يذكر فيها اسفة كذا في البزازية
"মুছান্নিফ তার ফাতওয়ার মধ্যে বলেন: মসজিদে উচ্চস্বরে জিকির করতে বাধা দিবেনা। বাধা দানকারী পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত হবে:
ومن أظلم ممن مع مساجد الله أن يذكر فيها اسمةومن أظلم ممن مع مساجد الله أن يذكر فيها اسمة
-"তার চেয়ে বড় জালিম কে আছে যে মসজিদ সমূহে আল্লাহর জিকির করতে বাধা দেয়। যেমনটি ফাতওয়ায়ে বাযাজিয়ার মধ্যে রয়েছে।(হাশিয়াতুত তাহতাভী আলা মাকিল ফালাহ,১ম খন্ড,৩১২ পৃ:)
দলিল: হিজরী ১৪ শ শতাব্দির অন্যতম মুজাদ্দিদ আল্লামা আহমদ রেজা খাঁন ফাজেলে বেরলভী(رحمة الله) বলেন: উচ্চস্বরে জিকির করা জায়েয, তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন কোন নামাজী, রােগী ও শয়নকারীর ক্ষতি না হয়।" (আহকামে শরীয়ত, ১৬৬ পৃ:)
দলিল: আল্লামা আশরাফ আলী থানভী ও আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী। উভয়ের অভিমত হচ্ছে:"তবে জিকিরের একাগ্রতা সৃষ্টি ও শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে বাচার একটা ব্যবস্থা হিসেবে উচ্চস্বরে জিকির করে, তবে তাতে কোন ক্ষতি নেই।" (মাজালিছে হাকিমুল উম্মত, ১৪৫ পৃ:)
কোন কোন শায়েখ ক্বালবী জিকিরের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে:
দলিল:"ইহা নিয়ম হইল এই শ্বাস গ্রহণ করার সময় অন্তরের ভাষায় বলিবে لا اله এবং বাহির করিবার সময়
ا لا اله
। তাছাড়া কোন কোন বুজুর্গের মতে ইহার বিপরিত অর্থাৎ, নিশ্বাস ত্যাগের সময় لا اله বলিবে।" (আনােয়ারুছ ছালিকিন, ৭৯ পৃ:)।
আল্লামা হাজী ইমদাদুল্লাহ মােহাজেরে মক্কী(رحمة الله) বলেন:
দলিল:"সূফীগণের পরিভাষায় পাক আনফাছ হইতেছে, নিশ্বাস ও প্রশ্বাস উভয় সময়ই সরবে হউক বা নীরবে আল্লাহর র করা।" (যিয়াউল কুলুব,২৯ পৃ:)
উল্লেখিত আলােচনা দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, উচ্চ আওয়াজে আল্লাহর জিকির করা জায়েয ও মুস্তাহাব এবং পবিত্র কোরআন ও ছহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। পাশাপাশি ফোকাহায়ে কেরাম ও সূফিয়ায়ে এজামগণের আকওয়াল দ্বারাও ইহা প্রমাণিত। তাই লােক দেখানাের উদ্দেশ্য না থাকলে, নামাজী, রােগী, ঘুমন্ত ব্যক্তি ও কোরআন তেলাওয়াতকারী না থাকলে উচ্চ আওয়াজে জিকির করা অবশ্যই জায়েয। বস্তুত লােক দেখানাের উদ্দেশ্যে কোন আমলই করা জায়েয নয়। কেননা রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন-
أخبرنا عیسی بن هلال الحمصي ، قال: حدثنا محمد بن جمير ، قال: حدثنا أمامة معاویه بن سلام ، عن عكرمة بن عمار ، عن شداد أبي عمار ، عن أبي الباهلي ، قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن الله لا يقبل من العمل إلا ما كان له خالصا
"হযরত আবু উমামা (رضي الله عنه) বলেন, রাসূলে পাক (ﷺ) বলেছেন: ঐ আমল আল্লাহ তাআ'লা কবুল করেন না, যা তার জন্য খালেছ ভাবে না করা হয়।
(ইমাম নাসাঈ: সুনানে কুবরা, হাদিস নং ৪৩৩৩ ; নাসাঈ শরীফ, কিতাবুয জিহাদ, হাদিস নং ৩১৪০ ; তাফছিরে মাজহারী, ৪ র্থ খন্ড, ২৯৯ পৃ: তাফছিরে রুহুল মাআনী, ১৬ তম জি: ৫২৪ পৃ:; ইমাম ছিয়তী: জামেউছ ছাগীর, ১ ম জি: ১১৪ পৃ:)
অতএব, লােক দেখানাে ব্যতীত আল্লাহ তা'লার সন্তুষ্টিচিত্তে উচ্চস্বরে জিকির করা জায়েয।
_________________
শরীয়তের দৃষ্টিতে ক্বালবী জিকির ও ছামার বৈধ্যতা
রচনা ও সংকলনেঃ মুফতি মাওলানা আলাউদ্দিন জেহাদী
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন