রােমক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিমদের অভিযান

 

রােমক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিমদের অভিযানঃ


এক নজরে দেখে নেয়া যাক : ক্রম  সময়  সেনাপতি ও যুদ্ধের বর্ণনা 

◼ ১মঃ মহানবি (ﷺ) এর সময় (৮ হি./ ৬২৯খ্রি.)

মুতার যুদ্ধ নামে ইতিহাসে পরিচিত। যায়েদ ইবন হারিসা (رضي الله عنه) ছিলেন প্রথম সেনাপতি। এ যুদ্ধে যায়েদ ইবন হারিসা  (رضي الله عنه) জাফর ইবন আবু তালিব (رضي الله عنه) ও আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা


৬২৯ খ্রি.)  (رضي الله عنه) ইন্তিকাল করেন।

◼ ২য়ঃ উমর (رضي الله عنه) এর খিলাফতকালে (১৬ হি./৬৩৭ খ্রি.)



হিমস অভিযান হিসেবে প্রসিদ্ধ। আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (رضي الله عنه) এর নেতৃত্বে এ অভিযানে খালিদ ইবন ওয়ালিদ (رضي الله عنه), বিলাল (১৬ হি./  (رضي الله عنه) প্রমুখ অংশ নিয়েছিলেন।



◼ ৩য়ঃ উসমান (رضي الله عنه) এর খিলাফতকালে(৩২ হি./৬৫২ খ্রি.)



আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এ বছর রােম সম্রাজ্যের দেশগুলােতে যুদ্ধ করেন। তিনি যুদ্ধ করতে করতে কন্সট্যান্টিনােপলের প্রণালী পর্যন্ত পৌঁছে যান। (ইমাম ইবনুল আসির, আল  কামিল ফিত তারিখ, বৈরুত : দারুল কুতুব আল ইলমিয়্যাহ,   ১৯৮৭ খ্রি., খ, ৩, পৃ. ২৫)।



◼ ৪র্থঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪২ হি./৬৬২ খ্রি.)



এ বছরও মুসলিমগণ আরমেনিয়ার লান প্রদেশ ও রােম এর  সম্রাজ্য আক্রমণ করেন। তাদের বহু সৈন্য ও সেনাপতি শাসনামলে  মুসলমানদের হাতে নিহত হয়। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত, খ.  ৩, পৃ. ২৮৩)।



◼ ৫মঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪৩ হি./৬৬৩ খ্রি.)



এ বছর বুসর ইবন আবি আরতাআর নেতৃত্বে মুসলমান


সৈন্যরা রােমানদের আক্রমণ করেন। আল্লামা ওয়াকেদির শাসনামলে  মতে, বুসরের বাহিনী কন্সট্যান্টিনােপল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ২৮৭) এটাকে কন্সট্যান্টিনােপলে প্রথম আক্রমণ বলে ধরতে পারি।



◼ ৬ষ্ঠঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪৪ হি./৬৬৪ খ্রি.)



এ বছর মুসলিমগণ আব্দুর রহমান ইবন খালিদ ইবন এর ওয়ালিদের নেতৃত্বে পুনরায় রােমের শহরগুলােতে আক্রমণ শাসনামলে  করে মুসলিমদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। শীতকালটা তারা সেখানেই কাটান। এদিকে বুসর ইবন আবি আরতাআ সমুদ্রে অভিযান পরিচালনা করেন। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত,


খ. ৩, পৃ. ২৯৮)



◼ ৭মঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪৬হি./৬৬৬ খ্রি.)



এ বছর মুসলিমগণ আব্দুর রহমান ইবন খালিদ ইবন এর ওয়ালিদের নেতৃত্বে সরাসরি কন্সট্যান্টিনােপলের উদ্দেশে শাসনামলে  অভিযান অংশ নেন। আসলাম ইবন আবু ইমরান বলেন,


 غزونا من المدينة تريد القسطنطينية وعلى الجماعة عبد الرحمن بن خالد بن الوليد والتروم ملصقو ظهورهم بحائط المدينة


‘আমরা মদিনা থেকে কন্সট্যান্টিনােপলের উদ্দেশে যুদ্ধে বের হলাম। আব্দুর রহমান ইবন খালিদ ইবন ওয়ালিদ ছিলেন সেনাপতি। রােমানরা শহরটির অর্থাৎ কন্সট্যান্টিনােপলের নগরপ্রাচীরে পিঠ ঠেকিয়ে যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল।


(ইমাম আবু দাউদ আস সিজিস্তানি, আস সুনান, কিতাব : আল জিহাদ, বাব : ফি কাওলিহি তায়ালা—ওয়ালা তুলকু বিআইদিকুম ইলাত তাহলুকা)।



◼ ৮মঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪৭হি./৬৬৭ খ্রি.)



এ বছর মালিক ইবন হুবায়রার নেতৃত্বে রােমানদের এর শহরগুলােকে অভিযান পরিচালিত হয়। (ইবনুল আসির, শাসনামলে  প্রাগুক্ত, খ, ৩, পৃ. ৩১১)



◼ ৯মঃ মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)  এর শাসনামলে (৪৯হি./৫০হি./ ৬৬৯/৬৭০ খ্রি.)



এ বছর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) রােমানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানাের জন্য বিরাট একটি বাহিনী তৈরি করেন। সুফিয়ান ইবন  শাসনামলে  আউফকে সৈন্যদলের প্রধান বানানাে হয়। এরপর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এর ছেলে ইয়াযিদকেও মুসলিম বাহিনীর সাথে যেতে বলেন কিন্তু ইয়াযিদ গড়িমসি করে এবং অসুস্থতার ভান করে যুদ্ধে গেল না। মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) আপাতত তাকে কিছু বললেন না। এদিকে যুদ্ধে যাওয়া মুসলিম সৈন্যরা রােগ ব্যাধি ও ক্ষুধার জ্বালায় অত্যন্ত কষ্টের ভেতর পড়লেন। এ খবর শুনে ইয়াযিদ আবৃত্তি করল



ما إن أبالي بما لاقت جموعهم + بالفرقدونة★


من حمى ومن موم؛


إذا اتكأت على الأنماط مرتفعة  + بدير مران★


عندي أم كلثوم؛



জ্বর আর ক্ষুধা নিয়ে ফারকদুনায় তাদের যে বিপদ,


তাতে আমার কিছু যায় আসে না,


যতক্ষণ দির-মুররানে আছি উঁচু তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে,


আর সাথে আছে উম্মে কুলসুম।



রােমানদের এলাকায় মুসলিম সৈন্যরা যেখানে শিবির স্থাপন করেছিলেন, সে জায়গার নাম ছিল ফারকদুনা। উম্মে কুলসুম ছিল ইয়াযিদের স্ত্রী। যাই হােক, এ কবিতা শুনে মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কঠিন রাগ করলেন। তিনি শাস্তিস্বরূপ ইয়াযিদকে কন্সট্যান্টিনােপলে পাঠালেন। (ইবনুল আসির, প্রাগুক্ত, খ. ৩, পৃ. ৩১৪)



৫২ হিজরিতে ইয়াযিদ বাহিনীর নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ ঐ বছরই প্রখ্যাত সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারী (رضي الله عنه) ইন্তিকাল করেন। সে হিসেবে কন্সট্যান্টিনােপলে প্রথম দলে তাে নয়ই, ইয়াযিদ  ছিল সর্বশেষ আগত ব্যক্তিদের একজন।



দেখা যাচ্ছে সিজারের বিভিন্ন শহরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ স্বয়ং মহানবি (ﷺ) এর সময়েই শুরু হয়েছিল। তখন ইয়াযিদের জন্মই হয়নি। আমরা ধরে নিচ্ছি হাদিসে কন্সট্যান্টিনােপলের কথাই বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে বহু বছর পরে ৪৯ মতান্তরে ৫০ হিজরিতে কন্সট্যান্টিনােপলে নবম অভিযানে ইয়াযিদ অংশ নিয়েছিল এবং সেনাপতি হয়েছিল। অবশ্য এই অভিযানেও সে ইচ্ছা করে যায়নি। আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) তাকে শাস্তিস্বরূপ সেখানে পাঠিয়েছিলেন।



এ প্রথম দলের সাথে নয়, পরবর্তীতে যাত্রা করা দলের সাথে সে কন্সট্যান্টিনােপল পৌঁছেছিল। এতকিছুর পরও আমরা যদি ইতিহাস গ্রন্থাদির সমস্ত বর্ণনা ভুল বলে ধরে নেই এবং যুক্তিবােধকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইয়াযিদকে ‘সিজারের শহরে প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে ক্ষমাপ্রাপ্ত বলে মেনে নেই, তবুও তাতে ইয়াযিদের নাজাত লাভের আশা করা যায় না, তাকে আল্লাহর ওলি কিংবা মাকবুল বান্দা (!) হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া যায় না। একইভাবে তাকে লানত দেয়া নিয়ে আলিমগণের অবস্থান পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র প্রয়ােজন পড়ে না।



◼ এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (رحمة الله) এর মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি রাজিমু আবওয়াবিল বুখারি নামক গ্রন্থে লিখেছেন



إن قوله مغفور لهم تمسك به بغض النّاس في نجاةٍ يزيد لأنه كان من جملة هذا الجيش الثاني بل كان رأسهم ورئيسهم على ما يشهد به التواريخ والصحيح أنه لا يثبت بهذا الحديث إلا كونه مغفورا له ما تقدم من ذنبه على هذا الغزوة لأن الجهاد من الكفارات وشان الكفارات إزالة آثار الذنوب السابقة عليها لا الواقعة بعدها . نعم لو كان مع هذا الكلام أنه مغفور له إلى يوم القيامة لد على نجاته وإذ ليس فليس بل أمرّة مفوض الى الله تعالى فيما ارتكبة من القبائح بعد هذه الغزوة من قتل الحسين رضي الله عنه وتخريب المدينة والإصرار على شرب الخمر إن شاء عفاً عنه وإن شاء عبه كما هو مطرد في حق سائر العصاة على أن الأحاديث الواردة في شان من استخف بالعترة الطاهرة والمُلحد في الحرم والميل للسنّة تبقي مخصصات لهذا العموم.



‘রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর  বাণী মাগফুরুল লাহুম’ (তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত) কিছু লােক এটা দিয়ে ইয়াযিদের নাজাতের স্বপক্ষে দলিল দেয়। কারণ ইতিহাস গ্রন্থাদির সাক্ষ্য অনুসারে সে এই দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এমনকি সে তাদের নেতা ও সেনাপতি ছিল। আসলে এ হাদিস দ্বারা যুদ্ধের আগে করা তার অপরাধগুলাে ছাড়া অন্য কিছু মাফ হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কারণ জিহাদ কাফফারার অন্তর্ভুক্ত। আর কাফফারার রীতি হলাে পূর্বের গুনাহ দূর করা, ভবিষ্যতে ঘটিতব্য গুনাহগুলাে নয়, হ্যাঁ! যদি হাদিসে এমন বলা হতাে যে, সে কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমাপ্রাপ্ত’- তাহলে তার নাজাত বুঝা যেত। তা তাে কস্মিনকালেও বলা হয়নি। তাই এ যুদ্ধের পরে হুসাইন (رضي الله عنه)কে হত্যা, মদিনাকে ধ্বংস করা, মদ্যপানের সাথে লেগে থাকা ইত্যাদি জঘন্য যেসব কাজ ইয়াযিদ করেছে, সেসব আল্লাহর কাছে ন্যস্ত থাকবে। অন্যান্য পাপীদের ব্যাপারে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন অথবা চাইলে শাস্তি দেবেন। এরপরও পবিত্র আহলে বায়তের অবমাননাকারী, হারামে সীমালঙ্কারী, সুন্নাতের পরিবর্তনকারী সম্পর্কে বর্ণিত হাদিস উপরােক্ত আম বক্তব্যকে খাস করার জন্য তাে রয়েছেই।'


(শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি, শারহু তারাজিমি আবওয়াবিল বুখারি, করাচি : কারখানায়ে তেজারতে কুতুব, প, ৩১-৩২)



ছয় ব্যক্তিতে নবিগণের লানত দেয়া সম্পর্কিত একটি হাদিস আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।


শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (رحمة الله) সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর মতে ক্ষমাপ্রাপ্তির হাদিস ব্যাপকার্থে অভিযানে অংশগ্রহণকারী সবার জন্য বলা হলেও যারা অন্য হাদিসের ছয়টি দোষে দুষ্ট, তারা সাধারণ ক্ষমার আওতায় পড়বে না।



◼ এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লামা আব্দুর রউফ আল মানাভি বলেছেন,



ولا يلزم منه كون يزيد بن معاوية مغفورا له لكونه منهم ، إذ الغفران مشروط بكون الإنسان من أهل المغفرة ، ويزيد ليس كذلك


الخروجه بدلیل خاص



‘ঐ সৈন্যদলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ইয়াযিদের ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া আবশ্যক নয়, যেহেতু ব্যক্তির ক্ষমার যােগ্য হবার উপর ক্ষমাপ্রাপ্তি নির্ভরশীল। অথচ নির্দিষ্ট দলিলের ভিত্তিতে শুধুমাত্র বের হবার জন্য ইয়াযিদ তেমন কেউ বলে গণ্য হবে না।'


(আব্দুর রউফ আল মানাভি, প্রাগুক্ত, ফায়দুল কাদির, খ. ৩, পৃ. ৮৪)।



মােটকথা আমরা বুঝতে পারলাম সহিহ বুখারির উক্ত হাদিসের ভবিষ্যদ্বাণী ইয়াযিদকে লক্ষ্য করে করা হয়নি, তার বাবা আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এখানে উদ্দেশ্য হতে পারেন। এ হাদিস আরও অনেক অর্থের সম্ভাবনা রাখে। এখানে কন্সটান্টিনােপল বিজয়ীর কথা বলা হতে পারে। সেক্ষেত্রে অটোম্যান সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ এখানে প্রাসঙ্গিক। কারণ তার হাতে কন্সট্যান্টিনােপল মুসলমানদের করায়ত্ত হয়েছিল। এছাড়া হাদিসে কিয়ামতের আগে শহরটি বিজিত হবার কথা আছে। সেটাও এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে। সবকিছু ছাপিয়ে রােমানদের অধীন অন্য যেকোনাে শহর উদ্দেশ্য হবার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। অতএব ইয়াযিদের মতাে ঘৃণ্য ব্যক্তিত্বকে এ হাদিসের আওতায় আনার চেষ্টা করা হাদিসের অপব্যাখ্যার শামিল। মহান আল্লাহ সবাইকে আকলে সালিম দান করুন।

__________

পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ

কৃতঃ (ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ, আব্দুল্লাহ যােবায়ের)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন