ইমাম নঈম উদ্দীন মুবাদাবাদী (রহ.)-এর ‘সাওয়ানিহে কারবালা’
সদরুল আফাযিল হযরত আল্লামা মাওলানা সায়্যিদ মুহাম্মদ নঈম উদ্দীন মুবাদাবাদী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘সাওয়ানিহে কারবালায়’ উল্লেখ করেছেন : হোসাইনী দুল্হা সায়্যিদুনা হযরত ওহাব ইবনে আবদুল্লাহ কালবী رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ বনী কল্ব গোত্রের একজন সদাচারী ও চরিত্রবান যুবক ছিলেন। তারুণ্য, উচ্ছ্বলতা ও যৌবনকাল ছিল তার। বিয়ে করেছেন মাত্র সতের দিন হল। তখনও যৌবনের তারুণ্যঘন যুগল-জীবনের পূর্ণ স্বাদে বিভোর ছিলেন। এমতাবস্থায় শ্রদ্ধেয় আম্মাজান এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ছিলেন বিধবা। যার একমাত্র অবলম্বন ও ঘরের উজ্জল প্রদিপ ছিলেন এই একটি মাত্র পুত্র সন্তানই। স্নেহময়ী মা কান্না জুড়ে দিলেন। পুত্র আশ্চর্য হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করল: প্রাণপ্রিয় মা! আপনি কান্না করছেন কেন? আমার মনে পড়ছে না যে, জীবনে কখনো আপনার অবাধ্য হয়েছি, আগামীতেও আমি এমন হতে পারি না। আপনার আনুগত্য ও মান্যতা আমার জন্য ফরয। আমি সারা জীবন আপনার অনুগত হয়েই থাকব। মা! আপনার মনে কিসের দুঃখ? কোন দুঃখে আপনি কাঁদছেন? হে আমার প্রিয় মা! আমি আপনার আদেশে নিজের জীবনও উৎসর্গ করতে রাজি আছি। আপনি চিন্তিত হবেন না।
একমাত্র সন্তানের এমন ভাবপূর্ণ কথা শুনে মায়ের কান্না আরও বেড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন: প্রাণপ্রিয় সন্তান আমার! তুমি আমার চোখের জ্যোতি, হৃদয়ের প্রশান্তি। হে আমার ঘরের উজ্জল প্রদীপ! হে আমার বাগানের সুবাসিত ফুল! আমার অক্লান্ত পরিশ্রমে তুমি আজ যুবক হয়েছ। তুমিই আমার হৃদয়ের প্রশান্তি, মনের প্রবোধ। এক মূহুর্তকাল তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না।
চু দর খাব বাশম তুঈ দর খেয়ালম,
চু বেদার গরদম তুঈ দর জমীরম।
(অর্থাৎ, আমার শয়নে-স্বপণে কেবল তোমারই চিন্তা, তোমারই ভাবনা। জাগরণেও আমার হৃদয়ে একমাত্র তুমিই তুমি)।
হে আমার জান! আমি তোমাকে আমার কলিজার রক্ত পান করিয়েছি। আজ, এখনি কারবালার প্রান্তরে আল্লাহ তা’আলার প্রিয়পাত্র রাসুলের দৌহিত্র, মুশকিলকুশার প্রাণপ্রিয় সন্তান, খাতুনে জান্নাতের নয়নের মণি, সুন্দর চরিত্রের বিরল আদর্শ, জুলম-অত্যাচারের শিকার হয়ে আছেন। হে আমার সন্তান! তুমি কি পার তোমার প্রাণ তাঁর পবিত্র কদমে উৎসর্গ করতে? এমন মানবতাহীন জীবনের উপর হাজারো ধিক্কার, আমরা বেঁচে থাকব, অথচ; সুলতানে মদীনা মুনাওয়ারা, শাহেনশাহে মক্কা মুকাররমা صَلَّی اللّٰہُ تَعَالٰی عَلَیْہِ وَاٰلِہٖ وَسَلَّم এর দৌহিত্র শাহজাদাকে অত্যাচারের নিপীড়নে শহীদ করে দেওয়া হবে! আমার ভালবাসার কিছুও যদি তোমার মনে থাকে, আর তোমাকে লালন-পালনে যে কষ্ট আমি সহ্য করেছি তা যদি তুমি ভুলে না যাও, তবে হে আমার বাগানের সুবাসিত ফুল! তুমি প্রিয় হোসাইন رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ এর জন্য উৎসর্গ হয়ে যাও।
হযরত সায়্যিদুনা ওয়াহাব رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ আরজ করেন: হে আমার প্রাণপ্রিয় মা! সৌভাগ্যের বিষয় হবে যদি আমার এ প্রাণ শাহজাদা হোসাইন رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ এর জন্য উৎসর্গ হয়, তাই আমিও মনে প্রাণে প্রস্তুত। আমি আপনার কাছে একটি মুহুর্তের জন্য অনুমতি চাই, আমার সেই স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলার জন্য, যে তার সারাটা জীবনের সমস্ত আশা-ভরসা ও আরাম-আয়েশের দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। যার ইচ্ছা এই যে, আমি ব্যতীত সে অন্য কারো দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। সে যদি চায়, তাহলে আমি তাকে অনুমতি দিয়ে দেব যে, সে তার জীবনকে যেভাবে চায় সেভাবে অতিবাহিত করতে পারবে। মা বললেন: হে আমার বৎস! মেয়ে লোকেরা বুদ্ধি-বিবেচনায় অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে। আল্লাহ্ না করুন, তুমি যদি তার ধোকায় পড়ে যাও, তাহলে তো এত বড় সৌভাগ্য তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে।
সায়্যিদুনা হযরত ওয়াহাব ইবনে আবদুল্লাহ رَحْمَةُ اللهِ تَعَالٰى عَلَيْهِ আরজ করলেন: প্রিয় মা আমার! আমার হৃদয়ে ইমাম হোসাইন رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ এর ভালবাসার গিট এতই শক্তভাবে লেগে আছে যে, সেটি কেউ খুলতে পারবে না। আর তাঁর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা আমার মনের মাঝে এভাবে খুদিত হয়ে আছে, যা দুনিয়ার কোন পানি দিয়েও মুছে ফেলতে পারবে না। এ কথা বলে তিনি স্ত্রীর নিকট গেলেন। আর তাকে সংবাদ দিল যে, রাসুলের বংশ, ফাতেমার নয়ন মণি, মওলা আলীর পুষ্পকাননের সুবাসিত এক ফুল কারবালার ময়দানে খুবই শোচনীয়, বড়ই চিন্তাগ্রস্ত এবং অত্যন্ত করুণ অবস্থার শিকার। গাদ্দারেরা তাঁর উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আমার ইচ্ছা যে, তাঁর জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করে দিই। স্বামীর এ কথা শুনে নববধু অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ একটি অন্তর কাপাঁনো ব্যথাভরা নিশ্বাস ফেলল। আর বলল: হে আমার মাথার মুকুট! আফসোস যে, আমি নিজেও আপনার সাথে যুদ্ধে অংশ নিতে পারছি না। ইসলামী শরীয়ত মহিলাদেরকে জিহাদের ময়দানে যাবার অনুমতি দেয়নি। আহ্! এমন একটি সৌভাগ্য আমি অর্জন করতে পারছি না যে, আপনার সাথে আমিও জিহাদের ময়দানে গিয়ে দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইমামে আলী মাকাম رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ এর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করি।
سُبْحٰنَ اللهِ عَزَّوَجَل! আপনি তো জান্নাতের পুস্পিত বাগানের ইচ্ছা পোষণ করে নিয়েছেন। সেখানে হুরেরা আপনার সেবা করার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। ব্যাস; শুধু আমাকে এ দয়াটুকু করুন, যখন আহলে বায়তের সর্দারগণের সাথে জান্নাতে আপনার জন্য জান্নাতী নেয়ামতগুলো পরিবেশন করা হবে, আর জান্নাতের হুরেরা আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে, সে সময় আপনি আমাকেও সাথে রাখবেন। হোসাইনী দুল্হা এই নেক নববধুসহ নিজের পরম শ্রদ্ধেয় আম্মাজানকে নিয়ে রাসুলের দৌহিত্রের নিকট গিয়ে পৌঁছান। নববধু নিবেদন করল: হে রাসুলের বংশধর! শহীদরা ঘোড়া হতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথেই হুরদের কোলে পৌছে যায়। আর জান্নাতের হুর ও গিলমানরা আনুগত্য সহকারে তাঁদের সেবায় নিয়োজিত হয়ে যায়। ‘এ অধম’ হুজুরের দরবারে আমার জীবন উৎসর্গ করে দিতে চাই। আমি খুবই নিঃস্ব। আমার এমন কোন আত্মীয়-স্বজনও নেই, যে আমার দায়ভার গ্রহণ করে। আমার আবেদন যে, হাশরের দিন আমার স্বামী যেন আমার থেকে পৃথক না হয়, আর পৃথিবীতেও যেন আমি নিঃস্বকে আপনার আহলে বাইতগণ নিজেদের দাসী হিসাবে গ্রহণ করে নেয়, আর আমার সারা জীবনটা যেন আপনার পবিত্র বিবিগণের رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُنَّ
খেদমত করে কাটিয়ে দিতে পারি।
____________
হোসাইনী দুলহা
🖋আমীরে আহলে সুন্নাত হযরত মাওলানা ইলয়াস আত্তার কাদেরী রযভী
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন