মনীষীদের দৃষ্টিতে আ’লা হযরত রহমতুল্লাহ আলাইহি


 আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন একজন খাঁটি নবীপ্রেমিক ইসলামী জ্ঞান বিশারদ ও মুজাদ্দিদ। তাঁর জন্ম এমনই এক সময় যখন বিজাতি ব্রিটিশরা উপমহাদেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এবং দীর্ঘ মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান সাম্রাজ্যকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্যবস্তুকে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা ধর্মীয় অঙ্গনে বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য কিছু ভারতীয় দেওবন্দী উলামাকে ভাড়া করে তাদের দিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করিয়ে কুরআন সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিচ্ছিল এবং মুসলমানদের ঈমান আক্বীদা কলুষিত করছিল। বিশেষ করে ইসলামের মহান পয়গাম্বর হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মান-মর্যাদা খাটো করে এই সব ভাড়াটে মৌলভীরা যখন ফতোয়াবাজি করছিল, ঠিক তখনই বজ্রনিনাদে আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেজা খাঁন সাহেব ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে কলমী যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং মুসলমানরূপী শত্রুকে সমূলে উৎখাত করেন। 

 তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে রাসূল প্রেমের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেন এবং ঈমানকে সঞ্জীবিত করেন। 

 বস্তুত তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ১৮৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৭ সালে। দেওবন্দের কাশেম নানুতবী, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী, খলিল আহমদ আম্বেটী ও আশ্রাফ আলী থানবী রচিত কুফুরী আক্বিদা সম্বলিত সমস্ত কিতাবের খণ্ডণ লিখে তিনি ইমামে আহলে সুন্নাত ও মুজাদ্দেদ খেতাব লাভ করেন। 

 আ’লা হযরত সম্পর্কে বিশ্বের মনীষীগণ উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। আমরা সেই সমস্ত মনীষীর বক্তব্য উপস্থাপন করবো। উল্লেখ্য যে- এগুলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাসউদ আহমদের “ইমাম আহমদ রেযা” শীর্ষক গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। এ দেশীয় আ’লা হযরতের দুশমনরা এসব মন্তব্য দেখুন। 

 আ’লা হযরত সম্পর্কে পীর-মাশায়েখগণের ভাষ্য 

 ১. আল্লামা হেদায়াতুল্লাহ সিন্দী মোহাজির মাদানী বলেন : তিনি (আ’লা হযরত) একজন প্রতিভাধর, নেতৃত্ব দানকারী আলেম, তাঁর সময়কার প্রখ্যাত আইনবিদ এবং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর দৃঢ় হেফাজতকারী, বর্তমান শতাব্দীর পুণরুজ্জীবন দানকারী, যিনি “দ্বীনে মতিন” এর জন্য সর্বশক্তি দ্বারা আত্মনিয়োগ করেছিলেন, যাতে শরীয়তের হেফাজত করা যায়। “আল্লাহর পথের” ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণকারীদের ব্যঙ্গ বিদ্রƒপের প্রতি তিনি তোয়াক্কা করেননি। তিনি দুনিয়াবী জীবনের মোহসমূহের পিছু ধাওয়া করেননি বরং রাসুলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রশংসাসূচক বাক্য রচনা করতেই বেশি পছন্দ করেছিলেন। হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেমের ভাবোন্মত্ততায় তিনি সর্বদা মশগুল ছিলেন বলেই প্রতীয়মান হয়। সাহিত্যিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও প্রেমভক্তিতে ভরপুর তাঁর “নাতিয়া পদ্যের” মূল্য যাচাই করা একেবারেই অসম্ভব। দুনিয়া এবং আখেরাতে তাঁর প্রাপ্ত-পুরস্কারও ধারণার অতীত। মওলানা আব্দুল মোস্তফা শায়েখ আহমদ রেযা খাঁন-হানাফী কাদেরী সত্যিই পাণ্ডিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়ার যোগ্য। আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন। (১৯২১ সালের প্রদত্ত বক্তব্য, তথ্যসূত্র : মা’আরিফে রেযা করাচী, ১৯৮৬ খ্রি. পৃষ্ঠা নং-১০২)


 ২. জিয়াউল মাশায়েখ আল্লামা মোহাম্মদ ইব্রাহীম ফারুকী মোজাদ্দেদী, কাবুল, আফগানিস্তান : তিনি বলেন-“নিঃসন্দেহে মুফতী আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী ছিলেন একজন মহাপণ্ডিত। মুসলমানদের আচার- আচরণের নীতিমালার ক্ষেত্রে তরীকতের স্তরগুলো সম্পর্কে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। ইসলামী চিন্তা-চেতনার ব্যাখ্যা করেন জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উচ্চসিত প্রশংসার দাবীদার। ইসলামী আইনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মৌলনীতিমালার সাথে সঙ্গতি রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরিশেষে, একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, এ আক্বিদা বিশ্বাসের মানুষের জন্য তাঁর গবেষণাকর্ম আলোকবর্তিকা হয়ে খেদমত আঞ্জাম দেবে”। (মকবুল আহমদ চিশতি কৃত পায়গামাতে ইয়াওমে রেযা, লাহোর, পৃ. -১৮)

 বিদেশী অধ্যাপকবৃন্দের অভিমত

 ১. অধ্যাপক ড. মহিউদ্দিন আলাউয়ী, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর : তিনি বলেন-“একটি প্রাচীন প্রবাদ আছে যে, বিদ্যায় প্রতিভা ও কাব্যগুণ কোন ব্যক্তির মাঝে একসাথে সমন্বিত হয় না। কিন্তু আহমদ রেযা খাঁন ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তাঁর কীর্তি এ রীতিকে ভুল প্রমাণিত করে। তিনি কেবল একজন স্বীকৃত জ্ঞান বিশারদই ছিলেন না বরং একজন খ্যাতমানা কবিও ছিলেন”। (সাওতুশ শারক, কায়রো, ফেব্রুয়ারি ১৯৭০, পৃ. ১৬/১৭)

 ২. শায়খ আবদুল ফাততাহ আবু গাদ্দা, ইবনে সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় রিয়াদ, সৌদি আরব : তাঁর বক্তব্য- “একটি ভ্রমণে আমার সাথে এক বন্ধু ছিলেন। যিনি ফতোয়ায়ে রেযভীয়া (ইমাম সাহেবের ফতোয়া) গ্রন্থখানা বহন করছিলেন। ঘটনাচক্রে আমি ফতোয়াটি পাঠ করতে সক্ষম হই। এর ভাষার প্রাচুর্য, যুক্তির কীক্ষতা এবং সুন্নাহ ও প্রাচীন উৎস থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিসমূহ দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমি নিশ্চিত- এমনকি, একটি ফতোয়ার দিকে এক নজর চোখ বুলিয়েই নিশ্চিত যে- এই ব্যক্তিটি বিচারবিভাগীয় অন্তর্দৃষ্টি সমৃদ্ধ একজন মহাজ্ঞানী আলেম”। (ইমাম আহমদ রেযা আরবার ইত্যাদি, পৃ.-১৯৪)।

 অন্যান্য ধর্মাবলম্বী পণ্ডিতবর্গের অভিমত

 ১. ড. বারবারা, ডি, ম্যাটকাফ, ইতিহাস বিভাগ বারকলী বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : তিনি অভিমত পেশ করেন- “ইমাম আহমদ রেযা খাঁন তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অসাধারণ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টির একটি ঐশীদান প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি ড. জিয়াউদ্দিনের একটি গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে দিয়েছেন- অথচ এর সমাধানের জন্য ড. জিয়াউদ্দিন জার্মান সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন”। (মা’আরিফে রেযা ১১তম খণ্ড আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ, ১৯৯১ পৃ.-১৮)।

 ২. অধ্যাপক ড. জে. এম. এস. বাজন-ইসলাম তত্ত্ব বিভাগ, লিডেন বিশ্ববিদ্যালয়, হল্যান্ড : ড. মাসউদ আহমদের নিকট লিখিত তাঁর বক্তব্য হলো- “ইমাম সাহেব একজন বড় মাপের আলেম। তাঁর ফতোয়াগুলো পাঠের সময় এই বিষয়টি আমাকে পুলকিত করেছে যে- তাঁর যুক্তিগুলো তাঁরই ব্যাপক গবেষণার সাক্ষ্য বহন করছে। সর্বোপরি- তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ভারসাম্যপূর্ণ। আপনি (ড. মাসউদ আহমদ) সম্পূর্ণ সঠিক। পাশ্চাত্যে তাঁকে আরো অধিক জানা ও মূল্যায়িত করা উচিত- যা বর্তমানে হচ্ছে”। (ড. মাসউদ আহমদকে প্রেরিত পত্র, তাং-২১-১১-৮৬ হতে সংগৃহীত)

 প্রতিপক্ষের দৃষ্টিতে ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রহ.)

 ১. মওলভী আশরাফ আলী থানবী, থানাবন, ভারত : তিনি বলেন-“(ইমাম) আহমদ রেযা খাঁনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে- যদিও তিনি আমাকে কাফের (অবিশ্বাসী) ডেকেছেন। কেননা, আমি পূর্ণ অবগত যে, এটা আর অন্য কোন কারণে নয়- বরং নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিত্বের প্রতি তাঁর সুগভীর ও ব্যাপক ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত”। (সাপ্তাহিক চাতান, লাহোর, ২৩শে এপ্রিল ১৯৬২) 

 ২. আবুল আ’লা মওদুদী, প্রতিষ্ঠাতা, জামায়াতে ইসলামী : তিনি মন্তব্য করেন- “মাওলানা আহমদ রেযা খাঁনের পাণ্ডিত্যের উচুঁমান সম্পর্কে আমার গভীর শ্রদ্ধা বিদ্যমান। বস্তুত দ্বীনি চিন্তা-চেতনার তাঁর মেধাকে স্বীকার করতে হয়”। (মাকালাতে ইয়াওমে রেযা, ১ম ও ২য় খণ্ড, পৃ.- ৬০)

 ইমাম আহমদ রেজা খাঁন রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন মুসলিম মনীষার প্রাণপুরুষ। তাঁর অধিকাংশ গবেষণাকর্ম উর্দু ভাষায় রচিত হওয়ায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণ সেগুলো থেকে বঞ্চিত। তাঁর গবেষণা কর্মকে বাংলায় অনুবাদ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহপাক তাওফিক দিন।

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন