সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১২০১ হিজরি সফর মাসের ৬ তারিখ মোতাবেক ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর ভারতের রায় বেরেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ ইরফান।
‘চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে পাঠানো হল। কিন্তু বহু চেষ্টা তদবির সত্ত্বেও তার প্রকৃতি, স্বভাবকে ধাবিত করা গেল না। পুথিগত বিদ্যায় তার কোন উন্নতি হল না।’ (ঈমান যখন জাগল, কৃত আবুল হাসান আলী নদভী)
সৈয়দ আহমদ একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট স্বাস্থ্যবান বালক ছিলেন। তার দৈহিক শক্তি ছিল বেশি কিন্তু লেখা-পড়ায় কোন মনোযোগ ছিল না। তিনি কৈশোরে আশেপাশের গ্রামে কিংবা সাম নদীর তীঁরে সমবয়সীদের সঙ্গে শুধু ঘুরে বেড়াতেন এবং কাবাডি খেলা, মল্লক্রীড়া, সাতার ও ঘোড় দৌড়ে প্রচুর আনন্দ পেতেন। এভাবে তার সতের বছর কেটে গেল। কিন্তু তার কিতাবী শিক্ষালাভ কিছুই হল না, সতের বছর বয়সে তার পিতার মৃত্যু হয়, তার দু’তিন বৎসর পর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এই গেঁয়ো তরুণ চাকুরী যোগাড়ের উদ্দেশ্যে লৌক্ষ্মতে শহর উপস্থিত হলেন। (আব্দুল মওদুদ চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ ইং পৃষ্ঠা-১৭)
লৌক্ষ্মতে দীর্ঘদিন অবস্থান করার পরও তার উপযুক্ত কোন চাকরি পাওয়া গেল না। তিনি দিল্লির দিকে ছুটলেন সে সময় তার বয়স হয়েছিল ২০ বৎসর। গরিব ও দরিদ্র অবস্থার কারণে তিনি অতিকষ্টে দিল্লিতে পৌঁছলেন। (মির্জা হায়রত দেহলভী, হায়াতে তাইয়েবা ৪০৫ পৃষ্ঠা
অনেকখানি রাস্তা পায়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে সৈয়দ আহমদ- শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত এর দরবারে এসে জোর গলায় জানালেন- আসসালামু আলাইকুম। বিশ বৎসরের যুবকের মুখে এই বলিষ্ট সম্ভাষণ ‘আদাব ও তসলিমাত’ অভ্যস্ত শহরে ভদ্র শ্রেণীর কানে খুবই অদ্ভুত শোনালেন। (চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ইং পৃষ্ঠা- ১৭))
উপরন্তু দিল্লিতে তার জানাশোনা কেউ ছিল না। বাধ্য হয়ে তিনি শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভীর মাদ্রাসায় আশ্রয় নিলেন এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত করলেন। হযরত শাহ আব্দুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু হিন্দুস্তানের এক সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সুখ্যাতি হিন্দুস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ছিল। সুতরাং শিক্ষার্থীরা সবসময় চন্দ্রের বৃত্তের মত তাঁকে ঘিরে রাখতো। সৈয়দ আহমদ তাহার এই অবস্থা দেখে ইলিম শিক্ষার আগ্রহ জাগল।
এ প্রসঙ্গে মির্জা হায়রত লিখেছেন- সৈয়দ আহমদের ইচ্ছা ছিল যে, কোন মতে লেখাপড়া শিক্ষা করে আমি সম্মানিত হব। কিন্তু মনের গতি কি করবেন, মনতো এদিকে মোটেই ঝুঁকছে না। (মির্জা হায়রত দেহলভী, হায়াতে তাইয়েবা ৪০৬ পৃষ্ঠা
মির্জা হায়রত আরো লিখেছেন-
একমাস পর্যন্ত শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে পড়ালেন কিন্তু ফল হল না। হাজার চেষ্টা করা হয়ে ছিল যে, সৈয়দ আহমদের কিছু শিক্ষালাভ হোক কিন্তু পড়া-লেখায় তার মন একেবারেই ঠিকে না। (হায়াতে তাইয়েবা- ৪০৯ পৃষ্ঠা)
কোন কোন জীবনীলেখক তার সম্পর্কে বলেছেন সৈয়দ সাহেব শাহ আব্দুল কাদির দেহলভীর খেদমতে ছিলেন ও তাঁর নিকট লেখা-পড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট মুরিদ হয়ে তার নিকট থেকে তরিকতের তা’লিম নিতেন। এভাবে দু’বৎসর কাটালেন।
একদিনের ঘটনা, সৈয়দ আহমদ বেরলভী- শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভীর দরবারে ছিলেন। শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত যখন তাসাব্বুরে শায়খ বা পীরের ধ্যান করার কথা বললেন, তখন সৈয়দ আহমদ বলে উঠলেন, আমি এটা করতে পারব না। কেননা পীরের ধ্যান করা আর মূর্তিপূজার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। মূর্তিপূজা হচ্ছে জঘন্যতম কুফুরি ও শিরিক। রূহানী সাহায্য ও তাওয়াজ্জুহ চাওয়াতো মূর্তিপূজা এবং প্রকাশ্য শিরিক। আমি কখনো এ কাজ করব না। (মাও: মুহাম্মদ আলী বেরলভী মাহজানে আহমদী- ১৯ পৃষ্ঠা)
অনুরূপ চেতনায় বালাকোট স্মারক ২০১০ইং ১৮ পৃষ্ঠায় আব্দুল মওদুদ তার নিবন্ধে উল্লেখ করেন-
‘ছুফী সাধনা অনুযায়ী শাহ আব্দুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মুরীদ সৈয়দ আহমদকে শিক্ষা দিলেন যে, পীর, মুর্শিদের চিন্তায় মনের এতখানি একাগ্রতা আনতে হবে যে, তার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে। সৈয়দ আহমদ আপত্তি তুলে প্রমাণ চাইলেন যে, এ পদ্ধতি কেন পৌত্তলিকতার পর্যায়ে পড়বে না? এরপর থেকে সৈয়দ আহমদকে অধ্যয়ন করতে না দিয়ে স্বাধীন এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকতে দেওয়া হয়।’
মোদ্দাকথা হলো- সৈয়দ আহমদ বেরলভীর এহেন জঘণ্যতম ফতওয়া পীরের ধ্যান করা যাকে ‘রাবেতায়ে শায়খ’ বলা হয়ে থাকে অর্থাৎ পীর সাহেব যখন মুরিদ থেকে দূরে থাকেন, তখন মুরিদ তা’জিম ও মহব্বতে তাঁর গুণাবলীকে সামনে রেখে পীর সাহেবের ধ্যান করলে তাঁর সহবতে থাকার ন্যায় ফয়েজ ও বরকত লাভ করতে সক্ষম হবে। (আলকাউলুল জামীল ৫০ পৃষ্ঠা শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলায়হি রহমত) বলেন- আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য এই পন্থাই সর্বোত্তম। অযোগ্য মুরিদ যখন পীরের সঙ্গে সীমাতিরিক্ত মহব্বতে বিভোর হয়ে (পীরের ধ্যানে মগ্ন হয়ে) পড়ে, তখন কামেল মুর্শিদ খোদাপ্রদত্ত ক্ষমতাবলে মুরিদের মধ্যে যোগ্যতা সৃষ্টি করে দিয়ে থাকেন। (হাশিয়ায়ে কাউলুল জামীল ৫০ পৃষ্ঠা।
সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার এমন পীরের বিরুদ্ধে মূর্তিপূজার তহমত দিল, যিনি হিন্দুস্তানের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ও ফকীহ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ যাঁর শরিয়ত ও তরিকতের তা’লিম বা শিক্ষা হিন্দুস্তানের সীমানা অতিক্রম করে গিয়েছিল, এমন কামেল পীরের শরিয়তসম্মত নির্দেশ ‘তাছাব্বুরে শায়খ’ বা পীরের ধ্যানকে মূর্তিপূজা ও প্রকাশ্যে পৌত্তলিকতা বা শিরিক বলে আখ্যায়িত করে ফতওয়া প্রদান করলো- যা সহস্র বছর ধরে এ জমিনের বুকে আল্লাহ তা’য়ালার ওলীগণের আমল ছিল।
এখন যদি আপনি ইচ্ছা করে অজ্ঞ সৈয়দ আহমদের কথা গ্রহণ করেন, তাহলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ও বিশ্ববিখ্যাত মোহাদ্দিস শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) থেকে শুরু করে ইমামুত তরিকত শায়খ সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী আজমিরী ছিনজেরী, মোজাদ্দিদে আলফেসানী সিরহিন্দী ও বাহাউদ্দিন নকশেবন্দী রেদওয়ানুল্লাহি আলাইহিম আজমাঈনসহ সকল আউলিয়ায়ে কেরামগণের উপর মূর্তিপূজা ও প্রকাশ্য শিরিক এর অপবাদ বা ফতওয়া থেকে বাদ পড়েনি।
সৈয়দ আহমদ যখন আউলিয়ায়ে কেরামের কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক একটা তরিকতের আমল পীরের ধ্যান করাকে পৌত্তলিকতা ও মুশরিক ফতওয়া দিতে দুঃসাহস করল, তখনই তার পীর ও মুর্শিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) সৈয়দ আহমদকে তার মতের উপর ছেড়ে দিলেন অর্থাৎ তাকে দরবার থেকে বের করে দিলেন এবং সেও তার বদ আক্বিদার উপর অটল থেকে নিজেও বের হয়ে গেল। শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর দরবার থেকে বের হয়ে সৈয়দ আহমদ নবীর সমকক্ষ হওয়ার দাবিদার হয়ে ‘তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া’ নামে একটা নিজস্ব তরিকা আবিষ্কার করলো। এ প্রসঙ্গে চেতনায় বালাকোট ২০১০ইং ৭৭ পৃষ্ঠায় মাওলানা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন-
‘সৈয়দ আহমদের সময় মানুষের জাহেরী আমল আগের চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে গিয়েছিল, ধর্ম-কর্মের প্রতি মানুষের মোটেই লক্ষ্য ছিল না, তাই তিনি তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া বাতিনী তরবিয়াতের সাথে সাথে জাহিরী আমলের ও তরবিয়াত আরম্ভ করেন এবং হযরত মুহাম্মদ (স.) এর নামানুসারে এ তরিকার নাম রাখলেন ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ কেননা রাসূল (স.) একই সাথে জাহির ও বাতিনের তরবিয়ত দিতেন।’
দেখলেন তো সৈয়দ আহমদকে আল্লাহর হাবীবের সঙ্গে কিরূপ তুলনা করলো।
(নাউজুবিল্লাহ) তরীকতের প্রত্যেক ইমামগণই জাহির ও বাতেন উভয়েরই তা’লিম ও তরবিয়ত দিয়েছিলেন, এতদসত্ত্বেও তাঁরা কেহই আল্লাহর হাবীবের নামানুসারে তরীকার নাম দেননি, কারণ আল্লাহর হাবীব তরীকার উর্দ্ধে তিনি হচ্ছেন শরিয়ত ও তরিকত উভয়েরই মূল।
কাদেরিয়া তরিকার ইমাম গাউছুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রাদিয়াল্লাহু আনহুও সর্বপ্রথম ‘গুণিয়াতুত্বালেবীন’ কিতাব লিখে আক্বাইদ ও আমলের সবিস্তার আলোচনা করেন এবং এ শিক্ষাও দিয়েছেন, শরিয়ত মজবুত না হলে তরিকত লাভ করা সম্ভব হবে না।
মোজাদ্দিদে আলফেসানী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর মকতুবাতশরীফ ১ম জিলদের ৫৫ নং মকতুবাতে ১১৩১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
جوشریعت کی پابندی کرتا ہے- وہ صاحب معرفت ہے جتنی پابندی زیادہ کرے گا اتنی ھی معرفت زیادہ ہوگی اور جوستی کرنے والاہے وہ معرفت سے بے نصیب ہے-
‘যে ব্যক্তি শরিয়ত মোতাবেক আমল করতে থাকবে সে ব্যক্তিই মা’রিফাতের অধিকারী হবে। শরিয়তের পাবন্দী যত বেশি হবে, ততই মা’রিফাত বেশি লাভ হবে। যে ব্যক্তি আলস্যবশতঃ শরিয়ত থেকে বঞ্চিত থাকবে সে কস্মিনকালেও মা’রিফাত লাভ করতে সক্ষম হবে না।’
উপরন্তু দলিলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো, তরিকার সকল ইমামগণই জাহেরী ইলিমের পাশাপাশি বাতেনী ইলিম শিক্ষা দিয়েছেন এতদসত্ত্বেও তারা কেহই আল্লাহর হাবীবের নামানুসারে তরিকার নামকরণ করেননি। শুধুমাত্র সৈয়দ আহমদ বেরলভী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামানুসারে ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’ নামকরণ করার দাবি করেছে, তার মূল উদ্দেশ্য হলো সে নবীর সমকক্ষ হওয়ার দাবিদার।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর ‘মলফুজাত’ মাওলানা ইসমাইল দেহলভীর লিখনী এবং জৌনপুরী কেরামত আলীর সমর্থিত ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামীয় কিতাবের বর্তমান দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে জাত ও সিফাত দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, সৈয়দ আহমদকেও নবীর জাত ও সিফাতের (গুণাবলীর) কামালে মুশাবিহত বা পুর্ণাঙ্গ সামঞ্জস্য রেখে সৃষ্টি করেছেন। (নাউজুবিল্লাহ)
আরো লিখা রয়েছে- সৈয়দ আহমদের অক্ষর জ্ঞান ছিল না অর্থাৎ সে উম্মী ছিল।’
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, উম্মী হওয়া আল্লাহর হাবীবের একটি অনুপম মু’জিযা। যিনি সৃষ্টিকুলের কারো নিকট জ্ঞানার্জন না করেই স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সৃষ্টির মধ্যে অতুলনীয় জ্ঞানার্জন করেছেন তিনি হলেন উম্মী।
উম্মী হওয়া আল্লাহর হাবীবের অনুপম মু’জিযা হওয়া সত্ত্বেও সৈয়দ আহমদকে নবীর সঙ্গে তুলনা করেই দাবি করা হয়েছে যে, সৈয়দ আহমদ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সরাসরি ইলিম লাভ করেছেন।
এ সম্পর্কে সিলেটের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী সাহেবের পুত্র জনাব মাওলানা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী সাহেব কর্তৃক লিখিত ‘সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনী’ গ্রন্থের (১ম সংস্করণ) ১০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে- ‘(সৈয়দ আহমদ বেরলভী) স্বগোত্রীয় অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মত লেখাপড়ার দিকে তার তেমন ঝোঁক দেখা গেল না। দীর্ঘ তিন বৎসরে তিনি কোরআন শরীফের কয়েকটি মাত্র সূরা মুখস্থ করলেন এবং কিছু লিখতে শিখলেন।’
অনুরূপ সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী কর্তৃক লিখিত ও আবু সাঈদ মোহাম্মদ ওমর আলী কর্তৃক অনুদিত এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত, সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের জীবনী গ্রন্থ ‘ঈমান যখন জাগল’ (প্রথম সংস্করণ) ১৪/৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে-
‘চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে পাঠানো হয়। কিন্তু বহু চেষ্টা তদবীর সত্ত্বেও লেখাপড়ার প্রতি তার প্রকৃতি ও স্বভাবকে ধাবিত করা গেল না। পুথিগত বিদ্যায় তার তেমন কোন উন্নতিও হল না।
সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ, বিশেষ করে বিরোচিত ও সৈনিকসূলভ খেলাধুলার প্রতি। কাবাডি অত্যন্ত আগ্রহ ও উৎসাহের সাথেই খেলতেন।’
উপরোক্ত প্রমাণভিত্তিক আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সৈয়দ আহমদ বেরলভী লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি জ্ঞানান্ধ, নিরক্ষর ও মূর্খ ছিলেন।
মূর্খ হয়ে কিভাবে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’র ইমাম ও মোজাদ্দিদ হবেন, এ চিন্তায় তার সমর্থকগণ লিখিতভাবে প্রকাশ করতে বাধ্য হলো তিনি (সৈয়দ আহমদ) মূর্খ হলেইবা কি দোষ (কোন দোষ-ত্রুটি নেই) কারণ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো উম্মী বা নিরক্ষর ছিলেন। (নাউজুবিল্লাহ)
আল্লাহ তায়ালা যেভাবে তাঁর হাবীবকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছিলেন। ঠিক তেমনিভাবে সৈয়দ আহমদকেও আল্লাহ তায়ালা সরাসরি ইলিম দান করেছেন। নাউজুবিল্লাহ।
এ প্রসঙ্গে মাওলানা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জীবনী গ্রন্থের (১ম সংস্করণ) ১১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
‘আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উম্মী বা নিরক্ষর বলে ঘোষণা করেও বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে যতটুকু জ্ঞানের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি জ্ঞান দান করেছিলেন।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা শুধু আম্বিয়াগণকেই নয় তার অনেক মকবুল বান্দাকেও সরাসরি ইলিম দান করে থাকেন। সৈয়দ আহমদ (রা.)ও সে দান থেকে বঞ্চিত হননি।’ নাউজুবিল্লাহ।
দেখলেন তো সৈয়দ আহমদকে আলেম সাজাবার জন্য আল্লাহর হাবীবের সঙ্গে কিভাবে তুলনা করা হলো!
সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার পীর ও মুর্শিদ যিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত)সহ বিশ্বের সকল আউলিয়ায়ে কেরামগণকে মুশরিক ফতওয়া দিয়ে (তাছাব্বুরে শায়খ বা পীরের ধ্যান করাকে পৌত্তলিকতা বা মুশরিক বলে আখ্যায়িত করে (ফতওয়া দিয়ে) তাঁর দরবার (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভীর দরবার) থেক বের হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সমকক্ষ হওয়ার দাবি করে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামকরণে তার বাতিল আক্বিদা প্রচারের একটা মাধ্যম সৃষ্টি করেছে।
সৈয়দ আহমদের সমর্থকগণের ভাষ্যমতে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ মূলত আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর প্রবর্তিত ওহাবী আন্দোলনের একটি শাখাই প্রমাণিত হয়।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের সিলসিলাভুক্ত ‘মকছুদুল মো’মিনীন’ গ্রন্থের লিখক কাজী মোহাম্মদ গোলাম রহমান (কে. এম. জি. রহমান, পো: তালতলা বাজার নোয়াখালী) লিখিত ‘হযরত শাহজালাল ও শাহপরান (রহ.) নামক পুস্তকের (১০ম মুদ্রণ, মার্চ ২০০৮ইং) ১৫৭ পৃষ্ঠায় ‘সিলেটে ধর্মীয় আন্দোলন’ শিরোনামে উল্লেখ করেন-
‘১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামে একটি ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করেন। তাহার এই আন্দোলনের মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় প্রেরণা জাগরিত করিয়া তাহাদিগকে আত্মসচেতন করিয়া তোলা। তাঁহার এই আন্দোলনের ঢেউ সিলেট জেলায়ও প্রবেশ করিয়াছিল। বহু লোক সিলেট হইতে কলিকাতায় গিয়া সৈয়দ সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করিয়াছিল। সিলেটে যিনি তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া প্রচার করেন তাহার নাম জয়নাল আবেদীন। তিনি হায়দারাবাদের অধিবাসী ছিলেন। তাহার প্রচারের ফলে সিলেটের বহুলোক এই আন্দোলনে যোগদান করিয়াছিল। সিলেটের উর্দু কবি আশরাফ আলী মজুমদারও ইহাতে যোগদান করেন। আরবের আব্দুল ওহাব নামক জনৈক প্রখ্যাত আলেম এই আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন বলিয়া ইহাকে ওহাবী আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে।’
উল্লেখ্য যে, অত্র শাহজালাল ও শাহপরান (রহ.) পুস্তকে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন ১৭৮৬ ইংরেজি থেকে শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা মূলত এ আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ বেরলভীর জন্ম সন। ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে, আর সৈয়দ আহমদ বেরলভীর কলিকাতায় আগমন হয়েছিল ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে। মুদ্রণগত ভুলের দরুণ ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়ার কথা ছাপা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।’
উক্ত পুস্তক লিখক কাজী মোহাম্মদ গোলাম রহমান সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সিলসিলাভূক্ত একজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব এবং আপন ঘরের লোক, তার লিখিত বক্তব্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ আন্দোলনের প্রধান হোতা ছিলেন আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী।
মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর ভ্রান্ত-মতবাদকে উপমহাদেশে প্রচার ও প্রসার করার মাধ্যম হিসেবে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেন। এবং এই আন্দোলনের নাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাবের দিকে সম্পর্ক করে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া’ বলে নামকরণ করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, সৌদিআরব থেকে প্রকাশিত ‘আশ শায়খ মুহাম্মদ বিন আবদিল ওহহাব’ নামক পুস্তকের ৭৭/৭৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্যানুযায়ী সৈয়দ আহমদ বেরলভী আরবের নজদী মুবাল্লিগগণের ভারতীয় প্রতিনিধি ছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
নিম্নে উক্ত কিতাবের এবারত দেওয়া হল-
كما غزت الدعوة الوهابية السودان كذالك غزت الدعوة بعض المقاطعات الهندية بواسطة احد الحجاج الهنود وهو السيد احمد وقد كان الرجل من امراء الهند
অর্থাৎ ‘যেমনিভাবে ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য সুদানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল তেমনিভাবে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ওহাবী মতবাদ প্রচারের জন্য ভারতীয় হাজীগণ থেকেও একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি হচ্ছেন সৈয়দ আহমদ। তিনি ছিলেন ভারতের একজন আমীর।
সুতরাং সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেব যে ওহাবী ছিলেন এবং তার আক্বিদা যে শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুর রহিম মোহাদ্দিসে দেহলভী, শেখ আব্দুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমতসহ সমস্ত মোহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন ও আউলিয়ায়ে কেরাম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বিদার পরিপন্থী ছিল তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
১৮১৮ ইংরেজি সনে সৈয়দ আহমদ বেরলভী যখন নবাব আমীর খানের সেনাদল থেকে বের হয়ে পুনরায় দিল্লিতে আগমন করলো, তখন মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী উভয়ে তাদের বাতিল আক্বিদা প্রচারের মানসে সৈয়দ আহমদ বেরলভীকে পীর সাজিয়ে তার মুরিদ বা শিষ্যত্ব গ্রহণ করলো।
তারা (মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী) উভয়ে সুদুর প্রসারী চিন্তাভাবনার মাধ্যমে স্থির করে নিল যে, সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে বাতিল আকিদার প্রচার ও প্রসার সহজ সাধ্য হবে। কারণ সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার পীর ও মুর্শিদের শিক্ষা ‘তাছাব্বুরে শায়খ’ বা পীরের ধ্যানকে পৌত্তলিকতা বা শিরিক ফতওয়া দিয়ে তার মুর্শিদের দরবার থেকে বের হয়ে আসছে। এটাই তারা দুজন মাও: আব্দুল হাই ও মাও: ইসমাইল দেহলভী উভয়ের সাথে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর বাতিল আক্বিদার পূর্ণ সামঞ্জস্য বা মিল রয়েছে। এজন্য তারা দুইজন সৈয়দ আহমদ বেরলভীর অনুগত হয়ে গেল।
১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আহমদ বেরলভী তার ভ্রান্ত মতবাদ বা আক্বিদাগুলো লিপিবদ্ধ করিয়েছিলেন এবং সেই গ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন ‘সিরাতে মুস্তাকিম’। সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবটি মূলত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা বাণী। যেগুলোকে সংকলন করেছিলেন তার দুই শিষ্য : ১. মৌলভী ইসমাইল দেহলভী, ২. মৌলভী আব্দুল হাই।
উক্ত কিতাবের সর্বমোট চারটি পরিচ্ছেদ। প্রথম ও চতুর্থ পরিচ্ছেদ মৌলভী ইসমাইল দেহলভী এবং দ্বিতীয় তৃতীয় পরিচ্ছেদ মৌলভী আব্দুল হাই কর্তৃক লিখিত।
অতঃপর মৌলভী ইসমাইল দেহলভী সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সকল মলফুজাত বা বাণীগুলোকে একত্রিত করে অক্ষরে অক্ষরে দেখিয়ে শুনিয়ে তার (সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের) পুন: ইজাজত বা স্বীকৃতি লাভ করেন। (সিরাতে মুস্তাকিম কিতাবে ভূমিকা দ্র:) এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের (বাংলা ও আসামের) প্রসিদ্ধ খলিফা মাও: কেরামত আলী জৈনপুরী তদীয় ‘জখিরায়ে কেরামত’ নামক কিতাবের ১ম জিলদের ২০ পৃষ্ঠায় লিখেন-
صراط المستقیم کہ اسکے مصنف حضرت سید صاحب اور اسکے کاتب مولانا محمد اسمعیل محدث دہلوی ہیں-
অর্থাৎ ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবের মুসাননিফ বা রচয়িতা সৈয়দ সাহেব (বেরলভী) এবং কাতিব বা লিখক মাওলানা মোহাম্মদ ইসমাইল মোহাদ্দিসে দেহলভী।’ এতে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো- ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ কিতাবখানা সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের মলফুজাত বা বক্তব্য। উল্লেখ্য যে, মৌলভী আব্দুল হাই ছিলেন শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর জামাতা এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের দক্ষিণহস্ত ও মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম ভুটানবী, ভুপালী তারই পুত্র। (তারিখে ইলমূল হাদীস) জেনে রাখা আবশ্যক উনি মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী নন। যিনি মাওলানা আব্দুল হালিম লাখনবী সাহেবের পুত্র। কেননা আব্দুল হাই লাখনবী সাহেবের জন্ম হয়েছে ১২৬৪ হিজরিতে। সৈয়দ আহমদ বেরলভী সাহেবের জন্ম হলো ১২০১ হিজরিতে এবং মৃত্যু হয়েছে ১২৪৬ হিজরিতে। অতএব প্রমাণিত হলো সৈয়দ আহমদ সাহেবের মৃত্যুর ১৮ বছর পর আব্দুল হাই লাখনবী সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন।
_______________
ইজহারে হক্ব
লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন