হস্তীবাহিনীর লোকদের প্রতি অবতীর্ণ শাস্তির স্মরণ এবং মুহাসসির উপত্যকা দ্রুত অতিক্রম
মুহাসসির উপত্যকা কোথায় অবস্থিত, এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। একটি মত হলো, স্থানটি মুযদালিফা’র কাছে [এয়া’ক্বূত আল-হামাভী কৃত ‘মু’জাম আল-বুলদা’ন’, ১:৪৪৯]। ফযল ইবনে আব্বা’স (رحمة الله)-এর ভাষ্য মোতাবেক আরেকটি মত হলো তা মিনা’য় অবস্থিত [মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘হাজ্বীর পাঠকৃত তালবিয়্যার সময়কাল’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯৩১ #১২৮২; আল-নাসা’ঈ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক আল-হাজ্জ্ব’, ‘আরাফা হতে সফরের সময় শান্ত থাকার নির্দেশ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২৮৫ #৩০২০; আল-নাসা’ঈ লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪৩৪ #৪০৫৬; আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২১০ #১৭৯৬; এবং আল-বায়হাক্বী রচিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১২৭ #৯৩১৬]। শায়খ আবদুল হক্ব মোহাদ্দিসে দেহেলভী (رحمة الله) এই দুটো মতের মধ্যে সমন্বয় করে বলেন যে মুহাসসির উপত্যকা প্রকৃতপক্ষে মিনা’ ও মুযদালিফা’র মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত [শায়খ আবদুল হক্ব দেহেলভী প্রণীত ‘আশয়াত আল-লুম’আ’ত শরহে মিশকা’ত আল-মাসা’বিহ’, ২:৩৪৫]। মুযদালিফা’র আশপাশ এলাকাটিতে হাজ্বী সাহেবান অবস্থান করলেও মুহাসসিরউপত্যকাটি ওই এলাকার বাইরে হওয়ায় সেখানে অবস্থান করতে তাঁদেরকে নিষেধ করা হয়েছে [আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ৪:৮২ #১৬,৭৯৭; ইবনে হিব্বা’ন রচিত ‘আল-সহীহ’, ৯:১৬৬ #৩৮৫৪; আল-শায়বা’নী প্রণীত ‘’কিতা’ব আল-মাবসূত’, ২:৪২২; ইবনে আবী শায়বা লিখিত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৩:২৪৬ #১৩৮৮৪-১৩৮৮৫; আল-দায়লামী রচিত ‘আল-ফেরদৌস বি-মা’সূর আল-খিতা’ব’, ৩:৪৪ #৪১১৩; আল-বায়হাক্বী কৃত ’আল-সুনান আল-কুবরা’, ৯:২৯৫ #১৯,০২১; আল-তাবারা’নী প্রণীত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ২:১৩৮ #১৫৮৩; আল-হায়সামী লিখিত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৩:২৫১; এবং আল-হায়সামী কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৪:২৫]।
যিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয়ের প্রাক মুহূর্তে (ফজরের দুই রাক’আত নামায পড়ার সময়ে) হাজ্বী সাহেবান তালবিয়্যা পাঠ করতে করতে মিনা’র উদ্দেশ্যে মুযদালিফা ত্যাগ করেন; আর যখন তাঁরামুহাসসির উপত্যকায় পৌঁছেন, তখন তাঁদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে বাঁচতে তাঁরই কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে করতে দ্রুতবেগে সে স্থান অতিক্রম করতে হয়। [ওয়াহবা আল-যুহায়লী রচিত ‘আল-ফিকহু আল-ইসলা’মী ওয়া আদিল্লাতুহু’, ৩:২১৬৮]
কেন এটা এরকম? এ কারণে যে, প্রিয়নবী (ﷺ)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের আগে বাদশাহ আবরাহা এক হস্তীবাহিনীসহ কা’বা শরীফ ধ্বংস করার ইচ্ছা করেছিল। তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সে মুহাসসির উপত্যকায় পৌঁছুলে সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার গযব (রোষ) তার ওপর অবতীর্ণ হয়। এক ঝাঁক (আবাবীল) পাখি ওপর থেকে কঙ্কর নিক্ষেপ করে তাকে এবং তার হস্তীবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় [ইবনে হিশা’ম প্রণীত ‘অাল-সীরা আল-নাবাউইয়্যা’, পৃষ্ঠা ৬৫-৬৭; ইবনে আসীর কৃত ‘আল-কা’মিল ফী আল-তা’রীখ’, ১:৪৪২-৪৪৭; আল-সুহায়লী রচিত ‘আল-রওদ আল-উনুফ ফী তাফসীর আল-সীরা আল-নাবাউইয়্যা লি-ইবনে হিশা’ম’, ১:১১৭-১২৬; ইবনে আল-ওয়ার্দী লিখিত ‘তাতিম্মা আল-মুখতাসার ফী আখবা’র আল-বাশর’, ১:৯২; ইবনে কাসীর প্রণীত ‘আল-বেদা’য়া ওয়া আল-নেহা’য়া’, ২:১০১-১১০; আল-কসতলা’নী কৃত ‘আল-মাওয়া’হিব আল-লাদুন্নিয়্যা’, ১:৯৯-১০৪; আল-সা’লেহী রচিত ‘সুবুল আল-হুদা’ ওয়া আল-রাশা’দ ফী সীরা খায়র আল-এবা’দ’, ১:২১৭-২২২; এবং আল-যুরক্বা’নী লিখিত ‘শরহু আল-মাওয়া’হিব আল-লাদুন্নিয়্যা’, ১:১৫৬-১৬৬]। এই ঘটনাটি কুরআনে করীমের সূরা ফীল, অর্থাৎ, হস্তী অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ আছে এভাবে:
হে মাহবূব! আপনি কি দেখেননি আপনার রব্ব ওই হস্তী আরোহী বাহিনীর কী অবস্থা করেছেন? তাদের চক্রান্তগুলোকে কি তিনি ধ্বংসের মুখে ছুঁড়ে ফেলেননি? এবং তাদের ওপর পাখির ঝাঁকগুলোকে প্রেরণ করেছেন; যেগুলো তাদেরকে কঙ্কর-পাথর দিয়ে হনন করছিল। অতঃপর (তিনি) তাদেরকে চর্বিত ক্ষেতের পল্লবের মতো করেছেন। [আল-ক্বুরআ’ন, ১০৫:১-৫]
এ কারণেই হজ্জ্ব পালনকালে মহানবী (ﷺ) তাঁর পুণ্যবান সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে মুহাসসির উপত্যকাটি তাড়াতাড়ি পার হয়ে যেতে আদেশ করেন। তাঁদের আচরণ ছিল শঙ্কার, যেন এই বুঝি শাস্তি এসে পড়বে; যে শাস্তি প্রকৃতপক্ষে বহু বছর আগেই আবরাহা ও তার হস্তীবাহিনীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর পুতঃপবিত্র সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه)-কে তাঁদের নিজেদের মধ্যে আল্লাহভীতির এক অনুভূতি/হাল জাগিয়ে তুলতে বলেন। তিনি নিজেও একই কাজ করেন, আর উপত্যকাটি ত্বরিত অতিক্রম করেন।
মুহাসসির উপত্যকা পার হওয়ার সময় হুযূর পাক (ﷺ)-এর হাল/অবস্থা হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ) বর্ণনা করেন এভাবে: তিনি মুহাসসির উপত্যকা পর্যন্ত গমন করলে তাঁর উটের লাগাম আপন পবিত্র হাতে নেন, আর উটটি দ্রুত উপত্যকা পার হয়ে যায়। অতঃপর তিনি থামেন। [আল-তিরমিযী প্রণীত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘গোটা আরাফা দাঁড়াবার জায়গা মর্মে যাবতীয় বর্ণনা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২৩২ #৮৮৫; আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৭৫ #৫৬২; ইবনে খুযাইমা রচিত ‘আল-সহীহ’, ৪:২৭২ #২৮৬১; আল-বাযযার লিখিত ‘আল-বাহর আল-যুখা’র’, ২:১৬৫ #৫৩২; এবং আবূ এয়া’লা’ প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৬৪ #৩১২]
শায়খ আবদুল হক্ক মোহাদ্দেসে দেহেলভী (৯৫৮-১০৫২ হিজরী) লেখেন: পদব্রজে হোক, বা সওয়ারে চড়ে হোক, এই উপত্যকাটি দ্রুত পার হওয়া মুস্তাহাব (প্রশংসনীয় আমল)। [আবদুল হক্ক দেহেলভী রচিত ‘আশ’আত আল-লোম’আত শরহে মিশকা’ত আল-মাসা’বীহ’, ২:৩২৪]
মহানবী (ﷺ) কেন তাঁর সাহাবাবৃন্দকে (رضي الله عنه) উপত্যকাটি দ্রুতবেগে অতিক্রম করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন? এখন তো আর (আবাবীল) পাখির ঝাঁক বা কঙ্করবৃষ্টির অস্তিত্ব-ই নেই। এর উত্তর হচ্ছে এটা এমনই এক আমল (অনুশীলন), যা থেকে আমরা উপদেশ ও সতর্কবাণী এবং নিজেদের আধ্যাত্মিক অবস্থার উন্নতিসাধন সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। উপত্যকাটিতে তাড়াতাড়ি পার হওয়ার এই ব্যাপারটি শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত অনুশীলনীয় একটি সুন্নাহ’তে পরিণত হয়েছে, আর হাজ্বীদেরকে এই স্থানটি ত্বরিত অতিক্রমের হুকুম দেয়া হয়েছে।
এর পেছনে একটি উদ্দেশ্যই নিহিত আর তা হলো, অতীত ঘটনাবলী প্রত্যেকের অন্তরে স্মরণীয় হয়ে থাকা এবং মস্তিষ্কে সেগুলোকে দৃঢ়ভাবে গেঁথে রাখা। ওপরোক্ত হাদীসগুলো এর সত্যতা প্রতিপাদন করে; এধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বীন-ইসলামের শিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন