সাফা ও মারওয়া’র সাঈ: হযরত মা হাজেরের সুন্নাহর স্মরণে
আল্লাহতা’লার পছন্দকৃত বান্দাদের এমন কিছু কাজ বিদ্যমান, যেগুলো দৃশ্যতঃ এবাদত-বন্দেগীর মতো দেখায় না এবং এবাদতের নিয়্যতেও সেগুলো পালিত হয়নি, কিন্তু মহান আল্লাহ পাক সেগুলোকে মহামূল্যবান বিবেচনা করে সংরক্ষণ করেছেন এমনভাবে যে, তিনি সেগুলোকে একটি সামষ্টিক এবাদতের অংশ হিসেবেই ঘোষণা করেছেন।
এর একটি (উৎকৃষ্ট) উদাহরণ হলো মা হাজেরা (رضي الله عنه)-এর ঘটনাটি, যেখানে তিনি তাঁর শিশুপুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)-এর জন্যে পানির তালাশে মরিয়া হয়ে আল-সাফা’ ও আল-মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ছুটোছুটি করেছিলেন। আল্লাহতা’লা তাঁর এই কাজটিকে এতো-ই পছন্দ করেন যে তিনি এ মর্মে আদেশ জারি করেন যেন হাজ্বী সাহেবান হজ্জ্বের অঙ্গ হিসেবে ওই দুটো পাহাড়ের মাঝখানে একইভাবে দ্রুত চলাচল করেন। এর পরিভাষাগত শব্দ হচ্ছে সা’ঈ। হজ্জ্ব ও উমরা উভয় ক্ষেত্রেই সা’ঈ ওয়া’জিব তথা অবশ্যকর্তব্য।
মনে রাখতে হবে যে সাতবার সা’ঈ পালনকালে সুনির্দিষ্ট কোনো ক্বুরআ’ন মজীদের আয়াত তেলাওয়াত কিংবা কোনো যিকর পাঠ নির্ধারণ করা হয়নি। যার যেমন ইচ্ছে সে মোতাবেক ক্বুরআ’ন মজীদের যে কোনো আয়াত তেলাওয়াত করার অনুমতি আছে; আর মহানবী (ﷺ)-এর প্রতি সালাত-সালাম প্রেরণ-ও জায়েয। মুখস্থ কিছু জানা না থাকলেও আল্লাহতা’লার মহিমাপূর্ণ নামগুলো জপা কিংবা বিশ্বাসসংক্রান্ত কলেমা-বাক্য মুখে আওড়ানোই যথেষ্ট হবে। নতুবা স্রেফ নিশ্চুপ থেকেও সা’ঈ সুসম্পন্ন করা বৈধ।
ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী) ও অসংখ্য হাদীসশাস্ত্র বিশারদ এবং তাফসীরবিদ আল-সাফা ও আল-মারওয়া’র তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু আহাদীস ও রওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছেন। এর একটি নমুনা নিম্নরূপ:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) মা হাজেরা (رضي الله عنه) ও (তাঁর শিশুপুত্র) পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)-কে সিরিয়া হতে মক্কা মোয়াযযমায় নিয়ে যান। ওই সময় নগরীটি বসতিহীন ছিল এবং পানির উৎস-ও দৃশ্যমান ছিল না। পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে আল্লাহর ঘরের পাশে রেখে তাঁদের কাছে কিছু খেজুর ও পানির মওজূদ জমা দিয়ে বিদায় নিতে গেলে মা হাজেরা (رضي الله عنه) বেদনার্তস্বরে বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি, ইবরাহীম?’ আপনি কি আমাদেরকে এই বিরাণ মরু-উপত্যকায় রেখে চলে যাচ্ছেন?’ তিনি এই প্রশ্নটি বারংবার করতে থাকেন। কিন্তু পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর দিকে পেছন ফিরে তাকাননি। এমতাবস্থায় মা হাজেরা (رضي الله عنه) জিজ্ঞেস করেন, ‘মহান আল্লাহতা’লা আপনাকে আদেশ করার কারণেই কি আপনি আমাদেরকে এখানে ছেড়ে যাচ্ছেন?’ তিনি এর প্রতি হাঁ-সূচক উত্তর দেন। অতঃপর মা হাজেরা (رضي الله عنه) বলেন, ‘এ-ই যদি অবস্থা হয়, তাহলে আল্লাহতা’লা আমাদেরকে পরিত্যাগ করবেন না।’
এরপর মা হাজেরা (رضي الله عنه) ওই স্থানেই বসে থাকেন যতোক্ষণ না পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর যাত্রায় দৃষ্টির বাইরে চলে যান। তিনি যখন ‘সানিয়্যা’ নামের একটি জায়গায় পৌঁছেন, তখন দুই হাত তুলে মোনাজাত করেন:
“হে আমার রব্ব! আমি আমার কিছু বংশধরকে (মানে মা হাজেরা ও পুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল এবং পুত্রের অনাগত বংশধরদের) এমন এক উপত্যকায় বসতি স্থাপন করালাম, যেখানে ক্ষেত হয় না এবং যে স্থানটি আপনারই সম্মানিত ঘরের সন্নিকটে; হে আমাদের রব্ব! (এটা) এই জন্যে যে তারা নামায ক্বায়েম রাখবে। অতঃপর আপনি কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের দিকে অনুরাগী করে দিন এবং তাদেরকে কিছু ফলমূল খেতে দিন; হয়তো তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।” [আল-ক্বুরআ’ন, ১৪:৩৭; মুফতী আহমদ এয়ার খান (رحمة الله) প্রণীত নূরুল এরফান]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, মা হাজেরা (رضي الله عنه) তাঁর শিশু পুত্রকে বুকের দুধ খাওয়াতে আরম্ভ করেন এবং পানির মওজূদ হতে পান করতে থাকেন যতোক্ষণ না পাত্রের জল ফুরিয়ে যায়। এরপর তিনি ও তাঁর শিশু তৃষ্ণার্ত হন। মা হাজেরা (رضي الله عنه) লক্ষ্য করেন যে তাঁর শিশুপুত্র বেজায় তৃষ্ণার্ত হয়ে কাতরাচ্ছেন এবং এর দরুন মাটিতে পা দ্বারা আঘাত করছেন। তিনি শিশুর এই অবস্থা আর সহ্য করতে পারেননি। আল-সাফা ছিল সবচেয়ে কাছে অবস্থিত পাহাড়। তাই তিনি তাতে আরোহণ করে উপত্যকার ওপারে মানুষজনের খোঁজ করেন। কাউকে না পেয়ে তিনি এরপর উপত্যকা অতিক্রম করে আল-মারওয়া পাহাড়ে ওঠেন। এরকম তিনি সাতবার করেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহা্নবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান: এই দুটো পাহড়ের মধ্যবর্তী স্থানে মানুষের সা’ঈ করার কারণ এটাই। [আল-বুখারী রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’, “আল্লাহর বাণী – ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’” শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২২৮-১২২৯ #৩১৮৪; অাল-নাসা’ঈ লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১০০ #৮৩৭৯; আবদুর রাযযাক্ব কৃত আল-মুসান্নাফ, ৫:১০৫-১০৬ #৯১০৭; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১০০ #৮৩৭৯; আল-নাসা’ঈ লিখিত ‘ফাযা’ইলে সাহা’বা’, ১:৮২ #২৭৩; আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ৯:৩৬৮-৩৬৯; এবং ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম’, ১:১৭৭]
মহান আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দীর ধার্মিকতা এতোই সযত্নে লালন করেন যে তিনি একে তাঁর নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি এরশাদ ফরমান:
“নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত।” [আল-ক্বুরআ’ন, ২:১৫৮]
এই ঘটনা আনুমানিক চার হাজার বছর আগে ঘটেছিল। ওই উপত্যকা ও পাহাড়গুলো তাদের মৌলিক আকৃতিতে এখন আর বিরাজ করছে ন। আর খোদাতা’লার প্রিয় বান্দীর শঙ্কাও বর্তমানে অস্তিত্বশীল নেই। তথাপিও হাজ্বী সাহেবান আল্লাহতা’লার আদিষ্ট দুই পাহাড়ের মাঝে সা’ঈ পালন করে থাকেন। এসব কিছুই মা হাজেরা (رضي الله عنه) কর্তৃক তাঁর পুত্র পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)-এর প্রতি অনুভূত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং তাঁরই অস্বস্তিকর ও পেরেশানি অবস্থার স্মরণার্থে করা হয়।
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন