তওয়াফ: আম্বিয়া (عليه السلام)-এর সুন্নাহ (রীতিনীতি)-এর স্মরণে

 তওয়াফ: আম্বিয়া (عليه السلام)-এর সুন্নাহ (রীতিনীতি)-এর স্মরণে

কা’বা গৃহের চারপাশ সাতবার ঘুরে ঘুরে প্রদক্ষিণ করা তওয়াফ হিসেবে পরিচিত। এই তওয়াফ পালন করা পয়গম্বর আলাইহিমুস্ সালামেরই অনুশীলিত একটি রীতি (সুন্নাহ)। নিম্নবর্ণিত রওয়ায়াতগুলোতে এতদসংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে:

১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন, কা’বা ঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন, এতে প্রার্থনা ও তওয়াফ যিনি সর্বপ্রথম করেন, তিনি হলেন পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম)। [আল-আযরাক্বী প্রণীত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ১:৩৬, ৪০; এবং ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ১:৩১৩]  

২. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব বিবৃত করেন যে তাঁকে এ মর্মে জানানো হয়েছে, পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ধরণীতলে প্রার্থনা করার মতো কোনো বেহেশতী পরিবেশ না পেয়ে দুঃখভারাক্রান্ত ছিলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহতা’লা (ফেরেশতাকুলের মাধ্যমে) পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর জন্যে একটি পবিত্র মসজিদ বানিয়ে দেন এবং সেই স্থানে বসতি করতে তাঁকে আদেশ করেন। হযরত আদম (عليه السلام) মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং তিনি যেখানে বিশ্রাম নেন, সেখানে আল্লাহতা’লা পানির ঝর্ণা সৃষ্টি করে দেন। অতঃপর তিনি মক্কা শরীফ পৌঁছুলে সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করে ওই কা’বা গৃহের পাশে আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন হন এবং কা’বা গৃহ তওয়াফ করেন। তাঁর বেসাল (পরলোকে আল্লাহর সাথে মিলনপ্রাপ্তি) না হওয়া পর্যন্ত এই স্থান-ই হয় তাঁর আবাসস্থল। [আল-আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৩৯; ইবনে আসাকির লিখিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৭:৪২৫; এবং আল-মাক্বদাসী প্রণীত ‘আল-বাদ’ ওয়া আল-তা’রীখ’, ৪:৮২]

৩. খলীফা উমর আল-খাত্তাব (رضي الله عنه) হযরত কা’আব আল-আহবার (رضي الله عنه)-কে আল্লাহতা’লার ঘরটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেন, “আল্লাহতা’লা পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর সাথে একটি হীরের মোড়কের ভেতরে কা’বা ঘরটি দুনিয়াতে নামিয়ে দেন এবং তাঁকে বলেন, ‘ওহে আদম! আমি আমার গৃহ তোমার সাথে পৃথিবীতে পাঠালাম। এটাকে তওয়াফ করতে হবে এবং এর পাশে এবাদত-বন্দেগীও করতে হবে, ঠিক যেমনটি করা হয় আমার ’আরশে।’ ফেরেশতাকুল ওই ঘরের সাথে অবতীর্ণ হন এবং এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও এর নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন। হযরত আদম (عليه السلام) এই কা’বা ঘরের তওয়াফ করতেন, যেমনভাবে ’আরশকে ঘিরে তা করা হয়। আর তিনি এর পাশে নামায-দোয়াও আদায় করতেন, যেমনটি তিনি ’আরশের পাশে প্রার্থনা করতেন।” [আল-আযরাক্বী রচিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৩৯]

৪. পয়গম্বর আদম (আলাইহিস্ সালাম) ছাড়াও অসংখ্য আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) কা’বা ঘরের তওয়াফ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাবেঈ হযরত মুজা’হিদ (رحمة الله) বলেন, “পঁচাত্তর জন পয়গম্বর (عليه السلام) হজ্জ্ব পালন করেন। এঁরা সবাই কা’বা ঘরকে তওয়াফ করেন।” [আল-আযরাক্বী কৃত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৭-৬৮; আল-ফা’কাহী প্রণীত ‘আখবার মক্কা ফী ক্বাদীম অাল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ৪:২৬৮ #২৫৯৯; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-’ইলাল ওয়া মা’রিফা আল-রিজা’ল’, ৩:১৯৩ #৪৮৩১]

কা’বা শরীফকে সাতবার তওয়াফ করাও পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীরই রীতি (সুন্নাহ)।

৫. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: “পয়গম্বর আদম (عليه السلام) হজ্জ্ব পালন করেন এবং কা’বা ঘরকে সাতবার প্রদক্ষিণ (তওয়াফ) করেন।” [আল-আযরাক্বী কৃত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৪৫; এবং আল-সুয়ূতী লিখিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ১:৩২০]

৬. ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে আবী সুলাইমান বলেন: পয়গম্বর আদম (عليه السلام) দুনিয়াতে অবতরণের পরে কা’বা ঘরকে সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-আযরাক্বী প্রণীত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৪৩]

৭. ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাক্ব সর্ব-পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام)-এর তওয়াফ প্রসঙ্গে লেখেন: পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলউল্লাহ (আলাইহিস্ সালাম) পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণ সুসম্পন্ন করার পর হযরত জিবরীল (عليه السلام) তাঁর কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন, ‘এটাকে সাতবার তাওয়াফ করুন।’ এমতাবস্থায় সর্ব-পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام) কা’বা ঘরকে সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-আযরাক্বী লিখিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৫; এবং আল-কুরতুবী কৃত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআন, ২:১২৯]

সর্বশেষ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের এই আচরিত প্রথাটিকে কা’বা শরীফের সাতবার তাওয়াফ দ্বারা সংরক্ষণ করেন।

৮. হযরত উমর ইবনে আল-খাত্তাব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা মোয়াযযমায় প্রবেশ করে কা’বা গৃহকে সাতবার তাওয়াফ করেন। [আল-বুখারী লিখিত ‘সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘যে ব্যক্তি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমের পেছনে তাওয়াফ-পরবর্তী দুই রাক’আত নামায আদায় করেন’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮৮ #১৫৪৭; আল-বুখারী কৃত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী সাঈ সম্পর্কে বর্ণিত বিষয়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৯৩ #১৫৬৩; আল-বুখারী প্রণীত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা-শেষে এহরাম খোলার সময়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৬৩৬ #১৭০০; এবং মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘হজ্জ্বে এহরাম বাঁধা ব্যক্তির প্রতি আরোপিত বাধ্যবাধকতা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯০৬ #১২৩৪]  

৯. হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: মহানবী (ﷺ) মক্কা শরীফে প্রবেশ করলে তিনি কা’বা ঘর সাতবার তওয়াফ করেন। [আল-তিরমিযী রচিত ‘আল-জা’মে’ আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘আল-মারওয়ার আগে আল-সাফা’য় আরম্ভ করা প্রসঙ্গে বর্ণনাসমূহ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২১৬ #৮৬২; আল-তিরমিযী কৃত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ’: আবওয়াব আল-তাফা’সীর, ‘সূরা আল-বাক্বারা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫: ২১০ #২৯৬৭; আল-নাসাঈ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতাব মানা’সিক আল-হাজ্জ্ব, ‘তাওয়াফ-পরবর্তী দুই রাক’আত নামাযশেষে বক্তব্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২৩৫ #২৯৬১; ইবনে খুযায়মা লিখিত ’আল-সহীহ’, ৪:১৭০ #২৬২০; এবং আল-তাবারানী রচিত ‘’আল-মু’জাম আল-সগীর’, ১:১২৬ #১৮৭]

এসব রওয়ায়াত হতে সহজে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে তাওয়াফ (সাতবার প্রদক্ষিণসহ) পালন করাটা পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দেরই পদাঙ্ক অনুসরণ; এর পালনের মাধ্যমে আমরা পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের পুনঃপুনঃ স্মৃতিচারণ করে থাকি।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন