রামল: মহানবী (ﷺ) ও সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর দ্বারা অনুশীলিত তওয়াফ-পদ্ধতির স্মরণে

রামল: মহানবী (ﷺ) ও সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর দ্বারা অনুশীলিত তওয়াফ-পদ্ধতির স্মরণে

তাওয়াফ পালন হজ্জ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের একটি। পুরুষ হাজ্বীদের আদেশ করা হয়েছে যেন তাঁরা তাওয়াফ তথা প্রদক্ষিণের প্রথম তিনবার কিছুটা গর্বের সাথেই তা সম্পন্ন করেন। এর ইসলামী পারিভাষিক শব্দ হচ্ছে ‘রামল’। তবে সার্বিকভাবে বলা যায়, গর্বভরে হাঁটা ঔদ্ধত্যেরই একটি চিহ্ন এবং এটা আল্লাহতা’লা পছন্দ করেন না; তবে হজ্জ্বের সময় এর বিপরীত-ই ঘটে থাকে। [নোট: হা’রিসা বিনতে ওয়াহহাব অাল-খুযাঈ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আমি কি তোমাদেরকে বেহেশতী মানুষদের সম্পর্কে জানাবো না? তারা হলো যারা দুর্বল এবং দুর্বল বলে মনে করা হয়। কিন্তু যদি তারা আল্লাহর নামে কসম/শপথ করে, আল্লাহতা’লা তা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করে দেন। আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামী লোকদের সম্পর্কে বলবো না? তারা হলো যারা অমার্জিত, উদ্ধত ও অহঙ্কারী।” এ হাদীস বর্ণনা করেন অাল-বুখারী তাঁর ‘সহীহ’: কিতা’ব আল-তাফসীর, সূরা নূন ওয়াল্ ক্বালাম’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৮৭০ #৪৬৩৪ গ্রন্থে; আল্-বুখারী প্রণীত ‘আল-সহীহ’: কিতা‘ব আল-আদাব, ’ঔদ্ধত্য’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২২৫৫ #৫৭২৩; এবং মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতা’ব আল-জান্নাহ ওয়া সিফা নাঈমিহা’ ওয়া আহলিহা’, ‘দাম্ভিক জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং দুর্বল জান্নাতে প্রবেশ করবে’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২১৯০ #২৮৫৩। হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান, “আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন: শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে আমারই ভূষণ এবং অহঙ্কার আমারই পরিধেয়। যে কেউ এগুলোর কোনোটি আমার কাছ থেকে অপসারণ করতে চাইবে, আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো।” এ হাদীস বর্ণনা করেন ইবনে আবী শায়বা নিজ ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:৩২৯ #২৬,৫৭৯ গ্রন্থে; আল-তাবারানী এটা হযরত আলী (ক:) হতে উদ্ধৃত করেন নিজ ‘আল-মু’জাম আল-আওসাত’, ৩:৩৫২ #৩৩৮০ পুস্তকে; আল-ক্বাদা’ঈ কৃত ‘মুসনাদ আল-শিহা’ব’, ২:৩৩১ #১৪৬৪; আল-বায়হাক্বী লিখিত ‘শু’আব আল-ঈমা’ন’, ৬:৩৮০ #৮১৫৭]

এতে নিহিত (ঐশী) জ্ঞান-প্রজ্ঞা এই যে, মদীনায় হিজরতের পরে মুসলমানবৃন্দ অবিরত অনেক সংগ্রামের ফলে দুর্বল ও ক্ষীণকায় হয়ে পড়েন। হুদায়বিয়ার সন্ধি স্থাপিত হওয়ার এক বছর পর তাঁরা মক্কা মোয়াযযমায় উমরাহ হজ্জ্ব পালন করতে ফেরত গেলে তাঁদের শরীরে এই দুর্বলতা দৃশ্যমান হয়। মক্কার কুফফার (অবিশ্বাসী গোষ্ঠী) দেখতে পায় যে মুসলমানবৃন্দ তাওয়াফ পালনে ধীরগতিসম্পন্ন; আর তাই তারা মুসলমানদেরকে এ মর্মে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে যে তাঁরা মক্কা ছেড়ে যাওয়ায় এতোই ক্ষীণকায় হয়েছেন, যার দরুন তাঁরা এমন কি ঠিকভাবে হাঁটতেও পারছেন না। এমতাবস্থায় মহানবী (ﷺ) সম্মানিত সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে সাড়ম্বরে হাঁটতে নির্দেশ দেন, যাতে অবিশ্বাসীদের মস্তিষ্ক থেকে এই ধারণা দূর হয়ে যায়। মক্কা বিজয়ের পরে যদিও কোনো অমুসলিম আর সেখানে অবশিষ্ট ছিল না, তবুও তাওয়াফের এ রীতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই একই রকমভাবে পালিত হয়ে আসছে।

ইমাম মুসলিম তাঁর ‘সহীহ’ গ্রন্থের ‘কিতাবুল হজ্জ্ব’ বইয়ের ‘এসতেহবা’ব আল-রামল ফী আল-তাওয়া’ফ ওয়া আল-উমরা ওয়া ফী আল-তাওয়া’ফ আল-আওয়াল মিন আল-হাজ্জ্ব’ (উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা) শীর্ষক অধ্যায়ে এ বিষয়ে অনেক রওয়ায়াতের উল্লেখ করেন, যা নিম্নে লিপিবদ্ধ হলো:

১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন যে প্রিয়নবী (ﷺ) ও তাঁর মহান সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) মদীনা মোনাওয়ারায় এক মহামারী দেখা দিলে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁরা (হুদায়বিয়ার সন্ধির এক বছর পর উমরা’র উদ্দেশ্যে) মক্কা মোয়াযযমায় উপস্থিত হওয়ার সময় (সেখানকার) মুশরিক নেতৃবর্গ তাদের অনুসারীদের বলে, ‘তোমাদের কাছে এমন এক জাতি আগমন করবে যারা রোগে দুর্বল হয়ে গিয়েছে।’ এতদশ্রবণে মক্কাবাসী মানুষ কালো পাথরের কাছে গিয়ে বসেন। অতঃপর মুসলমানবৃন্দ সেখানে পৌঁছুলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদেরকে প্রথম তিন তওয়াফ সাড়ম্বরে পালন করতে নির্দেশ দেন এবং দুই কোণার (অর্থাৎ, ইয়েমেনী কোণা ও কালো পাথরের কোণা) মধ্যবর্তী স্থানে হাঁটতে বলেন, যাতে মুশরিকবর্গ তাঁদেরকে শক্ত-সামর্থ্য দেখতে পায়। (এ দৃশ্য দর্শনে) মুশরিকবর্গ বিস্ময়ভরে বলে, ‘তোমরা কি আমাদের এ কথা বিশ্বাস করতে বলো যে এই মানুষগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে দুর্বল হয়ে গিয়েছে? সত্যি তারা ভীষণ বলবান এবং তোমরা যা দাবি করছো তা হতে (সম্পূর্ণ) মুক্ত!’ [ইমাম মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯২৩ #১২৬৬; ইমাম বুখারী প্রণীত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘রামল যেভাবে সূচিত হয়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৮১ #১৫২৫; ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯৪; এবং ইমাম বায়হাক্বী লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৬]

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) আরেকটি রওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কা’বা ঘরের চারদিক দ্রুত হেঁটে প্রদক্ষিণ (তাওয়াফ) করেন এবং আল-সাফা ও আল-মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে (জোরে) সাঈ করেন, যাতে তিনি তাঁর দৈহিক শক্তি মুশরিকদের দেখাতে সক্ষম হন। [আল-বুখারী কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ সম্পর্কে যা যা বর্ণিত’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৫৯৪ #১৫৬২; মুসলিম প্রণীত ‘সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘উমরা‘র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তাওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ অধ্যায়, ২:৯২৩ #১২৬৬; আল-তিরমিযী রচিত ‘আল-জামেউস্ সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘সাফা ও মারওয়া’র মধ্যবর্তী স্থানে সাঈ সম্পর্কে যা যা বর্ণিত’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:২১৭ #৮৬৩; আল-নাসাঈ লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪০৫ #৩৯৪১; আল-হুমায়দী কৃত ‘আল-মুসনাদ, ১:২৩২ #৪৯৭; এবং আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘অাল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৭-৫৮]

৩. আবূ তোফায়ল আমির বিন ওয়া’সিলা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন যে মহানবী (ﷺ) মক্কা মোয়াযযমায় প্রবেশ করলে অবিশ্বাসীরা বলে, ‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাথীবৃন্দ ক্ষীণকায় হওয়ার দরুন কা’বা ঘরের তাওয়াফ করতে অক্ষম’। মুশরিকবর্গ তাঁর প্রতি হিংসাবোধ করতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে তওয়াফের প্রথম তিনবার রামল এবং পরবর্তী চারবার হাঁটতে নির্দেশ দেন। [মুসলিম রচিত ‘সহীহ’: কিতাবুল হাজ্জ্ব, ‘উমরা’র তাওয়াফ ও হজ্জ্বের প্রথম তওয়াফে রামলের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯২১-৯২২ #১২৬৪; ইবনে হিব্বান লিখিত ‘সহীহ’, ৯:১৫৪ #৩৮৪৫; এবং আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:৮২ #৯০৫৭-৯০৫৮]।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন