এহরাম: হজ্জ্বে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের পরিধেয় বস্ত্রের স্মরণে

এহরাম: হজ্জ্বে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের পরিধেয় বস্ত্রের স্মরণে

হজ্জ্ব ও উমরাহ পালনের ক্ষেত্রে ‘এহরাম’ (বস্ত্র) বাঁধা হলো একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। কা’বা ঘর যে ব্যক্তি তাওয়াফ করবেন, তাঁর জন্যে এটা পরিধান করা অত্যাবশ্যক। আল্লাহ পাকের আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ হজ্জ্বের সময় যে বস্ত্র পরতেন, এই দুইখানি কাপড় ওই একই পরিচ্ছদ। আল্লাহতা’লা (তাঁদের) এই বসন এতোই পছন্দ করেছেন যে তিনি হাজ্বী সাহেবদের জন্যে নিজেদের গতানুগতিক জামাকাপড় ছেড়ে ওই দুই ফালি কাপড় পরাকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। এই একই দু টুকরো কাপড় গায়ে দিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে থেকে আগত হাজ্বী সাহেবান সত্তরজন পয়গম্বর (عليه السلام)-এর নিজ নিজ নবুওয়্যতকালে এহরাম হিসেবে পরিধানকৃত বস্ত্রের ওই প্রথাটি-ই চর্চা করে থাকেন। নিচে বর্ণিত হাদীসগুলো এই বিষয়টিকে খোলাসা করেছে:

১. হযরত আবূ মূসা আশআরী (رضي الله عنه) মহানবী (ﷺ)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, “সত্তরজন পয়গম্বর (عليه السلام) আল-রাওহা (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী উপত্যকা)-এর পাথরগুলো পার হন; এঁদের মধ্যে ছিলেন পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) যিনি একটি বস্ত্রাবৃত অবস্থায় ও খালি পায়ে আল্লাহতা’লার প্রাচীন ঘরে পৌঁছেন।” [ইমাম আবূ ইয়া’লা কর্তৃক নিজ ‘আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণিত, ১৩:২০১ ও ২৫৫ #৭২৩১ ও #৭২৭১; হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) হতেও ইমাম আবূ ইয়া’লা প্রণীত ’আল-মুসনাদ’ গ্রন্থে, ৭:২৬২ #৪২৭৫; ইমাম দায়লামী রচিত ‘আল-ফেরদৌস বি-মা’সূর আল-খিতা’ব, ৩:৪৩৩ #৫৩২৮; আবূ নুয়াইম লিখিত ‘হিলইয়া’ আল-আউলিয়া’ ওয়া তাবাক্বা’ত অাল-আসফিয়া’, ১:২৬০; ইমাম আল-মুনযিরী নিজের কৃত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শারীফ’, ২:১১৮ #১৭৩৯ গ্রন্থে বলেন যে এই হাদীসের এসনাদ সম্পর্কে কোনো আপত্তি-ই উত্থাপিত হয়নি; ইমাম ইবনে আসাকির-ও এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেন নিজ ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’ ২১:১৬৬ পুস্তকে; আর ইমাম আল-হায়সামী এটা বর্ণনা করেন আপন ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’আ আল-ফাওয়াঈদ’, ৩:২২০ কিতাবে]    

২. পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)-এর ‘এহরাম’ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান, “আমি যেন দেখলাম (পয়গম্বর) মূসা বিন ‘এমরা’ন (عليه السلام) এই উপত্যকায় দুটি ‘ক্বাতওয়া’নী’ (সাদা) বস্ত্র পরেছিলেন।” [ইমাম আবূ ইয়া’লা প্রণীত ‘আল-মুসনা’দ’, ৯:২৭ #৫০৯৩; আল-তাবারানী কৃত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ১০:১৪২ #১০,২৫৫; আল-তাবারানী রচিত ‘আল-মু’জাম আল-আওসাত’, ৬:৩০৮ #৬৪৮৭; আবূ নু’য়াইম লিখিত ‘হিলইয়া আল-আউলিয়া ওয়া তাবাক্বা’ত আল-আসফিয়া’, ৪:১৮৯; আল-মুনযিরী তাঁর প্রণীত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১১৮ #১৭৪০ গ্রন্থে বলেন যে আবূ ইয়া’লা ও আল-তাবারানী এই হাদীসটি ’হাসান’ সনদে বর্ণনা করেছেন; আল-হায়সামীও তাঁর কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়াঈদ ওয়া মানবা’আ আল-ফাওয়াঈদ’, ৩:২২১ পুস্তকে বিবৃত করেন যে আবূ ইয়া’লা ও আল-তাবারানী ’হাসান’ সনদে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন]

৩. ইমাম আযরাক্বী (জন্ম: ২২৩ হিজরী) সর্বপ্রথম মক্কা মোয়াযযমার একখানি ইতিহাসগ্রন্থ সংকলন করেন, যা ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি নিজস্ব এসনাদ-সহ বর্ণনা করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এর কথা, যিনি বলেন: “সত্তরজন পয়গম্বর (عليه السلام) হাজ্বী হয়ে আল-রাওহা’র গিরিপথ পেরিয়েছিলেন; তাঁরা পরেছিলেন ‘সূফ’ (পশমী বস্ত্র)।” [ইমাম আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৭১-৭২]

৪. হজ্জ্বের অনুষ্ঠানে পয়গম্বর মূসা (عليه السلام)-এর পরিচ্ছদ সম্পর্কে সর্ব-হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه)-এর শিষ্য ইমাম মুজাহিদ ইবনে জুবাইর (رحمة الله) বলেন: “পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) একটি লাল উটের ওপর চড়ে হজ্জ্ব পালন করেন। তিনি আল-রাওহা (এলাকা) অতিক্রম করেন দুটি ’ক্বাতাওয়া’নী’ (সাদা) বস্ত্র গায়ে; এর একটি শরীরের নিম্নভাগ আচ্ছাদনকারী বস্ত্র ছিল, আর অপরটি তাঁর দেহ মোবারককে আবৃত করেছিল। তিনি (এ সময়) কা’বা শরীফকে তওয়াফ (অর্থাৎ, চারদিক প্রদক্ষিণ) করেন।” [প্রাগুক্ত ইমাম আযরাক্বী কৃত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা মিন আল-আসা’র’, ১:৬৭]

৫. আরেকটি রওয়ায়াত তথা বর্ণনায় সর্ব-পয়গম্বর হূদ (عليه السلام) ও সা’লেহ (عليه السلام)-এর এহরা’ম সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে কোনো এক হজ্জ্ব (মওসূমে) মহানবী (ﷺ) ‘আসফান উপত্যকা অতিক্রম করার সময় জিজ্ঞেস করেন, ‘ওহে আবূ বকর, এটা কোন্ উপত্যকা?’ হযরত আবূ বকর (رضي الله عنه) উত্তর দেন, ‘এটা ’আসফা’ন উপত্যকা।’ এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এরশাদ ফরমান: “হূদ (عليه السلام) ও সালেহ (عليه السلام) এই উপত্যকা অতিক্রম করেছিলেন কম বয়সী লাল উটের পিঠে চড়ে, যেগুলোর গলার দড়ি ছিল তাল গাছের আঁশ দিয়ে তৈরি। তাঁদের (পয়গম্বরবৃন্দের) কোমরের (নিচের) কাপড় ছিল একটি আলখাল্লা, আর বহিরাবরণের বস্ত্র ছিল একখানি কালো ও সাদা ডোরাকাটা ঢিলে জামা। আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দ পবিত্র কা’বা গৃহে হজ্জ্ব পালনকালে তালবিয়া (অর্থাৎ, আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার বাক্যটি) পাঠ করছিলেন। [ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৩২; আল-বায়হাক্বী নিজ ‘শুয়া’ব আল-ঈমান’, ৩:৪৪০ #৪০০৩ গ্রন্থে পয়গম্বর মূসা (عليه السلام) সম্পর্কেও অনুরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন; এবং আল-মুনযিরী প্রণীত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিন আল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১১৭ #১৭৩৭]

এসব হাদীস থেকে পরিদৃষ্ট হয় যে হজ্জ্ব পালনকালে পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলী সাধারণ বস্ত্র পরিধান করতেন, আর তাঁরা তা পালন করতেন শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের খাতিরেই। তাঁদের জামা ছিল দু টুকরো কাপড়ের সমষ্টি। এগুলোর একটি তাঁদের পবিত্র শরীরের নিম্নভাগকে আবৃত করতো, অপরটি তাঁদের দেহ মোবারককে আবৃত করতো।

আল্লাহতা’লার কাছে এই (দুই টুকরো) বস্ত্রটি এতোই পছন্দনীয় হয়েছিল যে তিনি (এ উম্মতের) হাজ্বীদের পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে এটাকে বাধ্যতামূলক করে দেন। ফলে হজ্জ্ব পালনকালে কারো প্রথা বা রীতিগত বস্ত্র পরিধান একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মাথার চুল কামানো অবস্থায় নামায আদায় করাটা ভ্রান্তি ও সুন্নাহ’র পরিপন্থী হিসেবে পরিগণিত হয়, কিন্তু হজ্জ্বের বেলায় তা হয় না। ‘এহরা’ম’ অবস্থায় প্রত্যেক হাজ্বী সাহেব-ই আল্লাহর পবিত্র ঘর কা’বা শরীফের সামনে খালি মাথায় উপস্থিত হন। এরকম খালি মাথায় থাকাটা বিনীত ও সমর্পিত হওয়ার চিহ্ন বহন করে, আর আল্লাহতা’লার কাছেও এটা সবচেয়ে প্রশংসিত।

এর পাশাপাশি নখ ও চুল কাটা এবং মোচ ছাঁটাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে [আল-কা’সানী কৃত ‘বাদা’ঈ আল-সানা’ঈ ফী তারতীব আল-শারা’ঈ, ২:১৯৮], যাতে বাহ্যিকভাবে সকল ক্ষেত্রেই মহান আল্লাহতা’লার পবিত্র পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের প্রবর্তিত রীতিনীতি অনুযায়ী হজ্জ্ব পালন করা যায়।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন