তালবিয়া: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) কর্তৃক হজ্জ্বের প্রতি আহ্বান ও তার উত্তরের স্মরণে

তালবিয়া: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) কর্তৃক হজ্জ্বের প্রতি আহ্বান ও তার উত্তরের স্মরণে

হ্জ্জ্ব হোক বা উমরাহ, প্রত্যেক হাজ্বী সাহেব ‘এহরা’ম’ বেঁধে একান্ত নিষ্ঠা ও বিনয় সহকারে আল্লাহতা’লার কাছে নিম্নের বাক্যটি উচ্চারণ করে প্রার্থনা করেন: ”আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির! আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা, আশীর্বাদ ও সার্বভৌমত্ব আপনারই মালিকানাধীন। আপনার কোনো অংশীদার নেই।” [আল-বুখারী কর্তৃক নিজ সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত: কিতাবুল হজ্জ্ব (হজ্জ্বের বই), ‘তালবিয্যা’ অধ্যায়, ২:৫৬১ #১৪৭৪; আল-বুখারী কৃত সহীহ গ্রন্থ:কিতাবুল লিবাস্ (পরিচ্ছদবিষয়ক বই), ‘চুল কলপ/মেহেন্দি’ অধ্যায়, ৫:২২১৩ #৫৫৭১; সহীহ মুসলিম: কিতাবুল হজ্জ্ব, ‘তালবিয়্যা ও এর বিবরণ’ অধ্যায়, ২:৮৪১-৮৪২ #১১৮৪; আল-তিরমিযী প্রণীত ‘আল-জামিউস্ সহীহ’: কিতাবুল হজ্জ্ব’, ’তালবিয়্যা-সংক্রান্ত বর্ণনাসমূহ’ অধ্যায়, ৩:১৮৭-১৮৮ #৮২৫-৮২৬; আবূ দাউদ রচিত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানাসিক (হজ্জ্বের রীতিনীতি), ‘তালবিয়্যা পালনের পদ্ধতি’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৬২ #১৮১২; আল-নাসাঈ লিখিত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক আল-হজ্জ্ব, ’তালবিয়্যা পালনের পদ্ধতি’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:১৫৯-১৬০ #২৭৪৭-২৭৫০; এবং ইবনে মাজাহ কৃত ‘আল-সুনান’: কিতাবুল মানা’সিক, ’তালবিয়্যা’ অধ্যায়, ২:৯৭৪ #২৯১৮]

হজ্জ্ব ও উমরাহ’র সময় এই তালবিয়্যা পবিত্র (কা’বা) মসজিদে পাঠ করা হলেও খুব কম সংখ্যক মানুষ-ই এর উৎপত্তি সম্পর্কে জানেন। এটা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আদেশ পালনার্থে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর কা’বা ঘর নির্মাণ সুসম্পন্ন করার পর তাঁর আহ্বানের প্রতি প্রায় চার হাজার বছর যাবত সাড়া প্রদানেরই একটি রীতি। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বিবৃত হয়েছে:

“এবং (হে ইবরাহীম) মানুষের মধ্যে হজ্জ্বের সাধারণ ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে উপস্থিত হবে পদব্রজে ও প্রত্যেক ক্ষীণকায় উটনীর পিঠে করে, যা দূর-দূরান্তের পথ থেকে আসে।” [আল-ক্বুরআন, ২২:২৭; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস তথা বাণীসমূহে বিবৃত হয় যে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) আবূ ক্বুবায়স্ পর্বতশিখরে আরোহণ করেন এবং গোটা মনুষ্যকুলের প্রতি এই মর্মে আহ্বান জানান যে হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে খোদার ঘরে তাদের হাজির হওয়া উচিত। [ইবনে আবী হা’তিম কর্তৃক নিজ ‘তাফসীর আল-কুরআন আল-’আযীম’ ৮:২৪৮৭-২৪৮৮ গ্রন্থে বর্ণিত; ইবনে জাওযী কৃত ‘যা’দ আল-মাসীর ফী ‘ইলম আল-তাফসীর’, ৫:৪২৩; ইমাম সুয়ূতী প্রণীত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ৬:৩২; এবং ইবনে ‘আজীবা রচিত ‘আল-বাহর আল-মাদীদ ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন আল-মাজীদ’, ৪:৪১০]

স্থান-কালের উর্ধ্বে উঠে এই আহ্বানকে (পৃথিবীতে) মনুষ্য বসতির সর্বত্র পৌঁছে দেয়া হয়। বস্তুতঃ জন্মগ্রহণ করেননি আধ্যাত্মিক জগতের এমন সমস্ত আত্মা-ও এই আহ্বান শুনতে ও দেখতে পান; যিনি-ই এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন ‘আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ (অর্থাৎ, আমি হাজির), তাঁকেই হজ্জ্ব করার সামর্থ্য মঞ্জুর করা হয় এবং মহান আল্লাহতা’লার ঘরে হাজির হওয়ার অনুমতিও দেয়া হয়, যা নিম্নবর্ণিত হাদীসগুলোতে প্রমাণিত হয়:

১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন হুযূরে পাক (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) যখন কা’বা ঘর নির্মাণ করেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর প্রতি এ মর্মে ঐশী প্রত্যাদেশ দেন যেন তিনি মানবজাতিকে হজ্জ্বের দিকে আহ্বান জানান। পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের প্রভু (তাঁর) একখানি ঘর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন তোমরা তাতে হজ্জ্ব সম্পন্ন করো।’ এমন কোনো পাথর, গাছ, পাহাড় বা মাটি ছিল না যেটা এই আহ্বান শুনে না বলেছিল, ’আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির!’ [আল-হাকীম কর্তৃক নিজ ‘আল-মোস্তাদরাক ‘আলা আল-সহীহাইন’, ২:৬০১ #৪০২৬ গ্রন্থে বর্ণিত; আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৭৬ #৯৬১৩; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘’শু’আব আল-ঈমান, ৩:৪৩৯ #৩৯৯৮; আল-তাবারী রচিত ‘তা’রিখ আল-উমাম ওয়া আল-মুলূক’, ১:১৫৬; মুজাহিদ লিখিত ‘আল-তাফসীর’, ২:৪২২; আল-জাসসা’স কৃত ‘আহকা’ম আল-ক্বুরআন, ৫:৬৩; আল-তাবারী প্রণীত ‘জামে’ আল-বায়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ১৭:১৪৪; এবং ইমাম সুয়ূতী রচিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর, ৬:৩২]

২. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) যখন কা’বা ঘরের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন, তখন তাঁকে বলা হয়, ‘মানুষকে হজ্জ্বের দিকে আহ্বান করুন।’ তিনি আরয করেন, ‘হে আমার প্রভু, আমার কণ্ঠস্বর (অতোদূর) পৌঁছুবে না।’ সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা বলেন, ‘উচ্চস্বরে আহ্বান করুন, আমি সমগ্র সৃষ্টিকে তা শোনাবো।’ অতঃপর পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) বলেন, ‘ওহে মানবকুল! মহান আল্লাহ পাক তোমাদের জন্যে হজ্জ্বের বিধান জারি করেছেন।’ বর্ণনাকারী (সাহাবী) আরো যোগ করেন, ‘এই ঘোষণা আসমান ও জমিনে অবস্থিত সকল সৃষ্টি-ই শুনতে পান। তোমরা কি দেখতে পাও না পৃথিবীর দূর-দূরান্ত হতে মানুষ (এ আহ্বানে সাড়া দিতে) কীভাবে তালবিয়্যা পাঠ করতে করতে এসে হাজির হন?’ [ইবনে আবী শায়বা কর্তৃক নিজ ‘আল-মোসান্নাফ’, ৬:৩২৯ #৩১৮১৮ গ্রন্থে বর্ণিত; আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মোস্তাদরাক ‘আলা আল-সহীহাইন, ২:৪২১ #৩৪৬৪; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৭৬ #৯৬১৪; আল-মাক্বদাসী রচিত ‘আল-আহা’দীস আল-মুখতা’রা, ১০:২০-২১; আল-তাবারী তাঁর ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৪ গ্রন্থে সাঈদ বিন জুবায়র হতেও এই বর্ণনাটি লিপিবদ্ধ করেন; আল-সুযূতী লিখিত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর’, ৬:৩২; ইমাম সুযূতী একই গ্রন্থের (দুররুল মানসূর) ৬:২৩৩-এ এই রওয়ায়াত সাঈদ বিন জুবায়র হতেও বর্ণনা করেন; আল-শওকানী কৃত ‘ফাতহুল ক্বাদীর’, ৩:৪৫০; এবং আ’লূসী প্রণীত ‘রূহু আল-মা’আ’নী ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম ওয়া আল-সাব’ আল-মাসা’নী’, ১৭:১৪৩]  

৩. “এবং (হে ইবরাহীম) মানুষের মধ্যে হজ্জ্বের সাধারণ ঘোষণা করে দাও” – ক্বুরআন মজীদের এই আয়াতটি প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম খলীলউল্লাহ (عليه السلام) একটি পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘ওহে মানবকুল! হজ্জ্ব তোমাদের প্রতি ফরয করা হয়েছে।’ সকল পুরুষের ঔরসে ও নারীর গর্ভে যারা ছিলেন, তাঁদের সবাইকেই এই আহ্বান শোনানো হয়; আর অনাদিকাল হতে আল্লাহর জ্ঞাত সব মো’মেন বান্দা যাঁদের ভাগ্যে শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত হজ্জ্ব নসীব করা হয়েছিল, তাঁরা এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বলেন, ‘আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির।’ [আল-তাবারী কর্তৃক নিজ ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৪; আল-সুয়ূতী কৃত ‘আল-দুর্র আল-মানসূর ফী আল-তাফসীর বি আল-মা’সূর, ৬:৩৩; আল-তাবারী প্রণীত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়া আল-মুলূক’, ১:১৫৭; এবং আল-’আসক্বালা’নী রচিত ‘ফাতহ্ আল-বা’রী’, ৬:৪০৬]

৪. হযরত আবূ হুরায়রা (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী; তিনি বলেন, পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) যখন কা’বা ঘরের নির্মাণ কাজ সুসম্পন্ন করেন, তখন আল্লাহতা’লা তাঁকে হজ্জ্বের আহ্বান জানাতে নির্দেশ দেন। এমতাবস্থায় তিনি একটি উঁচু স্থানে উঠে উচ্চস্বরে বলেন, ‘ওহে মানবকুল! তোমাদের প্রভু তোমাদেরই জন্যে একটি ঘর নির্ধারণ করেছেন; অতএব, তোমরা হজ্জ্ব পালন করো এবং আল্লাহর (আহ্বানের) প্রতি সাড়া দাও।’ সকল পুরুষের ঔরসে এবং নারীর গর্ভে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা উত্তর দেন, ‘আমরা উত্তর দিচ্ছি! আমরা উত্তর দিচ্ছি! আমি হাজির, হে প্রভু, আমি হাজির!’ হাদীসটির বর্ণনাকারী (সাহাবী) আরো যোগ করেন, যে কেউ আজকাল হজ্জ্ব পালন করলে তিনি সে সকল (নেককার) বান্দার অন্তর্গত, যিনি পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর আহ্বানে যতোবার তালবিয়্যা পাঠের ভিত্তিতে সাড়া দিয়েছিলেন। [আল-ফা’কাহী প্রণীত ‘আখবা’র মক্কা ফী ক্বাদীম আল-দাহর ওয়া হাদীসিহী’, ১:৪৪৬ #৯৭৩; এ হাদীস সংক্ষেপে মুজা’হিদ বিন জুবায়র হতে নিম্নোক্ত বইগুলোতে উদ্ধৃত হয়েছে: ইবনে আবী শায়বা রচিত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৬:৩৩০ #৩১,৮২৬; আল-তাবারী লিখিত ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআন’, ১৭:১৪৫; ইবনে আবদ আল-বার্র প্রণীত ‘আল-তামহীদ লিমা’ ফী আল-মুওয়াত্তা মিন আল-মা’আনী ওয়া আল-আসা’নীদ’, ১৫:১৩১; এবং আল-যায়লাঈ কৃত ‘নাসব আল-রা’এয়া লি আহা’দীস আল-হেদা’এয়া’, ৩:২৩]

’লাব্বায়েক’-এর এক মুহূর্তের এ আহ্বান সহস্র সহস্র বছর আগে জানানো হলেও এই ঐশী সুরের অনুরণন চারদিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। হাজ্বী সাহেবান এটা আবৃত্তি করার মাধ্যমে পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সাথে সম্পর্কিত এ ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে অতীতের ঘটনার স্মৃতিচারণ করা দ্বীন ইসলামের শিক্ষার সাথে একদম সঙ্গতিপূর্ণ। অনুরূপভাবে, মওলিদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর উদযাপনের মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ)-এর বেলাদত তথা ধরাধামে শুভাগমনের স্মৃতিচারণ করি এবং তাঁর এ আবির্ভাবের প্রতি খুশি প্রকাশ করি। হুযূরে পূর নূর (ﷺ)-কে সমাবেশে, তাঁর প্রশংসায় নাত/শে’র/কসীদা/পদ্য আবৃত্তির মাধ্যমে এবং অন্যান্য প্রশংসনীয় আমল দ্বারা স্মরণ করা হয়।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন