বর্তমান প্রেক্ষাপটে জানাজায় উচ্চস্বরে যিকির করা জায়েয ও মোস্তাহাব
পুরাকালীন নিয়মের ভিত্তিতে যেসব ফকীহ উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ বলেছেন তার জবাবে উল্লেখ করেছেন যে, পুরাকালে জানাজা দেখলেই লোকেরা মৃত্যুকে স্মরণ করতেন। ভয়ে তাঁদের অন্তর কেঁপে উঠত। এমনকি ভয়ে কথা বলার সাহসও তাঁরা হারিয়ে ফেলতেন। সুতরাং তাঁরা তখন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নীরবে পথ চলতেন।
যেমন হযরত বারা বিন্ আযেব (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত-
قَالَ خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي جَنَازَةِ رَجُلٍ مِنْ الْأَنْصَارِ فَانْتَهَيْنَا إِلَى الْقَبْرِ وَلَمْ يُلْحَدْ بَعْدُ فَجَلَسَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُسْتَقْبِلَ الْقِبْلَةِ وَجَلَسْنَا مَعَهُ كَانَ عَلَى رَؤسنَا الطيْر . (رواه ابن ماجه)
অর্থাৎ- (হযরত বারা ইবনে আযেব (رضي الله عنه) বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এর সঙ্গে একজন ‘আনছারী’ এর জানাজায় উপস্থিত হয়েছিলাম। আমরা কবরের পাশে গিয়ে দেখলাম, কবর তখনও তৈরী হয়নি। তখন হুজুর (ﷺ) কেব্লামুখী হয়ে বসলেন। আমরাও হজুুর (ﷺ) এর সাথে এমনভাবে বসে পড়ি, যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসেছিল। অর্থাৎ আমরা পাখি শিকারীদের ন্যায় নিশ্চুপ ও অনড়ভাবে বসেছিলাম। (মিরআত)
এখন একথা হৃদয়াঙ্গম করা দরকার যে, পূর্ব যুগ ও বর্তমান কালের অবস্থা পরস্পর পৃথক ধরণের। এ যুগীয় লোকের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি পূর্ব যুগের তুলনায় অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে হাশর-নশর, মৃত্যু ও কবরের আজাব ইত্যাদির ভয়ভীতি তাদের অন্তরে নেই বললেও চলে। এমনকি প্রত্যক্ষ পরিদর্শনে দেখা যায় যে, জানাজার সাথে চলার সময় লোকেরা বাজে আলাপ-আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা এবং পার্থিব আলাপ আলোচনায় লিপ্ত হয়ে যায়; তারা অনর্থক কথা-বার্তায় সময় নষ্ট করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
এই জন্যই আবু দাউদ শরীফে উল্লেখিত হাদিসে এরশাদ করা হয়-
لَا تتْبَعُ الْجنَازَة بِصَوْتٍ .
অর্থাৎ- ‘জানাজার সাথে চলার সময় শোরগোল করা নিষিদ্ধ’।
ইমাম নববী (رحمة الله) ‘কিতাবুল আজকার’-১৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন-
فان هذا وقت فكرو ذكر يقبح الغفلة واللهو والاشتغال بالحديث الفارغ فان الكلام بما لا فائدة فيه حنهنى عنه فى جميع الاحوال فكيف فى هذا الحال.
অর্থাৎ- নিশ্চয়ই এটা অনুশোচনা ও ‘যিকির’ এর সময়। এ মুহূর্তে অন্য মনষ্ক হয়ে খেলাধুলা ও বাজে কাজ কর্মে লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয়। কাজেই বিশেষত যে সব অনর্থক কথাবার্তা অন্য যে সময়েই নিষিদ্ধ; তা এ মুহূর্তে কিভাবে জায়েজ বা বৈধ হতে পারে? এ জন্যই আহলে সুন্নাত ওয়াল জমাতের ইমামগণ এ মুহূর্তে (জানাজার সাথে চলার সময়) বাজে কথাবার্তা থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে উচ্চরবে ‘যিকির’ করা জায়েজ ও মোস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন- হযরত হাকীমুল উম্মত মুফ্তি আহমদ এয়ার খাঁন নঈমী (رحمة الله) ‘মিরআত শরহে মিশকাত’-২য় খণ্ডের ৪৭৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, এ যুগে ‘সরব-যিকিরই’ উত্তম হবে। নতুবা লোকেরা তখন দুনিয়াবী কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা, অন্যের কুৎসা রটনা ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাবে।
উসুল-ই-ফিকহ্বিদ ইমামগণ বলেছেন-
ان الحكم الشرعى المبنى على علّة يدور مع علّته وجودا وعدما .
অর্থাৎ- শর্তসাপেক্ষ শরীয়ত-বিধি তার পূর্বশর্তের অবস্থিতি ও উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ পূর্বশর্তের উপস্থিতি ঘটলেই তা পালনীয়; নতুবা নয়।
মাওলানা ‘আলীয়া’ ছাহেব বলেছেন-
ان الحكم الشرعى مبنى على علته فبانتهائها ينتهى .
অর্থাৎ- শরীয়তের কোন হুকুম যদি কোন ‘কারণ’ সাপেক্ষ হয়, তবে যখন সে ‘কারণ’ এর অনুপস্থিতি কিংবা অবসান ঘটে তখন উক্ত হুকুম পালনের সময় বা মেয়াদ শেষ হয়ে যায়; অর্থাৎ তখন তা আর পালনীয় থাকেনা।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, বর্তমান যুগে জানাজার সাথে চলার সময় উচ্চরবে যিকির করাই উত্তম। কাজেই এ পূণ্যময় কার্য থেকে বাধা দেয়া মোটেই উচিত হবে না। এসব প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও যদি কোন আলেম এ ধরণের যিকির নিষিদ্ধ, হারাম কিংবা মাকরূহ বলে ফতোয়া দেয়; তবে তাকে শান্তিকামী বা জনসাধারণের ভুলত্রুটি সংশোধনকারী বলা যাবে না, অথচ আলেমগণই হলেন উম্মতের দিশারী। তাদের ভুলত্রুটি সংশোধনকারী এবং তাদের আমানতদার। যেমন: হাদিস শরীফে হুজুর (ﷺ) এরশাদ করেছেন- العلماء امنعاء امتِى আলেম সম্প্রদায় আমার উম্মতদের মধ্যে শান্তি স্থাপনকারী।
স্মর্তব্য যে, ফকীহগণের মধ্যেও এ মাছয়ালাটি বিতর্কিত- কেউ কেউ তা ‘মাকরূহ তাহরীমী’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। আবার কোন কোন ফকীহ বলেছেন তা মাকরূহ তান্জীহি।
ফতোয়া শামীতে উল্লেখ করা হয়- قيل تحريما تنزيها كما فى البحر
অর্থাৎ- তা কোন কোন ফকীহ্র মতে মাকরূহ তাহরীমী, আবার কারো মতে মকরূহ তান্জীহি। যেমন বাহরূর রায়েকেও এরূপ উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া ফকীহদের মধ্যে কারো মতে আবার তা বর্জন করাই অধিকতর উত্তম। (ترك اولى)
ينبغى لمن تبع الجنازة ان يطيل الصمت .
অর্থাৎ- যাঁরা জানাজার সাথে পথ চলে তাদের নিশ্চুপ থাকা দরকার। যেহেতু ‘সরব যিকির’ থেকে বিরত থাকাই অধিকতর উত্তম। উল্লেখ্য যে মাকরূহ তান্জীহি এবং ‘অধিকতর উত্তম বর্জন’ (تـرك اولـى) জায়েজ বা বৈধরই পর্যায়ভূক্ত।
মুফ্তি মাওলানা আমিমুল ইহছান ছাহেব প্রণীত ‘আত্তা রীফাতুল্ ফিকহিয়্যাহ’ নামক কিতাবে উল্লেখ করা হয়-
ان كان الى الحل اقرب تكون تنزيهية .
অর্থাৎ- “যা হালালের কাছাকাছি তা’ মাকরূহ তানজীহি। বাকী রইল, উক্ত কাজটি ‘মাকরূহ তাহরীমি’ কিনা? তা কোন কোন ফকীহ মাকরূহ তাহরীমি বলেছেন। তবে অধিক সংখ্যক ফকীহর অভিমতানুসারে তা জায়েজ। যদিও কেউ কেউ তা বর্জন করা উত্তম বলেছেন। কারণ, তা পালনে কোন ক্ষতি বা গুনাহ নেই।
যুক্তির নিরীখে বিচার করলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আলোচ্য কাজটির অবৈধতার পক্ষে মাকরূহ তান্জীহি বা অপেক্ষাকৃত কাজ উত্তম-অধিক বর্জন এর (ترك اولى) বেশী কিছু অধিক বলা যাবে না। কারণ তার অবৈধতা প্রমাণের জন্য কোরআন মজিদ বা হাদিস শরীফের নিষেধসূচক কোন প্রমাণ উত্থাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং তা মাকরূহ তাহরীমি হতেই পারে না। কেননা, তাহলে ‘ওয়াজিব’ এরই সমপর্যায়ের। যেমন, ‘ফতোয়া শামী’ ১ম খণ্ড, ৬৩৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে-
انه فى رتبة الواجب لايثبت الّا بما يثبت به الواجب يعنى بالنهى الظنى الثبوت او الدلالة .
অর্থাৎ- তা (মাকরূহ তাহরিমী) ওয়াজিবেরই সমমানের। যেহেতু ওয়াজিব প্রমাণিত হবার জন্য যে মানের দলীল প্রয়োজন (يعنى ظنى الثبوت والدلالة) অনুরূপ দলিল দ্বারাই ‘মাকরূহ তাহরিমী’ প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অধিকন্তু মাকরূহ তানজিহী এবং অধিকতর উত্তম বর্জন (ترك اولى) যুগ পরিবর্তনের ফলে মোস্তাহাব এর মর্যাদা লাভ করে। আল্লামা শামী (رحمة الله) উচ্চরবে যিকির করা মাকরূহ বলেছেন। শুধু কোরআন মজিদের নিম্নলিখিত আয়াতের ভিত্তিতেই- قوله تعالى ان الله لايحب الـمعتدين .
অর্থাৎ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’ অতঃপর উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়- اى المجاهرين بالدعاء অর্থাৎ উচ্চরবে দোয়া করে এমন সব ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তায়ালা ভালবাসেন না।
মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) প্রণীত শরহে নেক্বায়া ও অন্যান্য কিতাবাদিতে তার কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয় যে, এ কাজটা নবী করীম (ﷺ) এর যুগে ছিল না। যেমন- উল্লেখ করা হয়:
لانه بدعة محدثة بعد النبى صلى الله عليه وسلّم . (شرح النفاية، ج-১،ص-১৩৮)
অর্থাৎ- কারণ, তা নবী করীম (ﷺ) এর পরবর্তী যুগে প্রচলিত একটা নূতন কাজ। (শরহে নেক্বায়া, ১ম খণ্ড, ১৩৮পৃ.)
এখন বিবেচ্য হল যে, ফকীহগণ জানাজার সাথে চলার সময় সরব নীরব কিংবা নির্বিশেষে ‘যিকির’ করা বৈধ বলে অভিমত প্রকাশ করে মুসলমানদেরকে যে অনুমতি দিয়েছেন তাতে যুক্তি-প্রমাণ কি? তাও তো নবী করীম (ﷺ) এর যুগে ছিলনা। যদি থাকত তবে হাদিস শরীফ সমূহে ছাহাবায়ে কেরামের বর্ণনা ও কার্যে তার প্রমাণ পাওয়া যেত নিশ্চয়ই। অথচ কোন ছাহাবীর বর্ণনা কিংবা অন্য কোন ছহীহ হাদিসে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না বরং হাদিস শরীফে শুধু নীরবে বসে থাকার বর্ণনাই প্রতিভাত হয়। যেমন, পূর্বোলেখিত ইবনে মাজা শরীফের এক হাদিসেই তার সমুজ্জ্বল প্রমাণ বিদ্যমান।
ইমাম নববী (رحمة الله) সেদিকে ইঙ্গিত করে উল্লেখ করেছেন-
ماكان عليه السلف رضى الله عنهم السكوت فى حال السير مع الجنازة .
অর্থাৎ- তা ‘ছলফে ছালেহীন’ এর আমলে ছিল না; বরং তাঁরা ‘জানাজার’ সাথে পথ চলার সময় নীরবই থাকতেন। তাই এখন প্রশ্ন জাগে তাঁরা মৌলিক যিকিরের অনুমতি দিলেন কোন্ দলীলের ভিত্তিতে? তদুত্তরে একথা অনস্বীকার্য যে, ফোকাহা-কেরাম যুগ পরিবর্তনের প্রেক্ষিতেই প্রথমতঃ মৌলিক যিকিরের অনুমতি দিয়েছেন। কারণ, কালের পরিবর্তনে মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় ও কবরের কঠিন শাস্তির ভীতি ক্রমশঃ হ্রাস পেয়েই আসছে। নবী করীম (ﷺ) এর যুগে মানুষের অন্তরের যে অবস্থা ছিল তা ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকে। এতদ্ভিত্তিতেই ফকীহগণ ‘জানাজার’ সাথে পথচলার সময়’ উচ্চস্বরে যিকির করার শিক্ষা দিয়েছেন।
_____________
আল্-ক্বাওলুল হক্ব
(জানাজায় উচ্চরবে যিকির জায়েয প্রসঙ্গে)
রচনায়ঃ মুহাম্মদ আজিজুল হক আল-কাদেরী (رحمة الله)
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মন্নান (এম.এম.এম.এফ)
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন