উচ্চস্বরে জিকির কি আল কুরআনে নিষিদ্ধ

 

উচ্চস্বরে জিকির কি আল কুরআনে নিষিদ্ধ


পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত নিয়ে কেউ কেউ ঢালাওভাবে উচ্চ আওয়াজে জিকির নিষেধ করে থাকেন। মূলত এই আয়াত অতি উচ্চস্বরে জিকিরকে নিষেধ করেছে কিন্তু স্বাভাবিক জোরে জিকিরকে নিষেধ করেনা। প্রথমেই আয়াত শরীফটি লক্ষ্য করুন,

-"আর স্বরণ করতে থাক স্বীয় পালনকর্তাকে বিনয় ও ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় এবং চিক্কার করা অপেক্ষায় কম ; সকাল ও সন্ধ্যায়। আর বেখবর থেকো না।" (সূরা আরাফ, ২০৫ নং আয়াত)



সূরা আরাফ এর ২০৫ নং আয়াত ও সূরা ইসরা এর ১১০ নং আয়াতের মূল মাআনা বা অর্থ একই। অথবা সূরা আরাফের ২০৫ নং আয়াতের সু- স্পষ্ট ব্যাখ্যা হল সূরা ইসরার ১১০ নং আয়াত। যেমন সূরা ইসরার ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ তালা বলেন,



قل ادعوا الله أو اذغوا الرخمن أيا ما ذغوا فله الأسماء الحسنى ولا تجهر بصلاتك ولا تخافت بها وابتغ بين ذلك سبيلا



-"বলুন, আল্লাহ বলেই ডাক অথবা রহমান বলেই ডাক, সকল সুন্দর নাম সমূহ তারই। আপনার নামাজ আদায়কালে উচ্চ আওয়াজে পড়বেন না। আবার নি:শব্দেও পড়বেন না। এতদুভয়ের মধ্যমপন্থা অবলম্বব করুন।" (সূরা ইসরা, আয়াত নং ১১০)



সূরা আরাফের ২০৫ নং আয়াতের তাফছিরে হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির(رحمة الله) বলেছেন,



وقد يكون المراد من هذه الآية كما في قوله تعالى: (ولا تجهز بصلاتك ولا تخافت بها وابتغ بين ذلك سبيلا فإن المشركين كانوا إذا سمعوا القرآن سوه ، وسبوا من أنزله ، وسبوا من جاء به ؛ فأمره الله تعالى ألا يجهر به



-"আর অবশ্যই এই আয়াতের অর্থ হবে যেমনটি আল্লাহ তা'লা বলেছেন: আপনার নামাজ আদায়কালে উচ্চ আওয়াজে পড়বেন না আবার নি:শব্দেও পড়বেন না। এতদুভয়ের অবলম্বব করুন। কেননা মুশরীকরা যখন ইহা শুনে তখন তাকে গালী দেয় যিনি ইহা নাজিল করেছেন এবং যে ইহা বহন করেছে তাকে। ফলে আল্লাহ তায়ালা ইহাকে অতি উচ্চ আওয়াজ ব্যতীত ডাকার নির্দেশ দেন।" (তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩ য় খন্ড, ৫৩৯ পৃ:)



সুতরাং আয়াতদ্বয়ের মূল উদ্দেশ্য হল, অতি উচ্চ আওয়াজে ক্বেরাত বা জিকির না করা এবং একেবারে নি:শব্দেও না করা। বরং এতদুভয়ের মাঝামাঝি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাই হল পবিত্র কোরআনের শিক্ষা। সূরা আরাফের ২০৫ নং আয়াতের তাফছিরে রইছুল মুফাচ্ছেরীন হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন,



قال ابن عباس: يغني بالذكر القراءة في الصلاة ، يريد يقرأ سرا في نفسه ، تضرعا وخيفة ، خوفا ، أي: تتضرع إلي وتخاف مني هذا في صلاة السر . وقوله: وذون الجهر من القول ، أراد في صلاة الجهر لا تجهز جهرا شديدا بل في خفض وسكون ، تسمع من خلفك .



-"হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, অর্থাৎ (আয়াতের উদ্দেশ্য হল) নামাজের ক্বেরাত পাঠের জিকির দ্বারা (উচ্চ আওয়াজ করােনা) এর দ্বারা ইচ্ছা হল, নামাজে বিনয় ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কেরাত পাঠ করাে। অর্থাৎ গােপন ক্বেরাতের নামাজেও আমার প্রতি বিনয় ও ভীত হালে ক্বেরাত পড়।"জোরে আওয়াজ ব্যতীত"এর দ্বারা ইচ্ছা হলাে উচ্চস্বরে ক্বেরাতের নামাজে বেশী জোর কেরাত না করা। বরং সামান্য নিচু ও শান্ত স্বরে যেন পিছন থেকে ইহার আওয়াজ শুনতে পায়। (তাফছিরে বাগভী,,২য় খন্ড,২৬৭৭ পৃ:; তাফসীরে কুরতবী,৭ম খন্ড,৩৫৫ পৃ:)



আয়াতের তাফছিরে প্রখ্যাত দুইজন তাবেঈ বলেছেন,



وقال مجاهد وابن جريج: أمر أن يذكروه في الصدور بالضرع إليه في الدعاء والاستكانة ، دون رفع الصوت والصياح بالدعاء .



-"হযরত মুজাহিদ ও ইবনে জুরাইয(رحمة الله) বলেছেন, এই মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, অন্তরে বিনয় ও চাপাস্বরে আল্লাহর প্রতি দোয়া প্রার্থনা করাে। উচ্চস্বরে চিৎকারের আওয়াজে দোয়া ব্যতীত।" (তাফছিরে বাগভী, ২ য় খন্ড, ২৬৪ পৃ:)



এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম কুরতবী(رحمة الله) উল্লেখ করেন,



قال أبو جعفر الاسن: ولم يختلف في مقتى واذكر ربك في نفسك أنه في الأغاء



-"আবু জাফর নাহহাস বলেছেন, তােমরা তােমাদের রবকে নিচুস্বরে ডাক নিশ্চয় এই আয়াত দোয়ার বেলায়, আর এ বিষয়ে কোন মতানৈক্য নেই।" (তাফছিরে কুরতবী, ৭ ম খন্ড, ৩৫৫ পূ:)



হাফিজুল হাদিস আল্লামা ইমাদুদ্দিন ইবনে কাছির(رحمة الله) বলেন,



ودون الجهر من القول وهكذا يستحب أن يكون الذكر لا يكون نداء و لاجهرا بليغا



-"উচ্চ আওয়াজ ব্যতীত"এরুপ নিচু আওয়াজে জিকির করা মুস্তাহাব যে, ইহা চিক্কার করে উচ্চ আওয়াজে আহবানের মত হবেনা।" (তাফছিরে ইবনে কাছির, ৩ য় খন্ড, ৫৩৯ পৃ:)



এই আয়াত সম্পর্কে ইমাম কুরতবী(رحمة الله) সবচেয়ে সুন্দর ও স্পষ্ট করে বলেছেন।



ودون الجهر) أي دون الرفع في القول . أي أسمع نفسك ، كما قال:"وابتغ بين ذلك سبيلا"أي بين الجهر والمخافتة .



-"উচ্চ আওয়াজ ব্যতীত"অর্থাৎ জোরে আওয়াজে ব্যতীত যেন নিজে ওয়াজ শুনতে পায়। এতদুভয়ের অবলম্বব করুন ' অর্থাৎ অধিক উচ্চ ও অত্যধিক নিচুর মাঝামাঝি আওয়াজে পড়ুন।" (তাফছিরে কুরতবী, ৭ ম খন্ড, ৩৫৫ পৃ:)



মাঝামাঝি আওয়াজে কেরাত বা জিকির করার বিষয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করলে বিষয়টি আরাে স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেমন লক্ষ্য করুন,



حدثنا موسى بن إسماعيل ، حدثنا حماد ، عن ثابت البناني ، عن النبي صلى الله عليه وسلم ، ح وحدثنا الحسن بن الصباح ، حدثنا يحيى بن إسحاق ، أخبرنا حماد بن سلمة ، عن ثابت البناني ، عن عبد الله بن رباح ، عن أبي قتادة ، أن النبي صلى الله عليه وسلم خرج ليلة ، فإذا هو بأبي بكر رضي الله عنه يصلي يخفض من صوته ، قال: ومر بعمر بن الخطاب ، وهو يصلي رافعا صوته ، قال: فلما اجتمعا عند النبي صلى الله عليه وسلم ، قال: يا أبا بكر ، مرز بك وأنت تصلي تخفض صوتك ، قال: قد أسقف من تاجي يا رسول الله ، قال: وقال لعمر: مرزث بك ، وأنت تصلي رافعا صوتك ، قال: فقال: يا رسول الله ، أوقظ الوسنان ، وأطرد الشيطان زاد الحسن في حديثه: فقال النبي صلى الله عليه وسلم: يا أبا بكر از فغ من صؤتك شيئ ، وقال لغمر: اخفض من صوتك شيئا .



-"হযরত আবু কাতাদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এক রাতে ঘর হতে বের হয়ে হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) কে আস্তে আস্তে (বেশী নিরবে) কেরাত পড়তে দেখলেন। অত:পর তিনি (ﷺ) উমর (رضي الله عنه) এর পাশ দিয়ে গমনকালে অধিক জোরে জোরে কেরাত পড়তে শুনলেন। অত:পর যখন তারা দুইজন রাসূলে পাক (ﷺ) এর কাছে একত্রিত হলেন, তখন রাসূলে করীম (ﷺ) আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) কে বললেন: আমি তােমার পাশ দিয়ে গমনকালে নি:শব্দে সালাত পড়তে শুনলাম। তখন আবু বকর (رضي الله عنه) বললেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার রবের সাথে গোপনে আলাপ করছি এবং তিনি শ্রবণকারী। রাবী বলেন: অত:পর তিনি (ﷺ) উমর (رضي الله عنه) কে বললেন, আমি তােমার পাশ দিয়ে গমনকালে উচ্চ আওয়াজে সালাত পড়তে শুনেছি। তখন উমর (رضي الله عنه) বললেন: এর দ্বারা ইচ্ছা ছিল ঘুমন্ত মানুষকে জাগ্রত করা এবং শয়তানকে বিতারিত করা। রাবী হাসান বলেন, তখন নবী পাক (ﷺ) বললেন: হে আবু বকর! তুমি তােমার কিরাতকে একটু শব্দ করে পাঠ করবে। উমর (رضي الله عنه) কে বললেন, তুমি তােমার কিরাত একটু নিম্ন শব্দে পাঠ করবে। (সুনানু আবী দাউদ, হাদিস নং ১৩২৯ ; ইমাম তাবারানী: মুজামুল অাওঁহাত, ৭২১৯ ; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নং ১১৬৮ ; ইমি বায়হাক্বী: সুনানুল কুবরা, হাদিস নং ৪৭০০ ; ছহীহ ইবনে খুজাইমা, হাদিস নং ১১৬১ ; ছহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ৭৩৩ ; তাফছিরে মাজহারী, ৩ য় খন্ড, ৪৫২ পূ:)



"অতএব, জোরে জিকির করা নিষেধ নয় বরং চিক্কার করে জোরে জিকির নিষেধ। স্বাভাবিক জোরে জিকির করা কোরআনের শিক্ষা ও রাসূলে পাক (ﷺ) এর তরিকা। তাই যারা ঢালাওভাবে জোরে জিকির করা নিষেধ করে। এতে করে তাদের জিহালত বা মূর্খতাই প্রকাশ পাবে। সুতরাং বেশী জোরে নয় আবার একেবারে নি:শব্দেও নয়, মধ্যপন্থা অবলম্বন করে জোরে জিকির করা জায়েয।

______________________

শরীয়তের দৃষ্টিতে ক্বালবী জিকির ও ছামার বৈধ্যতা

রচনা ও সংকলনেঃ মুফতি মাওলানা আলাউদ্দিন জেহাদী

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন