সামূদের প্রতি বিধানকৃত শাস্তি স্মরণকালে দুঃখ প্রকাশ

সামূদের প্রতি বিধানকৃত শাস্তি স্মরণকালে দুঃখ প্রকাশ

সামূদ গোত্র কর্তৃক পৃথিবীর বুকে সর্বশেষ হাঁটার সময় হতে এ যাবত দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়েছে। এখন তাদের অার লেশচিহ্ন মাত্রও অবশিষ্ট নেই। যে বদনসিব তাদের আক্রান্ত করেছিল, তা-ও বর্তমানে দূর-অতীত। তথাপি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর পুণ্যবান সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه)-কে তাদের বসতভিটায় প্রবেশ করতে বারণ করেছিলেন এবং আরো আদেশ করেছিলেন যেন তাঁরা ওই ধ্বংসাবশেষ অতিক্রমের সময় দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে ও অশ্রুসজল নয়নে তা পার হন, যাতে মনে হয় শাস্তি এখনো তাঁদের ওপর পড়ছে।

হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (رضي الله عنه) উদ্ধৃত করেন মহানবী (ﷺ)-কে, যিনি এরশাদ ফরমান: যারা নিজেদের (আত্মার) প্রতি যুলূম করেছিল, তাদের বসতিতে অশ্রুসিক্ত (ও বেদনার্ত) অবস্থা ছাড়া প্রবেশ করো না, পাছে তোমাদের প্রতিও অনুরূপ শাস্তি এসে পড়ে। [আল-বুখারী রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’, ‘আল্লাহর বাণী: আর সামূদের প্রতি তাদের ভাই সালেহ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৩৭ #৩২০০-৩২০১; মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-যুহদ’, ‘যারা নিজেদের প্রতি যুলূম করেছে তাদের বসতিতে প্রবেশ করো না’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২২৮৫-২২৮৬ #২৯৮০; আহমদ ইবানে হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ২:৯৬; ইবনে হিব্বান কৃত ‘আল-সহীহ’, ১৪:৮০ #৬১৯৯; এবং আল-রূইয়্যা’নী রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ২:৪০৭ #১৪০৯]

এই হতভাগ্য সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিশ্বনবী (ﷺ)-এর নির্দেশ ছিল এ মর্মে যে, দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে ও অশ্রুসিক্ত নয়নে  তাদের ধ্বংসাবশেষ অতিক্রম করতে হবে। সর্বাধিক করুণাময় রাসূল (ﷺ) তাঁর পুণ্যবান সাহাবাবৃন্দের (رضي الله عنه) মাধ্যমে এই উম্মতকে এটা  শিক্ষা দিয়েছেন যেন আমরা যখন বিলীন জাতিগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর কথা স্মরণ করবো, তখন আল্লাহর প্রতি এমন বিনয় প্রকাশ করবো যাতে ওই জাতিগোষ্ঠী যেভাবে খোদায়ী শাস্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল সেভাবে আমরাও আক্রান্ত না হই। যদিও দৃশতঃ (সাহাবা-মণ্ডলীর মাঝে) মহানবী (ﷺ)-এর সম্মানিত উপস্থিতি এধরনের (আযাবের) ঘটনা রহিত করার অসীলাস্বরূপ, তবু তাঁদেরকেও দুঃখ-বেদনাময় ভাবাপ্লুত হতে বলা হয়েছে। এই হাদীস হতে আমরা এ শিক্ষা-ই পেয়েছি।

এই বিষয়টি অন্তর ও আত্মার অনুভূতি ও আবেগের সাথে সম্পৃক্ত। ইমাম মুসলিম (رحمة الله) ওপরে বর্ণিত এ হাদীসটি তাঁর ‘আল-সহীহ’ গ্রন্থের ‘কিতাব আল-রাক্বা’য়েক্ব’ (আত্ম-অস্বীকৃতি ও অন্তর কোমলকরণ) শীর্ষক বইয়ে উদ্ধৃত করেন। ইমাম সাহেব (رحمة الله) চেয়েছেন এই বার্তা পৌঁছে দিতে যে বিষয়টি ওইসব আমল (পুণ্যদায়ক কাজ) ও অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত, যেগুলো কারো অন্তর ও আত্মার ওপর আধ্যাত্মিক প্রভাব ফেলে। এধরনের ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখ করার মাধ্যমে কারো অন্তস্তলে বিশেষ এক অনুভূতি বা আবেগ সৃষ্টি হয়, যার ফলে সে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে তার জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। কারো আত্মার মনস্তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক উপকার যদি এতে নিহিত না থাকতো, তাহলে সর্বাধিক দয়াশীল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেন তাঁর সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه)-কে পুনরায় ওই অভিজ্ঞতা পেতে নির্দেশনা দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন? তাঁদের আত্মিক হাল তথা অবস্থার পরিশুদ্ধি বা উন্নতিতে প্রভাব ফেলে না এমন কোনো কাজ করতে তো তিনি তাঁদেরকে আদেশ দিতে পারতেন না। তিনি তাঁদেরকে এটা করতে নির্দেশ দেয়ার বাস্তবতা-ই প্রমাণ করে যে এসব অবস্থা ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রভাব ফেলে থাকে।

হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন মহানবী (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: এসব (খোদায়ী) শাস্তিপ্রাপ্ত লোকদের বসতিতে অশ্রুসিক্ত অবস্থা ছাড়া প্রবেশ করো না। অশ্রুসজল না হতে পারলে তাতে প্রবেশ করো না, যাতে অনুরূপ অভিসম্পাত তোমাদের ওপর এসে না পড়ে। [আল-বুখারী লিখিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-মাসা’জিদ’, ‘শাস্তির এলাকায় নামায’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:১৬৭ #৪২৩; আল-বুখারী কৃত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-মাগা’যী’, ‘আল-হিজর এলাকায় মহানবী (ﷺ)-এর শিবির স্থাপন’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৬০৯ #৪১৫৮; মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-যুহদ’, ‘যারা নিজেদের প্রতি যুলূম করেছে তাদের বসতিতে প্রবেশ করো না’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২২৮৫ #২৯৮০; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪৫১; এবং আবদ বিন হুমায়দ লিখিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৫৫ #৭৯৮]

প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-কে সামূদ গোত্রের লোকদের বসতভিটায় প্রবেশ করতে এমনভাবে মানা করেন যেন তারা এখনো সেখানে জীবিতাবস্থায় আছে। এটা এ কারণে যে, (পয়গম্বর সালেহ আলাইহিস্ সালামের) মাদী উটকে হত্যা করার অপরাধে আল্লাহতা’লা তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করেন। যদিও এ ঘটনা দীর্ঘকাল আগে ঘটেছিল, তবুও সর্বাধিক দয়াবান রাসূল (ﷺ)-ই এখানে খোদায়ী প্রতিবিধানের কথা স্মরণ করানোর জন্যে এবং প্রত্যেকের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্দেশ প্রদান করেছেন।

মহাসম্মানিত নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁর পুণ্যবান সাহাবা (رضي الله عنه)-মণ্ডলীকে আদেশ করেন যেন তাঁদের চোখের সামনে আল্লাহর শাস্তি ভেসে ওঠে, যাতে ওই ধ্বংসাবশেষ অতিক্রমকালে তাঁদের অন্তরে আল্লাহর শাস্তি পতিত হওয়ার ভীতির দরুন তাঁদের কান্না আসে। আর এটা তাঁরা না করতে পারলে তাঁদেরকে ওই উপত্যকায় প্রবেশ করতেই বারণ করা হয়। কতিপয় সাহাবা (رضي الله عنه) হুযূর পূর নূর (ﷺ)-এর কাছে আরয করেন এই মর্মে যে তাঁরা যদি বেদনায় অশ্রুসজল না হতে পারেন, তাহলে তাঁরা কী করবেন। হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর (رضي الله عنه) সাহাবামণ্ডলী (رضي الله عنه)-এর এই আর্জির পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী (ﷺ)-এর উত্তর বর্ণনা করেন এভাবে: তোমরা কাঁদতে না পারলে কান্নাকাটি করার চেষ্টা করো এ আশঙ্কায় যে তাদের প্রতি পতিত শাস্তি তোমাদের প্রতিও পতিত হতে পারে। [ইবনে কাসীর রচিত ‘আল-বেদা’য়া ওয়াল-নেহা’য়া’, ১:১৩৮; ইবনে কাসীর কৃত ’আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম’, ২:৫৫৭; এবং আল-আসক্বালা’নী প্রণীত ‘ফাতহুল বা’রী’, ৬:৩৮০]

কান্নাকাটি করা শ্রেয়তর; কিন্তু কেউ তা না পারলে তার উচিত যে ব্যক্তি এটা পেরেছে, তাকে অনুকরণ করা। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহতা’লার শাস্তির কথা চিন্তা করে মানুষ যেন খোদাভীরুতা অর্জন করে, এবং এরই ফলে মহান প্রভুর প্রতি বিনয়ী হয় এবং তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই ঘটনা বহুকাল আগে ঘটেছিল এবং এর মুহূর্তগুলোও অতিবাহিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও প্রিয়নবী (ﷺ) তাঁর পুতঃপবিত্র সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه)-কে সাথে নিয়ে এই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে একে জীবন্ত করে রেখেছেন।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন