আল-হিজর অতিক্রমকালে মহানবী (ﷺ)-এর নিজস্ব আমল
সামূদ গোত্রের বসতি অতিক্রমকালে সৃষ্টিকুল শিরোমণি মহানবী (ﷺ) আপন চলার গতি বাড়িয়ে দেন, আর আপন চাদর দ্বারা নিজেকে আচ্ছাদিত করেন এমনভাবে যেন (খোদায়ী) শাস্তি বুঝি ওই সময়েও পতিত হচ্ছিল।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সওয়ারের জন্তুর ওপর বসা অবস্থাতেই আপন চাদর দ্বারা নিজেকে আবৃত করেন। [আল-বুখারী প্রণীত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’, ‘আল্লাহর বাণী: আর সামূদের প্রতি তাদের ভাই সালেহ’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৩৭ #৩২০০; আহমদ ইবনে হাম্বল কৃত ‘আল-মুসনাদ’, ২:৬৬; আল-নাসাঈ রচিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৬:৩৭৩ #১১,২৭০; এবং ইবনে মুবারক লিখিত ‘আল-যুহদ’, পৃষ্ঠা নং ৫৪৩ #১৫৫৬]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (رضي الله عنه) আরো বর্ণনা করেন: মহানবী (ﷺ) আল-হিজর অতিক্রম করার সময় বলেন, “যারা নিজেদের প্রতি যুলূম করেছে, তাদের বসতিতে তোমরা প্রবেশ করো না, পাছে তোমাদের ওপরও ওই শাস্তি পতিত হয়। বরঞ্চ তোমরা তাদেরকে অতিক্রম করো কান্নারত অবস্থায়।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর শির মোবারক ঢেকে দ্রুতবেগে সেই স্থান পার হয়ে যান। [আল-বুখারী রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-মাগা’যী’, ‘আল-হিজরে মহানবী (ﷺ)-এর সেনাশিবির’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৬০৯ #৪১৫৭; মুসলিম কৃত ‘আল-সহীহ’: কিতা’ব আল-যুহদ’, ‘যারা নিজেদের প্রতি যুলূম করেছে তাদের বসতিতে প্রবেশ করো না’ শীর্ষক অধ্যায়, ৪:২২৮৬ #২৯৮০; আবদুর রাযযাক্ব প্রণীত ‘আল-মুসান্নাফ’, ১:৪১৫ #১৬২৪; এবং আল-বায়হাক্বী লিখিত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ২:৪৫১]
প্রিয়নবী (ﷺ) কর্তৃক উক্ত উপত্যকা দ্রুত অতিক্রম করার সময় নিজ শির মোবারককে ঢেকে রাখা এবং এর পাশাপাশি তাঁর পুণ্যবান সাহাবাবৃন্দ (رضي الله عنه)-কে কান্নারত অবস্থায় এলাকাটি পার হতে বলাটা এমন এক আমল, যা’তে নিহিত রয়েছে আমাদের জন্যে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা।
২.৪.৫.১ বিবেচনাযোগ্য বিষয়াবলী
এসব হাদীসের আলোকে নিম্নের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া যায়:
প্রথমতঃ আমাদের মনে রাখতে হবে যে সর্বসেরা আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান নবী করীম (ﷺ)-এর উপস্থিতি-ই আল্লাহতা’লার করুণার এক উৎস এবং তাঁর গযব (রোষ/অসন্তুষ্টি) ও আযাব (শাস্তি) নিরোধক। অতএব, প্রিয়নবী (ﷺ) সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه)-এর মাঝে স্বশরীরে উপস্থিত থাকা অবস্থায় শাস্তি পতিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। উপরন্তু, ওই সেনা অভিযানে শরীক হয়েছিলেন হুযূর পাক (ﷺ)-এর পুণ্যবান সাহাবীবৃন্দ (رضي الله عنه), যাঁদের মধ্যে একজনও বে-ঈমান ছিলেন না, আল্লাহ মাফ করুন। ইতিহাসজুড়ে এর চেয়ে শ্রেয়তর সঙ্গি-সাথী পৃথিবীর বুকে আর কেউই ছিলেন না। এরকম মহান ব্যক্তিত্বদের প্রতি আল্লাহতা’লা শাস্তির বিধান করবেন, এ কথা কি চিন্তাও করা যায়?
ওই সময় সামূদ গোত্রের লোকেরা, যারা মাদী উটের পেশীতন্তু কেটে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করেছিল, তারা আর জীবিত ছিল না। এতদসত্ত্বেও সবচেয়ে দয়াবান মহানবী (ﷺ) তাঁর পুতঃপবিত্র সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে এ মর্মে উপদেশ দেন যেন তাঁরা শাস্তি পতিত হওয়ার ঘটনাটি কল্পনা করেন এবং তাঁদের অন্তর ও মস্তিষ্কে এর ভয় ও আশঙ্কার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এর ফলে প্রত্যেক সাহাবী (رضي الله عنه)-ই প্রচুর কান্নাকাটি করেন এবং এই বিবেকের দংশন অনুভব করেন যে শাস্তি প্রকৃতপক্ষে তৎক্ষণাৎ পতিত হতে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়তঃ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সেনা অভিযানে মহান সাহাবী (رضي الله عنه)-বৃন্দ একা ছিলেন না, তাঁদের সাথে উপস্থিত ছিলেন সৃষ্টিকুল শিরোমণি, মহাসম্মানিত পয়গম্বর (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) স্বয়ং। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান: “এবং আল্লাহর কাজ এ নয় যে তাদেরকে শাস্তি দেবেন যতোক্ষণ পর্যন্ত হে মাহবূব, আপনি তাদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন।” [আল-ক্বুরআ’ন, ৮:৩৩; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন সাহেব কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’]
খোশ-খবরীর (মানে ঐশী সুসংবাদের) ব্যাপারে ওয়াকেফহাল থাকা সত্ত্বেও পুণ্যবান সাহাবা-এ-কেরাম (رضي الله عنه) ‘সামূদ’ গোত্রের (করুণ) পরিণতি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন এবং আল্লাহ-ভীতির (তাক্বওয়ার) কারণে তাঁর প্রতি সমর্পিত হন। এটা অনুশীলন করে তাঁরা বাস্তবায়ন করেন প্রিয়নবী (ﷺ)-এর শিক্ষাসমূহ এবং পূরণ করেন দ্বীন-ইসলামের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত, যথা – (ঐশীদানের) আনন্দঘন মুহূর্তে খুশি ও দুঃখ-বেদনার সময় শোক প্রকাশ। অন্তর ও মস্তিষ্কে মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিত ঘটনা হতে প্রত্যাশিত আবেগগুলোর রোমন্থন করা। কারো অন্তরে এ ধরনের আবেগ ও অনুভূতি গড়ে তোলার জন্যে একটি জায়গা বানিয়ে রাখা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কোনো কিছু স্বাভাবিকভাবে অনুভব করা আর কোনো কিছুর জন্যে অনুভূতি সৃষ্টি করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিরাজমান। কোনো ব্যক্তির যখন বিশ্বাস অটল-অবিচল এবং তার চেনাজানার সম্পর্ক-ও সুদৃঢ়, তখন তার আবেগ বৃদ্ধি পায় প্রেরণার ভিত্তিতে। কেউ এটা অর্জন করতে পারেন শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি নিজের গোলামির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধির মাধ্যমেই। কোনো দুঃখ-বেদনার ঘটনায় শোকের কারণে কারো অশ্রু প্রয়াসহীনভাবে গড়িয়ে পড়ে; আর খুশির ঘটনার মুহূর্তে উৎফুল্লচিত্তের কারণে কেউ স্বাভাবিকভাবেই স্মিতহাস্য করেন। এ উপায়ে অতীত ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণ করাটা মহানবী (ﷺ)-এর উদ্দেশ্যের সাথে একদম সঙ্গতিপূর্ণ, আর এ বিষয়টি হাদীসগুলো হতে সপ্রমাণিত।
সবশেষে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হলো, পরম দয়াবান মহানবী (ﷺ) শুধু তাঁর মহান সাহাবা (رضي الله عنه)-বৃন্দকে কান্নারত অবস্থায় উপত্যকাটি অতিক্রম করতে বলেই ক্ষান্ত হননি, বরঞ্চ তিনি নিজেও তা অতিক্রমের সময় কাপড় দ্বারা আপন শির মোবারককে আবৃত করেছিলেন এবং তাঁর সওয়ারকৃত উট দ্রুতবেগে ছুটিয়েছিলেন। এটা (দেখে) কারো কাছে এমন মনে হতে পারতো যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ধ্বংসের মুখোমুখি (সামূদের) এসব লোকজন হতে বহু দূরে সরে যেতে চাইছিলেন।
প্রিয়নবী (ﷺ) এ রকম (আচরণ) করার কী প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন, যদিও বাস্তবতা ছিল এ ঘটনা বহু হাজার বছর আগে ঘটেছিল? আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ মর্যাদাবান পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মাক্বাম এমন-ই যে তিনি যেখানে যেতেন, সেখানেই রহমত (আশীর্বাদ) নাযেল হতো, আর শাস্তি নিবারণ হতো। মহানবী (ﷺ) স্বয়ং হচ্ছেন (খোদায়ী) করুণার পরমোৎকর্ষের মূর্ত রূপ এবং মানবজাতির সুপারিশকারী ত্রাতা। যাঁর খাতিরে আল্লাহতা’লা নিজের আরোপিত শাস্তি ফিরিয়ে নেন, তিনি কীভাবে ওই শাস্তির ভয়ে মুহ্যমান থাকবেন? এ ধরনের চিন্তা করাটাও অসম্ভব, এমন কি সবচেয়ে দুর্বল ঈমানদার ব্যক্তিও এভাবে চিন্তা করবেন না। অতএব, হুযূর পূর নূর (ﷺ) যদি ওই হালত তথা (মানসিক) অবস্থায় উপত্যকাটি ছেড়ে যান, তাহলে স্রেফ উম্মতকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই তিনি তা করেছিলেন।
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন