গোলাম দস্তগীর লিসানী
--------
প্রথমেই একটা ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিই। বলেছিলাম, ফ্রান্সে কয়েকশো কাটা মাথা পাঠানো হয়েছিল। আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের মুসলিমদের খুলি। আলজেরিয়া থেকে সুদূর ফ্রান্সে।
ভুল বলেছি।
শুধু প্যারিসের মিউজিয়াম অভ ন্যাচারাল হিস্ট্রি (মানবজাতির জাদুঘর বা Musée de l’Homme ও বলা হয়) তে আলজেরিয়ার ৫৩৫ জনের ছিন্নমস্তক গোণা হয়েছে।
একজনের নাম্বার ছিল, খুলি নং ৫,৯৪২...
তাহলে ফ্রান্স কত হাজার মুসলমানের খুলি জমিয়ে রেখেছে? ছয়? অসম্ভব। এমন তো নয়, এ কাটা মাথা শেষ ছিল! দশ? কে জানে! বিশ হাজার? তিরিশ হাজার?
এক একটা মাথা,
১. আটককৃত যুদ্ধবন্দীকে জবাই করে আলাদা করা হয়েছে
২. বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শুকানো হয়েছে খোলা জায়গায় প্রদর্শন করে করে।
৩. শুকানো শেষ হবার পর, প্রতিটি খুলির নাম পরিচয় সংরক্ষণ করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে।
দু হাজারের বেশি কিলোমিটার চওড়া আলজেরিয়া, দু দিক দিয়ে। এই হাজার হাজার কিলোমিটার বহন করা ও করানো হয়েছে।
৪. জাহাজে অনেক পদ্ধতিগতভাবে আঁটানো হয়েছে।
৫. আফ্রিকা থেকে হাজার কিলোমিটার দূরের ফ্রান্সের বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ( আলজেরীয় আন্নাবা থেকে ফরাসি নানতেস বন্দরের দূরত্ব ৪৫৪ নটিক্যাল মাইল)
৬. নানতেস বন্দরের দূরত্ব প্যারিস থেকে ৩৮৫ কিলোমিটার। জানি না কোন বন্দর থেকে প্যারিস নেয়া হতো। যাই হোক, চারশো কিলোমিটার এ মাথাগুলো বহন করে নিয়ে গেল।
৭. জাদুঘরে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখলো।
৮. ১৭০ বছর ধরে প্রদর্শন করলো নিজের জাতিকে। মনোগড়ন দিল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড়ে তুলল।
৯. একটা নয়, দশটা নয়, হাজার হাজার হাজার মুসলিমের কাটা মাথা! এক জায়গা থেকে নয়। সমগ্র আলজেরিয়া থেকে। এক ঘটনার নয়। ১৫ লাখ মানুষের মধ্য থেকে। এক বছর ধরে নয়। ৪৫+ বছর ধরে।
ফ্রান্সের দৃঢ়তাকে সালাম।
ওই সেনাদের সালাম যারা মাথা কাটতো।
ওই সেনাপতিদের সালাম যারা আটককৃত বন্দিদের মাথা কাটার আদেশ দিতো।
ওই প্রশাসক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মীদের সালাম, যারা এ মাথা শুকাতো। নাম অনুযায়ী লিস্ট করতো। জড়ো করতো। হাতে বহন করতো। ঘোড়ার গাড়িতে তুলতো। নামাতো। শিপের কাপিতানদের সালাম। অফিসার ও কর্মীদের সালাম। তাদের মাতৃভূমিতে যারা নামাতো, যারা বহন করতো, যারা জায়গায় জায়গায় প্রদর্শন করতো, বিশেষ করে ওসব মিউজিয়ামের কিউরেটর, কর্তৃপক্ষ, কর্মীকে সালাম। পুরো বিপ্লবী ফরাসি জাতিকে সালাম, যারা হাসিমুখে এসব কল্লা কাটা দেখে গেছে ১৭০ বছর ধরে। আজও।
ও, খুলি নং ৫,৯৪২ ছিলেন সূফি শাইখ মূসা আল দারকাওয়ি আল মিশরি রা.; আশ শাইখ আস সূফি মুহাম্মাদ বিন হামযা জাফর আল মাদানি র.'র সুযোগ্য মুরিদ।
তাঁকে যথারীতি আটকের পর শিরচ্ছেদ করা হয়। তিনি আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সম্মান সহ দাফন হয়েছেন ১৭১ বছর পর, ২০২০ সালে, আলজেরিয়াতে।
সালামে ফিরে আসি।
এত সালামের কারণ, তাদের দৃঢ়তা, তাদের ধারাবাহিকতা। কিংবদন্তিতুল্য, প্রবাদপ্রতিম। সুদূরপ্রসারী।
যারা জন্ম থেকে কেটে আনা খুলি দেখে বেড়ে উঠেছে, তারা ব্যংগচিত্র স্বাভাবিক জানবে না কেন?
এ খুলি নিয়ে কেউ কিছু বলো না প্লিজ। এটা ফ্রান্সের জাতিগত ঐতিহ্য। নিজস্বতা। স্বকীয়তা। ফ্রিডম অভ স্কাল।
সালামটা এ কারণেও যে, এ আলোকে যদি কোন মুসলমানের বাচ্চার শিরদাঁড়া একটু হলেও টানটান হয়, যদি ধারাবাহিকতা, সায়েন্টিফিক মেথডোলজি, নিজের কমন গ্রাউন্ড, দৃঢ়তা, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে কোন কোন মুসলিমের বাচ্চা আত্মপরিচয়ের কলজে হিম করা চিৎকার নিজের ভেতরও দিয়ে উঠতে পারে, যদি নিজের বাস্তব প্রতিপক্ষের বাস্তব পদক্ষেপ বুঝতে পারে- মানুষ হতে পারবে।
এ খুলিগুলোর পথপরিক্রমা এতই আকর্ষণীয় যে, যে কোন মুসলমানকে এক ধাক্কায় মানুষ করে দেয়ার জন্য এটা যথেষ্ট। সে বুঝতে পারবে, সে ভালো থাকতে চাইবে এটা যেমন স্বাভাবিক, তার বিপরীত তাকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটায় শত বছরের ধারাবাহিকতায়, এটাও স্বাভাবিক।
মুসলিমকে আত্মপরিচয়ের চিঠি পাঠানোয় ফ্রান্স তোমায় সালাম। ওদের কেউ কেউ শত বছরের জন্য সচেতনভাবেই জেগে রইল।
(ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, আরবি, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি সহ মেজর ভাষাগুলোয় অনুবাদও করতে পারেন। ভাল হবে। মৌলিক বেশ কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণ আছে।)
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন