রাসূল (ﷺ)‘র সৃষ্টি বিষয়ক আলোচনা তাফসির নং- ১-১০



বিষয় নং-১: সূরা মায়েদার ১৫ নং আয়াত (قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ)-এর সঠিক ব্যাখ্যা এবং বাতিল পন্থীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব



দেওবন্দী মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী তার “বিভ্রান্তির অবসান” গ্রন্থের ৯৫-৯৬ পৃষ্ঠায় এবং পাকিস্তানের আরেক দেওবন্দী আলেম মাওলানা সরফরায খাঁন সফদর তার “নূর আওর বাশার” গ্রন্থে, এছাড়া বিভিন্ন কতিপয় দেওবন্দী ও আহলে হাদিসগণ এবং ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩১৬-৩১৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আলোচনা করে কৌশলতা অবলম্বন করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে সূরা মায়েদার উক্ত আয়াত এ ‘নূর’ দ্বারা উদ্দেশ্য কোরআনুল কারীম। তারা তাদের গ্রন্থে জোর গলায় দাবী করেছেন যে, নূর দ্বারা উদ্দেশ্য রাসূল (ﷺ) এটা দুর্বল অভিমত। নাউযুবিল্লাহ, তাদের জবাবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (رحمة الله)সহ একজামাত মুফাস্সিরগণ লিখেন-


الثَّالِثُ: النُّورُ/ وَالْكِتَابُ هُوَ الْقُرْآنُ، وَهَذَا ضَعِيفٌ لِأَنَّ الْعَطْفَ يُوجِبُ الْمُغَايَرَةَ بَيْنَ الْمَعْطُوفِ وَالْمَعْطُوفِ عَلَيْهِ


-‘‘তৃতীয় অভিমত: যারা উক্ত আয়াতের নূর ও কিতাব যারা একক কুরআনই উদ্দেশ্য বলতে চান আমি বলবো এই অভিমত দুর্বল। কারণ “আতফ” (ব্যাকরণগত সংযোজন) “মা‘তুফ” (সংযোজিত) ও “মা‘তুফ আলাইহি” (যার সাথে সংযোজন করা হয়েছে) এর মধ্যে ভিন্নতা প্রমাণ করে।’’ ১

অথাৎ,  নূর ও কিতাব একই জাতের নয়।

➥{ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী : তাফসীরে কাবীর : ১১/৩২৭ পৃ. দারুল ইহইয়াউল তুরাস আল-আরাবী,  বয়রুত।}



তাদের আবার কেউ কেউ তাদের গ্রন্থে লিখেছেন উক্ত আয়াতে ‘নূর’ দ্বারা ইসলামকে উদ্দেশ্য। বুঝা গেল তাদের মধ্যেও আবার তা নিয়ে অনেক মতানৈক্য, আমি বলবো, আপনারওতো  উক্ত আয়াতে নূর দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে সে ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। তাহলে আপনারাই বলুন আমরা কোনটি বলবো? নির্ভরযোগ্য সকল তাফসীরে রয়েছে উল্লেখিত আয়াতে কারীমার ‘নূর’ দ্বারা নূরে মুহাম্মদী (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। আর ৫টি তাফসীরে  রয়েছে ভিন্নমত। তার মধ্যে মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর ‘বয়ানুল কুরআন’ এবং মাওলানা আবুল আ‘লা মওদুদীর ‘তাফহীমুল কুরআন’ অন্যতম। সংক্ষেপে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রসিদ্ধ তাফসীরকারকদের মতামত পাঠকগণের অবগতির জন্য উল্লেখ করা হল। আমি আরো অনেক তাফসীরকারকের মতামত কিতাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকায় উল্লেখ করছি না। ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে লিখেছিলেন যে, অত্র আয়াতে নূর দ্বারা যে রাসূল (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে এ প্রসঙ্গে কোন সাহাবীর এবং তাবেয়ীদের মতামত নেই। যখন আমার এ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশ হলো তিনি তখন সেই কথাটি কেটে ফেলেন পরবর্তী সংস্করণে। তাই আমি প্রথমে ১নং এ সাহাবীদের এবং ১৩,  ২০, ৪৯,  ৫০, নং এ তাবেয়ীদের মতামত দিয়ে তার মিথ্যা বক্তব্যের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছি।



(১) মুফাস্সির কুল সম্রাট, বিশিষ্ট মুজতাহিদ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) [ওফাত. ৬৮ হি.] স্বীয় উল্লেখযোগ্য তাফসীর ‘তানভিরুল মিকবাস ফী তাফসীরে ইবনে আব্বাসে’ উল্লেখ করেন-


[قَدْ جَآءَكُمْ مِّنَ الله نُورٌ] رَسُول يَعْنِي مُحَمَّدًا [وَكِتَابٌ مُّبِينٌ] بالحلال وَالْحرَام


-‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর, এই নূরের মর্মার্থ হযরত মুহাম্মদ (ﷺ), আর কিতাবুম মুবীন বলতে হালাল-হারামের সুস্পষ্ট গ্রন্থ (আল-কুরআন) কে বুঝানো হয়েছে।’’ ২

➥{আল্লামা ফিরযাবাদি : তানভিরুল মিকবাস ফি তাফসীরে ইবনে আব্বাস : ১/৯০.পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।}



(২) ইমাম ইবনে জরীর ত্বাবারী (رحمة الله) [ওফাত ৩১০ হি.] উক্ত আয়াতের তাফসীরে উল্লেখ করেন,


يَعْنِي بِالنُّورِ مُحَمَّدًا صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , الَّذِي أَنَارَ اللَّهُ بِهِ الْحَقَّ , وَأَظْهَرَ بِهِ الْإِسْلَامَ , وَمَحَقَ بِهِ الشِّرْكَ فَهُوَ نُورٌ لِمَنِ اسْتَنَارَ بِهِ يُبَيِّنُ الْحَقَّ , وَمِنْ إِنَارَتِهِ الْحَقَّ تَبْيِينُهُ لِلْيَهُودِ كَثِيرًا مِمَّا كَانُوا يُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ.


-‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা এখানে নূর মানে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর কথা বুঝিয়েছেন। যার মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘য়ালা সত্যকে আলোকিত করেছেন এবং ইসলামকে জাহির (বিকাশিত) করেছেন এবং শিরকে মিটিয়ে দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারা আলোকিত হতে চায় তার জন্য তিনি আলো। তিনি হক্ক বা সত্য প্রকাশ করেন। তাঁর হক্ককে আলোকিত করার একটি দিক হলো যে, ইহুদীরা আল্লাহর কিতাবের যে সকল বিষয় গোপন করত তার অনেক কিছু তিনি প্রকাশ করেছেন।’’ ৩

➥{ইমাম জারীর আত-তাবারী : জামেউল বায়ান : ৮/২৬৪ পৃ. মুয়াস্সাতুর রিসালা, বয়রুত, লেবানন।}



(৩) ইমাম আবূ ইসহাক যুজ্জাজ (ওফাত. ৩১১ হি.) তার বিখ্যাত তাফসিরে লিখেন-


النور هو: محمدٌ - صلى الله عليه وسلم


-‘‘মহান রব তা‘য়ালা নূর বলতে এখানে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কে উদ্দেশ্য করেছেন।’’


(ইমাম যুজ্জাজ, মা‘নীল কোরআন ওয়া ইরাবিহী, ২/১৬১ পৃ.)



(৪) আহলে সুন্নাতের আকায়েদের একজন অন্যতম ইমাম মাতুরিদী (رحمة الله) [ওফাত. ৩৩৩ হি.] উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন


وقال غيره: النور: هو مُحَمَّد، والكتاب: هو القرآن،


-‘‘অনেকে বলেছেন উক্ত আয়াতের নুর দ্বারা হযরত মুহাম্মাদ (ﷺ) কে উদ্দেশ্য আর কিতাব দ্বারা কুরআন উদ্দেশ্য।


(তাফসীরে মাতুরীদী, ৩/৪৮৫পৃ.দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।)


অতএব বুঝা গেল যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকায়েদের ইমামের কথা মানে না পাঠকবৃন্দ তারাও কী প্রকৃত আহলে সুন্নাতের অনুসারী দাবি করতে পারেন!



(৫) ইমাম আবূ জাফর নাহ্হাশ (ওফাত. ৩৩৮ হি.) এ আয়াতের তাফসিরে লিখেন-


قال جل وعز (قد جاءكم من الله نور) قيل نور يعني به النبي صلى الله عليه وسلم


-‘‘মহান আল্লাহ  ইরশাদ রাসূল (ﷺ)-এর শানে ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট আল্লাহ্ হতে এসেছে এক মহান নূর, কোনো কোনো মুফাস্সির বলেন, এ নূরের মমার্থ প্রসঙ্গে লিখেছেন, এ নূর হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)।’’


(নাহ্হাশ, মা‘আনীল কোরআন, ২/২৮৪ পৃ.)



(৬) সিহাহ সিত্তার অন্যতম ইমাম আবু দাউদের ছাত্র ইমাম আবূ বকর আজরী বাগদাদী (ওফাত. ৩৬০ হি.) তার হাদিসের গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসিরে লিখেন-


وَأَنَّ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ النُّورُ


-‘‘তোমাদের নিকট এসেছে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) তিনি (আলোচ্য আয়াতের) সেই নূর।’’


(ইমাম আবূ বকর আজরী, আশ-শারীয়াহ, ৩/১৩৮৮ পৃ.)



(৭-৮) ইমাম আবু লাইস সমরকন্দী (رحمة الله) [ওফাত. ৩৭৩ হি.] উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-


قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ ، وهو محمد صلى الله عليه وسلم


-‘‘তোমাদের নিকট আল্লাহ্ হতে এসেছে এক মহান ‘নূর’ সেটা হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) এর নূর।


(ইমাম আবু লাইস সমরুকন্দী, তাফসীরে বাহারুল উলুম, ১/৩৭৮ পৃ.)


❏ তিনি তাঁর বিখ্যাত তাফসিরে সূরা নূরের ৩৫ নং আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেন-


فسماه نورا كقوله: قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ [المائدة: ١٥]


-‘‘রাসূল (ﷺ)-এর নামসমূহের মধ্যে একটি নাম মোবারক হল ‘নূর’, যেমন মহান রব তা‘য়ালা  তাঁর হাবিবের শানে ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এক মহান নূর অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)।’’


(ইমাম আবু লাইস সমরুকন্দী, তাফসীরে বাহারুল উলুম, ২/৫১৩ পৃ. শামেলা)



(৯) ইমাম খতিব ইসকাফী  (ওফাত. ৪২০ হি.) তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে এ আয়াতের তাফসিরে লিখেন-


قوله: قد جاءكم من الله نور، [المائدة:١٥] ، يعني النبي صلى الله عليه وسلم


-‘‘মহান রব তা‘য়ালা রাসূল (ﷺ)-এর শানে ইরশাদ করেন, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে নূর (সূরা মায়িদা, আয়াত নং-১৫) এ নূরের মমার্থ হল হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)-এর নূরাণী সত্ত্বা।’’


(ইমাম খতিব ইসকাফী, দুররুল তানযিল, ১/৪৪৩ পৃ.-৪৪৪ পৃ.)



(১০) অপরদিকে ইমাম আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ মাখলুফ ছা’লাভী (رحمة الله) [ওফাত.৪২৭ হি.] উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন-


قَدْ جاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ يعني محمد صلى الله عليه وسلّم وكِتابٌ مُبِينٌ: هو القُرآن


-‘‘আল্লাহর বাণী : তোমাদের নিকট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে ‘নূর’। আর সেই নূর হলেন হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) আর কিতাবুম মুবিম হলো কুরআন।’’ ৪

➥{ইমাম ছা’লাভী : তাফসীরে ছা’লাভী : ৪/৩৯ পৃ. দারুল ইহ্ইয়াউল-তুরাস আল আরাবী,  বয়রুত,  লেবানন।}


━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন