মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ফকীহগণের দৃষ্টিতে শবে বরাত



(১) আহলে হাদিসের অন্যতম আলেম মুবারকপুরী তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তোহফাতুল আহওয়াযীতে’ বলেন,


اعْلَمْ أَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ عِدَّةُ أَحَادِيثَ مَجْمُوعُهَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ لَهَا أَصْلًا -------- فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ بِمَجْمُوعِهَا حُجَّةٌ عَلَى مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ لَمْ يَثْبُتْ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ شَيْءٌ وَاَللَّهُ تَعَالَى أَعْلَمُ -


-‘‘জেনে রাখুন,  শাবানের মধ্যরাতের (শবে বরাতের) ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে,  সব হাদিস একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতের ফযীলতের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। অনুরূপভাবে এ হাদিসগুলো সম্মিলিতভাবে তাদের বিপক্ষে প্রমাণ বহন করে যারা ধারণা করে যে, শবে বরাতের ফযীলতের ক্ষেত্রে কোন প্রমাণ মেলে না। আল্লাহ্ তা‘য়ালাই ভাল জানেন।’’  ৭৮

➥{আল্লামা মুবারকপুরী: তোহফাতুল আহওয়াজী শরহে তিরমিযী : ৩/৪৪১ পৃ. হা/৭৩৬}



(২) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) এক হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-


هَذَا الْحَدِيثِ بِالْبَابِ الْإِيذَانُ بِأَنْ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ لِمَا وَرَدَ فِي إِحْيَائِهَا مِنَ الثَّوَابِ


-‘‘এই হাদিসে অধ্যায়ের দ্বারা সংবাদ বা খবর দিয়েছে যে শাবানের ১৫ই তারিখ রাতে (শবে বরাতে) জেগে ইবাদত করলে সাওয়াব রয়েছে যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।’’  ৭৯

➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী মিরকাত : কিয়ামে রমযান: ৩/৯৬৯ পৃ. হা/১২৯৯}



(৩) আল্লামা তাহতাভী হানাফী (رحمة الله) বলেন, 


ندب إحياء ليلة النصف من شعبان


-‘‘শবে বরাতে (১৫ই শাবান) রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব।’’  ৮০

➥{আল্লামা ইমাম তাহতাভী : মারাকিল ফালাহ : পৃ-১৫১}



❏ তিনি গোসল করার সুন্নাত ওয়াক্তের আলোচনা করতে গিয়ে লিখেন-


وندب في ليلة براءة وهي ليلة النصف من شعبان لإحيائها وعظم شأنها إذ فيها تقسم الأرزاق والآجال


-‘‘মুস্তাহাব হচ্ছে লায়লাতুল বারাআতে অর্থাৎ শাবানের ১৫ তারিখের রাতে জাগরণ করে ইবাদত করা, এ রাতে জাগরণের অনেক মর্যাদা রয়েছে, কেননা এ রজনীতে আয়ূ এবং রিযিক বন্টন করা হয়।’’


(মারাকিল ফালাহ, ৪৮ পৃ.)


(৪) আল্লামা আলাউদ্দিন হাসকাফী (رحمة الله) বলেন,


وَمِنْ الْمَنْدُوبَاتِ رَكْعَتَا السَّفَرِ وَالْقُدُومِ مِنْهُ. .....وَإِحْيَاءُ لَيْلَةِ الْعِيدَيْنِ، وَالنِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، وَالْعَشْرِ الْأَخِيرِ مِنْ رَمَضَانَ، وَالْأُوَلُ مِنْ ذِي الْحِجَّةِ،


-‘মুস্তাহাব হলো এ সমস্ত রাত্রিগুলোতে ইবাদত করা কমপক্ষে দুরাকাত নামায হলেও পড়া যেমন-

১. সফরের প্রথম রাত

২. দুই ঈদের রাত

৩. ১৫ ই শাবান অর্থাৎ শবেই বরাতে

৪. রমযানের শেষ দশ দিনের রাত,

৫. জিলহজ্জের ১ম তারিখ।’’  ৮১

➥{আল্লামা আলাউদ্দিন হাস্কাফী দুররুল মুখতার : ২/২৪-২৫ পৃ. পরিচ্ছেদ: بَابُ الْوِتْرِ وَالنَّوَافِلِ , কিতাবুল বিতর এবং নফল অধ্যায়।}



(৫) এর ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) গোসল করার সুন্নাত ওয়াক্তের আলোচনায় তিনি লিখেন-


(قَوْلُهُ: وَفِي لَيْلَةِ بَرَاءَةٍ) هِيَ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ.


-‘‘(লায়লাতুল বারাতে) অর্থাৎ ১৫ শাবানে গোসল করে নফল ইবাদত করা সুন্নাত।’’


(ফাতওয়ায়ে শামী, ১ম খণ্ড১৭০ পৃ.),


❏ তিনি তার বিখ্যাত ফাতওয়ার গ্রন্থে নফল ইবাদতের তালিকা দিতে গিয়ে লিখেন-


(قَوْلُهُ وَالنِّصْفِ) أَيْ وَإِحْيَاءُ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ.


-‘‘১৫ শাবানে রাত জাগরণ করে নফল ইবাদত করা।’’


(ফাতওয়ায়ে শামী, ২/২৫ পৃ.)


(৬) আল্লামা ইবনে নুজাইজ হানাফী মিশরী (رحمة الله) বলেন,


وَمِنْ الْمَنْدُوبَاتِ إحْيَاءُ لَيَالِي الْعَشْرِ مِنْ رَمَضَانَ وَلَيْلَتَيْ الْعِيدَيْنِ وَلَيَالِي عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ كَمَا وَرَدَتْ بِهِ الْأَحَادِيثُ


-‘‘মুস্তাহাব হলো রমযানের শেষ দশ দিনের রাতে ও দুই ঈদের রাতে ইবাদত করা। জিলহজ্ব মাসের দশ রজনী এবং শবে বরাতের রাতে ইবাদত করা, এমনটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।’  ৮২

➥{আল্লামা ইবনে নুজাইম মিশরী : বাহরুর রায়েক : ২/৫৬ পৃ., কিতাবুল বিতর ওয়ান নাওয়াফেল}



(৭) ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (رحمة الله) লিখেন-


فَابْن الصّلاح يزْعم أَن لَهَا أصلا من السّنة

-‘‘ইমাম ইবনে সালাহ (رحمة الله) দাবী করেছেন, শবে বরাতের বিষয়ে সুন্নাহের মধ্যে ভিত্তি রয়েছে।’’

(আল্লামা আইনী, উমদাতুল ক্বারী, ১১/৮২ পৃ.)




শাফেয়ী ফকীহদের অবস্থান:


১. ইমাম বায়হাকী (رحمة الله) সংকলন করেন-


قَالَ الشَّافِعِيُّ: وَبَلَغَنَا أَنَّهُ كَانَ يُقَالُ إِنَّ الدُّعَاءَ يُسْتَجَابُ فِي خَمْسِ لَيَالٍ فِي لَيْلَةِ الْجُمُعَةِ، وَلَيْلَةِ الْأَضْحَى، وَلَيْلَةِ الْفِطْرِ، وَأَوَّلِ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبَ، وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ


-‘‘ইমাম শাফেয়ী (رحمة الله) বলেন, আমাকে বলা হয়েছে যে, আগের যুগে (সাহাবী, তাবেয়ীদের যুগে) বলা হতো, পাঁচ রাতের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন,

১. জুম‘আর রাতের দোয়া,

২-৩. ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতরের রাতের দোয়া,

৪. রযব মাসের প্রথম মাসের রাতের দোয়া এবং

৫. শবে বরাতের দোয়া।’’

(ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, ৫/২৮৭ পৃ. হা/৩৪৩৮)


২. ইমাম ইবনে আবেদীন শামী (رحمة الله) লিখেন-

عَنْ بَعْضِ الشَّافِعِيَّةِ: أَنَّ أَفْضَلَ اللَّيَالِي لَيْلَةُ مَوْلِدِهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - ثُمَّ لَيْلَةُ الْقَدْرِ، ثُمَّ لَيْلَةُ الْإِسْرَاءِ وَالْمِعْرَاجِ، ثُمَّ لَيْلَةُ عَرَفَةَ، ثُمَّ لَيْلَةُ الْجُمُعَةِ، ثُمَّ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، ثُمَّ لَيْلَةُ الْعِيدِ

-‘‘একদল শাফেয়ী ফকীহগণ থেকে বর্ণিত আছে, সবচেয়ে উত্তম রাত হলো রাসূল (ﷺ)-এর জন্ম দিনের রাত, তারপর লাইলাতুল ক্বদরের রাত, তারপর ইসরা বা মি‘রাজের রাত, তারপর আরাফাতের রাত, তারপর জুম‘আর রাত, তারপর ১৫ই শাবান তথা শবে বরাতের রাত, তারপর দুই ঈদের রাত।’’

(ইমাম ইবনে আবিদীন শামী, ফাতওয়ায়ে শামী, ২/৫১১ পৃ.)


৩. ইমাম শিহাবুদ্দীন কাস্তাল্লানী (رحمة الله) লিখেন-

وقد كان التابعون من أهل الشام، كخالد بن معدان، ومكحول يجتهدون ليلة النصف من شعبان فى العبادة، وعنهم أخذ الناس تعظيمها

-‘‘শবে বরাতে ইবাদত করার বিষয়ে শাম দেশের তাবেয়ীদের আমল রয়েছে, যেমন খালেদ বিন মা‘দান এবং মিকহুল শামী (رحمة الله) প্রমুখ এ রাতে ইবাদত করার বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন। শামের লোকগণ তা‘যিমের সাথে তা গ্রহণ করেছেন।’’

(আল্লামা কাস্তাল্লানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ৩/৩০০ পৃ.)


❏ তিনি আরও লিখেন-

وقد ورد فى فضل ليلة النصف من شعبان أحاديث كثيرة

-‘‘শবে বরাতের ফযিলতে অনেক হাদিসে পাক বর্ণিত হয়েছে।’’

(আল্লামা কাস্তাল্লানী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, ৩/৩০০ পৃ.)



হাম্বলী ফকীহদের অবস্থান:

১. বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শায়খ মনসূর বিন ইউনূস বাহুতী হাম্বলী (رحمة الله) বলেন,

وَفِي اسْتِحْبَابِ قِيَامِهَا أَيْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ مَا فِي إحْيَاءِ لَيْلَةِ الْعِيدِ

-‘‘শবে বরাত (১৫ শাবান) এর রাতে,  দুই ঈদের রাতে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ নামাযে লিপ্ত হওয়া মুস্তাহাব।’’  ৮৩

➥{আল্লামা শায়খ মনসূর বিন ইউনূস, কাশফুল কানাঈ : ১/৪৪৪ পৃ., পরিচ্ছেদ: فَصْلٌ صَلَاةُ الضُّحَى }



২. আল্লামা ইমাম ইবনে ইসহাক বুরহান উদ্দিন ইবনে মুফলিহ হাম্বলী (ওফাত.৮৮৪ হি.) বলেন,

وَيُسْتَحَبُّ إِحْيَاءُ مَا بَيْنَ الْعِشَاءَيْنِ لِلْخَبَرِ.قَالَ جَمَاعَةٌ: وَلَيْلَةِ عَاشُورَاءَ، وَلَيْلَةِ أَوَّلِ رَجَبٍ، وَلَيْلَةِ نِصْفِ شَعْبَانَ

-‘‘মুস্তাহাব হলো মাগরিব ও ইশার মাঝখানে এই সমস্ত রাত্রিগুলোতে জেগে ইবাদত করা। এক জামাত ইমামগণ বর্ণনা করেছেন, এই সমস্ত রাত্রি হল,  আশুরার রাত্রি, রজবের প্রথম রাত্রি এবং শাবানের ১৫ তারিখ (শবে বরাত) রাত্রি। এই সমস্ত রাত্রিতে জাগ্রত থাকা মুস্তাহাব।’’  ৮৪

➥{মুফলিহ : মাবদাউ শরহে মাকানা: ২/৩৩ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ,  বয়রুত,  লেবানন।}



মালেকী ফকীহদের অবস্থান:

❏ অন্যতম মুহাদ্দিস আল্লামা ইমাম জুরকানী আল-মালেকী (رحمة الله) ওফাত.১১২২হি. বলেন,

اذا كان ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها فقوموا ليلها أي: أحيوه بالعبادة وانصبوا أقدامكم لله قانتين

-‘‘(ইবনে মাযাহ শরীফের হাদিসে এসেছে, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন) যখন ১৫ই শাবান আসবে তখন রাতে তোমরা ইবাদতের জন্য দন্ডায়মান হবে অর্থাৎ এ রাতে ইবাদতে জাগ্রত থাক, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দন্ডায়মান রাতকে ইবাদতে স্থাপন করবে।’’  ৮৫

➥{আল্লামা ইমাম জুরকানী : শরহে মাওয়াহেবে লাদুন্নীয়া : ১০/৫৬১ পৃ.}


━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন