দা’ওয়াতে খায়র’র গুরুত্ব ও আমাদের দায়িত্ব


মাওলানা আবু যাহরা মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক


পূর্ব প্রকাশিতের পর=
বর্তমান মুসলমানদের অবস্থা
নামায আদায় মুসলমানদের জন্য ফরয। নামায আদায় না করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। যারা নামায পড়েন, তাদের অধিকাংশ নামাযের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত নয়। সহীহ শুদ্ধভাবে ক্বোরআনে পাক পড়তে জানেন না। পবিত্রতা, গোসল ও ওযু সঠিকভাবে করতে জানেন না অধিকাংশ মুসলমান নর-নারী। নাপাক কাপড় ও আসবাব পত্র পাক করার সঠিক পদ্ধতি অনেকেরই অজানা। অপরদিকে যারা জানেন তাদের অনেকেই অবহেলা করে নিজের মতো করে চলতে থাকেন। সুন্নাতে রসূলের অনুসরণ না চেহারা ও পর্দায় আছে, না চাল-চলন ও পোষাক-পরিচ্ছদে আছে। না নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চা আছে, না ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার সংরক্ষণের চেষ্টা আছে। আজ বিশ্বময় মুসলমানদের যে অবস্থা তা কারো কাছে গোপন নয়। চতুর্দিকেই আমলহীনতার ছড়াছড়ি। মুসলমানরা নিজেদের অতীত গৌরবকে ভুলতে বসেছে। এ যুগের মুসলমানতো ‘খাও দাও ফূর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়’-এ শ্লোগানকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করে। তাকে যে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন সে মহান উদ্দেশ্য থেকে সরে পড়েছেন। সে কিভাবে অপরকে নামাযের কথা, ভাল কাজের কথা শিক্ষা দেবে, মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেবে। নিজেই নামায থেকে, নেক আমল থেকে বহু দূরে অবস্থান নিয়েছে। সুন্নাতী পোষাক-পরিচ্ছদ বর্জন করে নিত্য-নতুন বিজাতীয় ফ্যাশনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যকে দা‘ওয়াত দেবে কিভাবে, জীবনের প্রতিটি ভালো কাজে সুন্নাতে মোস্তফার অনুসরণ করার, যিনি নিজেই আজ ঐ নাপাকীতে ফেঁসে গেছে। হায় আফসোস! আহা! আজ কিছু মুসলমান, অমুসলমানদের ফ্যাশন অনুযায়ী চলার মধ্যে গৌবরবোধ করে। ইংরেজ লেবাসধারী হওয়া, ইংরেজ স্টাইলে চুল রাখা, চেয়ার-টেবিলে পানাহার করা, লম্বা গোপ রাখা ও দাড়ি শেভ করা, মহিলারা পুরুষের কাপড় পরিধান করা, পুরুষ টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখা। আজকাল বয়স্করাও হাফপ্যান্ট পরিধান করে রাস্তায় চলা-ফেরা করছে। যা দেখে অন্যদেরও লজ্জায় পড়তে হয়। রাত-দিন খেলা-ধূলা নিয়ে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদিই একমাত্র সৌভাগ্য বলে মনে করে। অথচ কোন ইংরেজ ও বেদ্বীনকে কি দেখা গেছে যে মুসলমানদের প্রকৃত আকৃতি-প্রকৃতিকে (এক মুষ্টি দাড়ি, বাবরী চুল রাখা, পায়ের অর্ধগোছা পর্যন্ত কল্লি ওয়ালা পাঞ্জাবী বা জুব্বা, সুন্নাত অনুযায়ী পাগড়ী ইত্যাদি)তে অভ্যস্ত হয়েছে? হয়তো কখনো দেখা যায়নি। ইংরেজ ও বেদ্বীন তার বাতিল ধর্ম ছেড়ে কখনো মুসলমানদের নবীর অনুসরণ করে না। কিন্তু অন্য জাতীর অনুকরণ করার মতো বোকামী তো এখন মুসলমানদের স্বভাবে পরিণত হতে চলেছে! এখন তো দুর্ভাগ্যের পালা এ টুকু পর্যন্ত পৌঁছে গেছে যে, ইসলামী চাল-চলন ও সুন্নাতী পোষাক-পরিচ্ছেদ গ্রহণকারী মুসলমানদেরকে কোন কোন নামে মাত্র মুসলমানের চোখে মোটেই ভালো লাগে না। ওহে উদাসীনতার নিদ্রায় বিভোর মুসলমান ভাই ও বোনেরা! আল্লাহ্র ওয়াস্তে বিবেককে জাগ্রত করুন মৃত্যুদূত ফিরিশতা, জীবনের সম্পর্ককে এ দুনিয়া থেকে সবসময়ের জন্যই ছিন্ন করে দেয়ারই পূর্বে হুশে আসুন, জেগে উঠুন। অন্যান্য মুসলমান ভাই-বোনদেরও জাগিয়ে তুলুন। অন্যথায় পরকালে পস্তাতে হবে। তখন আর কোন সুযোগ থাকবে না। যা করার ইহকালে করে নিন।
দা‘ওয়াতে খায়র কর্মসূচি
আল্লাহ্ তা‘আলা প্রদত্ত আপনার এ দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, দুনিয়ায় শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির মাধ্যমে মহান মালিকের মহাপুরস্কার অর্জনে সক্ষম হওয়ার লক্ষ্যে বিগত ১৯৮৬ ইংরেজী সালে যামানার গাউস, মাতৃগর্ভের ওলী, অসংখ্য মানুষকে জান্নাতের পথ প্রদর্শনকারী, সুন্নাতে রাসূলের পূর্ণ অনুসরণকারী, অগণিত মানুষের হৃদয়ে ইশকে রসূলের প্রদীপ প্রজ্জ্বলনকারী, যুগের রাহবার, হাদিয়ে মিল্লাত, আওলাদে রাসূল হুযূর আল্লামা হাফিয ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রতিষ্ঠা করেন তরীক্বত ভিত্তিক সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। এ সংগঠনের অন্যতম কর্মসূচী হলো দা’ওয়াতে খায়র তথা কল্যাণের দিকে আহ্বান। বিশ্ব মুসলমানের দ্বীনী বিষয়ক জ্ঞানার্জন, বিশেষত: দৈনন্দিন জীবনে যে সকল মাস‘আলার সম্মুখীন হতে হয়, যেমন: পবিত্রতা, ওযূ, তায়াম্মুম, গোসল, নামায, সহীহ ক্বোরআন তেলাওয়াত ও দো‘আ ইত্যাদি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং যুগের প্রয়োজনীয় মাসআলা সম্পর্কে অবগত করার সাথে সাথে সুন্দর চরিত্র গঠন, আখিরাতের চিন্তা-চেতনা তৈরি এ কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য। যাতে মুসলিম সমাজ সুন্নাতে রাসূলের অনুসারী, আমল ও তাক্বওয়াভিত্তিক জীবন গঠনের প্রতি অনুপ্রাণিত হতে পারেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত তথা ইসলামের সঠিক রূপরেখার আক্বীদা সম্পন্ন আদর্শিক মুসলমান হয়ে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তির মোহনায় মিলিত হওয়ার লক্ষ্যে এ আযীমুশ্শান কর্মসূচি প্রদান করে মুসলমানদের উপর বড়ই ইহসান করেছেন।
সাথে সাথে হুযূর ক্বিবলাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ছোট শাহযাদা ও খলীফায়ে রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত, রওনকে আহলে সুন্নাত, পীরে বাঙ্গাল হযরতুলহাজ্ব আল্লামা সাইয়্যিদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ মুদ্দাযিল্লুহুল আলীর সদয় নির্দেশ ক্রমে এ কর্মসূচি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। আর এ কর্মসূচির অনুমোদন ও তার উন্নতিকল্পে দো‘আ দ্বারা মুসলিম উম্মাহর প্রতি আরো একবার ইহসান করলেন হুযূর ক্বিবলাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বড় শাহযাদা ও খলীফা রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত, যীনতে কাদিরিয়্যাত, আলমবরদারে আহলে সুন্নাত, হযরতুলাহজ্ব শাহসূফি সাইয়্যিদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ ক্বিবলা দামাত বারাকাতু হুমুল ক্বুদসিয়্যাহ। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কিংবা ত্বরীক্বায়ে ‘আলিয়া ক্বাদেরিয়র অনুসারীদের জন্য সীমাবদ্ধ নয় বরং সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণে ‘দা‘ওয়াতে খায়র’র এ কর্মসূচি।
যাতে প্রত্যেক ত্বরীক্বার অনুসারী, প্রত্যেক সত্যপন্থী, সত্যানুসন্ধানী প্রতিটি মানুষ সঠিক পথের দিশা লাভ করতে পারে। সুতরাং এ পয়গাম যার নিকট পৌঁছবে, সত্যের এ কাফেলায় তার অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজন কেননা এ আহ্বান হযরত সাইয়্যিদুনা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র আওলাদে পাকের হুসাইনী আহ্বান। সত্যপন্থীদের এক মঞ্চে মিলিত হওয়ার এ এক অনন্য কর্মসূচি। এখান থেকেই সূচিত হতে পারে নতুন দীগন্ত। এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে সত্যের জয়গান গাওয়া এবং তা বিশ্বের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেয়ার এ এক মহা ব্যবস্থাপনা।
‘দা’ওয়াতে খায়র’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের রূপরেখা
হুযূর পীরে বাঙ্গাল মুদ্দাযিল্লুহুল আলী কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে ব্যাপক গবেষণার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট তাঁর এ সদয় নির্দেশনার আলোকে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ও আনজুমান রিসার্চ সেন্টারের সুপরামর্শক্রমে পৃথকভাবে দা’ওয়াতে খায়র কেন্দ্রীয় দপ্তর’র ব্যবস্থা করেছেন, যাতে এ কাজের সঠিকভাবে মনিটরিং করা যায়।
সারাদেশ থেকে শত শত আগ্রহী আবেদনকারীকে ক্বিরাত ও মু‘আল্লিম প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রতি সপ্তাহে কেন্দ্রীয়ভাবে এক স্থানে মিলিত হয়ে নিজের সংশোধন এবং সারা বিশ্বের মানুষের সংশোধনের নতুন নতুন কর্মকৌশল তৈরি করা ও তা বাস্তবায়নের নব উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ষোলশহরস্থ আলমগীর খানক্বাহ-এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া শরীফে প্রতি বৃহস্পতিবার বা‘দে মাগরিব সাপ্তাহিক দা‘ওয়াতে খায়র মাহফিল’র আয়োজন নিয়মিত হয়ে থাকে।
দা‘ওয়াতে খায়র মাহফিল
মসজিদ, মাদ্রাসা, খানক্বাহ্, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন অফিস এবং উম্মুক্ত মাঠে-ময়দানে এ মাহফিল আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া মুসলিম মহিলাদের জন্য ঘরে বা এসব স্থানে শরীয়তের সীমারেখায় থেকে উপস্থিত হয়ে দ্বীনি জ্ঞানার্জনের সুযোগ রাখা হবে। স্থানীয় গাউসিয়া কমিটি, বিশেষত: দা’ওয়াতে খায়র সম্পাদক ও মু‘আল্লিম এবং দা‘ঈগণ সমন্বয় করে নিজ এলাকায় ঐসকল স্থানে দা‘ওয়াতে খায়র মাহফিল আয়োজন করবেন। এ মাহফিল আয়োজনের প্রস্তুতি পর্ব ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি হুযূর পীরে বাঙ্গাল মুদ্দাযিল্লুহুল আলীর সদয় নির্দেশনার আলোকে দা‘ওয়াতে খায়র কেন্দ্রীয় দপ্তর, সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে বিন্যস্ত করেছেন।
দা’ওয়াতে খায়র সম্পাদকের দায়িত্ব
দা’ওয়াতে খায়র মাহফিল বাস্তবায়নে তার ভূমিকাই মূখ্য। তিনি সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অন্যদের সাথে পরামর্শ করে মাহফিলের স্থান নির্ধারণ করে মাহফিল বাস্তবায়ন পদ্ধতি অনুসারে জোরালো পদক্ষেপ নেবেন। প্রশিক্ষিত মু‘আল্লিম নির্বাচন করে তাঁকে স্থান ও সময় সম্পর্কে অবহিত করে তাঁর পরামর্শক্রমে মাহফিল বাস্তবায়ন ও নিয়মিত চালু রাখতে সচেষ্ট থাকবেন। মু‘আল্লিম এবং দা‘ঈদের তালিকা করে তাদেরকে নিয়ে ঐ এলাকায় দা’ওয়াত এবং ঐ এলাকায় দাওরাহ্ বা প্রদক্ষিণের মাধ্যমে দা’ওয়াত দেয়ার বিশেষ কাজটি সম্পাদন করবেন। এ ছাড়া সাপ্তাহিক কেন্দ্রীয় দা’ওয়াতে খায়র মাহফিলে নিজ আওতাধীন যতগুলো মাহফিল হয় সেখান থেকে যতবেশী সংখ্যক সম্ভব মুসল্লীদের নিয়ে অংশগ্রহণ করা তার অন্যতম দায়িত্ব। দা’ওয়াতে খায়র সম্পাদকবৃন্দ আন্তরিক ও নিষ্ঠার সাথে এ মোবারক কর্মসূচি এগিয়ে নিলে অচিরেই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আওলাদে রাসূলের দা’ওয়াতি মিশন পৌঁছে যাবে। মুসলিম ভাই-বোনেরা দ্বীনি জ্ঞানার্জন করে ইসলামের মূলস্রোত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত এর আক্বীদা ধারণপূর্বক সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগী করে উভয় জাহানের সফলতা অর্জনে সক্ষম হবেন ইনশাআল্লাহ।
দা‘ঈ-এর দায়িত্ব
দা‘ঈ শব্দের অর্থ হচ্ছে- দা’ওয়াত দাতা বা আহ্বানকারী। দা’ওয়াতে খায়র’র পরিভাষায়, যিনি ‘দা’ওয়াতে খায়র মাহফিল’-এ অংশগ্রহণ করার জন্য মুসলমানদের দা’ওয়াতের মাধ্যমে মাহফিলে যোগদানের আহ্বান করবেন তিনিই দা‘ঈ। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পেশার মুসলমান এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যে স্থানে মাহফিল হবে তথায় কোন একটি সময় বিশেষ করে আসরের নামাযের পর দলবদ্ধভাবে সুশৃঙ্খল ও গাম্ভীর্যের সাথে দাওরাহ বা প্রদক্ষিণের মাধ্যমে মাহফিলের দা’ওয়াত পৌঁছে দেয়া তার মূল দায়িত্ব। নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক মাহফিল যেখানে হবে তার দা’ওয়াত ঐ দিন নির্দিষ্ট সময়ে দাওরাহ্-এর মাধ্যমে দেয়া আওলাদে রাসূলের প্রত্যক্ষ নির্দেশ বিধায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া পরবর্তী মাহফিলের পূর্ব পর্যন্ত সাক্ষাতে, মোবাইল কল ও এসএমএস ইত্যাদির মাধ্যমে দা’ওয়াত দেয়া দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে তিনি সত্যিকার অর্থে একজন দা‘ঈ ইলাল্লাহ্ তথা আল্লাহ্-রাসূলও কল্যাণের পথে আহ্বানকারীর মহামর্যাদা লাভ করতে পারবেন। দা‘ঈগণ, দা’ওয়াতে খায়র সম্পাদককে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।
স্মরণ রাখবেন, দা‘ঈ’র সুন্দর আচরণ ও মিষ্ট ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাহফিলে যোগদান করবেন। মাহফিল সফল হওয়া অনেকটা দা‘ঈ’র উপর নির্ভর করে, তাই এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুতরাং সত্য ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করা তার একান্ত কর্তব্য।
কল্যাণের পথে আহ্বান’র ফযীলত
দা’ওয়াতে খায়র তথা মানুষকে কল্যাণের পথে আহ্বান করা দা‘ঈকুল সরদার, হাবীবে পরওয়ারদিগার, হুযূর সায়্যিদুল আবরার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান সুন্নাত। রাব্বুল ‘আলামীন জাল্লাশানুহু, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ শানে আক্বদস ক্বোরআনে পাকে এভাবে ইরশাদ করেছেন- وَدَاعِنيًا اِلَى اللهِ بِاِذْنِهِ-
অর্থ: এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর নির্দেশে আহ্বানকারী। [সূরা আহযাব: আয়াত- ৪৬, কানযুল ঈমান]
প্রথম দিকে রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তিন বছর যাবৎ গোপনেই ইসলামের দা’ওয়াত পেশ করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে দা’ওয়াত প্রদানের আদেশ আসে।
[আস্সীরাতুন নবভিয়্যাহ্] আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন- وَاَنْزِرْ عَشِيْرَتَكَ الْاَقْرَبِيْنَ-
অর্থ: এবং হে মাহবূব! আপন নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করুন। [সূরা শু‘আরা: আয়াত- ২১৪, কানযুল ঈমান] এ নির্দেশ আসার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সফা পর্বতে আরোহণ করে ক্বোরাইশদের আহ্বান করলেন, যখন লোকেরা সমবেত হলো তখন তিনি ইরশাদ করলেন, আমি যদি তোমাদেরকে বলি যে, মক্কার উপত্যকা থেকে শত্র“দল তোমাদের আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে, তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে? সকলে এক বাক্যে বলে উঠলো, কেন বিশ্বাস করবনা, আমরা তো আপনাকে সবসময় সত্য কথাই বলতে দেখেছি। তিনি বললেন, ‘‘তাহলে তোমরা শোন, তোমরা যদি আমার উপর ঈমান না আন, তবে তোমাদের উপর কঠিন আযাব নাযিল হবে,’’ একথা শুনে আবূ লাহাব তিরস্কার করতে লাগলো, আর সাবই চলে গেলো। [বুখারী শরীফ: ৩য় খণ্ড]
এভাবে তারা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো আর এ মুক্তির বাণী শুনতে কেউ রাজী ছিলো না। পরবর্তীতে তাঁকে তারা শত্র“ হিসেব গ্রহণ করে বিভিন্ন নির্যাতনের পাহাড় তাঁর উপর চাপিয়ে দিলো। কখনো যালিম কাফিররা নামাযরত অবস্থায় তাঁর পবিত্র পিঠ মোবারকে উটের নাড়িভূড়ি তুলে দিতো, কখনো অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো, জাদুকর বলে বিদ্রুপ করতো, আবার কখনো তাঁর চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখতো এবং তাঁর পবিত্র শরীরে পাথর নিক্ষেপ করতো। এমনকি শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁকে সামাজিকভাবে বয়কট করেছিলো। [মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ্]
তায়িফে নাজুক নূরানী শরীর মোবারক পাথরের আঘাতে জর্জরিত হয়ে এতই রক্ত মোবারক বের হয়েছিলো যে, জুতো মোবারক রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিলো। তিনি যখন ব্যথায় অস্থির হয়ে বসে যেতেন, তখন অত্যাচারী কাফিরগণ তাঁর কোমল বাহু মোবারক ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতো। যখন পুনরায় পথ চলা শুরু করতেন, তখন তারা আবারো পাথর নিক্ষেপ করতো আর আল্লাহ্ তা‘আলার খাতিরে দ্বীনের পতাকাকে উড্ডীন করতে এবং তাতে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে আযাবে ইলাহী থেকে মুক্তির পয়গাম প্রচারকারী বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র রাহে খোদার এ অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করাকে উপহাস করে হাসাহাসি করতে থাকতো। ওহে নবী প্রেমিক দাবীদার মুসলমান! ক্বোরবান হয়ে যান এমন শুভাকাক্সক্ষী নবীর প্রতি যিনি নিজে অসহণীয় কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়েছেন। আমাদেরকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষার জন্য নিজের পবিত্র জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। অথচ আজ কাফিরদের নিকট নয় বরং স্বগোত্রীয়, স্বধর্মীয়দের নিকট জীবন সংশোধনের দা’ওয়াত, নামায ও সুন্নাত এবং আমলী যিন্দেগী গঠন করার প্রতি উৎসাহিত করার আহ্বান নিয়ে গুনাহর সাগরে হাবুডুবু খাওয়া মুসলমানদের রক্ষার দা’ওয়াত দিতে যেতে লজ্জাবোধ করছি, অলসতা প্রদর্শন করছি।
এর নামই কি ইশক্বে রসূল! আমরা যাঁর প্রেমের দাবীদার সে মহান মাশুক রহমাতুল্লিল ‘আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাঁটার উপর চলে, পবিত্র শরীরে পাথরের আঘাত সহ্য করে, রক্ত ঝরিয়ে পেটে পাথর বেঁধে এবং আরো অসংখ্য নির্যাতন সহ্য করেও ইসলামের দা’ওয়াত বন্ধ করেননি অথচ আমরা এখনো এরূপ পরিস্থিতির শিকার হইনি। ঠান্ডা বাতাস প্রদানকারী ফ্যান ও এসির শীতল পরিবেশে মনোরম বিছানায় পেটভরে খেয়ে আরামের যিন্দেগী অতিবাহিত করার পরও এবং আমাদের জন্য মানুষ ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছে, আমাদের চলার পথে ফুল বিছিয়ে দিচ্ছে তবুও এ মোবারক সুন্নাতের উপর আমল করা থেকে অর্থাৎ দা’ওয়াতে খায়র তথা কল্যাণের পথে আহ্বান করার জন্য রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, দোকানে, অফিসে এমনকি প্রতিটি ঘর এবং প্রতিটি মানুষের নিকট যাওয়া থেকে দূরে সরে আছি। একবার কি ভেবে দেখেছি, নবী প্রেমের আমার এ দাবী কতটুকু যুক্তিযুক্ত, যে গুনাহগার উম্মতের জন্য মহান নবী কেঁদে যাচ্ছেন, এত কষ্ট স্বীকার করেছেন, তাদের বে-আমলীর অবস্থা দেখে আমার চোখে অশ্র“ বের না হওয়া, তাদের সংশোধনের জন্য রাস্তায় বের না হয়ে হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকলে ক্বিয়ামতের দিন হায়াতুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সম্মুখে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবো। সুতরাং আসুন উম্মতে রসূলের হিতাকাক্সক্ষী হয়ে দা’ওয়াতে খায়র’র দাওরায় নেমে পড়ি। আজকে আমরা কয়েকটি মিনিট এ কাজে ব্যয় করছি না অথচ যাঁরা সত্যিকারের ‘আশিক্বে রসূল ও ‘আশিক্বে মুর্শিদ ছিলেন তাঁরা নিজ জন্মভূমি পর্যন্ত ত্যাগ করেছেন, বছরের পর বছর প্রবাসে থেকেছেন এ মহান দায়িত্ব পালন করার জন্য। তাঁদের এ ক্বোরবানীর বদৌলতে আজ আমরা সুন্নী মুসলমান। একজন আওলাদে রাসূলের জীবনের একটি অধ্যায়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে তাঁর জীবনের ১৬ টি বছর মানুষের কল্যাণে সুদূর পাকিস্তান থেকে মিয়ানমারে গিয়ে অতিবাহিত করেছেন। ইতোমধ্যে তাঁর সন্তান ও প্রিয় মুরর্শিদ ওয়াফাত লাভ করেছেন তবুও তিনি দেশে ফিরতে পারেননি, কেবল মুর্শিদে করীমের নির্দেশ প্রতিপালনের মাধ্যমে আল্লাহ্ ও রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনকে সামনে রেখে মানুষকে নেকীর পথে, সুন্দর ও সত্যের দিকে আহ্বান করার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। যার প্রতিফল হিসেবে আল্লাহ্ পাক তাঁকে মাদারজাত ওলী সন্তান হুযূর আল্লামা হাফিজ ক্বারী সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে দান করলেন।
(চলবে)
লেখক: প্রধান মুয়াল্লিম- গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পরিষদ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন