দরসে কোরআন



 অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
___________________

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَسْتَغْفَرْتَ لَهُمْ أَمْ لَمْ تَسْتَغْفِرْ لَهُمْ لَنْ يَغْفِرَ اللهُ لَهُمْ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ- هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ حَتَّى يَنْفَضُّوا وَلِلّهِ خَزَائِنُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ- يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ وَلِهُِخ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ-
তরজমাঃ (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) তাদের জন্য (অর্থাৎ মুনাফিকদের জন্য) এক সমান, আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন অথবা নাই করুন আল্লাহ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিকদেরকে সৎপথ প্রদান করেন না। তারাই, (অর্থাৎ মুনাফিকরাই) যারা বলে, তাদের জন্য ব্যয় করো না, যারা আল্লাহর রাসূলের নিকট রয়েছে, যতক্ষণ না তারা পেরেশান হয়ে যায়। এবং আল্লাহরই (মালিকানাধীন) নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের ধনভান্ডারসমূহ। কিন্তু মুনাফিকদের বোধশক্তি নেই। তারা বলে, আমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে অবশ্য যে বড় সম্মানিত সে সেখান থেকে তাকেই বের করে দেবে যে অধিক লাঞ্চিত। আর সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও মুমিনদের জন্যই। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। [৬-৮ নং আয়াত, সূরা আল মুনাফিকুন]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
هُمُ الَّذِينَ يَقُولُونَ لَا تُنْفِقُوا عَلَى مَنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ الخ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন বনি মুস্তালিক যুদ্ধ শেষে মুরাইসী কূপের নিকট সমবেত থাকাবস্থায় হযরত জাহ্জাহ্ বিন সাঈদ মুহাজির ও সিনান বিন ওবরা আনছারী রা. এর মধ্যে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ বিন উবাই বিন সলূল এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আনসারদেরকে মুহাজিরদের বিরূদ্ধে উত্তেজিত করার অসুদুদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বলল তোমরা মুহাজিরদেরকে দেশে ডেকে এনে মাথায় চড়িয়েছ, নিজেদের ধন-সম্পদ ও সহায়-সম্পত্তি তাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছ। তারা তোমাদের রুটি খেয়ে লালিত হয়ে এখন তোমাদেরই ঘাড় মটকাচ্ছে। যদি তোমাদের এখনও জ্ঞান ফিরে না আসে তবে পরিণামে এরা তোমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। কাজেই তোমরা ভবিষ্যতে টাকা-পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করো না। এতে তারা আপনা-আপনি ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যাবে। (নাউজুবিল্লাহ)
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলূল এর এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য খন্ডনে উপরোক্ত আয়াত নাযিল করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করলেন, অজ্ঞ-নির্বোধেরা মনে করে মুহাজিরগণ তাদের দান-খায়রাতের মুখাপেক্ষী এবং ওরাই তাদের অন্ন যোগায়। এসব মূর্খরা জানে না যে, সমগ্র নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের ধনভান্ডারসমূহ আল্লাহরই মালিকানাধীন। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকার মালিক একমাত্র আল্লাহ। যেমন, কুরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে, وما من دابة فى الارض الا على الله رزقها- অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠে বিচরণকারী প্রাণীকুলের রিজিক আল্লাহই দান করেন। কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর উপর কোন প্রাণীর রিজিক নির্ভরশীল নয়। সুতরাং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইচ্ছা করলে মুনাফিকদের কোনরূপ সাহায্য-সহায়তা ব্যতিরেকে মুহাজিরগণকে সব কিছু দান করে সম্পদশালী করতে পারেন। কেননা, মহান আল্লাহ সর্ব বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতাবান। সবকিছুর সার্বভৌম ও চিরস্থায়ী একচ্ছত্র মালিক। কিন্তু মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সঙ্গী-সহচররা নিজেদের চরম নির্বুদ্ধিতা ও বোকামীর কারণে তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। যেমন আলোচ্য আয়াতের শেষাংষে এরশাদ হয়েছে, وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَفْقَهُونَ অর্থাৎ কিন্তু মুনাফিকরা এ সত্য অনুধাবন করতে পারে না। কেননা মুনাফিকরা প্রকাশ্যে কলমা পড়ুয়া ও মুসলমানী বেশ-ভুষা পরিহিত অবস্থায় সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে অবস্থান করলেও প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ-রাসূলের উপর তাদের ঈমান নেই। তারা সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও যুদ্ধলব্দ সম্পদ গনিমতের লোভে কিংবা নিজেদের জীবন-জীবিকাকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করার স্বার্থে। দ্বীনের প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে নয়। যেহেতু তাদের অন্তরে দ্বীন নেই। গোপনে কিংবা রাতের আধারে তারা কাফের-মুশরিকদের সঙ্গে উঠাবসা করে। ঈমান-আক্বিদার মূল কেন্দ্রস্থল হলো ক্বলব বা অন্তঃকরণ। এতে ঈমানের বীজ অংকুরীত না হলে প্রকাশ্যে দ্বীনদারী প্রদর্শনের কোনরূপ মূল্যায়ন আল্লাহর দরবারে হবে না। মুনাফিকদের জীবন পরিক্রমা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ الخ
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন, মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুল আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত বাণীর মাধ্যমে সে নিজেকে ও পবিত্র মদিনার আনসারগণকে সম্মানিত ও শক্তিশালী এবং এর বীপরীতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুহাজিরগণকে দূর্বল ও লাঞ্চিত বলে প্রকাশ করেছিল। সে মদিনার আনসারদেরকে উত্তেজিত করেছিল, যাতে তারা এই দূর্বল ও হেয় লোকদেরকে মদিনা থেকে বহিস্কার করে দেয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ করে ইবনে উবাই ইবনে সলুল এর কথা তারই দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যদি ইজ্জত ওয়ালারা হেয় লোকদেরকে বের করেই দেয়, তবে এর কুফল মুনাফিকদেরকেই ভোগ করতে হবে। কারণ, ইজ্জত তো আল্লহর, তাঁর রাসূলের এবং মুমিনদের প্রাপ্য। সুতরাং আল্লাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুমিনগণই একমাত্র সম্মান ও শক্তিমত্তার অধিকারী বিধায় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলূলসহ মুনাফিকদেরকে মদিনা শরীফ থেকে বের করে দেয়া হলে তাদের দাবী অনুযায়ী তাহলে আল্লাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুমিনগকে কোনরূপ দোষারূপ করার যৌক্তিক সুযোগ থাকবে না। পবিত্র মদিনার সম্মানিত লোকেরা লাঞ্চিতদেরকে বহিস্কার করেছে। ঈমান-ইসলামের কারণে মুমিনরাই চির সম্মানিত ও মর্যদামন্ডিত। আর কুফর শিরক ও মুনাফিকীর অপবিত্রতায় মুনাফিক-মুশরিকরাই চির লাঞ্চিত-অপদস্থ।
আলোচ্য আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতিয়মান হয় যে, রাসূলে আকরাম নূরে মুজাস্সাম ইমামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম আওলিয়ায়ে কামেলীন এবং হক্কানী রব্বানী ওলামায়ে দ্বীনকে গালমন্দ করা কিংবা তাদের শানে অপমান অবমাননাকর মন্তব্য বা কটুক্তি করা শরীয়তের ফায়সালানুযায়ী কুফুরী এবং এটা মুনাফিকদেরই চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র। যেমন আলোচ্য আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী প্রমাণিত হয় মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলূল রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে লাঞ্চিত বলে অবমাননাকর কটুক্তি করেছে। তাছাড়া সূরা বাক¦ারা এর প্রারম্ভে,أنؤمن كما امن السفهاء অর্থাৎ আমরা কি ঈমান আনয়ন করবো যেমন নির্বোধেরা ঈমান আনয়ন করেছে। এখানেও মুনাফিকরা সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমকে নির্বোধ বলে গালমন্দ করেছে।
তাদের এহেন অবমাননাকর উক্তির জবাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেছেন,الا انهم هم السفهاء ولكن لا يعلمون অর্থাৎ নিঃসন্দেহে তারাই (অর্থাৎ মুনাফিকরাই) নির্বোধ। কিন্তু তারা জানে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রিয়নবির সঙ্গী-সহচর সাহাবায়ে কেরামকে নির্বোধ বলে গালাগালকারী মুনাফিকরাই নিঃসন্দেহে নির্বোধ। (নাউজুবিল্লাহ)
এছাড়া কুরআনে কারীমের বিভিন্ন সূরায় বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ মুনাফিকদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও লক্ষনাদি প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো আল্লাহর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এর প্রসঙ্গে অবমাননাকর মন্তব্য ও কটুক্তি করা। ইসলামী শরিয়তের ফায়সালা অনুযায়ী যা সুস্পষ্ট কুফুরী। (নাউজুবিল্লাহ)
যেমন তাফসীরে সাভীতে রয়েছে, من استخف بجنابه صلى الله عليه وسلم فهو كافر وملعون فى الدنيا والاخرة অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবি করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে সামান্য পরিমাণ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে সে কাফের এবং দুনিয়-আখেরাতে উভয় জাহানে অভিশপ্ত বলে গন্য হবে। (নাউজুবিল্লাহ)
আল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল্লাহ ওয়লাদের প্রতি সর্বোচ্চ আদব তাজীম ও সম্মান প্রদর্শনের নামই হলো ঈমান। আর তাদের প্রতি সমান্যতম অশ্রদ্ধা অভক্তি ও অবমাননা পোষণ করা কুফরী। যা সর্ব যুগের সকল বাতিল-ভ্রান্ত ফিরকা-গোষ্ঠির কমন বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ- কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।

http://www.anjumantrust.org


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন