ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান)


সপ্তম অধ্যায়ঃ সফরের উদ্দেশ্যে আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার যিয়ারত প্রসঙ্গঃ

বাতিল পন্থীগণের একটি ধোঁকাঃ ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল (ﷺ) কবর যিয়ারত নিষেধ করেছিলেন। পরে অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তিনি কাছে দূরে খাস করেননি। যেমন হযরত ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত রাসূল (ﷺ)বলেন,

كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا، فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْآخِرَةَ،ـ

-‘‘তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা নিশ্চয় তা পরকালের কথা মনে করিয়ে দেয়।"
🔺(আবদুর রায্যাক,আল-মুসান্নাফ, ৩/৫৬৯পৃ. হাদিস : ৬৭০৮, ইমাম তিরমিযী : আস সুনান : কিতাবুজ জানাইয : ২/৩৬১.পৃ, হাদিস ১০৫৪, আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৩/২৯পৃ. হাদিস : ১১৮০৪, মুসনাদে বায্যার, ১০/২৭১পৃ. হাদিস : ৪৩৭৩, সুনানে নাসাঈ, ৮/৩১০পৃ. হাদিস : ৫৬৫২, সহিহ ইবনে হিব্বান, ৩/২৬১পৃ. হাদিস : ৯৮১, তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ২/১৯পৃ. হাদিস : ১১৫২, নাসাঈ, সুনানে কোবরা, ৮/৫৪০পৃ. হাদিস : ১৭৪৮৬, সবাই উপরের হযরত বুরায়দা (رضي الله عنه) এর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ১/২১২পৃ. হাদিস, হাদিস :৩১২,সুনানে ইবনে মাযাহ, ১/৫০১পৃ. হাদিস : ১৫৭১, হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৩১পৃ. হাদিস : ১৩৮৭, নাসাঈ, সুনানে কোবরা, ৪/১২৯পৃ. হাদিস : ৭১৯৭,উপরের সবাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) এর সূত্রে। আবি শায়বাহ, আল-মুসান্নাফ, ৩/২৯পৃ.হাদিস :১১৮০৬, মুসনাদে আহমাদ, ২/৩৯৭পৃ. হাদিস : ১২৩৬, উপরের সবাই হযরত আলী (رضي الله عنه) এর সূত্রে। তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর, ২/৯৪পৃ. হাদিসঃ ১৪১৯, হযরত ছাওবান (رضي الله عنه) এর সূত্রে। হাকিম নিশাপুরী, আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৩২পৃ. হাদিসঃ ১৩৯৩, ও ১/৫৩২পৃ. হাদিসঃ ১৩৯৪, হযরত আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) এর সূত্রে, ইমাম মুসলিম : কিতাবুজ জানাইয : হাদিসঃ ১০৬)

 বর্তমানে এক শ্রেণীর নামধারী মুসলিম রয়েছেন যারা নিন্মের এ হাদিস দ্বারা সফরের উদ্দেশ্যে আওলিয়াদের মাযার যিয়ারতকে হারাম বলে থাকেন। হাদিসটি হল-

وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ: مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هَذَا

-‘‘তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন (মসজিদের) দিকে সফর করবে না। এ তিন মসজিদগুলো হলো বায়তুল্লাহ, বায়তুল মুকাদ্দিস ও আমার এ মসজিদ।’’(বুখারী, মুসলিম)
তারা বুঝাতে চান এ হাদিস থেকে বোঝা যায় এ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন দিকে সফর করা জায়েয নেই এবং কবর যিয়ারতের সফর এ তিনটির বাইরে বিধায় নাজায়েয। অথচ এ হাদিসের ভাবার্থ হচ্ছে এ তিন মসজিদে নামাযের ছওয়াব বেশী পাওয়া যায়। যেমন মসজিদ বায়তুল্লাহ এক নেকীর ছওয়াব অন্যান্য জায়গায় এক লাখের সমান (বুখারী) এবং বায়তুল মুকাদ্দাস ও মাদীনা পাকের মসজিদে এক নেকীর ছওয়াব পঞ্চাশ হাজারের সমান। (ইবনে মাযাহ) সুতরাং এসব মসজিদসমূহে এ নিয়তে দূর থেকে সফর করে আসা কল্যাণকর ও জায়েয। কিন্তু অন্য কোন মসজিদের দিকে একই নিয়তে সফর করা অনর্থক ও নাজায়েয। নাউযুবিল্লাহ!

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! কবর যিয়ারত মানুষ কোনো খারাপ উদ্দেশ্য করে না। ইমাম সান‘আনী (رحمة الله) বলেন-

وَمَقْصُودُ زِيَارَةِ الْقُبُورِ الدُّعَاءُ لَهُمْ وَالْإِحْسَانُ إلَيْهِمْ وَتَذَكُّرُ الْآخِرَةِ وَالزُّهْدُ فِي الدُّنْيَا

-‘‘কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হলো মৃতদের জন্য দু‘আ করা, তাদের সাথে সদাচরণ করা, পরকালের কথা স্মরণ করা ও দুনিয়ার প্রতি অনীহাবোধ জাগ্রত করা।’’
🔺(সানআনী, সবলুস সালাম,  ১/৫০৯পৃ.)

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) মিশ্কাত শরীফের অপর ব্যাখ্যা গ্রন্থ মিরকাতে এ হাদিস প্রসঙ্গে লিখেন-

وَفِي شَرْحِ مُسْلِمٍ لِلنَّوَوِيِّ قَالَ أَبُو مُحَمَّدٍ: يَحْرُمُ شَدُّ الرَّحْلِ إِلَى غَيْرِ الثَّلَاثَةِ وَهُوَ غَلَطٌ، وَفِي الْإِحْيَاءِ: ذَهَبَ بَعْضُ الْعُلَمَاءِ إِلَى الِاسْتِدْلَالِ بِهِ عَلَى الْمَنْعِ مِنَ الرِّحْلَةِ لِزِيَارَةِ الْمَشَاهِدِ وَقُبُورِ الْعُلَمَاءِ وَالصَّالِحِينَ، وَمَا تَبَيَّنَ فِي أَنَّ الْأَمْرَ كَذَلِكَ، بَلِ الزِّيَارَةُ مَأْمُورٌ بِهَا لِخَبَرِ: ( كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ أَلَا فَزُورُوهَا ) . وَالْحَدِيثُ إِنَّمَا وَرَدَ نَهْيًا عَنِ الشَّدِّ لِغَيْرِ الثَّلَاثَةِ مِنَ الْمَسَاجِدِ لِتَمَاثُلِهَا، بَلْ لَا بَلَدَ إِلَّا وَفِيهَا مَسْجِدٌ، فَلَا مَعْنَى لِلرِّحْلَةِ إِلَى مَسْجِدٍ آخَرَ، وَأَمَّا الْمَشَاهِدُ فَلَا تُسَاوِي بَلْ بَرَكَةُ زِيَارَتِهَا عَلَى قَدْرِ دَرَجَاتِهِمْ عِنْدَ اللَّهِ، ثُمَّ لَيْتَ شِعْرِي هَلْ يَمْنَعُ هَذَا الْقَائِلُ مِنْ شَدِّ الرَّحْلِ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ كَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَيَحْيَى، وَالْمَنْعُ مِنْ ذَلِكَ فِي غَايَةِ الْإِحَالَةِ، وَإِذَا جُوِّزَ ذَلِكَ لِقُبُورِ الْأَنْبِيَاءِ وَالْأَوْلِيَاءُ فِي مَعْنَاهُمْ، فَلَا يَبْعُدُ أَنْ يَكُونَ ذَلِكَ مِنْ أَغْرَاضِ الرِّحْلَةِ، كَمَا أَنَّ زِيَارَةَ الْعُلَمَاءِ فِي الْحَيَاةِ

-‘‘ইমাম নববী (رحمة الله) এর শরহে মুসলিমে বর্ণিত আছে-ইমাম আবু মুহাম্মদ (رحمة الله) বলেছেন যে, ওই তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য দিকে সফর করা হারাম। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। ইমাম গাযযালীর ‘ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দীন’ কিতাবে উল্লেখিত আছে “কতেক আলিম বরকতময় স্থানসমূহ ও উলামায়ে কিরামের মাযারে যিয়ারত উপলক্ষে সফর করাকে নিষেধ বলে। কিন্তু আমি যা বিশ্লেষণ করে পেয়েছি, তা এরকম নয় বরং কবর যিয়ারতের নির্দেশ আছে যেমন হাদীসে আছে أَلَا فَزُورُوهَا  (এখন থেকে যিয়ারত কর) ঐ তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে সফর করার থেকে নিষেধ এজন্য করা হয়েছে যে বাকী সব মসজিদ ফযীলতের দিক দিয়ে একই বরাবর। কিন্তু বরকতময় স্থানসমূহ একই বরাবর নয় বরং মর্তবা অনুযায়ী ওগুলোর বরকত ভিন্ন ভিন্ন। এসব নিষেধকারীরা কি নবীদের মাযার, যেমন হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) হযরত মুসা (عليه السلام) হযরত ইয়াহিয়া (عليه السلام) প্রমুখের মাযার যিয়ারত করা থেকে নিষেধ করতে পারবে কি? নিশ্চয়ই না, কারণ এটা অসম্ভব। আর আল্লাহর ওলীগণের বেলায়ও একই হুকুম প্রযোজ্য। সুতরাং বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে যদি ওনাদের সেখানে সফর করে যাওয়া হয়, যেমনি উলামায়ে কিরামের জীবদ্দশায় তঁাদের কাছে যাওয়া যায়, কি অসুবিধে আছে?।’’
🔺(মোল্লা আলী ক্বারী, মেরকাত, ২/৫৮৯পৃ. হাদিস নং.৬৯৩)।

+++++++
ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান)
গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ
মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর
প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম আযম রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ ০১৭২৩-৯৩৩৩৯৬

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন