ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান)


অষ্টম অধ্যায়

★গেয়ারভী শরীফের ইতিহাস★

★গেয়ারভী শরীফের ভিত্তি ও ইতিকথা ★

হাকীমুল উম্মত মুফতী আহ্মদ ইয়ার খান নঈমী গুজরাটী (رحمة الله) স্বীয় রচিত তাফসির- আহছানুত তাফসীর-(সংক্ষেপে তাফসীরে নঈমী) প্রথম পারা সুরা বাক্বারা ২৭ নম্বর আয়াত পৃষ্ঠা ২৯৭ তে হযরত আদম আলাইহিস সালামের তাওবা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে গেয়ারভী শরীফের ভিত্তি ও ইতিকথা লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানে তিনি প্রসিদ্ধ আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালামগণের গেয়ারভী শরীফ পালনের ইতিকথা বর্ণনা করেছেন। নিম্নে তা উদ্ধৃত করা হলোঃ

১. হযরত আদম আলাইহিস সালাম কতৃক গেয়ারভী শরীফ পালনঃ
 হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত বিবি হাওয়া আলাইহিস সালাম বেহেস্ত হতে দুনিয়াতে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর আল্লাহর সান্নিধ্য ও স্বর্গসুখ হতে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এবং নিজেদেও সামান্য ভুলের অনুশোচনায় তিনশত বৎসর একাধারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলে এবং তাওবা কারেছিলেন। তাঁদের প্রথম আমল ছিল অনুতাপ ও তাওবা। তাই আল্লাহর নিকট বান্দার তাওবা ও চোখের পানি অতি প্রিয়। তিনশত বৎসর পর আল্লাহর দয়া হলো। হযতর আদম আলাইহিস সালামের অন্তরে আল্লাহ তায়ালা কতিপয় তাওবার দোয়া গোপনে ঢেলে দিলেন। হযতর আদম আলাইহিস সালাম সে সব দোয়া করে অবশেষে আল্লাহর আরশে আল্লাহরই নামের পাশের্ব লিখা নাম “মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ” (ﷺ)- এর উছিলা ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। আল্লাহ্ এতে খুশী হয়ে হযতর আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা কবুল করলেন।
🔺(এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ ১ম খন্ডের ১০৫-১০৯ পর্যন্ত দেখুন)

ঐ দিনটি ছিল আশুরার দিন- অর্থাৎ মুহররমের ১০ তারিখ রোজ শুক্রবার। এ মহা বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম ঐ রাতে অর্থাৎ ১১ই রাতে তাওবা কবুল ও বিপদ মুক্তির শুকরিয়া স্বরূপ মুযদালিফার যে বিশেষ ইবাদত করেছিলেন- তারই নাম গেয়ারভী শরীফ।

২.হযরত নূহ আলাইহিসসালাম কতৃক গেয়ারভী শরীফ পালনঃ
 হযরত নূহ্ আলাইহিস সালাম মহা প্লাবনের সময় রজব মাসের ১০ তারিখ থেকে মুহররম মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত ছয় মাস ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কিস্তির মধ্যে ভাসমান ছিলেন। গাছ-গাছালী, পাহাড়-পর্বত সব কিছু ছিল পানির নীচে। অতঃপর আল্লাহর রহমতে ছয়মাস পর তার নৌকা জুদী পাহাড়ের চূড়ায় এসে ঠেকলো। পানি কমে গেলে তিনি দুনিয়ায় নেমে আসেন। ঐ তারিখটিও উপলক্ষে সকলকে নিয়ে ১১ই রাত্রে শুকরিয়া স্বরূপ ইবাদত করেছিলেন। এটা ছিল নূহ নবীর আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।


৩.হযতর ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফঃ
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে কোন রকমেই তার ইসলাম প্রচার থেকে বিরত করতে না পেরে এবং সকল বাহাছ-বিতর্কে পরাজিত ও নাস্তনাবুদ হয়ে অবশেষে জালেম বাদশাহ নমরূদ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করলো। চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাকে অগ্নিকুন্ডের মধ্যে রাখা হলো। আল্লাহর অসীম রহমতের আগুনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলো এবং অগ্নিকুন্ডে ফুল বাগিচার পরিণত হলো। চল্লিশ দিন পর যেদিন হযতর ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আগুন থেকে বের হয়ে আসলেন- সে দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি এই মহামুক্তির শুকরিয়া আদায় করলেন ১১ই রাত্রে। তাই এটা ছিল হযতর ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফ।

৪.হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
 হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম আপন প্রিয়তম পুত্র হযতর ইউসুফ আলাইহিস সালামকে হারিয়ে চল্লিশ বৎসর একাধারে কান্নারত ছিলেন। কুরআনে বর্ণিত বহু ঘটনার পর অবশেষে তিনি হারানো পুত্রকে ফিরে পেলেন এবং তার অন্ধ চক্ষু হযতর ইউসুফের জামার বরকতে ফিরে পেলেন। এই দীর্ঘ বিপদ মুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি ঐ রাত্রে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। এটা ছিল হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৫.হযতর আইউব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
 হযরত আইউব আলাইহিস সালাম আল্লাহর বিশেষ পরীক্ষা স্বরূপ দীর্ঘ আঠার বৎসর রোগমুক্তির দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি এই রোগমুক্তি ও ঈমানী পরীক্ষা পাশের শুকরিয়া স্বরূপ ১১ই রাত্রটি ইবাদতে কাটালেন। এটা ছিল হযতর আইউব আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৬.হযরত মুছা আলাইহিসসালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ 
 হযরত মুছা আলাইহিস সালাম ও বণী ইসরাঈলকে মিশরের অধিপতি ফেরাউন বহু কষ্ট দিয়েছিল। নবীর সাথে তার বেয়াদবী যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং তার খোদায়ী দাবীর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়, তখন আল্লাহর নির্দেশে হযতর মুছা আলাইহিস সালাম শিশুসহ ১২ লক্ষ বণী ইসরাঈলকে নিয়ে মিশর ত্যাগ করেন। সামনে নীল নদ। আল্লাহর নির্দেশে তার লাঠির আঘাতে নীলনদের পানি দ্বিখন্ডিত হয়ে দু’দিকে পাহাড়ের মত দেয়াল স্বরূপ দাঁড়িয়ে  যায় এবং ১২টি শুকনো রাস্তা হয়ে যায়। প্রত্যেক রাস্তা দিয়ে একলক্ষ লোক তড়িৎ গতিতে অতিক্রক করে নদীর অপর তীরে এশিয়া ভূ-খন্ডে প্রবেশ করে। ফেরাউন তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে দু’দিকের পাহাড়সম পানির আঘাতে স্বসৈন্যে ডুবে মরে। হযরত মুছা আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীসহ ১১ই রাত্র শুকরিয়া স্বরূপ আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকেন। এটা ছিল হযতর মুছা আলাইহিস সালামের গেয়ারভী শরীফ। নবী করিম (দ.) মদিনার ইহুদী জাতিকে আশুরার দিনে রোযা পালন করতে দেখেছেন। তাই উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আশুরার রোযা রাখা নফল করে দিয়েছেন।

৭. হযতর ইউনুছ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
হযতর ইউনুস আলাইহিস সালাম দীর্ঘ ৪০ দিন পর মাছের পেট থেকে মোসেলের নাইনিওয়া নামক স্তানে মুক্তি পেয়েছিলেন। সেদিনটিও ছিল আশুরার দিন। তাই তিনি ঐ রাত্রে খোদার শুক্রিয়া আদায় করেছিলেন খুব দুর্বল অবস্থায়। কাজেই এটা ছিল হযতর ইউনুছ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৮.হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
 হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম ১০০তম বৈধ বিবাহের কারণে আল্লাহর ইঙ্গিতে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে সিজদায় পড়ে তাওবা করেন। আল্লাহ তার তাওবা কবুল করে খুশি হয়ে যান। ঐ দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তাই তিনি ঐ রাত্রে শুকরিয়া আদায় করেন। এটা ছিল হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

৯. হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
হযতর সোলায়মান আলাইহিস সালাম একবার রাজ্য ও সিংহাসন হারা হয়েছিলেন। চল্লিশ দিন পর জ্বীন জাতি কতর্ৃক লুক্বায়িত তার হারানো আংটি ফেরত পেয়ে রাজ্য ও সিংহাসন উদ্ধার করেন এবং জ্বীন জাতিকে শাস্তি প্রদান করেন। সৌভাগ্যক্রমে ঐ রাত্রেই হারানো নেয়ামতটি ফেরত পাওয়ার শুকরিয়া আদায় করেন। এটা ছিল হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

১০.হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফঃ
 হযতর ঈসা আলাইহিস সালামকে ইহুদী জাতি কখনও বরদাস্ত করতে পারেনি। ইহুদী রাজা হেরোডেটাস গুপ্তচর মারফত হযতর ইসা আলাইহিস সালামকে গ্রেফতার করার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু আল্লাহ্ পাক ঈসা আলাইহিস সালাম কে জিব্রাইলের মাধ্যমে আকাশে তুলে নেন এবং ঐ গুপ্তচরের আকৃতি পরিবর্তন করে ঈসা আলাইহিস সালামের আকৃতির অনুরূপ করে দেন। অবশেষে ঈসা আলাইহিস সালাম এর শক্রই ধৃত হয়ে শুলে বিদ্ধ হয়। হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর আকাশে উত্তোলনের দিনটিও ছিল আশুরার দিন। তিনি মহাবিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে ঐ রাত্রে আকাশে খোদার শুকরিয়া আদায় করেন। এটাই হযতর ঈসা আলাইহিস সালাম এর গেয়ারভী শরীফ।

১১.সাইয়িদুল মুরসালিন  হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা  (ﷺ) এর গেয়ারভী শরীফঃ
নবী করিম রাউফুর রাহীম হযতর মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরীতে চৌদ্দশত সাহাবায়ে কেরামকে সাথে নিয়ে ওমরাহ্ করার উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ রওয়ানা দেন। কিন্তু মক্কার অদূরে হোদায়বিয়ার পৌঁছে মক্কার কুরাইশদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। ১৯ দিন পর অবশেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে তিনি সে বৎসর ওমরাহ্ না করেই মদিনার পথে ফিরতি যাত্রা করেন। সাহাবায়ে কেরাম এটাকে গ্লানী মনে করে মনক্ষুন্ন হলেও রাসুলে পাকের দির্দেশ নতশীরে মেনে নেন। মদিনার পথে কুরা গামীম নামক স্থানে পৌঁছে নবী করিম (ﷺ) বিশ্রামের জন্য তাবু ফেলেন। ঐখানে সুরা আল ফাতাহ্ এর প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। এতে মনক্ষুন্ন সাহাবায়ে কেরামকে শান্তনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীবকে লক্ষ্য করে বলেন- “হে রাসুল! আমি আপনার কারণেই হোদায়বিয়ার সন্ধিটিকে একটি মহান বিজয় হিসাবে দান করেছি। আপনার উছিলায়ই আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গুনাহ্ আল্লাহ্ মাফ করে দিবেন।”


যেদিন এই সুসংবাদবাহী আয়াত নাযিল হয়- সেদিনটিও ছিল মুহররম মাসের ১০ তারিখ। মহা বিজয় ও গুনাহ মাগফিরাতের সুসংবাদ শ্রবণ করে সাহাবায়ে কেরাম হোদায়বিয়ার চুক্তির প্রকৃত রহস্য বুঝতে পারেন। নবী করিম (ﷺ) এবং সাহাবায়ে কেরাম ঐ ১১ই রাত্র আল্লাহ্ তায়ালার শুক্রিয়া আদায় করে কাটিয়ে দেন। এটা ছিল হুযুর (ﷺ) এর গেয়ারভী শরীফ। এ ঘটনাগুলো বিভিন্ন তাফসীরে বিদ্যমান রয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে এখানেই ক্ষান্ত হলাম।
এখানে সর্বমোট ১১ জন নবীর গেয়ারভী শরীফের দলীল পেশ করা হলো। অন্যান্য নবীগণের ঘটনাবলী এবং কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাও ১০ই মুহররম তারিখে সংঘটিত হয়েছিল। গেয়ারভী শরীফের তাৎপর্যের সাথে সঙ্গতি রেখেই মাত্র ১১টি ঘটনার উল্লেখ করা হলো।

++++++++
ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান)
গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ
মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর
প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম আযম রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ।
মোবাইলঃ ০১৭২৩-৯৩৩৩৯৬

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন