জা’আল হক (প্রথমাংশ)


প্রথম অধ্যায়


ইলমে গায়বের প্রমাণ সম্বলিত বর্ণনাঃ-
-----------------

এ অধ্যায়টি ছয়টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা অদৃশ্য জ্ঞান প্রমাণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে বিভিন্ন হাদীছের দ্বারা উহার প্রমাণাদি উপস্থাপিত করা হয়েছে। তৃতীয় পরিচ্ছেদে হাদীছের ব্যাখ্যাকারকদের ব্যাখ্যা দ্বারা গায়বের সমর্থনে উলামায়ে উম্মত ও ফিকহ শাস্ত্রবিদদের উক্তিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। পঞ্চম পরিচ্ছেদে স্বয়ং অদৃশ্য জ্ঞানের অস্বীকারকারীদের রচিত গ্রন্থাবলী থেকে উহা প্রমাণ করা হয়েছে, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে যুক্তিগত প্রমাণাদি ও আওলিয়া কিরামের ইলমে গায়ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
-----------------------

প্রথম পরিচ্ছেদ


কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণঃ-




(১) وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ


-‘‘এবং আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত কিছুর নাম শিখিয়ে দিলেন। অতঃপর সে সমস্ত বস্তু ফিরিশতাদের কাছে উপস্থাপন করলেন।’’

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ৩১, পারাঃ ১}

   

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে-


وَمَعْنَى تَعْلِمِيهِ اَسْمَاءِ الْمُسَمِّيَاتِ اَنَّهُ تَعَالَى اَرَاهُ اَلاَجْنَاسَ الَّتِىْ خَلَقَهُا وَعَلَّمَهُ اَنَّ هَذَا اِسْمُهُ فَرَسٌُ وَهَذَا اِسْمُهُ بَعِيْرٌُ وَهَذَا اِسْهُمُ كَذَا، وَعَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ عَلَّمَهُ اِسْمَ كُلِّ شَئْىٍ حَتًّى الْقَصْعَةَ وَالْمَغْرَفَةَ


‘‘হযরত আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর নাম শিক্ষা দেয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর সৃষ্ট সব কিছুর দেখিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে এটার নাম ঘোড়া, এটার নাম উট এবং ওটার নাম অমুক। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে, তাঁকে প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছেন, এমন কি পেয়ালা ও কাঠের চামচের নাম পর্যন্ত।’’।

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/৪৫ পৃ.}


❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একই কথা বলা হয়েছে তবে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে-


وَقِيْلَ عَلَّمَ اَدَمَ اَسْمَاءَ الْمَلَئِكَة وَقِيْلَ اَسْمَاَءَ ذُرِّيَّتِهِ وَقِيْلَ عَلَمَّهُ اللَّغَاتَ كُلَّهَا


(কারো মতে আদম (عليه السلام) কে সমস্ত ফিরিশতাদের নাম, কারো মতে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নাম, আবার কারো মতে সমস্ত ভাষা শিখানো হয়েছিল)।

 (তাফসীরে খাযেনঃ ১/৪২ পৃ.)


❏উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরে লেখা হয়েছে,


قَوْلُهُ اَىْ عَلَّمَهُ صِفَاتَ الْاَشْيَاءِ وَنَعُوْتَهَا َ.... وَهُوَ الْمَشْهُورُ أَنَّ الْمُرَادَ أَسْمَاءُ كُلِّ مَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْ أَجْنَاسِ الْمُحْدَثَاتِ مِنْ جَمِيعِ اللُّغَاتِ الْمُخْتَلِفَةِ الَّتِي يَتَكَلَّمُ بِهَا وَلَدُ آدَمَ الْيَوْمَ مِنَ الْعَرَبِيَّةِ وَالْفَارِسِيَّةِ وَالرُّومِيَّةِ وَغَيْرِهَ


-‘‘আদম (عليه السلام) কে সমস্ত বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও অবস্থাদি শিক্ষা দিয়েছেন। একথাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, সৃষ্টবস্তু দ্বারা বোঝানো হয়েছে অচিরন্তন প্রত্যেক বস্তুর নাম সমূহ, যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত হবে ও যে নামগুলো আজ পর্যন্ত আদম সন্তান-সন্ততিগণ আরবী, ফার্সী, রুমী ইত্যাদি ভাষায় ব্যবহার করে আসছে।’’

{ইমাম রাজীঃ তাফসীরে তাফসীরে কাবীরঃ ১/৩৯৮পৃ. দারু ইহইয়াউত্-তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ.১৪২০হিজরী}


❏তাফসীরে আবু সাউদে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,


وَقِيْلَ اَسْمَاءَ مَاكَانَ وَمَا يَكُوْنُ وَقِيْلَ اَسْمَاءِ خَلْقِهِ مِنَ الْمَعْقُوْلاَتِ وَالْمَحْسُوَسَاتِ وَالْمُتَخَيَّلاَتِ وَالْمُوْهُوْمَاتِ وَاَلْهَمَهُ مَعْرَفَةَ ذَوَاتِ الاْشَيْآَءِ وَاَسْمَاءِ هَاخَوَاصَهَا وَمَعَارِفَهَا اُصُوْلَ الْعِلْمِ وَقَوَانِيْنَ الصَّنْعَاتِ وَتَفَاصِيْلَ اَلاَتِهَا وَكَيْفِيَّةً اِسْتِعْمَالَاتِهَا


-‘‘কারো মতে আদম (عليه السلام) কে অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত বিষয়ের নাম শিখিয়েছেন। আর কেউ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে তাঁকে সমগ্র সৃষ্টির নাম শিখিয়েছিলেন। ইন্দ্রিয়াতীত, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য, কাল্পনিক ও খেয়ালী সবকিছুই শিক্ষা দিয়েছিলেন, সব কিছুর সত্ত্বা, নাম, বৈশিষ্ট্য, পরিচিত জ্ঞান বা বিদ্যার নিয়মাবলী, পেশা ও কারিগরী নীতিমালা এবং সংশি­ষ্ট যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জামের বিস্তারিত বর্ণনা ও সেগুলোর ব্যবহার প্রণালী আদম (عليه السلام) কে অবহিত করেছিলেন।’’

{.ইমাম আবুস সাউদঃ তাফসীরে আবুস সাউদঃ ১/৮৪ পৃ.}

   

❏তাফসীরে রুহুল বয়ানে আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,


وَعَلَّمَهُ اَحْوَالَهَا وَمَا يَتَعَلَّقَ بِهَا مَنَ الْمَنَافِعِ الدِّيْنِيَّةِ وَالدُّنْيَوِيَّةِ وَعَلَّمَ اَسْمَاءَ الْمَلاَ ئِكَةِ وَاَسْمَاءَ. ذُّرِّيَتِهِ وَاَسْمَاءَ الْحَيْوَانَاتِ وَالْجَمَادَاتَ وَصَنْعَةَ كُلَّ شَئِّىٍ وَاسْمَاِءَ الْمُدْنِ وَالْقُرَىَ وَاَسْمَاءَ الطَّيْرِ وَالشَّجَرِ وَمَا يَكُوْنُ وَاَسْمَاَءَ كُلِّ شَئِّى يَخْلُقَهَا اِلَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَاَسْمَاء الْمَطْعُوْمَاتِ وَاْلمَشْرُوْبَاتِ وَكُلِّ نَعِيْمِ فِى الجَنَّةِ وَاَسْمَاَءُ كُلِّ شَيِّئٍ وَفِى الْخَبْرِ عَلْمَهُ سَبْعَ مِاَئةِ اَلَّفِ لَغَاتٍ


-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) সমস্ত জিনিসের অবস্থাদি শিখিয়েছেন এবং এগুলোর অন্তর্নিহিত, ধর্মীয়, পার্থিব উপকারিতার কথা বলে দিয়েছেন। তাঁকে ফিরিশতাদের নাম, তাঁর বংশধর, জীব জন্তু ও প্রাণীবাচক বস্তু সমূহের নাম শিক্ষা দিয়েছেন, প্রত্যেক জিনিস তৈরী করার পদ্ধতি, সমস্ত শহর ও গ্রামের নাম, সমস্ত পাখী বৃক্ষরাজির নাম যা হয়েছে এবং যা হবে সবকিছুর নাম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি হবে, সবকিছুর নাম, যাবতীয় আহার্য দ্রব্য সামগ্রীর নাম, বেহেশতের প্রত্যেক নিয়ামতের নাম-মোট কথা প্রত্যেক কিছুর নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন। হাদীছ শরীফে আছে যে আদম (عليه السلام) কে সাত লাখ ভাষা শিখিয়েছেন।’’

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}


উপরোক্ত তাফসীর সমূহ থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, যা কিছু হয়েছে ও যা কিছু হবে, সমস্ত কিছুর সম্পূর্ণ জ্ঞান হযরত (আদম (عليه السلام) কে দান করা হয়েছে। তাঁকে বিভিন্ন ভাষাজ্ঞান দান করেছেন, বিভিন্ন জিনিসের উপকারিতা ও অপকারিতা, তৈরী করার পদ্ধতি, যন্ত্রপাতির ব্যবহার সবকিছু দেখিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাদের অঁাকা মওলা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জ্ঞান ভান্ডার দেখুন। সত্যি কথা এই যে হযরত আদম (عليه السلام) এর এ ব্যাপক জ্ঞান নবী করিম عليه السلام'র জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোটা তুল্য বা ময়দানের এক কণা সদৃশ।


❏শাইখ ইবনে আরবী তদ্বীয় “ফুতুহাতে মক্কীয়া” গ্রন্থে দশম অধ্যায়ে বলেছেন,


اَوَّلَ نَائِبٍ كَانَ لَهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَخَلِيْفَتُهُ اَدَمَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ


-‘‘হযরত (ﷺ)এর প্রথম খলীফা ও প্রতিনিধি হলেন হযরত আদম (عليه السلام)। এতে বোঝা গেল যে, হযরত আদম (عليه السلام) হলেন হুজুর (ﷺ) এর  খলীফা।’’


‘খলীফা’ হচ্ছেন তিনিই, যিনি আসল বা প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিতে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজ করেন। হুজুর (ﷺ) এর  জন্মের আগেকার সমস্ত নবী (عليه السلام) তাঁরই প্রতিনিধি ছিলেন। একথাটি মৌলভী কাসেম নানুতবী ছাহেবও তদীয় ‘তাহজীরুন নাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, যার বর্ণনা পরে করা হবে। এহলো প্রতিনিধির ব্যাপক জ্ঞানের অবস্থা।


❏ইমাম কাযী আয়াযের (রহমতুল্লাহে আলাইহে) এর ‘শিফা শরীফ’ এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘নাসিমুর রিয়াদ্ব’ এ উল্লে­খিত আছে,


اِنَّهَ عَلَيْهِ السَّلَامُ عُرِضَتُ عَلَيْهِ الْخَلَائِقِ مِن لَّدْنِ اَدَمَ اِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ فَعَرَ فَهُمْ كُلَّهُمْ كَمَا عَلَّمَ اَدَمَ الْاَسْمَاءَ كُلَّهَا


-‘‘হযরত আদম (عليه السلام) থেকে আরম্ভ করে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তার বংশজাত আওলাদকে হুজুর (ﷺ) এর  সম্মুখে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) তাঁদের সবাইকে চিনেছিলেন, যেমনিভাবে হযরত আদম (عليه السلام) কে সবকিছুর নাম শিখানো হয়েছিল।’’

{ইমাম শিহাবুদ্দীন খিফ্ফাজীঃ নাসিমুর রিয়াদ্ধঃ ২/২০৮ পৃ.}   


❏এ ভাষ্য থেকে বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সবাইকে জানেন, সকলকে চিনেন।



(২) وَيَكُوْنَ الرَّسُوْلَ عَلَيْكُمْ شَهِيْدًا


-‘‘এ রসূল তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সাক্ষী হবেন।’’

{সূরাঃ বাকারাঃ আয়াতঃ ১৪৩, পারাঃ ২}

   

❏এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘তাফসীরে আযীযীতে’ লিখা হয়েছে,

رسول عليه السلام مطلع است بنور نبوت بردين هر متدين بدين خود كه در كدام درجه از دين من رسيده وحقيقت ايمان اوچيست وحجابے كه بداں ازترقى محجوب مانده است كدام است چس ادمى شناسد گناهان شمارا ودرجات ايمان شمارا واعمال بدونيك شمارا واخلاق ونفاق شمارا لهذا شهادت اودردنيا بحكم شرع درحق امت مقبول واجب العمل است


-‘‘হুজুর (ﷺ) স্বীয় নবুয়তের আলোতে প্রত্যেক ধর্ম পরায়ন ব্যক্তির ধর্মের অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। কোন ব্যক্তি ধর্মের কোন স্তরে পৌঁছেছেন, তার ঈমানের হাকীকত কি এবং তাঁর পরলৌকিক উন্নতির পথে

অন্তরায় কি, এসব কিছুই তিনি জানেন। সুতরাং, হুজুর (ﷺ) তোমাদের পাপরাশি, তোমাদের ঈমানের স্তরসমূহ, তোমাদের ভালমন্দ কার্যাবলী এবং তোমাদের বিশুদ্ধ চিত্ততা ও কপটতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। এ জন্যই তো পৃথিবীতে উম্মতের পক্ষে বা বিপক্ষে তার সাক্ষ্য শরীয়তের বিধানমতে গ্রহণীয় এবং অব্যশ্য পালনীয়।’’

{শায়খ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভীঃ তাফসীরে আযিযীঃ ১/৫১৮ পৃ.}

❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


هَذَا مَبْنِىَّ عَلَى تَضْمِيْنِ الشَّهِيَدِ مَعْنَىِ الرَّقِيْبِ وَالْمَطَلِّعِ وَالْوَجْهُ فِىْ اِعْتِبَارِ تَضْمِيْنِ الشَّهِيْدِ الْاِشَارَةُ اِلَى اَنَّ التَّعْدِيْلَ وَالتَّزْكِيَةَ اِنَّمَا يَكُوْنَ عَنْ خُبْرَةٍ وَمَرَ اقَبَةٍ بِحّالِ الشَّاهِدِ وَمَعْنَى شَهَادَةِ الرَّسُوْلِ عَلَيْهِمْ اِطَّلاَعُهَ رُتُبَةَ كُلِّ مُتَدَيْنٍ بَدِيْنِهِ فَهُوَ يَعْرِفُ دَنَوْبَهُمْ وَحَقِيْقَةَ اِيْمَانِهِمْ وَاَعْمَالِهُمْ وَحَسَنَاتِهِمْ وَسَيِّئاَتِهِمْ وَاِخْلَاصِهُمْ وِنِفَاقِهُمْ وَغَيْرِ ذَالِكَ بِنُوْرِ الْحَقِّ وَاُمَّتَهُ يَعْرِ فُوْنَ ذَالِكَ مِنْ سَائِرِ الْاُمَمِ بِنُوْرِهِ عَلَيْهِ السَّلَامُ


-‘‘এটা এ কারণেই যে, আয়াতে উল্লে­খিত (شهيد) শব্দটি রক্ষণাবেক্ষণকারী ও ওয়াকিফহাল কথাটাও অন্তভুর্ক্ত করে এবং এ অর্থ দ্বারা একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে কোন ব্যক্তির যথার্থতা ও দূষণীয়তার সাক্ষ্য প্রদান তখনই সম্ভবপর হবে, যখনই সাক্ষী উক্ত ব্যক্তির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে সম্যকরূপে ওয়াকিফহাল হয়। হুজুর (ﷺ) এর  পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। সুতরাং, বোঝা যায় যে, হুজুর (ﷺ) মুসলমানদের গুণাহ সমূহ, তাদের ইসলামের হাকীকত, তাদের ভালমন্দ কার্যাবলী, তাদের আন্তরিকতা ও কপটতা ইত্যাদিকে সত্যের আলোর বদৌলতে অবলোকন করেন। হুজুর (ﷺ) এর  উম্মতের নিকটও তাঁর নুরের ওসীলায় অন্যান্য সমস্ত উম্মতগণের অবস্থাও কিয়ামতের ময়দানে সম্পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত।’’

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/১৩৬ পৃ.}

   

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


 ثُمَّ يُؤْتَى بِمَحَمَّدٍ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَيُسْئَلُهُ عَنْ حَالِ اُمَّتِهِ فَيُزْكِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِصِدْقِهِمْ


-‘‘অতঃপর কিয়ামতের দিন হুজুর (ﷺ)কে আহ্বান করা হবে। এরপর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন তিনি তাঁদের পবিত্রতা ও সত্যতার সাক্ষ্য দিবেন।’’

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৮৭ পৃ}


❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ ২য় পারার সূরায়ে বাকারার’ এ আয়াতের তাফসীরে লিখা হইয়াছে,


فَيُؤْ تَى بِمُحَمَّدٍ فَيُسْئَلُ عَنْ حَالِ أمَّتِهِ فَيُزَ كِّيْهِمْ وَيَشْهَدُ بِعَدَ الَتِهِمْ. وَيُزُ كِّيْهِمْ وَيَعْلَمُ بِعَدَا لَتِكُمْ


-‘‘অতঃপর হুযুর (সাল্লাল্লাহু عليه السلامকে) আহ্বান করা হবে, তাঁর উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তখন তিনি স্বীয় উম্মতের সাফাই বর্ণনা করবেন এবং তাদের ন্যায়পরায়ণ ও যথার্থ হওয়া সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন। সুতরাং হুজুর (ﷺ) আপনাদের যথার্থতা সম্পর্কে অবগত আছেন।’’

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১.৮৮ পৃ.}


এ আয়াত ও তাফসীর সমূহে এটাই বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরামের (عليه السلام) উম্মতগণ আল্লাহর দরবারে আরয করবে, হে আল্লাহ! আমাদের কাছে তোমার কোন নবী আগমন করেন নি।’ পক্ষান্তরে, ঐ সমস্ত উম্মতের নবীগণ আরয করবেন, ‘হে খোদা! আমরা তাদের কাছে গিয়েছি, তোমার নির্দেশাবলী তাদের কাছে পৌঁছিয়েছি, কিন্তু তারা গ্রহণ করেনি।’

আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নবীগণকে বলা হবে, ‘যেহেতু তোমরা বাদী, সেহেতু তোমাদের দাবীর সমর্থনে কোন সাক্ষী উপস্থাপন কর। তাঁরা তখন তাঁদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে হুজুর (ﷺ) এর  উম্মতকে পেশ করবেন। তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন ‘হে আল্লাহ! তোমার নবীগণ সত্যবাদী, তাঁরা তোমার নির্দেশাবলী স্ব স্ব উম্মতের কাছে পৌঁছিয়েছিলেন।


এখানে দুটি বিষয়ের তাৎপর্য বিশে­ষণ করা দরকার। প্রথমতঃ মুসলমানগণ সাক্ষ্য দেয়ার উপযুক্ত কিনা। (ফাসিক, ফাজির ও কাফিরদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। একমাত্র পরহেযগার মুসলমানদের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য।) দ্বিতীয়তঃ এ সমস্ত লোকগণ তাঁদের পূর্বেকার নবীগণের জামানা দেখেন নি। তবুও তারা কিভাবে সাক্ষ্য দিচ্ছেন? মুসলমানরা আরয করবেনঃ ‘হে খোদা! আমাদেরকে তোমার হাবীব মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন যে, আগেকার নবীগণ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। এটা শুনেই আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ তখন হুযুর লাইহিস সালামকে আহ্বান করা হবে।

তিনি (ﷺ) দুটি বিষয়ের সাক্ষ্য দিবেন। একটি হলো এ সমস্ত লোকগণ এমন পাপিষ্ট বা কাফির নয় যে তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। বরং তাঁরা পরহেযগার মুসলমান। অন্যটি হলো তিনি (ﷺ) বলবেন, হ্যাঁ, আমিই তাদেরকে বলেছিলাম যে, আগেকার নবীগণ নিজ নিজ উম্মতের কাছে খোদার ফরমান পৌঁছিয়েছিলেন। অতঃপর ঐ সব নবীগণের পক্ষে রায় দেয়া হবে।



এ বর্ণনা থেকে নিম্নোলে­খিত কয়েকটি বিষয় জানা গেলঃ-


একঃ- হুজুর (ﷺ) কিয়ামত পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে আগমণকারী মুসলমানদের ঈমান, আমল, রোযা, নামায ও নিয়ত সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত। নচেৎ তাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়া কিভাবে সম্ভব? কোন মুসলমানের অবস্থা তাঁর দৃষ্টি বহির্ভূত হতেই পারে না। হযরত নূহ (عليه السلام) তাঁর কওমের ভবিষ্যৎ বংশধরদের অবস্থা জেনে আবেদন করেছিলেন, ‘হে খোদা! এদের বংশোদ্ভূত লোকগণও পাপিষ্ট ও কাফির হবে। সুতরাং, তুমি তাদেরকে ডুবিয়ে দাও।’ হযরত খিযির (عليه السلام) যে শিশুটিকে হত্যা করেছিলেন, তার ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে অবগতি লাভ করে বুঝতে পেরেছিলেন যে, যদি সে জীবিত থাকে তবে অবাধ্য হবে। তাহলে হুজুর (ﷺ) এর  কাছে আরো অবস্থা কিভাবে গোপন থাকতে পারে?


দুইঃ- পূর্ববর্তী নবীগণ ও তাঁদের উম্মতগণের অবস্থা হুজুর (ﷺ) নূরে নবুওয়তের বদৌলতে অবলোকন করেছিলেন এবং তাঁর (ﷺ) সাক্ষ্যটা ছিল একজন প্রত্যক্ষদশর্ীয় সাক্ষ্য। যদি তাঁর (ﷺ) সাক্ষ্য শ্রুত বিষয়ের সাক্ষ্য হতো, তাহলে এ ধরনের সাক্ষ্য মুসলমানেরাতো আগেই দিয়েছে। শ্রুত বিষয়ে সাক্ষ্য গ্রহনের সর্বশেষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেয়া হয়।


তিনঃ- এ থেকে আরও বোঝা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা নবী যে সত্যবাদী, তা জানা সত্ত্বেও সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে রায় দেন। অনুরূপ যদি হুজুর (ﷺ), বিচার কার্য তদন্ত করেন এবং সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করেন, তখন এ কথা বলা যাবে না যে, হুজুর (ﷺ) সে বিষয়ে অবগত নন। দায়েরকৃত মুকাদ্দমায় এটাই নিয়ম।

(এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে হলে আমার রচিত কিতাব শানে হাবীবুর রহমান, দেখুন) এ সাক্ষ্যের উল্লেখ পরবর্তী আয়াতের মধ্যেও রয়েছে




(৩) وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيدًا


-‘‘হে মাহবুব (ﷺ) আমি আপনাকে এদের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে আনব।’’

{সূরা নিসাঃ আয়াতঃ ৪১, পারাঃ ৫}

   

❏‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের তাফসীরে উল্লে­খিত আছে,


لِاَنًَّ رُوْحَهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ شَاهِدٌُ عَلَى جَمِيْعِ الْاَرْوَاحِ وُالْقُلُوْبِ وَالنَّفُوْسِ بِقَوْلِهِ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَوَّلُ مَاخَلَقَ اللهُ نُوْرِىْ


-‘‘এটা এ কারণে যে, হুজুর (ﷺ) এর  রূহ মুবারক সমস্ত রূহ, দিল ও সত্ত্বা সমূহকে দেখতে পান। কেননা তিনিই বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তা হলো আমার নূর।’’

{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীরঃ ৮/৬৬ পৃ.}

   

❏এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে রূহুল বয়ানে আছে,


وَاعْلَمْ اَنَّهُ يُعْرَضُ عَلَى النَّبِىْ عَلَيْهِ السَّلاَمُ اَعْمَالُ اُمَّتِهِ غَدَوْةً وَعَشِيَّةً فَيَعْرِ فُهُمْ بِسِيْمَاهُمْ اَعْمَالَهُمْ فَلِذَالِكَ يَشْهَدُ عَلَيْهِمْ


-‘‘হুজুর (ﷺ) এর  কাছে তাঁর উম্মতের আমলসমূহ সকাল বিকাল পেশ হয়। তাই তিনি উম্মতকে তাদের চিহ্ন দৃষ্টে চিনেন ও তাদের কার্যাবলী সম্পর্কেও অবগত হন। এ জন্য তিনি (ﷺ) তাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিবেন।’’

 {আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}

     

❏‘তাফসীরে মাদারেকে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খ করা হয়েছেঃ


اَىْ شَاهِدًا عَلَى مَنْ اَمَنَ بِالْايِمَانِ وَعَلَى مَنْ كَفَرَ بِا لْكُفْرِ وَعَلَى مَنْ نَافَقَ بِالنِّفَاقِ


-‘‘হুজুর (ﷺ) মুমিনদের জন্য তাদের ঈমানের, কাফিরদের জন্য তাদের কুফরীর ও মুনাফিকদের জন্য তাদের মুনাফেকীর সাক্ষী।’’

{ইমাম নাসাফীঃ তাফসীরে মাদারিকঃ ১/২৫৩ পৃ.}

   

এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আদিকাল থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত লোকের কুফর, ঈমান, কপটতা আমল ইত্যাদি সব কিছুই জানেন। এ জন্যই তো তিনি সকলের জন্য সাক্ষী একেইতো বলে ‘ইলমে গায়ব’ বা অদৃশ্য জ্ঞান।



(৪) مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ


-‘‘কে সে, যে তার কাছে তার অনুমতি ব্যতীত সুপারিশ করবে? তিনি তাদের পূর্বাপর সবকিছুই জানেন।’’

{সূরাঃ বাকারা, আয়াতঃ ২৫৫}

 

❏‘তাফসীরে নিশাপুরীতে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে,


يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ اَوَّلِيَّاتِ اَلاَمْرِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ


-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগেকার অবস্থাাদি জানেন এবং সৃষ্টির পরে কিয়ামতের যে ভয়াবহ অবস্থাদি সংঘটিত হবে, তা’ও তিনি জানেন।’’

{ইমাম নিশাপুরীঃ তাফসীরে নিশাপুরীঃ প্রথম পারাঃ ২৫৫ নং আয়াত এর ব্যাখ্যা।}

   

এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীরে রূহুল বয়ানে ❏আছে,


يَعْلَمُ مُحَمَّدٌُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنَ الْاُمُوْرِ الْاَوَّلِيَّاتِ قَبْلَ الْخَلاَئِقِ وَمَا خَلفَهُمِ مِنْ اَحْوَالِ الْقِيَامَةِ وَفَزَعِ الْخَلَقِ وَغَضَبِ الرَّبِّ


-‘‘হুজুর (ﷺ) সৃষ্টির আগের অবস্থা জানেন। সৃষ্টির পূর্বাপর যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে অবগত। কিয়ামতের অবস্থা, সৃষ্টিকূলের ভয়ভীতি, আল্লাহর গজব ইত্যাদির প্রকৃতি সম্পর্কেও সম্যকরূপে অবগত।’’ 

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্বীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ১/৪৩ পৃ.}


এ আয়াত ও তাফসীর সমূহ দ্বারা বোঝা গেল যে, ‘আয়াতুল কুরসী’র মধ্যে مَنْ ذَالَّذِىْ থেকে اِلاَّ بِمَا شَآءَ পর্যন্ত হুজুর (ﷺ) এর  তিনটি গুণের কথাই বিধৃত হয়েছে। বাকী অবশিষ্ট গুণাবলী আল্লাহর সহিত সম্পৃক্ত। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট বিনা অনুমতিতে কেউ সুপারিশ করতে পারে না। যিনি সুপারিশ করার অনুমতি প্রাপ্ত, তিনি হলেন প্রিয় নবী হুজুর (ﷺ)। সুপারিশকারীকে পাপীগণের পরিণাম ও অবস্থা সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হতে হয়, যাতে অনুপযুক্তদের জন্য সুপারিশ করা না হয়, আর সুপারিশের উপযুক্ত ব্যক্তিগণ যেন সুপারিশ থেকে বঞ্চিত না হয়। যেমন কোন ডাক্তারের আরোগ্য ও দুরারোগ্য ব্যাধি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা একান্ত দরকার।


❏এ জন্য বলা হয়েছে,


يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ


যাকে আমি (আল্লাহ) সুপারিশকারী মোতায়েন করেছি, তাকে সব কিছুর জ্ঞানও দান করেছি, কেননা ‘শাফায়াতে ‘কুবরা’ বা সুমহান সুপারিশের জন্য অদৃশ্য জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।


এ থেকে বোঝা গেল যে, যারা বলে যে হুজুর (ﷺ) কিয়ামতের মাঠে মুনাফিকদেরকে চিনবেন না, বা হুজুর (ﷺ) নিজেই জানেন না তাঁর কি পরিণতি হবে; ইহা তাদের নিছক ভুল ধারণা ও ধর্মহীনতা মাত্র। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলোচনা হবে।


(৫) وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ


-‘‘তারা তাঁর জ্ঞান ভান্ডার থেকে কিছুই পায় না, তবে তিনি যতটুকু ইচ্ছে করেন।’’

{সূরাঃ বাক্বারা, আয়াতঃ ২৫৫}

   

❏‘তাফসীরে রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লে­খ আছে,


يَحْتَمِلُ اَنْ تَكُوْنَ الْهَاءُ كِنَايَةً عَنهُ عَلَيْهِ السَّلاَمُ يَعْنِىْ هُوَ شَاهِدٌُ عَلَى اَحْوَالِ هِمْ يَعْلَمُ مَابَيْنَ اَيْدِيْهِمْ مِنْ سِيَرِهِمْ وَمَعَا مَلاَ تِهِمْ وَقَصَصِهَمْ وَمَا خَلْفَهُمْ مِنْ اُمُوْرِ الْاَخِرَةِ وَاَحْوَالِ اَهْلِ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ وَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا مِّنْ مَعْلُوْمَاتِهِ اِلَّا بِمَاشَآءَ مِنْ مَعْلُوْ مَاتِهِ عِلْمُ الْاَوْلِيَاءِ مِنْ عِلْمِ ألْاَنْبِيَآَء بِمَنْزِ لَةِ قَطْرَةٍ مِنْ سَبْعَةِ اَبْحُرٍ وَعِلْمُ الْاَنْبِيَآءِ مِنْ عِلمِ نَبِيِّنَا عَلَيْهِ السَّلاَمُ بِهَذِهِ الْمَنْزِ لَةِ وَعِلْمُ نَبِيِّنَا مِنْ عِلْمِ الْحَقِّ سُبْحَانَهُ بِهَذَ الْمَنْزَِلَةِ فَكُلُّ رَسُوْلٍ وَنَبِىٍّ وَوَلِىِّ اَخِذُوْنَ بِقَدْرِ الْقَابِلِيًَّةِ وَالْاِسْتِعْدَادِ مِمَّا لِدَيْهِ وَلَيْسَ لِاَحَدٍانْ يَعْدُفْهُ اَوْيَتَقَدَّمَ عَلَيْهِ


-‘‘এও হতে পারে যে উক্ত আয়াতের عَلَيْهِ শব্দের هِ (‘হি’) সর্বনাম দ্বারা হুজুর (ﷺ) এর  প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) মানুষের অবস্থা অবলোকন করেন, তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের চরিত্র, তাদের আচরণ তাদের ঘটনা প্রবাহ ও তাদের বিগত অবস্থাও তিনি জানেন। পরকালের হাল-হাকিকত ও বেহেশতী জাহান্নামী লোকদের অবস্থা সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিফহাল। ওই সমস্ত লোক হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান ভান্ডারের কিছুই জানতে পারেন না, তবে ততটুকু জানতে পারেন, যতটুকু তিনি (ﷺ) চান। আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানের সামনে আল্লাহর ওলীগণের জ্ঞান হলো সাত সমুদ্রের এক ফোটার সমতুল্য, আর হুযুর আলাইহি সালামের জ্ঞানের সামনে অন্যান্য আম্বিয়া কিরামের (عليه السلام) জ্ঞানও তদ্রুপ। অতএব প্রত্যেক নবী, রসূল ও ওলী নিজ নিজ ধারণ ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুসারে হুজুর (ﷺ) এর  নিকট থেকে আহরণ করেন। হুজুর (ﷺ) কে ডিঙিয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।’’

{আল্লামা ইসমাঈল হাক্কীঃ তাফসীরে রুহুল বায়ানঃ ২/২৫৭ পৃ.}

   

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খিত আছে,


يَعْنِىْ اَنْ يَطَّلِعَهُمْ عَلَيْهِ وَهُمُ الْاَنْبِيَاءُ وَالرُّسُلُ وَلِيَكُوْنَ مَا يُطْلِعَهُمْ عَلْيِه مِنْ عِلْمِ غَيْبِهِ دَلِيْلاً عَلَى نَبُوَّتِهِمْ كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فَلاَ يُظْهِرْ عَلَى غَيْبِهِ اَحَدًا اِلَّامَنِ ارْتَضَى مَنَ رَّسُوْلٍ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা যাদেরকে তার জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত করেন, তাঁরা হচ্ছেন নবী ও রাসূল, যা’তে তাঁদের অদৃশ্য জ্ঞান নবুয়তের দলীলরূপে পরিগণিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন, তাঁর বিশেষ অদৃশ্য বিষয় কারও নিকট প্রকাশ করেন না, একমাত্র তাঁর সে রাসূলের নিকট প্রকাশ করেন, যাঁর উপর তিনি (আল্লাহ) সন্তুষ্ট।”

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/১৯০ পৃ.}


❏‘তাফসীরে মা’আলিমুত তানযীলে’ উক্ত আয়াতের প্রেক্ষাপটে উল্লে­খিত আছে,


يَعْنِىْ لاَ يُحِيْطُوْنَ بِشَئٍ مِنْ عِلْمِ الْغَيْبِ اِلاَّبِمَاشَآءَمِمَّا اَخْبَرَبِهِ اِلرُّسُلُ


-‘‘এ সকল লোক অদৃশ্য জ্ঞানকে বেষ্টন বা আয়ত্ত্ব করতে পারে না। শুধু ততটুকুই তারা লাভ করে, যতটুকু রাসূলগণ তাদের নিকট পরিবেশন করেছেন।’’

{ইমাম বগভীঃ মা’আলিমুত তানযীলঃ ১/২৩৯ পৃ.}

   

এ আয়াত ও ব্যাখ্যাসমূহ  থেকে এতটুকু বোঝা গেল যে, উল্লে­খিত আয়াতে হয়তো আল্লাহর জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞান কারো কাছে নেই, তবে তিনি যাকে জ্ঞানদানের ইচ্ছা করেন, তিনিই অদৃশ্য জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা নবীগণ (عليه السلام) কে ইলমে গায়ব দান করেছেন এবং তাঁদের ওসীলায় কোন কোন মুমিন বান্দাকেও দিয়েছেন। অতএব মুমিন বান্দাগণও খোদা প্রদত্ত ইলমে গায়ব লাভ করেছেন। কি পরিমাণ (ইলমে গায়ব) দেয়া হয়েছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সামনে করা হবে।


অথবা, উল্লে­খিত আয়াতে হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান কেউ লাভ করতে পারে না, অবশ্য তিনি যাকে দিতে চান, দান করেন। অতএব আদম (عليه السلام) থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যার যতটুকু জ্ঞান অর্জিত হয়েছে বা হবে, উহা হুজুর (ﷺ) এর  জ্ঞান সমূহের এক ফোটার সমতুল্য। যার মধ্যে হযরত আদম (عليه السلام), ফিরিশতা ও অন্যান্য সৃষ্ট জীবের জ্ঞানও অন্তভুর্ক্ত। হযরত আদম (عليه السلام) এর জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে عَلَّمَ اَدَمَ الْاَشْمَاءَ আয়াতে বিশদভাবে আলোচনা করেছি।





(৬) وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُطْلِعَكُمْ عَلَى الْغَيْبِ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَجْتَبِي مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يَشَاءُ


-‘‘হে সাধারণ লোকগণ, এটা আল্লাহর শান নয় যে তোমাদের ইলমে গায়ব দান করবেন। তবে হ্যাঁ, রাসূলগণের মধ্যে যাকে তিনি ইচ্ছা করেন, তাকে এ অদৃশ্য জ্ঞানদানের জন্য মনোনীত করেন।’’

{সূরাঃ আলে ইমরান, আয়াতঃ ১৭৯, পারাঃ ৪}

   

❏‘তাফসীরে বায়যাবী’তে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লে­খ করা হয়েছে,


وَمَاكَانَ اللهُ لِيُوْتِىَ اُحَدَكُمْ عِلْمَ الْغَيْبِ فَيَطَّلِعُ عَلَى مَافِىْ الْقُلُوْبِ مِنْ كُفْرٍ وَّاِيْمَانٍ وَلَكِنْ اللهَ يَجْتَبِىْ لِرَسَالَتِهِ مِنْ يَّشَاءُ فَيُوْحِىَ اللهُ وَيَخْبِرَهُ بِبَعْضِ الْمُغَيِّبَاتِ اَوْيُنْصِبُ لَهُ مَايَدُلُّ عَلَيْهِ


-‘‘আল্লাহ তা’আলা তোমাদের মধ্যে কাউকে এমন ইলমে গায়ব প্রদান করেন না, যাতে তোমরা ঈমান ও কুফর, যা মনে মনে পোষণ করা হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে। কিন্তু তিনি তাঁর রাসূলগণের মধ্যে যাঁদেরকে ইচ্ছে করেন, তাঁদেরকে মনোনীত করেন, তাঁদের উপর প্রত্যাদেশ করেন, তাঁদেরকেই আংশিক গায়ব সম্পর্কে অবহিত করেন, অথবা তাঁদের জন্য এমন কিছু প্রমাণাদি উপস্থাপন করেন, যা’ গায়বের পথ নির্দেশ করে থাকে।’’

{ইমাম কাজী নাসিরুদ্দীন বায়যাভীঃ তাফসীরে বায়যাভীঃ ১/৩০৮ পৃ.}

   

❏‘তাফসীরে খাযেনে’ আছে,


لَكِنَّ اللهَ يَصْطَفِىْ وَبَخْتَارُ مِنْ رُسُلِهِ مَنْ يُّشَاءُ فَيُطْلِعُهُ عَلَى بَعْضِ عِلْمِ الْغَيْبِ


-‘‘কিন্তু আল্লাহ তা’আলা রাসূলগণের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছে করেন মনোনীত করেন, আংশিক ইলমে গায়ব সম্পর্কে তাঁদেরকেই অবহিত করেন।’’

{ইমাম খাযেনঃ তাফসীরে খাযেনঃ ১/৩০৮ পৃ.}।

++++++++++++
জা’আল হক (প্রথমাংশ)

মূলঃ হযরাতুল আল্লামা আলহাজ্ব মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমতুল্লাহে আলাইহে

অনুবাদকঃ (শাহজাদা) মাওলানা মুহাম্মদ জহুরুল আলম ও মুহাম্মদ লুৎফুর রহমান।

তথ্য সংযােজনঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন