প্রশ্নঃ এই ঘটনার সাথে পরোক্ষভাবে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র নাম এসে যায়। হযরত আলী (رضي الله عنه)-র হাতে বাইয়াত গ্রহণ না করা এবং ইয়াজিদকে মসনদে বসানোর যেই কাজ, সেই কাজের সাথে সংশ্লিস্ট থাকার কারণে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সম্পর্কে সলফে সালেহীন এবং পরবর্তীতে উম্মতে মুহাম্মদীর সংখ্যাগরিস্ঠ আইম্মায়ে কিরামের অভিমত কি?
Answer: এই বিষয়টি একটা সেটেল্ড বিষয়। এই বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ফতওয়া দেওয়ার, চিন্তা করার বা কথা বলার কোন সুযোগ নেই। কারণ এটার উপর মসলমানদের মেইন স্ট্রীম আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের উছুলুদ্দীন বা আকীদা, তাফছীর, হাদীছ ও ফিকাহ্-র আয়িম্মায়ে কেরামের ইজমা বা কনসেনসাস বা ঐক্যমত্য রয়েছে। সুতারং অন্য কথা বলা মানেই হচ্ছে মেইন স্ট্রীম বা আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাত থেকে সটকে পড়া।
হযরত আলী (رضي الله عنه)-র উপর খেলাফতের দায়িত্বভার অর্পণের পর হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কতৃক বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো যা পরবর্তীতে 'সিফফিনের' যুদ্ধে রূপ নেয়- এই মুশাজারাহ্ বা কনফ্লিকশন বা দ্বন্দ্বে আয়িম্মায়ে উম্নতের অভিমত হচ্ছে-
"হযরত আলী (رضي الله عنه) 'হক্ব' তথা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। উনিই লেজিটিমেট খলিফা ছিলেন এবং তাঁর দাবীই ন্যয়নিষ্ট ছিল। এই ক্ষেত্রে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা বিদ্রোহ ছিল এবং উনার দাবী অসমিচীন ছিল। তবে এই কারণে তাকে ফাছেক বা কাফের বলা যাবেনা, নিন্দা বা তিরস্কার করা যাবেনা এবং সমালোচনা করা যাবেনা। কারণ উনি একজন সম্মানিত সাহাবী। আর সাহাবীরা 'আদূল' বা ন্যয়নিস্ট বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে। বিশেষ করে উনার সাহাবী হওয়ার কারণে এবং সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও গলমন্দের উপর হুযুর করীম (ﷺ) এর নিষেধাজ্ঞার কারণে মুসলমানরা উনার মাধ্যমে সংঘঠিত বিষয় গুলিকে ইজতিহাদগত ভুল মনে করে এই বিষয়ে চুপ থাকবে"। কিন্তু এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, 'হক্ব' এর উপর হযরত আলীই (رضي الله عنه) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
আমি উপরে যেই অভিমতটা উল্লেখ করেছি তা গত হাজার, বারশ বছরে উম্মতে মুসলিমার আকিদার, হাদীছের এবং ফিকাহর ইমামদের লিখিত কিতাব থেকেই উল্লেখ করেছি। কেউই এই বিষয়ে ব্যতিক্রম বলেননি। আমি উদাহরণ স্বরূপ এই তিন বিষয়ের (আকিদা, হাদীছ ও ফিকহ্) তিনটি সর্বজনগৃহিত কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি দিবালোকের ন্যয় স্পষ্ট হয়ে যাবে । সুতরাং এই বিষয়ে অতিরিক্ত স্মার্ট ও আহলে বাইতের প্রেমিক সাজতে গিয়ে শিয়া ইজমের বেশ ধরার যেমন কোন সুযোগ নেই, ঠিক তেমনিভাবে নিজেকে অতিমাত্রায় সুন্নি প্রমাণ করতে গিয়ে মুহাররম মাসে হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র ওরছ করা, আহলে বাইতে রাছুল (ﷺ) ও শোহাদায়ে কারবালা বিষয়ক মাহফিলে অনুৎসাহিতবোধ করা ও হযরত আলী (رضي الله عنه) ও হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) এনে এক কাতারে দাড় করিয়ে দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই।
একঃ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (رضي الله عنه) উনার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব 'ফতহুল বারীতে' (যা সহিহ্ বোখারি শরিফের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং নির্ভরযোগ্য ব্যখ্যাগ্রন্হ) হুযুর (ﷺ) এর হাদীছ যাতে তিনি (ﷺ) হযরত আম্মার বিন ইয়াছের (رضي الله عنه)-র ব্যাপারে ভবিষ্যতবাণী করে বলেছিলেন যে, "হযরত আম্মার বিন ইয়াছের (رضي الله عنه) বিদ্রোহীদের হাতে শহীদ হবেন" (সহিহ্ বোখারি ও মুসলিম শরিফ-এ বর্ণিত এবং উনি পরবর্তীতে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র সৈন্যবাহিনীর হাতে শাহাদাত বরন করেন) এর ব্যখ্যায় বলেন: "ওয়াকাদ ছাবাতা আন্না মান কাতালা আলিয়্যান কানু বুগাত" অর্থাত্: এটা স্পষ্ট যে, যারা হযরত আলী (رضي الله عنه)-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তারা বিদ্রোহী ছিলেন। তবে এই কারণে তাদের 'ঝম' তথা তিরস্কার বা নিন্দা করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদগত ভুল বলে বিবেচ্য হবে"। এরপর উনি বলেনঃ "ওয়া ইয়াকফি লিইছবাতে ঝালিকা আল-হাদীছ আল-ছাহীহ্ আল্লাঝি রাওয়াহুল বোখারীয়্যু" অর্থাত: এটা যে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল তা বুঝার জন্য বোখারী শরিফের এই হাদীছ-ই যথেষ্ট। অর্থাত স্বয়ং রাছুল কারীম (ﷺ)-ই বলেছেন "আল ফিয়াতুল বাগিয়াহ্" বা বিদ্রোহী দল"।
ঠিক এই স্টাইলেই এই বিষয়ক বর্ণনা এসেছে ইমাম বদরুদ্দীন আইনি কৃত সহিহ্ বোখারীর শরাহ্ 'ওমদাতুল কারীতে' এবং মৌল্লা আলী কৃত মিশকাত শরীফের ব্যখ্যাগ্রন্হ 'মিরকাতে'। বরং মোল্লা আলী কারী বলেছেন: "বিআন্নাল লাঝীনা কাতালূহু বুগাতুন ঝালেমুনা লাহূ" (এই অনুবাদ সাধারণ মানুষের অন্তরে বে-আদবির জন্ম দেবে বিধায় বিরত রইলাম)
দুইঃ ইলমে উসুলিদ্দীনের উপর লিখিত সকল যুগের কিতাবেও ঠিক এটাই বর্ণিত হয়েছে। আমি শুধু দুটি স্বনামধন্য কিতাবের উদ্বৃতি এখানে উল্লেখ করব। একটা মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বহুল পঠিত।
-ইমাম আবুল মুঈন আন নছফি আল হানাফি উনার বিখ্যাত কিতাব "তাবছেরাতুল আদিল্লাহ্" তে উল্লেখ করেন যে, এটা হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র 'বাগাওয়াত' বা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনার কোনরূপ সমালোচনা করা যাবেনা। উনি এই বিষয়ে আরো বলেন যে, উভয়ের মধ্যে ফজিলতের ক্ষেত্রে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র মকাম ও মরতবা অনেক উপরে।
- ইমাম তাফতাঝানি শরহুল মাকাসিদে বলেনঃ "ফাল মুসীবু আলী, ওয়াল মুখালিফুনা বুগাত" অর্থাত্: হযরত আলী (رضي الله عنه) সত্যের উপর ছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরন যারা করেছেন তারা বিদ্রোহী ছিলেন। তবে এই কারণে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে কাফের, ফাছেক বলা যাবে না, যা শিয়া মুর্খরা করে থাকে।
মোদ্দা কথা আকিদার যেই কিতাবই আপনি পড়েন না কেন তাতে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে,
- হযরত আলী (رضي الله عنه) সত্যের উপর ছিলেন
-হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা 'বাগাওয়াত' বা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনাকে কাফের, ফাছেক বলা যাবেনা, তার নিন্দা করা যাবেনা, সমালোচনা করা যাবেনা, অভিসম্পাত করা যাবেনা এবং গালি-গালাজ করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদী ভুল বিবেচিত হবে। কারণ উনি সাহাবিয়ে রাছুল (ﷺ) আর সাহাবীরা 'আদূল' বা (ন্যয়নিস্ট) বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে।
তিন: এবার ফিকাহ্-র কিতাবে দেখব এই বিষয়ে কি বলা হয়েছে। ফিকাহ্ এর কিতাব সমুহের মধ্যে একটা অধ্যায় আছে- "আদাবুল কাজী" যা প্রধান বিচারপতির শিস্টাচার বিষয়ক। এই অধ্যায়ে আলোচিত বিষয় সমুহের মধ্যে একটি হচ্ছে- যদি কেউ অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করে তবে তার পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলে ঐ ব্যক্তির জন্য পোস্টটা গ্রহণ করা বা না করা এবং তার তাকলীদ করা আর না করা বিষয়ক।
এই বিষয়ে সকল কিতাবের ভাষার গঠন এবং ধরন অনেকটাই একইরকম। তবে এখানে আমরা শুধুমাত্র হিদায়ার উদ্বৃতি উল্লেখ করব। কারণ হিদায়া ফিকাহর অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব যা সকল মাদ্রাসাই অনার্স ও মাস্টার্স লেভেলে পড়ানো হয়। তাছাড়া এই কিতাবটি আরো তিনটি উল্লেখযোগ্য কিতাবকে নীজের মধ্যে ধারন করে: বিদায়াতুল মুবতাদী, কুদূরী, আল জামে' আল ছাগীর। ইমাম মরগেনানী হিদায়াতে উল্লেখ করেন: "ইয়াজুঝুত তাকলীদ মিনাছ ছুলতানিল জাঈর কামা ইয়াজুঝু মিনাল আদেল। লিআন্নাস সাহাবাতা তাকাল্লাদূহু মিন মুয়াবিয়াতা ওয়াল হাক্বু কানা বিইয়াদে আলিয়্য়িন ফি নাওবাতিহী। ওয়াত তাবেঈনা তাকাল্লাদূহু মিনাল হাজ্জাজ ওয়া কানা জাইরান"। অর্থাত শাসক গোষ্ঠী যদি অন্যায়ভাবেও ক্ষমতায় আসীন হয় তবুও কাজী বা প্রধান বিচারপতির তাকলীদ বৈধ। যেমন হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র সময়কালে সাহাবায়ে কেরামের তার তাকলীদ করেছেন। অথচ হক্বের উপর হযরত আলী (رضي الله عنه)-ই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাবেঈনগন অত্যাচারী হাজ্জাজেরটা মেনেছেন"।
সকল ফিকাহর কিতাবে ইমামগণ এই বিষয়ে (অর্থাত কেউ যদি অসমীচিন উপায়ে ক্ষমতা দখল করে তবে তার পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতির তাকলীদ প্রসঙ্গে)
সাহাবায়ে কেরামের সময়কালীন উদাহরণ দিতে গিয়ে হযরত আমীর মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র কথা উল্লেখ করেন।
সুতরাং এই বিষয়টা নিয়ে পানি ঘোলা করার কোন সুযোগ নেয়। এই ধরনের কথা বলা মুর্খতা ও বেঈমানি হবে যে, দুইজনই সাহাবীয়ে রাছুল (ﷺ)। জানিনা কে হক্বের উপর ছিলেন আর কে ছিলেন না। এই কথা চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে কেউ বলেননি। আর দুজনই সাহাবী, তবে তারা দুজন একই স্টেটাসের না। ফজিলতের দিক থেকে হযরত আলী (رضي الله عنه)-র মকাম অনেক উপরে। যেভাবে আম্বিয়ায়ে কিরাম সকলে একই স্টেটাসের না। ফজিলরের দিক থেকে কারো কারো অবস্থান অন্য নবীর তুলনায় অনেক উপরে।
পরিশেষে বলব আহলে বাইতে রাছুল (ﷺ) কে সম্মান করতে গিয়ে হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) সহ কোন সাহাবির নিন্দা করা শিয়াইজম। দুইজনকে মন্দ বলা 'খারিজিয়্যত'। হযরত আলীর (رضي الله عنه) প্রতি ছাপা ক্ষোভ বা হালকা মনোভাব পোষন করে হযরত আমির মুয়াবিয়া (رضي الله عنه) কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া এবং সমানে সমান বলা 'মোনাফেকত'। এই যুদ্ধে এবং দ্বন্দ্বে হযরত আলী (رضي الله عنه) হক্ব ছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া (رضي الله عنه)-র টা বিদ্রোহ ছিল। তবে সেই কারণে উনাকে কাফের, ফাছেক বলা যাবেনা, তার নিন্দা করা যাবেনা, সমালোচনা করা যাবেনা, অভিসম্পাত করা যাবেনা এবং গালি-গালাজ করা যাবেনা। এটা ইজতিহাদী ভুল বিবেচিত হবে। কারণ উনি সাহাবিয়ে রাছুল (ﷺ) আর সমস্ত সাহাবী 'আদূল' বা (ন্যয়নিস্ট) বলে রাছুল (ﷺ) এর ফরমান রয়েছে। এটাই আহলে ছুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা। আপনি এক সাহাবীর বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর ছুড়লে আরেকজন আরেক সাহাবীর বিরুদ্ধে ছুড়বেন। হাজার মুনাফিক অপেক্ষায় আছে এই অবস্থা সৃষ্টের। সুতরাং সাবধান। এটা দ্বীনে মুহাম্মাদীর (ﷺ)-র 'রেড ঝোন'। ক্রছ করলেই শয়তান কতৃক এরেস্টেড হবেন।
মারহুম আবুল আলা মাউদুদীর লিখিত কিতাব "খিলাফত আওর মুলুকিয়্যতে" হযরত উছমান (رضي الله عنه) ও হযরত আলী (رضي الله عنه) কতৃক গৃহিত অনেক পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন এই বলে- 'ভুল ভুলই। ভুলকে ইজতেহাদী ভুল বলে চালিয়ে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।'
আর এই কারণেই লক্ষ করবেন জামাত শিবিরের কর্মিদের মধ্যে 'মুহাব্বাত', 'আদব' এবং তা'যিমের মাত্রা কম। এটা মাউদুদীবাদের প্রভাব।
অনেকেই দেখি, অতিরিক্ত মুহাব্বাত আর স্মার্টনেসের ভারে সুন্নিয়তের চাদরে আবৃত হয়ে শিয়াদের টোনে কথা বলেন। এটা পাক্কা মুনাফেকি। আইম্মায়ে কেরাম সবকিছু দুধ কা দুধ, পানি কা পানি করে দিয়ে গেছেন।
আবার অনেকেই দেখি মুহাররম মাসে শিয়াদের রোধ করতে গিয়ে হযরত আমীর মুয়াবিয়ার (رضي الله عنه) ওরছ ও জিকির বেশি করা শুরু করেন। এটা খারিজি আইঢিওলজির প্রভাব এবং অত্যন্ত পরিতাপের। শিয়া রোধে আহলে ছুন্নতের প্লাটফর্মে এই ধরনের ফালতু টেকনিক খারিজিয়্যত, ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য।
______________________
আশুরা - শোহাদায়ে কারবালার স্মরণ - সুন্নি-শিয়া বিষয়ক কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নত্তোরঃ
🖋শায়খ সাইফুল আজম বাবর আল-আযহারী
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন