আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনা: পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর স্মরণে

আরাফাত, মুযদালিফা ও মিনা: পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর স্মরণে

প্রতি যিলহজ্জ মাসের নবম দিবসে হাজ্বী সাহেবান আরাফা’ ময়দানে অবস্থান করেন। লক্ষণীয় যে, সুনির্দিষ্ট কোনো এবাদত-বন্দেগীর আদেশ এখানে দেয়া হয়নি। আরাফাতে স্রেফ উপস্থিত থাকাটাই হজ্জ্বের অবশ্য পালনীয় শর্ত পূরণের জন্যে যথেষ্ট। আরাফাত আমাদেরকে পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ও মা হাওয়া (رضي الله عنه)-এর পুনর্মিলিত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেটা ৯ই যিলহাজ্ব তারিখে ঘটেছিল; ঠিক যেমনটি এক রওয়ায়াতে প্রমাণিত হয় –

১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ভারতে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (رضي الله عنه) জেদ্দায়। বাবা আদম (عليه السلام) তাঁর স্ত্রীর খোঁজ করতে থাকেন যতোক্ষণ না তাঁরা অবশেষে একে অপরের দেখা পান। মা হাওয়া (رضي الله عنه) তাঁর কাছে আসেন, যার দরুন তাঁকে ‘মুযদালিফা’ তথা ‘(বাবা আদমের) নিকটে গমনকারিনী’ নামে অভিহিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রী পরস্পর পরস্পরকে ‘আরাফাতে’ চিনতে পারেন, তাই এর নাম আরাফাত (অর্থাৎ, যেখানে একে অপরকে চিনতে পারেন)। তাঁরা জাম’-এ পুনর্মিলিত হন, সে মোতাবেক-ই এর নামকরণ হয়েছে (মানে পুনর্মিলনের স্থান)। [আল-তাবারী লিখিত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল-মুলূক’, ১:৭৯; ইবনে আল-আসীর কৃত ‘আল-কা’মিল ফী আল-তা’রীখ’, ১:৩৪; ইবনে সা’আদ প্রণীত ‘আল-তাবাক্বা’ত আল-কুবরা’, ১:৩৯; এবং ইবনে আসা’কির রচিত ‘তা’রীখ দিমাশক্ব আল-কবীর’, ৬৯:১০৯]

২. পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ভারত উপমহাদেশের ‘নাওয়ায’ নামের এক পাহাড়ে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (رضي الله عنه)-কে জেদ্দায় প্রেরণ করা হয়। ইবনে সা’আদ (১৬৮-২৩০ হিজরী), আল-তাবারী (২৬৪-৩১০ হিজরী) ও ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৭ হিজরী) এই অভিমত পোষণ করেন যে, বাবা আদম (عليه السلام) তাঁর স্ত্রীর সাথে আবার মিলিত হন আরাফাত নামের স্থানে, যার দরুন এই নামকরণ হয়েছে। [আল-তাবারী প্রণীত ‘তা’রীখ আল-উমাম ওয়াল-মুলূক’, ১:৭৯; ইবনে সা’আদ কৃত ‘আল-তাবাক্বা’ত আল-কুবরা’, ১:৩৫-৩৬; এবং আল-নববী রচিত ‘তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল-লুগা’ত’, ৩:২৩৭]

৩. আল-ক্বুরতুবী (২৮৪-৩৮০ হিজরী) নিজ ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’ গ্রন্থে লেখেন: পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ভারত উপমহাদেশে অবতরণ করেন, আর মা হাওয়া (رضي الله عنه) জেদ্দায়। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সাক্ষাৎ পান আরাফা দিবসে আরাফা’তেরই ময়দানে। অতএব, এই দিনটি আরাফা’ নামে পরিচিত হয়, আর স্থানটি খ্যাত হয় আরাফাত নামে। এটা আল-দাহহা’কের বক্তব্য। [আল-ক্বুরতুবী প্রণীত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ২:৪১৫]

৪. আল-মুযদালিফা নামকরণের ব্যাপারে ইবনে হাজর আল-আসক্বালা’নী (৭৭৩-৮৫২ হিজরী), এয়া’কূত আল-হামাভী (জন্ম:৬২৬ হিজরী) এবং আল-শওকানী (১১৭৩-১২৫০ হিজরী) লেখেন: আল-মুযদালিফাকে ’জাম’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়, কেননা বাবা আদম (عليه السلام) সেখানেই মা হাওয়া (رضي الله عنه)-এর সাথে পুনরায় মিলিত হন এবং তাঁর সান্নিধ্য পান। [আল-আসক্বালা’নী রচিত ‘ফাতহুল বা’রী’, ৩:৫২৩; এয়া’কূত আল-হামাভী কৃত ‘মু’জাম আল-বুলদা’ন’, ৫:১২১; এবং আল-শওকা’নী লিখিত ‘নায়ল আল-আওতা’র শারহ মুনতাক্বা’ আল-আখবা’র’, ১:৪২৩]

৫. মিনা’ নামকরণ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন: মিনা’ নামকরণ হয় যখন হযরত জিবরাঈল (عليه السلام) পয়গম্বর আদম (عليه السلام) হতে পৃথক হতে চান এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তিনি (বাবা আদম) কোনো কিছু কামনা করেন কি না। হযরত আদম (عليه السلام) উত্তর দেন, ‘বেহেশত’। একারণেই এই স্থানকে মিনা’ নামে ডাকা হয় – পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর আকাঙ্ক্ষার দরুন। [আল-আযরাক্বী রচিত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আ’সার’, ২:১৮০; আল-নববী প্রণীত ‘তাহযীব আল-আসমা’ ওয়াল-লুগা’ত’, ৩:৩৩৩; এবং আল-ক্বুরতুবী কৃত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ৩:৭]     

’রামী’ তথা পাথর নিক্ষেপের রীতির মতোই ’সা’ঈ’ ও ’তালবিয়্যা’ প্রথাগুলোও আল্লাহতা’লার নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের সম্মানার্থে উদযাপিত আমল। অনুরূপভাবে, ‘আরাফা’ত’ ও ‘মুযদালিফা’ স্থানগুলোও সম্মানিত হয়েছে, যেহেতু বাবা আদম (عليه السلام) ও মা হাওয়া (رضي الله عنه) দীর্ঘকাল পরে সেখানে পুনরায় মিলিত হন। এখানে গুরুত্বারোপ করতে হবে যে, আক্ষরিক অর্খে ‘আরাফা’ত’ বলতে ’চেনা’কে বোঝায়, আর ‘মুযদালিফা’ মানে ’সান্নিধ্য’। মহান আল্লাহতা’লা এই অতি গুরুত্বপূর্ণ পুনর্মিলনের স্মৃতি প্রতি বছর যেলহজ্জ্ব মাসের ৯ তারিখে কীভাবে সেখানে হাজ্বী সাহেবানের উপস্থিতিকে বাধ্যতামূলক করে দিয়ে পুনর্জাগরিত করেছেন, তা গভীরভাবে ভেবে দেখুন।

১.১৭ আরাফাত ও মুযদালিফায় আদায়কৃত নামাযের একত্রীভবন: মহানবী (ﷺ)-এর সুন্নাহ

মুসলমানবৃন্দ আল্লাহতা’লার ইচ্ছা মোতাবেক সর্বদা নির্দিষ্ট ওয়াক্তের নামায যথাসময়ে আদায় করে থাকেন। কিন্তু (এর ব্যতিক্রমস্বরূপ) আরাফাতের ময়দানে হাজ্বী সাহেবান যোহর ও আসর ওয়াক্তের নামায একত্রে পড়েন। এটা শুধু এ কারণেই যে প্রিয়নবী (ﷺ) এই দুই ওয়াক্তের নামায একত্রে পড়েছিলেন; আর তাই হাজ্বী সাহেবানের প্রতি অনুরূপ রীতি পালনের (শরঈ) বিধান জারি করা হয়। একইভাবে, সূর্য ডোবার সাথে সাথে হাজ্বী সাহেবান মাগরেব ও এশা’র নামায-ও একত্রে পড়েন। তাঁরা সরাসরি নামায আদায় করেন না, বরং মুযদালিফায় না পৌঁছুনো পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষা করেন। এটা নিম্নের রওয়ায়াত দ্বারা সপ্রমাণিত:

১. মুহাদ্দেসীনে কেরাম হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) হতে মহানবী (ﷺ)-এর বিদায়ী হজ্জ্ব সম্পর্কে একটি বিশদ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। তাঁরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করেন যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরাফাত ময়দানে এক আযান ও দুই এক্বা’মত সহকারে যোহর ও আসরের নামায একত্রে আদায় করেছিলেন, আর মুযদালিফায় মাগরেব ও এ’শার নামাযের ক্ষেত্রেও একই রকম করা হয়েছিল। [মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘মহানবী (ﷺ)-এর হজ্জ্ব’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৮৮৬-৮৯২ #১২১৭; এবং আবূ দাউদ লিখিত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক’, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হজ্জ্বের বিবরণ’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৮৫ #১৯০৫]

২. ইমাম জা’ফর আল-সা’দিক্ব (رحمة الله) তাঁর পিতা ইমাম বা’ক্বির (رحمة الله) হতে বর্ণনা করেন: হুযূর পূর নূর (ﷺ) আরাফা’তে যোহর ও আসরের নামায এক আ’যা’ন ও দুইটি এক্বা’মত সহকারে (একত্রে) আদায় করেন। তিনি উভয়ের মাঝে আল্লাহ পাকের কোনো ‘তাসবীহ’ (প্রশংসা-বাক্য) পাঠ করেননি। অতঃপর তিনি এক আ’যা’ন ও দুইটি এক্বা’মত সহকারে মাগরেব ও এ’শার নামাযও (মুযদালিফায়) আদায় করেন এবং সেখানেও তিনি উভয়ের মাঝে কোনো তাসবীহ পাঠ করেননি। [আবূ দাউদ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব আল-মানা’সিক’, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হজ্জ্বের বিবরণ’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:১৮৬ #১৯০৬; এবং আল-বায়হাক্বী কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ১:৪০০ #১৭৪১]

৩. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (رضي الله عنه) বলেন: আমি কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নামায তার নির্দিষ্ট ওয়াক্ত ছাড়া পড়তে দেখিনি (মানে নামায তরক করেননি); ব্যতিক্রম শুধু (হজ্জ্বের সময়) দুইটি নামায – মাগরেব ও এশা’ একত্রে আদায়। [মুসলিম রচিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘মুযদালিফায় নাহর দিবসে অন্ধকার থাকতে ফজরের নামায আদায়ের বাঞ্ছনীয়তা’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯৩৮ #১২৮৯; এবং আল-বুখারী লিখিত ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘জাম’ (মুযদালিফা)-এ ফজরের নামায পড়ার সময়’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৯০৪ #১৫৯৮]

ক্বুরআ’ন মজীদে যদিও নামায সুনির্দিষ্ট ওয়াক্ত অনুযায়ী আদায়ের হুকুম রয়েছে [আল-ক্বুরআ’ন ৪:১০৩], তবুও হজ্জ্বের সময় আরাফা’ত ও মুযদালিফায় এই সাধারণ আদেশের ব্যতিক্রম করা হয়েছে। এটা প্রিয়নবী (ﷺ)-এর অনুশীলিত রীতির কারণেই হয়েছে।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন