আম্বিয়া (عليه السلام)-এর মওলিদ হতে মহানবী (ﷺ)-এর মওলিদের ধারাবাহিকতা

 আম্বিয়া (عليه السلام)-এর মওলিদ হতে মহানবী (ﷺ)-এর মওলিদের ধারাবাহিকতা


সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লা তাঁর আশীর্বাদধন্য প্রিয় বান্দাদের মওলিদের স্মরণকে এতো উচ্চমর্যাদা দিয়েছেন যে এমন কি এসব প্রিয় বান্দার মনে যে সকল চিন্তার উদ্রেক হয়েছিল, সেগুলোরও তিনি উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, কেউ পয়গম্বর ইয়াহইয়া (عليه السلام)-এর মওলিদ সম্পর্কে অধ্যয়ন করলে দেখতে পাবেন যে পয়গম্বর যাকারিয়্যা (عليه السلام) মরিয়ম (عليه السلام)-এর মঠরূপী আবাসস্থলে প্রবেশ করার পর সেখানে বে-মওসূমি ফল-ফলাদির খোঁজ পেয়ে তিনি সন্তানপ্রাপ্তির আশায় দোয়া করেছিলেন।আর যখন তাঁকে একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ পুত্রসন্তান-প্রাপ্তির খোশখবরি দেয়া হয়েছিল, তখন নিজের বার্ধক্য ও তাঁরই স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের কারণে কীভাবে সন্তান লাভ হবে সে সম্পর্কে তাঁর মনে এক চিন্তার উদ্রেক হয়। এরই ফলে তিনি আল্লাহতা’লাকে এব্যাপারে প্রশ্ন-ও করেন। কুরআন মজীদে এই ঘটনা ও এর প্রতি (খোদার) জবাব-ও উল্লেখিত হয়েছে।

অনুরূপভাবে, পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর মওলিদের অধ্যয়ন-ও ঈমানকে দারুণভাবে সতেজ করে তোলে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়। প্রদত্ত কিছু খুঁটিনাটি বিষয়ের বিবরণ পাঠের পর কেউ স্রেফ থমকে একথা চিন্তা করবেন যে এসব বিবরণ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা কী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মরিয়ম (عليه السلام)-এর অনুভূত প্রসববেদনা ও এই শঙ্কাবোধের বহিঃপ্রকাশ যে এর আগে যদি তাঁর মৃত্যু হতো এবং তিনি বিস্মৃত হতেন। পয়গম্বর ঈসা (عليه السلام)-এর বেলাদতের সময় ফেরেশতা জিবরীল (عليه السلام)-এর উপস্থিতি হতে আরম্ভ করে প্রতিটি খুঁটিনাটি বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। এসব বর্ণনা প্রদান করে আল্লাহতা’লা এই উম্মতকে সচেতন করে তুলেছেন এ মর্মে যে, আল-কুরআনে যেভাবে পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের পূর্ণ বৃত্তান্ত দেয়া হয়েছে, ঠিক তেমনি তাঁর সর্বাধিক প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের মওলিদের সময় যখন আগমন করবে তখন একই উপায়ে সেটারও স্মরণ করতে হবে। পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর ঔরস হতে পিতা আবদুল্লাহ’র ঔরস হয়ে মা আমেনা’র কোলে মহানবী (ﷺ)-এর নূরানী বেলাদত তথা জ্যোতির্ময় শুভাগমন ও তৎপরবর্তী পর্যায়ে (দুধ-মা) হালিমা আল-সা’দিয়া কর্তৃক লালন-পালন পর্যন্ত সমস্ত বিবরণ-ই প্রত্যেকের স্মরণ করা উচিত। এসব বর্ণনা এমনভাবে প্রদান করতে হবে যাতে প্রত্যক্ষকৃত সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়, নেয়ামত তথা আশীর্বাদ ও মো’জেযা (অলৌকিকত্ব)-এর কথা উল্লেখিত হয়, কিছুই যাতে বাদ না পড়ে। এটা মহান আল্লাহতা’লার সুন্নাত (রীতিনীতি) এবং এর পক্ষেই আল-কুরআনের অবস্থান। অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের কথা ঐশী কালাম (বাণী)-এর সূত্রে আমাদের মহানবী (ﷺ)-ই প্রকাশ করেছেন; আর স্পষ্টতঃ আমাদের প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মওলিদের স্মরণ অনাগত প্রজন্মগুলোই করবেন, যেহেতু তাঁর পরে অন্য কোনো নবী আর আসবেন না। এই কারণেই তাঁর যিকর-তাযকেরা (স্মরণ) এ উম্মতকেই করতে হবে।

প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মওলিদ হচ্ছে ওইসব ঘটনার যিকর-তাযকেরা (স্মরণ) যা তাঁর ধরাধামে শুভাগমনের আগে এবং ওই শুভক্ষণে ঘটেছিল। মহানবী (ﷺ)-এর নূর (জ্যোতি) কীভাবে পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এর ঔরস হতে পুণ্যবান পুরুষদের ঔরস ও ন্যায়নিষ্ঠ নারীদের গর্ভে স্থানান্তরিত হয়ে (তাঁর বাবা) আব্দুল্লাহর ঔরসে পৌঁছে, এটা তারই উল্লেখ; আর তাঁরই বেলাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহতা’লা কীভাবে মানবজাতির প্রতি নিজের অসংখ্য রহমত-বরকত-নেয়ামত (আশীর্বাদ) বর্ষণ করেছেন, সেটারও স্মরণ বটে। সারা বছর ধরেই হুযূর পাক (ﷺ)-এর শানে না’ত-পদ্য-কসীদা পাঠ করা হয়, কিন্তু পবিত্র রবিউল আউয়াল মাস এলেই এই মহব্বত ও ভক্তিশ্রদ্ধা নতুন প্রাণস্পন্দন পায় এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্মানে বিশেষ মাহফিল ও মজলিশের আয়োজন করা হয়। এই উপলক্ষে কিছু মানুষ হুযূর পাক (ﷺ)-এর মনোরম অলকগুচ্ছ ও গণ্ডদেশ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেন, আবার অনেকে রোমন্থন করেন হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়ানো তাঁর স্মিত হাসি এবং মক্কার রাস্তায় রাস্তায় তাঁরই পদচারণাকে; কেউ কেউ সবুজ গুম্বজের শান-শওকত নিয়ে আলোচনা করেন, আর কেউ কেউ তাঁর পবিত্র রওযা শরীফের স্বর্ণের ঘের এবং মদীনা নগরীর রাস্তা ও সেগুলোর সৌন্দর্য সম্পর্কে বর্ণনা দেন। রাসূল (ﷺ)-এর মহান মাতা আমিনা (رضي الله عنه) ও দুধ-মা হালিমা (رضي الله عنه)-এর স্মৃতি চৌদ্দ’শ বছর আগেকার মক্কার দৃশ্যগুলোকে আবার স্মৃতিপটে ভাস্বর করে। এই মাসে নবী করীম (ﷺ)-এর প্রতি ভক্তিমূলক না’ত-শে’র-কসীদা গাওয়া হয়, আর তাঁকে স্মরণ-ও করা হয়। মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদতের কথা যখন উল্লেখ করা হয়, তখন ঈমানদারবৃন্দ এসব আবেগময় কাব্য শুনে তাঁদের অন্তরে সুপ্ত নবীপ্রেমের জাগরণ অনুভব করেন।

পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আমরা দেখিয়েছি কীভাবে আল-কুরআন অন্যান্য পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের উল্লেখ করেছে। এই পৃষ্ঠাগুলো সেসব লোককে খণ্ডন করে, যারা মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদতকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণের গুরুত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে। এসব কুরআনের আয়াত পাঠ করেও যদি কেউ এখনো মনে করে যে এগুলোর কোনো গুরুত্ব নেই, তাহলে এধরনের লোক আল-কুরআনের প্রকাশ্য আয়াতেরই প্রতি আপত্তি উত্থাপন করছে, আর এটা শুধু তার নিজস্ব জ্ঞানের অভাব ও ভুল উপলব্ধিরই পরিচায়ক হবে। এই কুরআনী বিশ্লেষণ দ্বারা এ বিষয়টি উপলব্ধি করা জরুরি যে মহানবী (ﷺ)-এর মওলিদের উদযাপন প্রকৃতপ্রস্তাবে আল্লাহতা’লারই একটি সুন্নাহ বা রীতি; আর শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত প্রিয়নবী (ﷺ)-এর প্রতি গভীর প্রেম-ভালোবাসা যাঁরা অন্তরে রাখবেন, তাঁরা এটাকে (মানে মওলিদকে) গ্রহণ বা ধারণ করবেন।

প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই স্মরণ কীভাবে করা উচিত? উত্তরটাও স্বয়ং খোদাতা’লা-ই ব্যাখ্যা করেছেন। হুযূর পাক (ﷺ)-এর ধরাধামে শুভাগমনের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনাগুলোর স্মরণ দ্বারা আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার সুন্নাহকেই মেনে চলি, কেননা তিনি-ই অন্যান্য আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের কথা উল্লেখ করেছেন (তাঁর পাক কেতাবে)। আমরা এ-ও ব্যাখ্যা করেছি যে আল্লাহতা’লা যখন কুরআন মজীদে পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের কথা উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি খুঁটিনাটি বিষয়ের বর্ণনাও উপেক্ষা করেননি। এভাবে আল্লাহর এই রীতির কথা স্মরণে রেখে রাসূল (ﷺ)-এর যিকর-তাযকেরা করার সময় আমাদের উচিত হবে তাঁর সৃষ্টি, তাঁর নূর হওয়ার বিষয় এবং তাঁর বেলাদত সম্পর্কে আলোচনা করা; তাঁর উচ্চবংশীয় খান্দান, তাঁর অনুপম বৈশিষ্ট্যাবলী এবং ধূলির ধরায় মাহবূব (ﷺ)-এর শুভাগমনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাগুলোর উল্লেখও আমাদের করা উচিত হবে।

মওলিদের উপলক্ষ পেলেই আমরা পয়গম্বর আদম (عليه السلام) হতে আরম্ভ করে সর্ব-পয়গম্বর ইব্রাহীম (عليه السلام) ও ইসমাঈল (عليه السلام) হয়ে (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাবা) আবদুল্লাহ (رضي الله عنه)-কে স্মরণ করি। অতঃপর আমরা বর্ণনা করি কীভাবে নবী করীম (ﷺ) মা আমিনা (رضي الله عنه)-এর কোলে এলেন এবং দুধ-মা হালিমা (رضي الله عنه) কর্তৃক লালিত-পালিত হলেন, যাতে এই যিকর-তাযকেরার আনন্দ আমাদের অন্তরে শান্তি বয়ে আনে এবং আমাদের মস্তিষ্কে চিরস্থায়ীভাবে এর গুণগত প্রভাব পড়ে। প্রিয়নবী (ﷺ)-এর মওলিদের অনুষ্ঠানগুলোতে তাঁরই নবুয়্যতের স্মরণ করা হয়। অতএব, এসব মাহফিল অনুষ্ঠান করাকে না-জায়েয বলা চরম ভ্রান্তি, আল্লাহ মাফ করুন। মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন জায়েয তথা অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়ার পক্ষে কুরআন-হাদীসের প্রামাণিক দলিলাদি এবং এর গঠনের উপাদানসমূহ পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে বিধৃত হয়েছে।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন