আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনীর প্রশ্ন- আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভীর উত্তরসংক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক পত্রালাপ


 মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থ প্রসঙ্গে আল্লামা শাহ মখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত)কে ৭ (সাতটি) গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্বলিত এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রেরণ করলেন আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনী (আলাইহির রহমত)।

 উত্তরে আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) ওফাত ১২৭৯ হিজরি ১৮৫৬ ইংরেজি) এর ঐতিহাসিক বক্তব্য।

 উল্লেখ্য যে, আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী (আলাইহির রহমত) হচ্ছেন শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর আপন নাতি, এবং শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর আপন ভাতিজা ও শাহ রফী উদ্দিন (আলাইহির রহমত)-এর পুত্র। অপরদিকে মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর আপন চাচাত ভাই। এজন্য এই ঐতিহাসিক চিঠির গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।

 আল্লামা ফজলে রাসূল বদায়ূনী (আলাইহির রহমত) তার লিখিত ‘তাহকীকুল হাকীকত’ নামক কিতাবে তা (প্রশ্নোত্তর) লিপিবদ্ধ করেছেন যা ১২৬৭ হিজরি সনে বোম্বাই থেকে তা প্রকাশ করা হয়।

 আল্লামা কাজী ফজল আহমদ লুদিয়ানবী (আলাইহির রহমত) কর্তৃক সম্পাদিত ‘আনোয়ারে আফতাবে ছাদাকাত’ নামক গ্রন্থের ৫৩০ পৃষ্ঠা থেকে ৫৩৮ পৃষ্ঠা ব্যাপীয়া এ প্রশ্নোত্তর সম্বলিত চিঠি হুবহু সংকলিত করা হয়।

 নিম্নে তারই বঙ্গানুবাদ পেশ করা হলো-

 (ফজলে রাসূল বদায়ুনীর লিখিত পত্র)

 ছালামবাদ আরজ এই যে, শাহ ইসমাঈল দেহলভী কৃর্তৃক প্রণীত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পর থেকে জন সাধারণের মধ্যে এ কিতাবের পক্ষে বিপক্ষে বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

 গ্রন্থের বিপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা বলছেন, এ গ্রন্থের বক্তব্য ছলফে ছালেহীন ও ছাওয়াদে আ’জম তথা বড় জামায়াত এমনকি লিখকের খানদানের নীতি বা আক্বিদা ও আমলের সম্পূর্ণ বিরোধী।

 এ কিতাবে লিখিত ফতওয়ার দরুন তার উস্তাদগণ হতে সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত কেহই তার সাজানো কুফুর ও শিরিক হতে অব্যাহতি পাননি।

 আর এ গ্রন্থের সপক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তারা বলছেন, এ গ্রন্থের বক্তব্য ছলফে সালেহীন ও তার খান্দানের অনুকূলে। এ ব্যাপারে আপনি যা জানেন, সম্ভবত অন্য লোকেরা তা জানেন না। একটা প্রবাদ আছে-اهل البيت ادرى ما فى البيت অর্থাৎ ঘরের লোক ঘরে কি আছে, তা অন্যের তুলনায় অধিক জ্ঞাত।

 এরূপ ধারণা করে আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি। আশা করি সঠিক উত্তর প্রদান করবেন।

 প্রশ্ন-১. ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি আপনার খানদানের আক্বিদা ও আমলের পক্ষে না বিপক্ষে?

 প্রশ্ন-২. অনেকে বলেন ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের মধ্যে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে কেরামের সাথে বে-আদবী করা হয়েছে। এর প্রকৃত অবস্থা কি?

 প্রশ্ন-৩. শরিয়তের দৃষ্টিতে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের লেখকের কি হুকুম?

 প্রশ্ন-৪. অনেকে বলেন- আরবের মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী জন্ম নিয়ে, সে নূতন মতবাদ প্রচার করেছিল। আরবের হক্বানী উলামায়ে কেরামগণ তার উপর তাকফীর বা কুফুরি ফতওয়া প্রদান করেছেন। ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবটি ওহাবী মতবাদ অনুযায়ী লিখিত?

 প্রশ্ন-৫. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ যখন হিন্দুস্তানে পৌঁছে তখন আপনার চাচাগণ (শাহ আব্দুল আজিজ, শাহ আব্দুল কাদির, শাহ আব্দুল গণি) ও আপনার পিতা (শাহ রফী উদ্দিন) এ কিতাব দেখে কী মন্তব্য করেছিলেন?

 প্রশ্ন-৬. এ কথা বিপুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ যে, যখন ওহাবী মাযহাবের নূতন মতবাদ প্রচার হলো তখন আপনি দিল্লির জামে মসজিদে তাশরীফ নিয়ে গেলেন, তখন আল্লামা রশীদুদ্দিন খাঁন দেহলভী (ওফাত ১২৫৯ হিজরি ১৮৪৩ ইংরেজি) প্রমুখ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ আপনার সাথে ছিলেন। আপনারা খাস ও আম সমাবেশে মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ও মাওলানা আব্দুল হাই সাহেবদ্বয়কে তর্কযুদ্ধে নিরুত্তর ও পরাজিত করেছিলেন। এ কথা কতটুকু সত্য?

 প্রশ্ন-৭. ঐ সময় (১২৪০ হিজরি) আপনার খান্দানের শাগরিদ ও মুরিদগণ (মাও: ইসমাঈল দেহলভী ও আব্দুল হাই উভয়ের মতবাদের) তাদের পক্ষে ছিলেন, না আপনাদের পক্ষে ছিলেন?

 (নিবেদক- ফজলে রাসূল বদায়ূনী)।

 উপরোক্ত (সাতটি প্রশ্ন সংবলিত) পত্রের জবাবে আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী বিন শাহ রফী উদ্দিন দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর লিখিত বক্তব্যের হুবহু বঙ্গানুবাদ নিম্নে পেশ করা হলো-

 উত্তর ১. ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের নাম আমি (শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী) তাফবিয়াতুল ঈমান রেখেছি। অর্থাৎ এ কিতাব একীন ও বিশ্বাসের সাথে পাঠ করলে ঈমানদারের ঈমান আর থাকে না, বরং ধ্বংস হয়ে যায়।

 ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের খণ্ডনে ‘মঈদুল ঈমান’ নামক কিতাব রচনা করেছি। ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘ তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক কিতাব শুধু আমাদের খান্দান কেন? সকল আম্বিয়া ও রাসূলগণ (আলাইহিমুস সালাম) এর তাওহীদ ও ঈমান শিক্ষার পরিপন্থী। কেননা পয়গাম্বরগণকে তাওহীদ শিখাবার জন্য এবং খোদাপ্রদত্ত ঈমান ও আক্বিদার উপর চালাবার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে খোদাপ্রদত্ত তাওহীদ ও পয়গাম্বরগণের সুন্নাতের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। ইসমাঈল দেহলভী শিরিক ও বিদআতের সংজ্ঞা নিজের ব্যক্তিমতে সাজিয়ে লোকদেরকে শিখাবার অপচেষ্টা চালাচ্ছে তার লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের মাধ্যমে।

 উত্তর ২. ইসমাইল দেহলভী নিজের ব্যক্তিমতে সাজিয়ে শিরকের যে সংজ্ঞা প্রণয়ন করে তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাব রচনা করেছেন, তাতে ফিরিশতাগণ এমনকি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আল্লাহর শরীক হয়ে যান। (নাউজুবিল্লাহ)

 ইসমাঈল দেহলভীর ব্যক্তিমতে সাজিয়ে ও যে শিরকের সংজ্ঞা প্রণয়ন করেছেন, ঐ শিরকের ফতওয়ায় যারা রাজি থাকেন তারাও আল্লাহতায়ালার নিকট অপছন্দনীয়।

 ইসমাঈল দেহলভী মনগড়ামতে বিদআতের যে সংজ্ঞা সাজিয়েছে, তাতে আউলিয়ায়ে কেরাম ও সুফিয়ায়ে এজামগণ বিদআতী সাব্যস্ত হন। এটাই শক্ত বে-আদবীর লক্ষণ।

 উত্তর ৩: প্রথম দু’টি উত্তর দ্বারা দ্বীনদার, গুণী-জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ অতি সহজে বুঝতে সক্ষম হবেন, যে পুস্তকের দ্বারা লোকগণ সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে উশৃঙ্খল ও বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারী লোক জন্ম নেয় এবং সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আউলিয়ায়ে এজামগণের বিপরীত বা ব্যতিক্রম মত ও পথ প্রকাশ হতে থাকে, কষ্মিকালেও তা হেদায়তের রাস্তা হতে পারে না।

 তার লিখিত পুস্তক বা আমলনামা আমার নিকট মওজুদ আছে। এ কিতাব পাঠ করলে হেদায়তের পরিবর্তে ফিৎনা ফাসাদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী লোকের প্রভাব বৃদ্ধি হতে থাকবে। অধিকন্তু এ পুস্তিকা অশান্তি, মূর্খতা ও বোকামীর উৎসাহ প্রদান করে।

 বাস্তব সত্য যে, আমাদের খান্দানে ইসমাঈল নামে এমন এক ব্যক্তির জন্ম নিয়েছে, আমাদের খানদানের অন্য সব আলেমদের সঙ্গে তার কোন প্রকারের মিল নেই।

 আক্বিদা বা বিশ্বাস, নিছবত বা সম্বন্ধ কোন কিছুতেই মিল অবশিষ্ট রহিল না। সে আল্লাহর প্রতি উদাসীন হওয়ার দরুণ সবকিছু তা থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। এটা সে প্রবাদ বাক্যের মতো: যখন যথাযত সম্মান প্রদর্শন করবে না, সেটাই বেদ্বীনি। আর তাই হলো।

 উত্তর ৪. মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর পুস্তিকা ‘কিতাবুত তাওহীদ’ যেন মতন বা পাঠ ছিল। মৌলভী ইসমাইল দেহলভীর লিখিত কিতাব ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ যেন সেই কিতাবুত তাওহীদেরই শরাহ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত।

 উত্তর ৫. বড় চাচা (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁকে বলতে শুনেছি যদি অসুস্থতার কারণে অপারগ না হতাম, তা হলে শিয়াদের বদ আক্বিদার বিরোদ্ধে যেভাবে ‘তোহফায়ে ইছনা আশারা’ কিতাব লিখেছি ঠিক তেমনিভাবে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর বাতিল আক্বিদার খণ্ডনে কিতাব লিখতাম।

 তাকে (ইসমাইল দেহলভীকে) ওহাবী মতবাদে প্রভাবান্বিত করে বিপথগামী করেছে। আমার পিতা (রফী উদ্দিন মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) তাকে (ইসমাঈল দেহলভীকে) দেখেননি।

 বড় হযরত (শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী আলাইহির রহমত) এ কথা বলার পর ইসমাইল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ দ্বারা তার বদ আক্বিদা প্রকাশ হয়ে গেল। যখন তিনি তাকে গোমরাহ বলে জানতে পারলেন, তখন ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ কিতাবের খণ্ডনে লিখতে নির্দেশ দিলেন।

 উত্তর ৬. প্রশ্নেবর্ণিত সব কিছুই বাস্তব সত্য। এজন্য আমি (মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী) পরামর্শের দৃষ্টিতে তাকে (ইসমাইল দেহলভী) বলেছিলাম তুমি সকল থেকে (আমাদের খান্দানের উলামায়ে কেরামের আক্বিদা ও আমল থেকে) বিচ্যুত হয়ে যে- দ্বীনের গবেষণা করছ, তা তুমি লিখে কেন প্রকাশ কর না।

 এভাবে আমাদের পক্ষ থেকে যত প্রকারেরই প্রশ্ন হয়ে ছিল, কোন প্রশ্নেরই উত্তর না দিয়ে, শুধুমাত্র জ্বি হ্যাঁ, জ্বি হ্যাঁ বলতে বলতে মসজিদ থেকে সে চলে গেল।

 উত্তর ৭. ১২৪০ হিজরিতে দিল্লীর জামে মসজিদে প্রথম বিতর্ক সভা পর্যন্ত আমাদের খানদানের ভক্ত মুরিদগণ সবাই আমাদের মতবাদ ও নীতির উপরই বহাল ছিলেন।

 অতঃপর তার অবাস্তব কথা শুনে আনাড়ী লোকেরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমাদের পিতার শাগরিদ ও মুরিদগণের মধ্যে অনেকেই এর থেকে বেঁচে থাকছেন। যদিও কেউ কেউ গিয়ে থাকেন তা আমাদের জানা নেই।

 মোদ্দাকথা হলো

 শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী ইবনে শাহ রফী উদ্দিন দেহলভী ইবনে শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহিমুর রহমত)

 আল্লামা শাহ মাখছুছ উল্লাহ দেহলভী ও আল্লামা ফজলে রাসূল বাদায়ূনী (আলাইহিমুর রহমত) এর উপরোক্ত ‘পত্রালাপ’ দ্বারা স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হলো, মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য তার খানদানের বিশিষ্ট বুজুর্গানে দ্বীন যথাক্রমে শাহ আব্দুর রহিম মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল কাদির মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ রফী উদ্দিন মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ আব্দুল গণি মোহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ মুছা দেহলভী ও শাহ মাখছুছ উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী প্রমুখ ইসলামজগতের বিজ্ঞ মোহাদ্দিসীন, মুফাসসিরীন, উলামায়ে কেরামগণের আক্বিদা ও আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

 কেননা তাঁরা সকলই ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পূর্ণ আক্বিদায় বিশ্বাসী। অপর দিকে ইসমাঈল দেহলভী ছিল ওহাবী মতাদর্শের বিশ্বাসী। 

 এমনকি তার (ইসমাঈল দেহলভী’র) সমকালীন অন্যান্য আলেমগণের মধ্যেও অধিকাংশ উলামায়ে কেরামগণ ছিলেন সুন্নী আক্বিদায় বিশ্বাসী। যার দরুণ তাঁরা তাকভীয়াতুল ঈমান কিতাবের গোমরাহী পূর্ণ বক্তব্যকে সমর্থন করেন নি।

 সৈয়দ আহমদ বেরলভী ও ইসমাঈল দেহলভীর গুনকীর্তন করিয়াও এ কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। যেমন ‘চেতনায় বালাকোট সম্মেলন স্মারক ২০১০ এর ৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে-

 ‘ইতিহাসের আয়নায় যদি আমরা বাস্তব অবস্থা অবলোকন করি তাহলে দেখতে পাই, ইসমাঈল দেহলভীর লেখা ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থের বক্তব্যকে তার সমসাময়িক গুটি কতক লোক ছাড়া কেউ সমর্থন করেননি।’ 

 অনুরূপ মাওলানা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী সাহেবও একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ইবনে তাইমিয়া প্রভাবিত ওহাবী মতালম্বী ছিলেন, তাই তিনি ইবনে তাইমিয়ার নীতি অনুসরণ করে কার্যক্রম চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু তারই জদ্দে আমজাদ শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) এর সুন্নি মতাদর্শভিত্তিক অনেক কিতাবাদি বিদ্যমান থাকার দরুন, ইসমাইল দেহলভী, তার ইবনে তাইমিয়াপন্থী ওহাবী মতবাদ সংবলিত রচনাবলী তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি।

 এ সম্পর্কে ওহাবী মতাবলম্বী সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী তার লিখিত পুস্তক ‘তাজদীদে এহইয়ায়ে দ্বীন’ যার বঙ্গানুবাদ ‘ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন’ এর ৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

 ‘যদিও মাওলানা শাহ ইসমাইল শহীদ এ সত্য যথার্থরূপ উপলব্ধি করে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু শাহ ওলী উল্লাহ (রা.) রচনাবলীতেই এর যথেষ্ট জওয়াব সরঞ্জাম ছিল এবং শাহ ইসমাঈলের রচনাবলীও তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’ 

 মাওলানা মওদুদী সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো- ১. মৌলভী ইসমাইল দেহলভী ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন।

 অপরদিকে তারই জদ্দে আমজদ শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদার পরিপন্থী সুন্নী আক্বিদায় বিশ্বাসী ছিলেন।

 ২. শাহ ওলী উল্লাহ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ও তাঁরই সাহেবজাদাগণ বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মোজাদ্দিদ শাহ আব্দুল আজিজ মোহাদ্দিসে দেহলভী (আলাইহির রহমত) ওহাবীদের বদ আক্বিদার মূলৎপাঠন কল্পে অনেক কিতাবাদী লিখে সুন্নি আক্বিদার প্রচার ও প্রসার করেছেন। সে কারণে ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ তাকভীয়াতুল ঈমান প্রভৃতি রচনাবালী বাতিল আক্বিদা প্রচারে তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

 এমনকি মুহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী সম্পাদিত পরওয়ানা জুন ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত ও মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরখলী লিখিত ‘ওহাবীদের ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে ২৩ পৃষ্ঠা উল্লেখ রয়েছে-

 ‘ইসলামের চিরশত্রু ওহাবীদের দ্বিতীয় গুরু হচ্ছে মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী (১৭৭৯-১৯৩৯ খ্রি:) সে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওহীদ’ এর ভারতীয় সংস্করণ করে এর নাম দিয়েছে ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’। সে ওহাবী মতবাদের নাম দিয়েছে তাওহীদপন্থী। সেই মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী তার ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ গ্রন্থে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা সম্পর্কে যে কটুক্তি করেছে তা হচ্ছে এই- ১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায়াতুন্নবী নন, তিনি মৃত্যুবরণ করে মাটি হয়ে গেছেন। ২. নবীগণ মেথর, চামার ও অকেজো লোকদের মতো। ৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান বড়ভাইয়ের মত। ৪. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে গায়েব আছে মনে করা শিরিক। ৫. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা শিরিক। ৬. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমতুল্য অন্য কেউ জন্মলাভ করা সম্ভব।

 মৌলভী ইসমাঈল দেহলভী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ গ্রন্থে লিখেছে- নামাযের মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেয়াল আসা গরু ও গাধার খেয়াল আসার চেয়ে নিকৃষ্টতম।’ 

 মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কর্তৃক সম্পাদিত মাসিক পরওয়ানায় এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত, এ ধরণের আরো নিবন্ধ প্রকাশিত হউক এটাই আমরা কামনা করি। যাতে উপমহাদেশের ওহাবী মতবাদের প্রচারক ও তাদের লিখিত বই-পুস্তকে গোমরাহীপূর্ণ উক্তি জনসাধারণ জানতে পারে।

 বড়ই পরিতাপের বিষয় মাওলানা হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী এর বড়ভাই মাওলানা ইমাদউদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী লিখিত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর জীবনীগ্রন্থ দ্বিতীয় সংস্করণে উপমহাদেশের ওহাবী মতবাদের প্রচারক মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীর লিখিত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর মলফুজাত বা মুখনিঃসৃতবাণী ‘সিরাতে মুস্তাকিম’ নামক বিতর্কিত কিতাবটিকে হেদায়েতের কিতাব বলে উল্লেখ করেছেন।

 আমাদের কাছে তাদের উভয়ের বক্তব্যকে স্ববিরোধী বক্তব্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আল্লাহ তা’য়ালাই হেদায়তের মালিক।

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন