মাক্বামে ইবরাহীম: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর স্মরণে

মাক্বামে ইবরাহীম: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর স্মরণে

মাক্বাম (মর্যাদাপূর্ণ স্থান) বলতে (আরবী) ভাষাবিদ্যায় এমন এক স্থানকে বোঝানো হয়, যেখানে কারো পা স্থাপিত হয়েছে [আল-ফারা’হীদী কৃত ‘কিতা’ব আল-’আইন’, ৫:২৩২; ফায়রূয আবা’দী প্রণীত ‘আল-ক্বা’মূস আল-মুহীত’, ৪:১৭০; ইবনে মানযূর রচিত ‘লিসা’ন আল-’আরব’, ১২:৪৯৮; এবং আল-যাবীদী লিখিত ‘তা’জ আল-উরূস’ মিন জওয়া’হির আল-ক্বা’মূস’, ১৭:৫৯২]। মাক্বাম-এ-ইবরাহীমসম্পর্কে বিভিন্ন মত বিদ্যমান। উলামাবৃন্দ ও মুফাসসিরীন-মণ্ডলী [সর্ব-হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه), আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه), ক্বাতাদা (رضي الله عنه) প্রমুখের মতামতের ভিত্তিতে] বিশ্বাস পোষণ করেন যে ‘মাক্বাম-এ-ইবরাহীম’ হচ্ছে এই স্থানে অবস্থিত পাথরটির নাম। এখানে দুই রাক’আত নামায আদায় করা হয়ে থাকে। এটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মত। [আল-তাবারী প্রণীত ‘জামেউল বয়া’ন ফী তাফসীরিল ক্বুরআ’ন’, ১:৫৩৭; আল-ক্বুরতুবী রচিত ‘আল-জামে’ লি-আহকা’ম আল-ক্বুরআ’ন’, ২:১১২; আল-রা’যী কৃত ‘আল-তাফসীর আল-কবীর’, ৪:৪৫; আল-আলূসী লিখিত ‘রূহুল মা’আনী ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন ওয়া সাব’ আল-মাসা’নী’, ১:৩৭৯; এবং আল-আসক্বালা’নী প্রণীত ‘ফাতহুল বা’রী’, ১:৪৯৯]

ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী) বর্ণিত একটি হাদীসে ওপরের বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ মর্মে যে, কা’বা শরীফ নির্মাণের সময় পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام) পাথরগুলো জড়ো করতে থাকেন, আর পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) দেয়ালগুলো দাঁড় করাতে থাকেন। দেয়ালগুলো যখন বেশ উঁচু হয়, তখন পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) এই পাথরটির (মাক্বামে ইবরাহীম) ওপর ওঠে দাঁড়ান যাতে শীর্ষদেশে পৌঁছে ইমারতটির নির্মাণ সুসম্পন্ন করা যায়। [আল-বুখারী রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-আম্বিয়া’, দ্রুত ফেরত যাওয়া: তাড়াতাড়ি হাঁটা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৩:১২৩৫ #৩১৮৪; আবদুর রাযযাক্ব প্রণীত ‘আল-মুসান্নাফ’, ৫:১১০ #৯১০৭; আল-তাবারী কৃত ‘জামেউল বয়া’ন ফী তাফসীরিল ক্বুরআ’ন’, ১:৫৫০; ইবনে কাসীর লিখিত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-আযীম’, ১:১৭৮; এবং আল-ক্বাযউইনী রচিত ‘আল-তাদউয়ীন ফী আখবা’র ক্বাযউয়ীন’, ১:১০৫]

অপর এক রওয়ায়াতে বিবৃত হয় যে, পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام)-এর আনা পাথরগুলো বহন করা যখনই পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর জন্যে কষ্টসাধ্য হতো, তৎক্ষণাৎ তিনি মাক্বামে ইবরাহীমের ওপর ওঠে দাঁড়াতেন এবং সেটা তাঁকে মাটি থেকে ওপরে তুলে ইমারতটির চারপাশ ঘুরিয়ে আনতো, যতোক্ষণ না কা’বা শরীফ নির্মাণ সুসম্পন্ন হয়। [আল-আযরাক্বী লিখিত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ১:৫৮ ও ২:৩৩]

হযরত আনাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন যে হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আরয করেন, “এয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আপনি যদি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমকে সালা’ত বা নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ করতেন!” অতঃপর আয়াতে করীমা অবতীর্ণ হয়: “আর (বল্লাম,) ’ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’। [আল-ক্বুরআন, ২:১২৫]

সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রিয়নবী (ﷺ) অবিলম্বে মাক্বামে ইবরাহীমে নামায আদায় করে এই ঐশী আজ্ঞা পালন করেন। [আল-বুখারী রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-তাফসীর’, “আল্লাহর বাণী – ‘ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’” শীর্ষক অধ্যায়, ৪:১৬২৯ #৪২১৩; আল-তিরমিযী লিখিত ‘আল-জামে’ আল-সহীহ: আবওয়া’ব আল-তাফসীর’, ‘সূরা আল-বাক্বারা’ শীর্ষক অধ্যায়, ৫:২০৬ #২৯৬০; ইবনে মা’জাহ প্রণীত ‘আল-সুনান: কিতা’ব এক্বা’মা আল-সালা’হ ওয়াল-সুন্না ফীহা’, ‘ক্বিবলা’ শীর্ষক অধ্যায়, ১:৩২২ #১০০৮; আল-নাসা’ঈ কৃত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৬:২৮৯ #১০,৯৯৮; ইবনে হিব্বা’ন লিখিত ‘আল-সহীহ’, ১৫:৩১৯ #৬৮৯৬; এবং আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৩৬ #২৫০]

হযরত জাবের ইবনে আব্দিল্লাহ (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন: আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে যখন কা’বা শরীফের সামনে উপস্থিত হই, তিনি তখন তাওয়াফ (তিনবার রামল ও চারবার স্বাভাবিক গতিতে) পালন করেন। এর অব্যবহিত পরেই তিনি মাক্বাম-এ-ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হন এবং “আর (বল্লাম,) ’ইবরাহীমের দাঁড়াবার স্থানকে নামাযের স্থানস্বরূপ গ্রহণ করো’ – ক্বুরআ’ন মজীদের এই আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তিনি কা’বা ও মাক্বামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে দুই রাকআত নামায আদায় করেন। [মুসলিম রচিত ‘সহীহ: কিতা’ব আল-হাজ্জ্ব’, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হজ্জ্ব’ শীর্ষক অধ্যায়, ২:৮৮৭ #১২১৮]

পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) যে পাথরটির ওপর দাঁড়িয়ে পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন, আল্লাহতা’লা তাকে এবাদতগাহ (উপাসনার স্থান) করার আদেশ দেন, যেহেতু এটা ছিল শীর্ষস্থানীয় সাহাবী (পুণ্যাত্মা) হযরত উমর ফারূক (رضي الله عنه)-এর (প্রাণের) আকাঙ্ক্ষা। এই পাথরটি আশীর্বাদধন্য, কেননা এর পাশেই দাঁড়িয়ে মহানতম পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম নামায পড়েন। শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো হাজ্বী সাহেবান কা’বা শরীফের তাওয়াফ করবেন, তাঁদের জন্যে মাক্বামে ইবরাহীমের পাশে দুই রাকআত নামায আদায় করা ওয়া’জিব (বাধ্যতামূলক) হবে; এতে ব্যর্থ হলে তাওয়াফ পালন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অবশ্য কোনো স্থান সংকুলান না হলে অন্যত্র নামায পড়ার অনুমতি আছে, যদিও ওই মাক্বামের কাছে নামায পড়াটা প্রশংসনীয় বলে সাব্যস্ত হয়েছে। [আল-সারখাসী লিখিত ‘কিতা’ব আল-মাবসূত’, ৪:১২; আল-কা’সা’নী রচিত ‘বাদা’ঈ আল-সানা’ঈ ফী তারতীব আল-শারা’ঈ’, ২:১৪৮; আল-সামারক্বান্দী কৃত ‘তোহফা আল-ফুক্বাহা’, ১:৪০২; এবং ইবনে নুজাইম প্রণীত ‘আল-বাহর আল–রা’ইক্ব শারহে কানয আল-দাক্বা’ইক্ব’, ২:৩৫৬]

যেহেতু পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পবিত্র পদচিহ্ন মাক্বামে ইবরাহীম পাথরটির ওপর অঙ্কিত রয়েছে, সেহেতু কা’বা ঘর নির্মাণে তাঁর কর্মপ্রয়াসের স্মরণে মুসলমান সমাজ চিরকাল এটাকে শ্রদ্ধা করবেন এবং এর পাশে নফল নামায-ও আদায় করবেন।

__________________

মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)

মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী

অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন