ঈমানের অর্থ দ্বীনের বিষয়ে প্রকাশ্য বা সঠিকভাবে যা কিছু আমাদের নিকট এসেছে, তার প্রতি কলব বা অন্তর দ্বারা বিশ্বাস করা। মৌখিক স্বীকারোক্তিকেও অবশ্য ঈমানের একটি রোকন বা স্তর বলা হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো তা পরিত্যাজ্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন, কোনো ব্যক্তি বাকশক্তিহীন হলে অথবা কারো বলপ্রয়োগের ফলে কেউ কুফরী কলেমা বলে ফেললেও তার অন্তরে ঈমান থাকা সম্ভব। এরকম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেও সে ঈমানসহই মরবে। অর্থাৎ, আন্তরিক ঈমানই প্রকৃত ঈমান। মৌখিক স্বীকৃতি শর্ত নয়।
ঈমানের দাবী এই যে, ঈমানদার ব্যক্তি অবশ্যই কুফর, কাফেরী এবং তার আনুষঙ্গিক কাজ থেকে বিমুখ থাকবে। যে ব্যক্তি ঈমানের দাবী করে এবং কুফরী আচার-আচরণের উপরে কায়েম থাকতে চায়, সে দুই ধর্মে বিশ্বাস স্থাপনকারী। মুনাফিক। সে এদিকের নয়। ওই দিকেরও নয়। নিখুঁত ঈমানের অধিকারী হতে
গেলে কুফরী থেকে বিমুখ হওয়া ব্যতিরেকে কোনো উপায়ই নেই। এই বিমুখতার সর্বনিম্ম স্তর কলব বা অন্তঃকরণ দ্বারা বিমুখ হওয়া এবং সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর কলব এবং কালাব বা দেহ দ্বারা বিমুখ হওয়া। তার মানে আল্লাহ্ তায়ালার শত্রুদের সঙ্গে শত্রুতা করা। কাফেরদের দ্বারা চরম কোনো অনিষ্টের সম্ভাবনা থাকলে কলব দ্বারা করা। নাহলে কলব ও কালাব দ্বারা করা।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন—
‘হে নবী! কাফের এবং মুনাফিকদের সঙ্গে যুদ্ধ করুন, তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করুন’।
--সূরা তাহরীম, ৯ আয়াত।
আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রেম, ভালোবাসা-মহব্বত তাঁদের শত্রুদের সঙ্গে শত্রুতা ব্যতীত সংঘটিত হয় না। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যে বুজর্গী এবং মাহাত্ম্য লাভ করেছেন, তা আল্লাহ্ তায়ালার শত্রুদের থেকে বৈমুখ্যের কারণেই পেয়েছেন।
আল্লাহ্ তায়ালা এরশাদ করেছেন—
‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য ইব্রাহিম ও তাঁর অনুগামীদের সুন্দর অনুসৃতি রয়েছে। যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, নিশ্চয় আমরা তোমাদের প্রতি এবং তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যে সমস্তের উপাসনা করো, তাদের প্রতি বিমুখ। আমরা তোমাদেরকে অমান্য করলাম। আমাদের সঙ্গে তোমাদের চিরকালীন প্রকাশ্য শত্রুতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো, যে পর্যন্ত না তোমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান আনো’।
--সুরা মুমতাহিনা, ৪ আয়াত।
হযরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি (রহঃ) বলেন‘এই ফকিরের দৃষ্টিতে আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের ক্ষেত্রে এই বিমুখতার তুল্য কোনোকিছুই নেই। আমি স্পষ্ট অনুভব করছি যে, কুফর ও কাফেরীর সঙ্গে আল্লাহ্ তায়ালার সত্তাগত শত্রুতা আছে। পৌত্তলিক এবং বিগ্রহপূজকেরা আল্লাহ্ তায়ালার সত্তাগত শত্রু। চিরস্থায়ী দোজখবাস এই দুষ্কর্মেরই প্রতিফল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উপাস্য যথা অসৎ উদ্দেশ্যসমূহ এবং সকল প্রকার অসৎকাজ এরকম নয়। মূর্তিপূজা ও অংশিবাদিতা ছাড়া অন্যান্য অসৎ কাজের প্রতি আল্লাহ্ তায়ালার ক্রোধ সেফাতী বা গুণজাত। ওই সকল কার্যফলের আজাব সাময়িক। তাই চিরস্থায়ী অগ্নিবাসী হওয়া তার প্রতিফল নির্ধারণ করা হয়নি। বরং তাদের ক্ষমা আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছাধীন।
জানা প্রয়োজন যে, কুফর এবং কাফেরদের সঙ্গে যখন আল্লাহ্ তায়ালার সত্তাগত শত্রুতা প্রমাণিত হলো, তখন আল্লাহ্ তায়ালার সুন্দর এবং শান্ত গুণসমূহের রহমত এবং অনুগ্রহ কাফেরেরা কিছুতেই পাবে না। কারণ, রহমত বা অনুকম্পা গুণ সত্তাগত ক্রোধ বিদূরিত করতে সক্ষম নয়। সত্তাগত সম্বন্ধ গুণজাত সম্বন্ধ অপেক্ষা দৃঢ় ও উচ্চ। সিফাতের চাহিদা জাতের চাহিদাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয় না। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে ‘আমার অনুকম্পা আমার রোষ অপেক্ষা অগ্রগামী’। এর অর্থ গুণজাত ক্রোধ, যা পাপী মুমিনদের জন্য বিশিষ্ট। মুশরিকদের জন্য যে জাতি গজব বা সত্তাগত ক্রোধ, তা নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ইহজগতে তো কাফেরেরাও মুমিনদের মতো রহমতের অংশীদার। তাহলে ইহজগতে কীভাবে গুণজাত রহমত জাতি শত্রুতা বিদূরিত করলো?
উত্তরঃ ইহজগতে কাফের মুনাফিকেরা যে রহমত লাভ করে, তা প্রকৃতপক্ষে প্রবঞ্চনা। ছলনামূলক শান্তি।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন—
‘তারা কি মনে করেছে আমি তাদেরকে ধনজন দিয়ে সাহায্য করছি এবং এভাবে তাদেরকে দ্রুতবেগে উৎকর্ষতার দিকে নিয়ে যাচ্ছি, বরং তারা বুঝতে পারছে না’।
--সূরা মু’মিনুন, ৫৫-৫৬ আয়াত।
আল্লাহ্ পাক আরো এরশাদ করেছেন—
‘আমি তাদেরকে এমনভাবে (ধ্বংসের দিকে) ধীরে ধীরে নিয়ে যাবো যে, তারা জানতেই পারবে না এবং এভাবেই তাদেরকে প্রশ্রয় দিতে থাকি। নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত নিপুণ’।
--সূরা আ’রাফ, ১৮২-১৮৩ আয়াত।
ইমান বাড়ে কমে কি না
________________
ঈমান বাড়ে কমে কি না এ ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ আছে।
ইমামে আযম (রহঃ) বলেন, ‘ঈমান বাড়েও না। কমেও না’।
ইমাম শাফী (রহঃ) বলেন ‘ঈমান বাড়ে এবং কমে’।
ব্যাপারটি নিঃসন্দেহ যে, কলব বা অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসকে ঈমান বলা হয়, যাতে বাড়া-কমার কোনো অবকাশই নেই। যা বাড়ে কমে তা প্রকৃতপক্ষে জন্ন বা সন্দেহ। সন্দেহ তো ঈমানবিরোধী বিষয়।
সৎআমল ঈমানকে নির্মল ও নূরানী করে। আর অসৎ আমল ঈমনাকে করে অপরিচ্ছন্ন। অতএব পরিষ্কৃতি ও নির্মলতার দিক দিয়ে ঈমান বাড়ে অথবা কমে— একথা অবশ্য বলা যেতে পারে। কিন্তু অস্তিত্বগতভাবে বাড়ে কমে না। অনুজ্জ্বল ঈমান অপেক্ষা উজ্জ্বল ঈমান বড়ো— এরকম কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। আবার কেউ অনুজ্জ্বল, অপরিচ্ছন্ন ঈমানকে ঈমান বলেই গণ্য করেন না। তাঁরা নূরানী একিনকে প্রকৃত একিন বলেন এবং অস্বচ্ছ ঈমানকে অপূর্ণ ধারণা করে থাকেন। এঁদের মধ্যে আবার যাঁরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন তাঁরা দেখলেন, এই কমবেশী হওয়া একিনের গুণাবলীর তারতম্য মাত্র। নিছক একিনের মধ্যে ন্যূনাধিক্য হওয়া নয়। তাই তাঁরা ‘একিন বাড়ে না, কিন্তু অপূর্ণ’— একথা বলে থাকেন। যেমন স্বচ্ছতার তারতম্যবিশিষ্ট দু’টি সমআকারের আয়না দেখে কেউ বললো ‘উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন আয়নাটি অপরিষ্কার আয়নাটি থেকে বড়ো’। আবার কেউ বললো ‘আয়না দু’টি আকার আয়তনে বড় ছোটো নয়। তবে এদের স্বচ্ছতার মধ্যে কম বেশী আছে’। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যক্তির লক্ষ্য ও বক্তব্যই অধিকতর সঠিক বলা যাবে। প্রথম ব্যক্তির লক্ষ্য আকৃতির প্রতি। প্রকৃত তত্ত্বের প্রতি নয়।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন—
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং এলেম প্রাপ্ত হয়েছে, তাদের মর্যাদাসমূহকে আল্লাহ্ তায়ালা উচ্চ করে থাকেন’।
হযরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি (রহঃ) বলেন ‘এই ফকির যে সমাধান প্রকাশ করতে সক্ষম হলেন, তার দ্বারা ‘ঈমান বাড়ে কমে না’। মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ খণ্ডন করা হয়েছে। সাধারণ মুমিনের ঈমান পয়গম্বর (আঃ) গণের ঈমানের মতো নয়। কেননা, তাদের বিশ্বাস কমবেশী তমসাচ্ছাদিত। পয়গমম্বর (আঃ) গণের ঈমান পূর্ণ নূরানী এবং বহুগুণ বেশী ফলদায়ক। ‘হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর ঈমান এই উম্মতের সকলের ঈমান অপেক্ষা ওজনে বেশী’ —এই হাদিসের অর্থও এভাবে বুঝতে হবে যে, এই বেশী হওয়ার অর্থ উজ্জ্বলতা, স্বচ্ছতা এবং পূর্ণতা গুণের দিক থেকে বেশী হওয়া। পয়গম্বর (আঃ) মানুষ হিসাবে সাধারণ মানুষের মতো। উভয়ের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রতঙ্গ সবই এক। কিন্তু কামালিয়াত ও ফযীলতের দিক দিয়ে পয়গম্বরগণই শ্রেষ্ঠ। বরং অন্যান্য মানুষ যেনো তাঁদের তুলনায় কিছুই নয়। অথচ, মানুষ হিসাবে আকার আয়তনের দিক থেকে সবাই এক। সুতরাং, একথা বলা যাবে না যে, মানুষ হওয়ার মধ্যে কমবেশী হয়। আল্লাহ্ তায়ালাই প্রকৃত তত্ত্ব অবগত।
অনেকে এরকমও বলে থাকেন যে, ‘তাসদীক্ব’ বা বিশ্বাসের অর্থ তর্কশাস্ত্রের পারিভাষিক ‘তাসদীক্ব’— যার মধ্যে বিশ্বাস ও সন্দেহ দু’টোই থাকতে পারে। অতএব, প্রকৃত ঈমানের মধ্যেই কমবেশী হওয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ‘তাসদীক্ব’ শব্দের অর্থ একিন বা কলবের দৃঢ় বিশ্বাস। সাধারণ অর্থে যেখানে ‘সন্দেহ’ শামিল থাকে, তা নয়।
ইমামে আযম (রহঃ) বলেছেন ‘আনাল হক মুমিন-আমি সত্য ঈমানদার’।
আর ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ্ আমি মুমিন’। উভয় বাক্যের মধ্যে শব্দগত তারতম্য থাকলেও উদ্দেশ্য এক। প্রথম বাক্য বর্তমান ঈমানজ্ঞাপক। দ্বিতীয় মত ঈমানের শেষ অবস্থার অনুকূল। তবে বাহ্যত ‘ইনশাআল্লাহ্’ (যদি আল্লাহ্ চান) শব্দ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। কারণ ঈমান তার নিঃসন্দিগ্ধ স্বীকৃতি চায়।
আমল ঈমানের অংশ নয়। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিশ্বাস। শুধু জানা বা চেনার নামও ঈমান নয়। যেমন মদীনার ইহুদীরা রসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জানতো, চিনতো। কিন্তু বিশ্বাস করতো না।
আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন—
‘তারা নবীকে এমনভাবে চিনে, যে রকম চিনে তাদের সন্তানকে’। --সূরা আনআম, ২০ আয়াত।
শায়েখ আবদুল হক দেহলভী (রহঃ) বলেন ‘আমল ব্যতীত ঈমান অসম্পূর্ণ থাকে। কিন্তু প্রকৃত ঈমানতো অন্তরের বিশ্বাসই। ঈমান ওই বৃক্ষের মতো যার কাণ্ড বিশ্বাস এবং আমল-আনুগত্য ফুল ও ফসল। যে গাছে পত্রপল্লব- ডালপালা নেই প্রকৃতপক্ষে তাকে পূর্ণ বৃক্ষ বলা যায় না। সুতরাং পূর্ণাঙ্গ ঈমান ওটাই, যা নেক আমলের পত্রপুষ্প দ্বারা সজ্জিত থাকে। বেআমল ব্যক্তি অসম্পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। তবুও অসম্পূর্ণ ঈমানকে ঈমানই বলতে হবে। কোরআনুল করীমের বহু স্থানে ঈমান ও আমলকে ভিন্ন ভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন এরশাদ হয়েছে—
‘যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করে’।
--সূরা আসর, ২ আয়াত।
এই আয়াতের মাধ্যমে একথা পরিষ্কার যে, মূল ঈমান হচ্ছে অন্তরের অটল বিশ্বাস। আর নেক আমল অন্য জিনিস।
_______________
ইসলামী বিশ্বাস
কৃত: মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ
ইসলামী বিশ্বকোষ ও ইসলামিক বই সম্ভার
এপ্সে রয়েছে ২৩০ টি কিতাব
👉https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
🌬যাজাকাল্লাহু খাইরান
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন