সৈয়দ আহমদ বেরলভী হচ্ছেন নজদী ওহাবীদের নেতা


 বিশিষ্ট লেখক এম. আর. আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি’ নামক পুস্তকের ভাষ্যমতে : 

 ‘ভারত উপমহাদেশে যারা মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীর ভ্রান্ত (ওহাবী) মতবাদকে আমদানি করেছিলেন তারা হচ্ছেন : ১. হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও ২. তদীয় পুত্র মুহাম্মদ মহসিন ওরফে পীর দুদু মিয়া ৩. নিসার আলী ওরফে তীতুমির এবং ৪. সৈয়দ আহমদ বেরলভী।’ (এম. আর. আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ নামক পুস্তক ৮২ পৃষ্ঠা ১ম সংস্করণ)

 ‘প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিতুমীর হজ্ব করার উদ্দেশ্যে মক্কায় গমন করলে সেখানেই ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তিনি পবিত্র মক্বা নগরীতে অবস্থানকালে সৈয়দ আহমদ এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন’ (কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ৮৪ পৃষ্ঠা) 

 ‘ঐতিহাসিক তথ্য থেকে দেখা যায় যে ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।

 ...এদিকে টুংকু সরদার আমীর খান ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করলে সৈয়দ আহমদ বেরলভী ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে বেরেলী থেকে ... দিল্লীতে গমন করে তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ আলাইহির রহমত এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন...

 ফলে তিনি আটনা কেন্দ্রের দুইজন বিশ্বস্ত অনুসারী শাহ ইসমাইল ও আব্দুল হাই তার প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করে নিজেদের মতাদর্শ প্রচার অব্যাহত রাখা ছাড়াও অত্যন্ত সংগোপনে জেহাদের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দান করেন।...

 ...গবেষক মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহর মতে, পবিত্র হজ্ব পালনের পর সৈয়দ সাহেব মধ্যপ্রাচ্যে বহু দেশ সফর করেন এবং একমাত্র কনসতান্তিনোপলেই (ইস্তাম্বুলেই) শিষ্য ও দর্শনার্থীদের নিকট থেকে নয় লক্ষাধিক টাকা নজরানা পেয়েছিলেন। এসময় তিনি (সৈয়দ আহমদ বেরলভী) মুহাম্মদ আল্লামা (ইবনে) আব্দুল ওহাব-এর বেশ ক’জন অনুসারীর সংস্পর্শে আসেন এবং তার চিন্তাধারা পরিধির ব্যাপ্তি ঘটে। অতঃপর সৈয়দ আহমদ ১৮২৩ সালের অক্টোবরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে দিল্লীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।...

 ‘সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী সীমান্ত প্রদেশের আফগান এলাকায় পৌঁছানোর পর তার প্রতিনিধিরা যেভাবে বাংলা ও বিহার এলাকা থেকে অর্থ ও নতুন রিক্রুট করা মুজাহিদ ট্রেনিং প্রদানের পর নিয়মিতভাবে প্রেরণ করেছে তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এজন্য শহরেই প্রতিষ্ঠিত হলো ওহাবীদের প্রধান কেন্দ্র আর দ্বিতীয় কেন্দ্রটি গড়ে উঠলো মালদহে।

 এ সময় মওলবী বেলায়েত আলী চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ও বরিশাল এলাকায় এবং পাটনার এনায়েত আলী পাবা, রাজশাহী, মালদহ, বগুড়া, রংপুর, এলাকায় কট্টর রক্ষণশীল ওহাবী মতাদর্শ প্রচার ছাড়াও অন্যান্য বাঙালি মুসলমান যুবককে মুজাহিদ হিসেবে সংগ্রহ করেন।’ (কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ৮৬/৮৭ পৃষ্ঠা)

 সংক্ষেপে ওহাবী আন্দোলনের গোড়ার ইতিহাস

 ‘ওহাবী আন্দোলনের প্রবর্তক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব এর সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায়নি। (কোন গবেষকের মতে ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম) তবে তিনি ছিলেন সৌদিআরবের নজ্দ প্রদেশের জনৈক সম্ভ্রান্ত সরদারের পুত্র।...

 আরবের অধিকাংশ এলাকাই তুরস্কেও সুলতানের (খলিফার) অধীনে ছিলো।...

 অবশেষে দেরইয়ার সরদার মোহাম্মদ ইবনে সৌদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইহারই সাহায্যে তিনি বেদুঈনদের সমবায়ে একটি ক্ষুদ্র সশস্ত্র বাহিনী গঠনপূর্বক প্রথম সুযোগে তুরস্ক সরকারের বিরোদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া দেন। ... এরূপে অতি অল্পকালের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করিয়া নজ্দ প্রদেশে ইবনে আব্দুল ওহাবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়া যায়। মোহাম্মদ ইবনে সৌদের সহিত তাহার এক কন্যার বিবাহ দিয়া ইবনে আব্দুল ওহাব সমগ্র নজদের শাসনক্ষমতা তাহার হস্তে অর্পণ করিয়া শুধু ধর্মীয় ব্যাপারে স্বয়ং সর্বময় কর্তা হইয়া রহিলেন।...

 ... বাগদাদের তুর্কী শাসনকর্তা নজ্দ এ ইবনে আব্দুল ওহাবকে দমন করার লক্ষে ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। কিন্তু যুদ্ধে তুর্কীবাহিনী পরাজিত হলে ইবনে আব্দুল ওহাব একটি নিয়মিত সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই আল্লামা ইবনে আব্দুল ওহাব ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এর অনুসারীরা অচিরেই আরও শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। ১৭৯১ সালে ওহাবীরা পবিত্র মক্কানগরী আক্রমণ করে। কিন্তু সম্পুর্ণ সফলকাম হতে পারেনি। ১৭৯৭ সালে এরা বাগদাদ আক্রমণ করে ইরাকের একটি এলাকা নজ্দ এর অন্তর্ভূক্ত করে নেয়।...

 ... এখানে আরও একটি ব্যাপার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ইবনে আব্দুল ওহাবের অনুসারীরা সব সময়েই নিজেদের মুজাহিদ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজরাই এদের ওহাবী নামকরণ করেছে। ১৮০১ সালে এ ধরণের প্রায় লক্ষাধিক মুজাহিদ পবিত্র মক্বানগরী আক্রমণ করে। কয়েক মাসব্যাপী এই যুদ্ধে মক্বানগরী মুজাহিদদের দখলে আসে এবং মক্কায় তুর্কী শাসনের বিলুপ্তি ঘটে। ১৮০৩ সাল নাগাদ মুজাহিদরা (ওহাবীরা) পবিত্র মদিনানগরীর উপর কর্তৃত্ব বিস্তারে সক্ষম হয়। কিন্তু মুজাহিদরা কবরপূজা ও এ ধরণের অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপ বন্দের লক্ষ্যে এসব যুদ্ধের সময় মক্বা ও মদিনায় অবস্থিত দরবেশ ও পীর ফকিরদের কবরের উপর নির্মিত কতিপয় সৌধ ভেঙ্গে দেয়। এমনকি হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর রওজার একটা অংশ তাদের হাত হইতে সে সময় রক্ষা পায় না।’ 

 এদিকে পবিত্র মক্বা ও মদিনা নগরী দু’টি হস্তচ্যুত হওয়ায় তুর্কী খলিফা খুবই রাগান্বিত ছিলেন। তাই ওহাবীরা হযরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) রওজার অংশবিশেষ ভেঙ্গে দিয়েছে এই কথাটা এবং অন্যান্য কয়েকটি অভিযোগ তুর্কীরা সমগ্র বিশ্বে বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে রটিয়ে দিলো। এরই দরুণ ১৮০৩ থেকে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত আরবের বাইরে থেকে হজ্ব যাত্রীদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পেলো।...

 ...অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ এবং প্রকৃত ইসলামী রীতিনীতি সম্পর্কে আল্লামা ইবনে আব্দুল ওহাব যে ব্যাখ্যা দান (ওহাবীয়ত প্রচার) করেছিলেন, সেই দর্শন অচিরেই ভারত উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর কৃতিত্বের দাবিদার (ওহাবীয়ত প্রচারের দাবিদার) যথাক্রমে হাজী শরিয়ত উল্লাহ ও তদীয় পুত্র মুহাম্মদ মহসিন ওরফে পীর দুদু মিয়া, নিসার আলী ওরফে তীতুমির এবং সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী।’ 

 (এম. আর আখতার মুকুল কর্তৃক লিখিত ‘কোলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী’ ৮১ হইতে ৮২ পৃষ্ঠা)।

_______________

ইজহারে হক্ব

লেখক : অধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ আব্দুল করিম সিরাজনগরী (মা:জি:আ:)

 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন