পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর দ্বীন (ধর্ম)
আমাদের (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের) পূর্ববর্তী পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দকে স্মরণ করা এবং তাঁদের নবুওয়্যতে বিশ্বাস স্থাপন করা আমাদের ঈমানেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সঙ্গত কারণেই আল-কুরআন বিভিন্ন আয়াতে ইসলাম ধর্মকে ‘মিল্লাত-এ-ইবরাহীম’ (ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের ধর্ম) বলে উল্লেখ করেছে। এরশাদ হয়েছে:
১/ “এবং ইব্রাহীমের দ্বীন থেকে কে বিমুখ হবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে অন্তরের (দিক দিয়ে) নির্বোধ? আর অবশ্যঅবশ্য আমি পৃথিবীতে তাকে মনোনীত করে নিয়েছি; এবং নিশ্চয় তিনি পরকালে আমার খাস্ নৈকট্যের উপযোগীদের অন্তর্ভুক্ত।” [আল-কুরআন, ২:১৩০; মুফতী আহমদ এয়ার খাঁন (رحمة الله)-এর কৃত ‘তাফসীরে নূরুল এরফান’ বাংলা সংস্করণ]
২/ “এবং কিতাবীরা বল্লো, ‘ইহুদী কিংবা খৃষ্টান হয়ে যাও, সঠিক পথ পাবে!’ (হে হাবীব!) আপনি বলুন, ’বরং আমি তো ইব্রাহীমের দ্বীনকেই গ্রহণ করছি, যিনি সব রকমের বাতিল থেকে মুক্ত ছিলেন; আর তিনি তো ছিলেন না মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত’।” [আল-কুরআন, ২:১৩৫]
৩/ “আপনি বলুন, ‘আল্লাহ সত্যবাদী। কাজেই ইব্রাহীমের দ্বীনের ওপর চলো, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে আলাদা ছিলেন এবং অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।” [আল-কুরঅান, ৩:৯৫]
৪/ “এবং ওই ব্যক্তির চেয়ে কার দ্বীন উত্তম, যিনি আপন চেহারা আল্লাহর জন্যে ঝুঁকিয়ে দিয়েছেন এবং তিনি হন সৎকর্মপরায়ণ; এবং (তিনি) ইব্রাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করেছেন, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন? এবং আল্লাহ ইব্রাহীমকে আপন ঘনিষ্ঠ বন্ধুস্বরূপ গ্রহণ করেছেন।” [আল-কুরআন, ৪:১২৫]
৫/ “আপনি বলুন, ‘নিশ্চয় আমার রব্ব (প্রভু) আমাকে সোজা (সহজ, সরল) পথ দেখিয়েছেন; সঠিক দ্বীন, ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শ, যিনি সমস্ত বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন এবং মুশরিক ছিলেন না’।” [আল-কুরআন, ৬:১৬১]
৬/ “অতঃপর আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি যে ‘ইব্রাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করুন, যিনি প্রত্যেক বাতিল থেকে পৃথক ছিলেন এবং মুষরিক ছিলেন না’।” [আল-কুরআন, ১৬:১২৩]
৭/ “এবং আল্লাহর পথে জ্বেহাদ করো যেভাবে করা উচিত। তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি দ্বীনের ব্যাপারে কোনো সংকীর্ণতা রাখেননি; তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের দ্বীন; আল্লাহ তোমাদের নাম ‘মুসলমান’ রেখেছেন পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে এবং এ ক্বুরআনে, যাতে রাসূল তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী হন এবং তোমরা অন্যান্য লোকদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দাও। সুতরাং নামায ক্বায়েম করো, যাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধরো। তিনি তোমাদের অভিভাবক – কতোই উত্তম অভিভাবক এবং কতোই উত্তম সাহায্যকারী!” [আল-কুরআন, ২২:৭৮]
আল-কুরআনের ওপরোল্লিখিত আয়াতগুলো প্রত্যেককে পয়গম্বর ইব্রাহীম (عليه السلام)-এর দ্বীনের ওপর অটল, অবিচল থাকতে আদেশ করে। পয়গম্বর ইউসূফ (عليه السلام) কয়েদখানায় তাঁর সাথী দুই জনের স্বপ্নগুলো ব্যাখ্যা করার আগে অনুরূপ ধর্মীয় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছিলেন: “এবং আমি আপন পিতৃপুরুষবৃন্দ – ইবরাহীম, ইসহাক্ব, ও ইয়া’ক্বুবের ধর্মকে গ্রহণ করেছি।” [সূরা ইউসূফ, ৩৮ আয়াত]
এই আয়াতে করীমায় পূর্ববর্তী পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের যিকর তথা তাঁদের এবং তাঁদের উম্মতদের বিবরণ স্মরণ করাটা ধর্মের মৌলিক নীতিমালার একটি নীতি হিসেবে প্রণীত হয়েছে; আর এটা আম্বিয়া (عليه السلام)-মণ্ডলীর অনুশীলিত আচার-ও। আল-কুরআন ঘোষণা করে: “নিঃসন্দেহে, হে মাহবূব! আমি আপনার প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি, যেমন ওহী নূহ ও তাঁর পরবর্তী আম্বিয়াবৃন্দের প্রতি প্রেরণ করেছি।” [আল-কুরআন, ৪:১৬৩]
পূর্ববর্তী উম্মতদের পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীর বিবরণগুলো স্মরণ করা এবং হযরত ইবরাহীম (عليه السلام)-এর দ্বীন সম্পর্কে জানার বিষয়টি ঈমানদারদের অন্তর ও মস্তিষ্ককে আলোকোজ্জ্বল করার একটি উৎস। এটা তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
’যিকর’ (স্মরণ) একটি ব্যাপক বিষয়, যার জন্যে (আলাদা) একটা গোটা বই উৎসর্গ করা প্রয়োজন। স্মরণ ( ও উদযাপন) প্রত্যেক মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে প্রভাব ফেলে থাকে, তা অনুধাবন করেই আল-কুরআন আমাদের মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করে। এই বিষয়ে যিকর তথা স্মরণের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব শব্দ কুরআন মজীদে ব্যবহৃত হয়েছে, তা যাচাই করাটাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট হবে। ‘যিকর’ শব্দটি এই মহাগ্রন্থে আনুমানিক ২৬৭ বার উচ্চারিত হয়েছে, আর এর উদ্দিষ্ট অর্থ – ‘স্মরণ করা’, ‘স্মরণ করানো’ এবং ‘সংরক্ষণ করা’; এটা উপদেশ ও সতর্ক করার বেলায়ও ব্যবহৃত হয়েছে। খোদ আল-কুরআনকেই ‘আল-যিকর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, ‘আল-নিসইয়ান’শব্দটি কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে যিকরের বিপরীত
শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হলো, ‘ভুলে যাওয়া’, ‘ভুলে যাওয়ার কারণ হওয়া’, ‘কোনো কিছুকে তাৎপর্যহীন বলে অবহেলা করা’, এবং ‘কোনো কিছুকে পরিত্যাগ করা’। [আল-ফারাহিদী কৃত ‘কিতাবুল আইন‘, ৭:৩০৪-৫; ইবনে মানযূর প্রণীত ‘লিসান আল-আরব’, ১৫:৩২২-৩; এবং ফায়রোয আবাদী, ‘আল-কামূস আল-মুহীত’, ৪:৩৯৮]
আল্লাহতা’লা মানুষের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে যেসব (ঐশী) শিক্ষা যুগে যুগে প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলোর নির্যাস ছিল এক ও অভিন্ন; তথাপি মনুষ্য হাতের কারসাজিতে বিকৃতি সাধিত হয়ে সেগুলোর মর্মবাণী হারিয়ে গিয়েছিল। কুরআন মজীদ তাই নিজস্ব হেদায়াতকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে আপন বার্তাকে পুনঃ পুনঃ ব্যক্ত করেছে; এমন কি মহাগ্রন্থের অভ্যন্তরে অবস্থিত আদেশ-নিষেধও ঘনঘন পুনর্ব্যক্ত হয়েছে, যদিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে পাঠকের মস্তিষ্কে তাজা রাখাই উদ্দেশ্য। এ উপায়ে এর তাৎপর্য সম্পর্কে অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার উদ্দেশ্যটি সাধিত হয়, যার ফলে এর বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রেও প্রত্যেককে সচেতন করে তোলা হয়।
এটা মনে রেখেই এবাদত-বন্দেগীর বিষয়গুলো কীভাবে নবুওয়্যতের প্রচেষ্টাসমূহের উদযাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট, তা পরবর্তী অধ্যায়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। উপরন্তু, তাতে আরো ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের জীবনে খুশি-আণন্দ ও দুঃখ-বেদনার ঘটনাগুলো আমাদের মাঝে মানবতা, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধকে আবার ফিরিয়ে এনে থাকে।
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন