ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) কি শিয়া পন্থী ছিলেন?
❏ পাকিস্তানের দেওবন্দী মুহাদ্দিস সরফরায খাঁন সফদর ‘‘নূর আওর বাশার’’(উর্দূ) গ্রন্থের ৬৭ পৃষ্ঠায় ‘তাযকিরাতুল হুফ্ফায’ গ্রন্থের নাম দিয়ে দাবী করেছেন যে, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) নাকি শিয়াপন্থী ছিলেন, কিন্তু কিতাবের মূল ইবারত উলেখ করেননি। অনুরূপ ধোঁকাবাজী করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম ওহাবী দেওবন্দী মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী তার ‘বিভ্রান্তির অবসান’ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায়। অনুরূপ জঘন্য বক্তব্য দিয়েছেন চট্টগ্রামের পটিয়া মাদ্রাসার নামধারী হাদিস পন্ডিত রফিক আহমদ তার কুখ্যাত গ্রন্থ “মহা মানব (সাঃ) এর নূর প্রসঙ্গ বা নূর ও মানুষ” গ্রন্থের ৮১-৮৩ পৃষ্ঠায়।
❏ তিনি উক্ত গ্রন্থের ৮২ পৃষ্ঠায় লিখেন, “ফাযায়েলে নবী সম্পর্কে তার আনীত হাদিসগুলো এই অনির্ভরযোগ্য হাদিস সমূহের অন্তর্ভুক্ত।” নাঊযুবিল্লাহ!
তিনি তার গ্রন্থের মধ্যে আরো অনেক মিথ্যা বক্তব্য প্রদান করেছেন। উক্ত কুখ্যাত লেখকগণ অবশেষে ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) কে জোর করে শীয়া বানাতে চেয়েছিল।
তাদের মিথ্যাচারের জবাব:
এখন আমরা ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সম্পর্কে তিনি শিয়া ছিলেন কিনা এ সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিত আলোকপাত করবো।
(১) আল্লামা হাফেয যাহাবী (رحمة الله) [ওফাত. ৭৪৮ হি.] উক্ত ইমাম সর্ম্পকে বলেন :
قال أحمد: كان عبد الرزاق يحفظ حديث معمر. قلت: وثقه غير واحد، وحديثه مخرج في الصحاح وله ما ينفرد به، ونقموا عليه التشيع، وما كان يغلو فيه بل كان يحب عليا رضي الله عنه ويبغض من قاتله، وقد قال سلمة بن شبيب: سمعت عبد الرزاق يقول: والله ما انشرح صدري قط أن أفضل عليا على أبي بكر وعمر. وكان رحمه الله من أوعية العلم، -
-‘‘ইমাম আহমদ (رحمة الله) বলেন, তিনি বিখ্যাত রাবি হযরত মা‘মার (রহ.) থেকে হাদিস হিফয্ করেছেন। হযরত আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) তিনি অসংখ্য হাদিসের হাফেয ছিলেন। অসংখ্য মুহাদ্দিস তাকে সিকাহ বা বিশ্বস্ত বলে অবহিত করেছেন। বিশুদ্ধ হাদিসের কিতাব সমূহে তার বর্ণনাকৃত হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তার একক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার ব্যাপারে শিয়া হওয়ার দোষারোপ করা হয়েছিল। তিনি এ ব্যাপারে (শিয়াদের ন্যায়) সীমালঙ্ঘন করেননি বরং তিনি হযরত আলী (رضي الله عنه) কে ভালবাসতেন এবং তার বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরকে ঘৃণা করতেন। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত সালমা বিন সাবিব (رحمة الله) বলেন, আমি হযরত আব্দুর রাজ্জাক (رضي الله عنه) কে আল্লাহর কসম খেয়ে এ কথা বলতে শুনেছি যে, আল্লাহর কসম, হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) ও হযরত ওমর (رضي الله عنه) এর উপরে হযরত আলী (رضي الله عنه) কে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতে আমার মন কখনো উদ্যত ছিল না এবং তিনি জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন।’’ ১০৪
➥{আল্লামা ইমাম যাহাবী : তাযকিরাতুল হুফ্ফায : ১ম খন্ডের ৩৬৪ পৃ. রাবী নং ৩৫৭, ইমাম যাহাবী : মিযানুল ই‘তিদাল : ২/৪৭০-৪৭১ পৃ. রাবী নং ৫৪৫৭}
(২) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) লিখেন,
وهو ابن همام بن رافع الحافظ الكبير الصغاني أحد الاعلام صاحب التصانيف روى عن عبيد الله بن عمرو عن الأوزاعي والثوري ومعمر وخلائق وعنه أحمد وإسحاق وابن معين وجماعة وقد وثقه غير واحد وأخرج له الأئمة الستة ونقموا عليه التشيع وهو غير ثابت فيه بل كان يحب عليا رضي الله تعالى عنه ويبغض من قاتله وقد قال سلمة بن شبيب سمعت عبد الرزاق يقول والله ما انشرح صدري قط أن أفضل عليا على أبي بكر وعمر رضي الله تعالى عنهم - (شرح الشفا: ١/٤٢٨)
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক ইবনে হুমাম সাগানী (رحمة الله) যিনি ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের বড় একজন হাফেয, বিজ্ঞ জ্ঞানী গুণীদের একজন আর তিনি হচ্ছেন অনেক গ্রন্থে লেখক। তিনি ওবায়দুল্লাহ ইবনে আমর, আওযায়ী, ইমাম সুফিয়ান সাওড়ী, হযরত মা’মার (رحمة الله) ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমদ, ইমাম ইসহাক, ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন এবং অনেক বড় এক জামাতের ইমামগণ তার থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং তাকে সিকাহ বা বিশস্ত বলেছেন অসংখ্য মুহাদ্দিস। প্রসিদ্ধ ছয়টি হাদিস গ্রন্থের ইমাম তাঁর হাদিস তাঁদের গ্রন্থে সিকাহ রাবী হিসেবে সংকলন করেছেন। কেউ কেউ তাকে শিয়া ধারণা করেছিলেন, কিন্তু তা মিথ্যা বা তাঁর ব্যাপারে প্রমাণিত নয়, তাদের সাথে তাঁর কোন সম্পর্কে ছিল না; বরং তিনি শুধু হযরত আলী (رضي الله عنه) কে ভালবাসতেন এবং তাঁর হত্যাকারীদেরকে ঘৃণা করতেন। হযরত সালমা বিন শাবিব (رحمة الله) বলেন, আমি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) কে কসম খেয়ে বলতে শুনেছি, আমার অন্তরে এ কথা কখনও জাগ্রত হয়নি যে, হযরত আলী (رضي الله عنه) হযরত ওমর ও হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) হতে উত্তম।’’ ১০৫
➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : শরহে শিফা : ১/৪২৮ পৃ:, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত।}
(৩) ইমাম যাহাবী আরও বলেন-
وقال أحمد بن الأزهر: سمعت عبد الرزاق يقول: أفضل الشيخين بتفضيل علي إياهما على نفسه، ولو لم يفضلهما لم أفضلهما، كفى بى إزراء أن أحب عليا-
-‘‘ইমাম আহমদ বিন আযহার (رحمة الله) বলেন, আমি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) কে বলতে শুনেছি যে তিনি বলেছেন, আমার অন্তরে কখনও একথা জাগ্রত হয়নি যে (শায়খাইন) হযরত আবু বকর ও উমর (رضي الله عنه) এর উপরে হযরত আলী (رضي الله عنه) কে প্রাধান্য দেয়া। আমি শুধু হযরত আলী (رضي الله عنه) কে ভালবাসি।’’ ১০৬
➥{আল্লামা ইমাম যাহাবী : মিযানুল ইতিদাল : ২/৪৭১ পৃ : রাবী : ৫৪৫৭}
(৪) আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) ‘মিরকাত’ গ্রন্থে বলেন,
عَبْدِ الرَّزَّاقِ: وَهُوَ مِنْ فُضَلَاءِ أَصْحَابِ الْحَدِيثِ، رَوَى عَنْهُ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ، وَيَحْيَى بْنُ مَعِينٍ وَغَيْرُهُمَا، وَهُوَ أَحَدُ الْمَشْهُورِينَ الْمُكْثِرِينَ مِنَ الرِّوَايَةِ، صَاحِبُ تَأْلِيفَاتٍ كَثِيرَةٍ
-‘‘যেমন উক্ত হাদিসটি ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) হতে বর্ণিত। তিনি হাদিস বিশারদদের মধ্যে মর্যাদাবানদের অন্যতম একজন। তার হতে রেওয়ায়েত করেছেন, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (رحمة الله) ও ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন (رحمة الله) সহ অন্যান্য বিখ্যাত ইমামগণ। তিনি মাশহুর ও অধিক বর্ণনা কারীদের মধ্যেও একজন, তিনি অনেক রচনাকারী।’’ ১০৭
➥{আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী : মিরকাত : ১/৪৬০, কিতাবুল ইলম : হা/২৪৬}
হাদিসের বাকী অংশ:
ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) হাদিসটি সম্পূর্ণ বর্ণনা করেছেন কিন্তু ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ মূল গুরুত্বপূর্ণ অংশটি তাদের কিতাবে উলেখ করেছেন।
❏ ইমাম দিয়ারবকরী (رحمة الله)সহ আরও অনেকে তার হাদিস গ্রন্থে বাকী অংশটি বর্ণনা করেছেন এভাবে-
ثم قسم الرابع أربعة اجزاء فخلق الشمس من جزء وخلق القمر من جزء والكواكب من جزء واقام الجزء الرابع فى مقام الرجاء اثنى عشر الف سنة ثم جعله أربعة اجزاء فخلق العقل من جزء والعلم والحلم من جزء والعصمة والتوفيق من جزء واقام الرابع فى مقام الحياء اثنى عشر الف سنة ثم نظر اليه فترشح النور عرقا فقرمنه مائة الف وعشرون الفا وأربعة الاف قطرة فخلق الله من كل قطرة نبيا ورسولا ثم تنفست ارواح الانبياء فخلق الله من انفاسهم نور ارواح الاولياء والسعداء والشهداء والمطيعين من المؤمنين إلى يوم القيامة فالعرش والكرسى من نورى والكروبيون والرحانيون من الملائكة من نورى وملائكة السموات التسبع من نورى والجنة وما فيها من النعيم من نورى الشمس والقمر والكواكب من نورى والعقل والعلم والتوفيق من نورى وارواح الانبياء والرسل من نورى والشهداء والسعداء والصالحون من نتائج نورى ثم خلق اثنى عشر حجابا فاقام النور وهو الجزء الرابع فى كل حجاب الف سنة وهى مقامات العبودية وهى حجاب الكرامة والسعادة والزينة والرافة والحلم والعلم والوقار والسكينة والصبر والصدق واليقين فعبد الله ذلك النور فى كل حجاب الف سنة فلما خرج ذلك النور من الحجب ركبه الله فى الارض فكان يضئ منه بين المشرق والمغرب كالسراج فى الليل والمظلم ثم خلق الله آدم من الارض وركب فيه النور فى جبهته ثم انتقل منه إلى شيث ولده وكان ينتقل من طاهر إلى طاهر ومن طيب إلى طيب إلى ان وصل إلى صلب عبد الله بن عبد المطلب ثم اخرجنى إلى الدنيا فجعلنى سيد المرسلين وخاتم النبيين ورحمة للعالمين وقائد الغر المحجلين هذا كان بدء نور يا جابر-
-‘‘অতঃপর চতুর্থভাগকে আবার চার ভাগ করলেন। প্রথম ভাগ দ্বারা সূর্য, দ্বিতীয়ভাগ দ্বারা চন্দ্র এবং তৃতীয়ভাগ দ্বারা নক্ষত্র সমূহ সৃষ্টি করলেন। চতুর্থ ভাগকে উচ্চাশার মাকামে বার হাজার বছর স্থিতিশীল রেখেছেন। অতঃপর তাকে চারভাগ করলেন। প্রথমভাগ দ্বারা বিবেক দ্বিতীয় ভাগ দ্বারা জ্ঞান ও গাম্ভীর্য এবং তৃতীয়ভাগ দ্বারা চারিত্রিক পবিত্রতা ও সামর্থ্য সৃষ্টি করলেন। চতুর্থ ভাগকে লজ্জাশীলতার মাকামে বার হাজার বছর স্থিতিশীল রেখেছেন। অতঃপর তার প্রতি এমন এক দৃষ্টি দান করলেন যে, ঐ নূর থেকে এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বিন্দু ঝড়ে পড়ল। আল্লাহ্ তা‘য়ালা প্রত্যেক বিন্দু থেকে নবী ও রাসূল সৃষ্টি করলেন। অতঃপর আম্বিয়ায়ে কেরামের রূহ সমূহ শ্বাস ফেলল তখন আল্লাহ্ তা‘য়ালা তাদের শ্বাস হতে কিয়ামত পর্যন্ত সৃজিতব্য সৎকর্ম পরায়ণ, শহীদ ও আনুগত্যশীল মুমিনদের আত্মার নূর সৃষ্টি করলেন। রাসূল (ﷺ) আরও বলেন, আরশ ও কুরসী আমার নূর হতে সৃজিত। মর্যাদাবান ও আত্ম জগতের ফেরেশতাগণ আমার নূর হতে সৃজিত। সপ্ত আসমানের ফেরেশতাগণ আমার নূর হতে সৃজিত। জান্নাত ও তার সমুদয় নিয়ামত আমার নূর হতে সৃজিত। বিবেক, জ্ঞান ও সামর্থ আমার নূর হতে সৃজিত। শহীদ, খোশ নসীব ও সৎকর্ম পরায়ণগণ আমার নূরী বাচ্চাগণ হতে সৃজিত। অনন্তর ‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা বারখানা পর্দা সৃষ্টি করলেন এবং নূরের চতুর্থভাগকে প্রত্যেক পর্দায় এক হাজার বছর করে স্থিতিশীল রেখেছেন। তা হল বন্দেগীর মাকাম সমূহ উদারতা, সৌভাগ্য, সৌন্দর্য, দয়া, সহানুভুতি, জ্ঞান, ভদ্রতা, গাম্ভীর্য, স্থিতিশীলতা, ধৈর্য, সততা ও বিশ্বাসের পর্দা সমূহ। অতঃপর ঐ নূর প্রত্যেক পর্দায় এক হাজার বছর করে ইবাদত করেছে। অনন্তর যখন ঐ নূর পর্দা সমূহ থেকে বের হল তখন আল্লাহ্ তাকে পৃথিবীতে স্থাপন করলেন। তখন সেটা উদয়াচল ও অস্তাচলের মধ্যে দীপ্তি ছড়াতে থাকে যেমন অন্ধকার রাতে উজ্জল প্রদীপ। অতঃপর ‘‘আল্লাহ্ তা‘য়ালা হযরত আদমকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করলেন এবং ঐ নূরকে তার ললাটে স্থাপন করলেন। তারপর ঐ নূর তার নিকট থেকে স্থানান্তর হয়ে তাঁর পুত্র হযরত শীষ (আ.) এর নিকট চলে আসে। এভাবে পবিত্র ব্যক্তি হতে পবিত্র ব্যক্তির নিকট উত্তম ব্যক্তি হতে উত্তম ব্যক্তির নিকট ঐ নূর স্থানান্তর হতে থাকে। অবশেষে তা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের পৃষ্ঠদেশে এল। [হুযূর (ﷺ)] ফরমান অতঃপর আল্লাহ্ আমাকে পৃথিবীতে বের করলেন এবং আমাকে সৈয়্যদুল মুরসালীন (তথা নবীদের সরদার), খা’তামুন্নাবিয়্যিন (নবীদের শেষ), রহমাতুলিল আলামীন ও কায়েদুল গুররিল মুহাজ্জিলীন (ধবধবে সাদা ললাট ও শুভ্র হাত-পা বিশিষ্টদের দিশারী) করেছেন। হে জাবের! এ হল তোমার নবীর নূরের সূচনা।’’ ১০৮
➥{ইমাম আব্দুর রায্যাক : জুযউল মুফকুদ মিনাল জুযউল আউয়্যাল মিনাল মুসান্নাফ : ১/৭৫ হা/১৮, আল্লামা শায়খ ইউসূফ বিন নাবহানী : জাওয়াহিরুল বিহার, আল্লামা শফী উকাড়ভী : যিকরে হাসীন : ২৩-২৪ পৃ.}
আহলে হাদিসদের প্রিয় নবীর হাদিস চুরির ইতিহাস:
আমাদের হযরতগণের দাবী যে, ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এর বর্তমান মার্কেটের ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থ দেখেছেন; কিন্তু উক্ত হাদিসটি দেখতে পাননি, তাই হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়।
জবাব: ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এর গ্রন্থে উক্ত হাদিসটি না থাকলে ৩৭-৪০ জন মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী ও তারা হাদিস শাস্ত্রের ব্যাপারে জ্ঞান শূন্য বলে বিবেচিত হবে। অপরদিকে ইমাম আব্দুর রাজ্জাকের মুসান্নাফ গ্রন্থের বিভিন্ন কপি বা পান্ডুলপি বিভিন্ন স্থানে ছিল। অপরদিকে লেবানন, মিশরসহ আহলে হাদিসদের লাইব্রেরীগুলোতে রাসূল বিদ্বেষী হওয়াতে আহলে হাদিস আলেমগণ ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এর বর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ৪০ টির বেশি হাদিস মূল গ্রন্থ হতে ফেলে দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো উক্ত জাবের (رضي الله عنه) এর বর্ণিত হাদিসটি। উক্ত আহলে হাদিসদের ধোঁকাবাজ সবার সামনে প্রকাশ করে দেওয়ার জন্য ইমাম আব্দুর রাজ্জাকের সেই হাদিসগুলো যা তারা জালিয়াতি করেছে তার ব্যাপারে আলাদা একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত দুবাই এর ওয়াকফ বিভাগের সাবেক পরিচালক আল্লামা ঈসা মানে হিমইয়ারী (মা.জি.আ) তিনি তার নাম দেন الجزء المفقود من الجزء الأول
আর উক্ত হাদিসগুলো কয়েকটি অধ্যায়ের হাদিস, যেগুলো লা মাযহাবীরা ফেলে দিয়েছে। সেগুলোর তিনি সেগুলো সন্নিবেশিত করেন অধ্যায়গুলো এভাবে-
১। كتاب الايمان অধ্যায় থেকে باب فى تخليق نور محمد صلى الله عليه وسلم পরিচ্ছেদের রাসূল (ﷺ) এর নূর প্রসঙ্গের হাদিস মোট ১৮ টি।
২। আর كتاب الطهارة (কিতাবতু তাহারাত) থেকে باب فى الوضوء ওজু পরিচ্ছেদের ১টি হাদিস।
৩। ত্বাহারাত অধ্যায়ের باب التسمية فى الوضوء পরিচ্ছেদের মোট ২টি হাদিস।
৪। উক্ত অধ্যায়ের باب اذا فرغ من الوضوء পরিচ্ছেদের মোট ৩টি হাদিস।
৫। উক্ত অধ্যায়ের باب فى كيفية الوضوء পরিচ্ছেদের ২টি হাদিস।
৬। উক্ত অধ্যায়ের باب فى غسل اللحية فى الوضوء পরিচ্ছেদের ২টি হাদিস।
৭। উক্ত অধ্যায়ের باب فى تخليل اللحية فى الوضوء পরিচ্ছেদের ৪টি হাদিস
৮। উক্ত অধ্যায়ের باب فى مسح الرأس فى الوضوء পরিচ্ছেদের ৩টি হাদিস।
৯। উক্ত অধ্যায়ের باب فى كيفية المسح পরিচ্ছেদের ২টি হাদিস
১০। উক্ত অধ্যায়ের باب فى مسح الأذنين পরিচ্ছেদের ২টি হাদিস
সর্বমোট ৪০টি সহীহ বিশুদ্ধ হাদিসকে তারা বাদ দিয়ে ইমাম আব্দুর রাজ্জাকের মুসান্নাফ গ্রন্থ প্রকাশ করে দিয়েছেন। তারা মনে করেছেন সত্য গোপন থাকবে, তা কখনও প্রকাশ হবে না। আল্লামা হিমইয়ারী এর গ্রন্থটি (আরবী) পাওয়াতে আমরা অনেক তথ্য জানতে পেরেছি এবং তিনি ভূমিকায় বলেছেন যে তাহা ৫০০ বছর আগের সংগৃহীত। আল্লামা হিমইয়ারী ইমাম আব্দুর রাজ্জাকের পান্ডুলিপির চিত্রসহ তার বইতে তুলে ধরেছেন এবং চ্যালেঞ্জ করেছেন যে তার কাছে একাধিক পান্ডুলিপি রয়েছে। আল্লামা হিমহিয়ারী উক্ত হাদিসগুলো সনদ সহকারে উলেখ করে প্রত্যেক রাবীর জীবনী ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে টিকায় উলেখ করেছেন। শুধু তাই নয়, উক্ত হাদিসগুলোর সমর্থনে হাদিস শাস্ত্রের কোন কোন কিতাবে প্রমাণ রয়েছে তাও তিনি টীকা আকারে সাজিয়েছেন।
তাই অনেক আলেম সমাজ এ হাদিস চুরির ইতিহাসটি না জানার কারণে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। উক্ত কিতাবটি আমার কাছেও রয়েছে, কারো প্রয়োজন হলে আমার সাথে যোগাযোগের করার অনুরোধ রইল।
এক জামাত মুহাদ্দিসগণ মিথ্যাচার করলেন?
আমাদের দেওবন্দী ও আহলে হাদিসদের দাবী ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এই হাদিস সংকলনই করেননি। এ হাদিস নিয়ে তাদের এ আপত্তিটিকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। কিতাব দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংঙ্কায় তাদের সবার বক্তব্য এক এক করে উল্লেখ করলাম না। আমাদের বক্তব্য হলো, এক জামাত হাদিস বিশারদগণ (প্রায় ৩৭ জন) এটি মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে ছিল বলে অভিমত পেশ করেছেন, আর যেই সমস্ত মুহাদ্দিসদের নামসহ তাদের কিতাবের নাম ইতোপূর্বে হাদিসের শেষে উল্লেখ করেছি। তাদের মধ্যে এমন কেহ নেই যিনি ধারণার উপরে হাওলা দিতেন।
দেওবন্দের শাইখুল হাদিস মাওলানা আনওয়ার শাহ ❏ কাশ্মীরী [ওফাত.১৩৫৩হি.] তিনি হচ্ছেন দেওবন্দী আলেমদের তালিকার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একজন। তিনি বুখারী শরিফ, তিরমিযি শরীফসহ বিভিন্ন হাদিসের কিতাবের শরাহও করেছেন। তিনি তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘‘আরফুশ্-শাযি শরহে সুনানে তিরমিযি’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে লিখেন-
أن أول المخلوقات نور النبي - صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، ذكره القسطلاني في المواهب بطريق الحاكم والترجيح لحديث النور على حديث الباب.
-‘‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম সৃষ্টি হল নূরে নাবী (ﷺ) যেটি ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) তাঁর মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া গ্রন্থে হাকেমের সূত্রে উল্লেখ করেছেন। আর তিনি সেখানে সবগুলো বর্ণনার মধ্যে (কলম/নূরে মুহাম্মদী/আক্বল সর্বপ্রথম সৃষ্টি বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে) নূরের হাদিসকে প্রাধান্য দিয়েছেন।’’ ১০৯
➥{আল্লামা আনোওয়ার শাহ কাশ্মীরী (ওফাত. ১৩৫৩ হি.), আরফুস সাযী শরহে সুনানে তিরমিযি, ৩/৩৯৪পৃ. হাদিস নং. ২১৫১, দারুল তুরাসুল আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ. ১৪২৫হি./২০০৪ ইং খৃ.}
তাই মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মালেক সাহেবকে বলবো, আপনি তার কবরে গিয়ে বলে আসুন কেন তিনি এ কথা কেনো লিখে গেলেন। আপনাদের দাবি অনুযায়ী দেওবন্দীদের থানবী সাহেব না হয় অর্থ সংকটে মূল কিতাব কিনতে না পেরে সরাসরি হাওয়ালা দেননি; কিন্তু অন্য মুহাদ্দিসদের বেলায়ও কী তাই!
এবার দেখুন, শাইখুল হাদিস আজিজুল হক বুখারীর অনুবাদে ৫ম খণ্ডে বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের দেওবন্দী সুপ্রসিদ্ধ শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক যিনি অসংখ্য কওমী দেওবন্দী আলেমদের উস্তাদ। তিনি সুপ্রসিদ্ধ দেওবন্দী আকায়েদের পত্রিকা মাসিক ‘আদর্শ নারীর’ ২০১২ ঈসায়ীর জানুয়ারী তথা রবিউল আউয়ালের সংখ্যার ‘‘মহানবীর (ﷺ) অলৌকিক বিলাদাত’’ শিরোনামের ১০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিদায়াতের নূরে সারাবিশ্ব আলোকিত হবে, তাই তাঁর শুভাগমন লগ্নে এসব নূরের বিকাশ ছিল। নবীজী (ﷺ) নিজেই ঐ নূরের আকর-নূরে মুজাস্সাম।’’
❏ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আজিজুল হক সাহেব খুব সুন্দর করেই রাসূল (ﷺ) কে নূরে মুজাস্সাম অর্থাৎ নবিজীর দেহ মোবারক নূরের তা বলে দিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আবদুল মালেকের মত তার ছাত্ররা এবং তার ছাত্রের ছাত্ররা আজ রাসুল (ﷺ) কে নূর বললেই আমাদেরকে কাফের ফাত্ওয়া দিতে শুরু করে। এখন তাদের সে ফাতওয়ায় তাদের শাইখুল হাদিস কী হন? আপনারাই বলুন? শাইখুল আজিজুল হক সাহেবের একটি বক্তব্য আমার খুব ভাল লেগেছে তা হল তিনি বুখারী শরীফের অনুবাদের ৫ম খণ্ডের শুরুর দিকে লিখেছেন এভাবে-‘‘এই হাকীকতে মুহাম্মদিয়াই হইল নিখিল সৃষ্টিজগতের সর্বপ্রথম সৃষ্টি। লৌহ-কলম, বেহেশত-দোযখ, আসমান-যমীন, চন্দ্র-সূর্য, ফেরেশতা এবং মানব-দানব সব কিছুই ঐ হাকীকতে মুহাম্মদিয়া বা নূরে মুহাম্মদীর পরে সৃষ্টি হইয়াছে।’’ ১১০
➥{শাইখুল হাদিস আজিজুল হক, বোখারী শরীফ, (অনুবাদ ও ব্যাখ্যা) ৫ম খণ্ড, ২-৩ পৃষ্ঠা, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, ৬৫, চক সারকুলার রোড, ঢাকা,-১২১১}
❏ মুফতি আমিমুল ইহসান (رحمة الله)‘র ছাত্র, ইমাম ও খতিব লালবাগ শাহী মসজিদ, সম্পাদক-মাসিক আল-বালাগ, তাফসীরকার রেডিও বাংলাদেশ, সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অফ গভর্নর, চেয়ারম্যান, তাফসীরে তাবারী প্রকল্প সম্পাদনা বোর্ড আল্লামা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম। যিনি অসংখ্য কওমী দেওবন্দী আলেমদের উস্তাদ।
❏ তিনি এ হাদিস প্রসঙ্গে যা লিখেছেন তা হলো-‘‘আবদুর রাজ্জাক তাঁর সনদ সহ হযরত জাবের এবনে আবদুল্লাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম! আমার পিতা মাতা আপনার প্রতি কোরবান হোক, আমাকে বলুন, আল্লাহ পাক সর্ব প্রথম আল্লাহ পাক কোন বস্তুটি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেনঃ হে যাবের ! আল্লাহ পাক সবকিছুর পূর্বে তোমার নবীর নূরকে সৃষ্টি করেছেন......দীর্ঘ হাদিস।’’ ১১১
➥{মওলানা আমিনুল ইসলাম, নূরে নবী (ﷺ), প্রথম খণ্ড, ৫ পৃষ্ঠা, আল বালাগ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, জুন, ১৯৯৯ ইং, রবিউল আউয়াল, ১৪২০হি.}
❏ বাংলাদেশের দেওবন্দী সুপ্রসিদ্ধ শাইখুল হাদিস আল্লামা মুফতি মনসূরুল হক যিনি অসংখ্য কওমী দেওবন্দী আলেমদের উস্তাদ। তিনি সুপ্রসিদ্ধ কওমী দেওবন্দী পত্রিকা মাসিক ‘আদর্শ নারীর’ ২০১২ ঈসায়ীর জানুয়ারী তথা রবিউল আউয়ালের সংখ্যার ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সারা জাহানের জন্য রহমত’’ শিরোনামের ৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘‘এই ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল এবং এতদুভয়ের যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টি রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর সৃষ্টির বরকতমণ্ডিত। তাঁর নূরে রহমত পরশিত করেই এসব কিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। সর্বপ্রথম মহান আল্লাহ মহানবী (ﷺ) এর নূরকে সৃষ্টি করেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)
তারপর সেই নূরকে কেন্দ্র করে অন্যান্য সকল কিছু, তথা আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, আলো-বাতাস, সমস্ত জীন-ইনসান এক কথায় সমগ্র জগতের সৃষ্টি হয়। (ইবনে আসাকির)’’ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! আপনারাই লক্ষ করুন মনসূরুল হক সাহেব কি সুন্দর করে নবিজির সৃষ্টি বর্ণনা দিলেন। অথচ তার সাথী আবদুল মালেকের কপালে এখনো হেদায়াত মিলেনি। আল্লাহ তার অনুসারীদের হিদায়াত নসিব দান করুক। তাহলে উনারা কি আবদুল মালেক সাহেবের ফাতওয়া মুতাবেক জাল হাদিসের তরফদারি ফরয মনে করে এগুলো উল্লেখ করেছিলেন? তার পত্রিকার লিখা পড়ে বুঝলাম, মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক সাহেবের প্রিয় মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী। এবার তিনি আমার বিরোদ্ধে লিখায় সবচেয়ে বেশী তার অভিমত পেশ করার চেষ্টা করেছেন। অথচ তিনি এই হাদিস উল্লেখ করে লিখেন-
قد ثَبت من رِوَايَة عبد الرَّزَّاق أولية النُّور المحمدي
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) এর বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় নূরে মুহাম্মাদী (ﷺ) সর্বপ্রথম সৃষ্টি।’’ ১১২
➥{আব্দুল হাই লাখনোভি, আছারুল মারফূ‘আ, ৪৩ পৃ. মাকতুবাতুল শারকুল জাদীদ, বাগদাদ, ইরাক।}
❏ পাঠকবৃন্দ! আপনারা গভীরভাবে লক্ষ্য করুন! যে তিনি রাসূল (ﷺ) কে নূরের সৃষ্টি মনে করেই এ হাদিসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। আজ দেওবন্দীরা এগুলো রীতিমতো গোপন করছে, এটা কতবড়ো মুনাফিকের পরিচয় এবং সত্য গোপনকারীর পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি এ গ্রন্থের আরেক স্থানে উল্লেখ করেন-
مَا يَذْكُرُونَهُ فِي ذِكْرِ الْمَوْلِدِ النَّبَوِيّ أَن نور مُحَمَّد خُلِقَ مِنْ نُورِ اللَّهِ بِمَعْنَى أَنَّ ذَاتَهُ الْمُقَدَّسَةَ صَارَتْ مَادَّةً لِذَاتِهِ الْمُنَوَّرَةِ وَأَنَّهُ تَعَالَى أَخَذَ قَبْضَة من نوره فخلق من نُورَهُ،
-‘‘যা নবি পাক (ﷺ)-এর মিলাদের আলোচনা কালে উল্লেখ করেছি যে, নিশ্চয় নূরে মুহাম্মাদী (ﷺ) আল্লাহর নূর হতে সৃষ্টি। এর অর্থ হল নিশ্চয় আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর সৃষ্ট নূরকে নিলেন ও নবি করীম (ﷺ) এর নূরকে সৃষ্টি করলেন।’’ ১১৩
➥{আব্দুল হাই লাখনোভি, আছারুল মারফূ‘আ, ৪২ পৃষ্ঠা}
❏ এর ব্যাখ্যায় তিনি নিজেই লিখেন-
قَالَ الزُّرْقَانِيُّ فِي شَرْحِ الْمَوَاهِبِ عِنْدَ شَرْحِ قَوْلِهِ مِنْ نُورِهِ إِضَافَةَ تَشْرِيفٍ
-‘‘ইমাম জুরকানী (رحمة الله) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তাঁর নূর হতে মানে এটি সম্মানের জন্য আল্লাহর দিকে নিসবত করা হয়েছে।’’ ১১৪
➥{আব্দুল হাই লাখনোভি, আছারুল মারফূ‘আ, ৪২ পৃষ্ঠা}
❏ তিনি এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট করে লিখেন-
أَيْ مِنْ نُورٍ هُوَ ذَاتُهُ لَا بِمَعْنَى إِنَّهَا مَادَةُ خَلْقِ نُورِهِ بَلْ بِمَعْنَى تَعَلُّقِ الإِرَادَةِ بِهِ بِلا وَاسِطَةِ شَيْء فِي وجوده.
-‘‘সেই নূরটি হল জাতি নূর। কিন্তু এর মমার্থ এই নয় যে সেটি আল্লাহর নূরের অংশ বিশেষ; তাই এজন্যই আল্লাহর দিকে নবিজীর নূর কে সম্পর্ক যুক্ত করা হয়েছে যে তাঁর নূরকে কোনরূপ মাধ্যম ব্যতীত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন।’’ ১১৫
➥{আব্দুল হাই লাখনোভি, আছারুল মারফূ‘আ, ৪২ পৃষ্ঠা}
২. ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) যদি এই হাদিস সংকলন না করে থাকেন কেন ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) অহেতুক এই কথা লিখেবেন-
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সনদসহকারে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।’’
(ইমাম কাস্তাল্লানী, মাওয়াহিবুল্লা দুনিয়্যাহ, ১/৪৮ পৃ.)
ইমাম কাস্তাল্লানী (رحمة الله) যদি সনদসহ না পেতেন তাহলে (بسنده) শব্দটি কেন আনলেন? সনদ না থাকলে তো رواه عبد الرزاق লিখাই যথেষ্ট ছিল। তাহলে তো দেখা যায় তিনি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হবেন? ইমাম কাস্তাল্লানীর এর পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ একমত যে র্জাহ ওয়া তাদীলের ক্ষেত্রে ইমাম কাস্তাল্লানী কখনও জাল হাদিসকে সহীহ বলেননি। শব্দের গ্রন্থনায় বুঝা যাচ্ছে তিনি এ হাদিসের সনদের ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় আস্থাশীল। কোন জীবনিকারকই হাফিয কাস্তাল্লানীর সম্পর্কে মিথ্যা হাদিস বর্ণনা কিংবা জাল হাদিস রচনার অপবাদ দেননি। তাঁর সমসাময়িক মনীষী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগের অগণিত পণ্ডিত ও ইসলামী চিন্তাবিদ সকলে এক বাক্যে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা, নির্ভরযোগ্যতা ও হাদিস বিষয়ে পারদর্শীতা সম্পর্কে একমত পোষণ করেছেন। আর মাওয়াহিবু ল্লাদুনিয়্যাহ হল তাঁর গ্রহণযোগ্য একটি কিতাব।
❏ এ গ্রন্থের প্রশংসায় হাজী খলিফা (ওফাত. ১০৬৭ হি.) লিখেন-
وهو: كتاب جليل القدر، كثير النفع. ليس له نظير في بابه.
-‘‘এটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন, অধিক উপকারী, এর উপমা নেই।’’
(হাজী খলিফা, কাশফুয যুনূন, ২/১৮৯৬ পৃ., দারুল কুতুব ইলমিয্যাহ, বয়রুত, লেবানন)
এ গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন শাহ আব্দুল আযিয মুহাদ্দেসে দেহলভী (رحمة الله) তার বুস্তানুল মুহাদ্দীসীন গ্রন্থে; এটি এখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে অনুবাদিতও প্রকাশিত হয়েছে। ইমাম জুরকানী (رحمة الله) এ গ্রন্থের শরাহ করেছেন কিন্তু তিনি ইমাম কাস্তাল্লানীর এ উক্তির কোন সমালোচনা করেননি।
(শারহুল মাওয়াহেব, ১/৮৯ পৃ.দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন)
৩. হাদিসের সনদ গবেষক, মুহাদ্দিস, ইমাম ইবনে হাজার মক্কী (رحمة الله) তাহলে কেন উল্লেখ করলেন-
رَوَاهُ عبد الرَّزَّاق أَنه - صلى الله عليه وسلم - قَالَ إِن الله خلق نور مُحَمَّد قبل الْأَشْيَاء من نوره
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন, সবকিছুর পূর্বে মহান রব রাসূল (ﷺ) এর নূর মোবারককে সৃষ্টি করেছেন।’’
(ইবনে হাজার হাইতমী, ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ, ২০৬ পৃ., দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।)
❏ তিনি তাহলে অন্য স্থানে সমর্থনে হাদিসটি এভাবে কেন উল্লেখ করেন-
فقد أخرج عبد الرَّزَّاق بِسَنَدِهِ عَن جَابر بن عبد الله الْأنْصَارِيّ رَضِي الله عَنْهُمَا قَالَ
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সনদসহকারে সাহাবী হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন তিনি বলেন,.....।’’
(ইবনে হাজার মক্কী, ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ, ৪৪ পৃ.)
❏ আল্লামা ইবনে হাজার হাইতমী এ কিতাবে অনেক ইখতিলাফী হাদিসের সমাধান দিয়েছেন; এটি যদি জাল হতো তিনি তাহলে অবশ্যই উল্লেখ করতেন। উক্ত মুহাদ্দিস তিনি তার আরেক গ্রন্থ ‘আফযালুল কুররা’ গ্রন্থেও এমনটি বলেই এটি উল্লেখ করেছেন।
৪. সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ইমাম মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) যিনি জাল যঈফ নির্ণয়ে কিতাব লিখেছেন তিনি স্বয়ং এই হাদিস উল্লেখ করার সময়ে লিখেছেন-
وروى عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله الأنصارى
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সনদসহকারে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত।’’
(মোল্লা আলী ক্বারী, মাওয়ারিদুর রাভী, ৮ পৃ.)
৫. আল্লামা ইয়াদরুসী (ওফাত. ১০৩৮ হি.) তিনি সুপ্রসিদ্ধ একজন মুহাদ্দিস। তিনি এই হাদিসটি এভাবে উল্লেখ করেন-
وروى عبد الرَّزَّاق بِسَنَدِهِ ان النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ [إِن الله خلق نور مُحَمَّد قبل الْأَشْيَاء من نوره فَجعل ذَلِك النُّور يَدُور بِالْقُدْرَةِ حَيْثُ شَاءَ الله وَلم يكن فِي ذَلِك الْوَقْت لوح وَلَا قلم الحَدِيث بِطُولِهِ
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সনদসহকারে সংকলন করেন, রাসূল (ﷺ) ইরশাদ করেন.....দীর্ঘ হাদিস।’’
(ইয়াদরুসী, নুরুস সাফর, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৪০৫ হি.)
৬. আল্লামা আজলূনী আশ-শাফেয়ী (رحمة الله) যিনি যঈফ, জাল এবং ইখতিলাফী হাদিসের উপর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাশফুল খাফা’ লিখেছেন। এই গ্রন্থের হাওয়ালা স্বয়ং আহলে হাদিসদের তথাকথিত ইমাম আলবানী পর্যন্ত তার গ্রন্থের অসংখ্য স্থানে দিয়েছেন। আল্লামা আজলূনী (رحمة الله) এই হাদিস উল্লেখের পূর্বে লিখেন-
رواه عبد الرزاق بسنده عن جابر بن عبد الله
-‘‘ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) সনদ সহকারে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন।’’
(আল্লামা আজলূনী, কাশফুল খাফা, ১/২৬৫ পৃ. হা/৮২৭)
এমন উদাহরণ স্বরূপ আরও ৩৭ জন মুহাদ্দিসের বক্তব্য তুলে ধরা যেতে পারে। তাহলে কি তারা ধারণার উপর হাওয়ালা দিতেন? নাউযুবিল্লাহ!
❏ আল্লামা শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (رحمة الله) তার মাদারিজুন নবুয়তের ২য় খণ্ডে গ্রন্থে এবং আল্লামা আব্দুল গণী নাবলুসী (رحمة الله) তার হাদিকাতুল নাদীয়ায় একে সহীহ বলেছেন; তাহলে তারা কিভাবে একে সহীহ বললেন?
এ হাদিস বিষয়ে কি বলেছিলেন ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله)!
❏ মাওলানা মতীউর রহমান তার ‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১৯৪ পৃষ্ঠায়, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩২৭ পৃষ্ঠায় এবং মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত ‘প্রচলিত জাল হাদীস’ গ্রন্থের ১৫৭ পৃষ্ঠায় তারা লিখেছেন যে, ইমাম আব্দুর রহমান জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) নাকি ‘আল-হাভী লিল ফাতওয়া’ কিতাবে নূরে মুহাম্মদী প্রথম সৃষ্টি হওয়ার হাদিসটিকে জাল বলেছেন। অথচ উল্লেখিত হাদিসটি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন:
لَيْسَ لَهُ إِسْنَادٌ يُعْتَمَدُ عَلَيْهِ
-“নির্ভর করা যায় ইহার এমন কোন সনদ নেই।”
(ইমাম সুয়ূতি: আল-হাভী লিল ফাতওয়া, ১ম খণ্ড, ৩৮৬ পৃ:)
ইমাম সুয়ূতি বলেননি যে, ইহার সনদ নেই, বরং তিনি বলেছেন নির্ভর করার মত সনদ নেই।
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার লিখিত ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থের ১৯২ পৃষ্ঠায় লিখেন-‘‘দশম হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ইমাম সুয়ূতী স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি অপ্রমাণিত ও অনির্ভরযোগ্য।’’
❏ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! তিনি একজন হাদিস গবেষক দাবী করে ইমামদের বক্তব্য কিভাবে তাহরীফ করে উল্লেখ করতে পারলেন! এ বিষয়ে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পাদিত গ্রন্থের ১৫৭ পৃষ্ঠায় ধোঁকার আশ্রয় নিয়ে লিখেছেন-‘‘মুহাদ্দিস আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রাহ.) নিশ্চিৎভাবে বলেন যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন কথা।’’
❏ মাওলানা মতিউর রহমান তার ‘এসব হাদীস নয়’ গ্রন্থের ১৯৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘বাক্যটি ভিত্তিহীন হওয়ার ব্যাপারে হাফেয সুয়ূতি মত ব্যক্ত করেছেন।’’ সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! কেহ একজন গিয়ে তাদের উচিত কেনো করছেন ইমামদের নামে মিথ্যাচার! পাঠকবৃন্দের সহজে তাদের মিথ্যাচারের বা ইমাম সুয়ূতির মত বিকৃতির ধোঁকাবাজি ধরতে চাইলে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের গ্রন্থের ৩২৭ পৃষ্ঠা দেখলেই যে কেহ বুঝতে পারবেন। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হচ্ছে উপরে উল্লেখিত তিনজন পণ্ডিতের কথা হুবহু মিল নেই, বরং ভিন্ন পণ্ডিত ভিন্ন রকম উল্লেখ করেছন।
❏ ইমাম সুয়ূতি মূলত ইমাম ছালাভী (رحمة الله) এর বর্ণিত হাদিসটি সম্পর্কে এরূপ বলেছেন। কেননা ইমাম সুয়ূতির উল্লেখিত হাদিসের মতন মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর হাদিসের মতনের সাথে সম্পূর্ণ মিল নেই। সর্বোপরি ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) এর উল্লেখিত হাদিসখানা ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (رحمة الله) বর্ণিত হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর হাদিসটি নয়। কারণ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর হাদিসের মতন এবং ‘আল হাভী লিল ফাতওয়া’ এর মতনে অনেক ব্যবধান রয়েছে। ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) তার আলোচনার মাঝে কোথাও বলেননি যে, এটি হযরত জাবের (رضي الله عنه) এর বর্ণিত মুসান্নাফের হাদিস। তাই ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ূতি (رحمة الله) এর এই কথা মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর হাদিসকে জাল-যঈফ বলার কোন সুযোগ নেই। বরং ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর হাদিসটির সত্যতা স্বীকার করেছেন এবং তাঁর ‘খাসায়েসুল কোবরা’ কিতাবে হাদিসটি চয়ন করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
❏ ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর তার ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থের ৩২৯ পৃষ্ঠায় ‘শায়েখ আব্দুল্লাহ গুমারী’ একটি কিতাবের বরাতে লিখেন-
روى السيوطى فى الخصائص الكبرى لمصنف عبد الرزاق
-“ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) তাঁর ‘খাসায়েসুল কুবরা কিতাবে মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর রেফারেন্সে হাদিস খানা বর্ণনা করেছেন।”
(ইরশাদুত তালেবীন নজীব ইলা মা ফিল মাওলিদিন নাববী মিনাল আকাজিব, ৯-১০ পৃ.)
অতীব আফসোসের সাথে বিষয় হল, বর্তমানে সেই ‘খাসায়েসুল কুবরা’ কিতাব থেকেও এই হাদিসখানা বাদ করে দিয়েছে। আল্লাহ পাক সব সত্যের পিছনে তার প্রমাণ রেখে দেন।
━━━━━━━━━━━━━━━━
🌍 তথ্যসূত্রঃ [শহিদুল্লাহ বাহাদুর গ্রন্থসমগ্র এপ্স]
ডাউনলোড লিংকঃ bit.ly/Sohidullah
অথবা, এপ্সটি পেতে প্লে স্টোরে সার্চ করুন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন