নৈতিকতা মানবের ভূষণ
মুহাম্মদ ওসমান গণি
----------
ধর্মবোধের প্রকৃত ভিত্তিই হল নৈতিকতা। এ জন্য ইসলামে নৈতিকতার গুরুত্ব ও প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। নৈতিকতা কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ, যা অপরের প্রতি দয়া-মায়া, ক্ষমা-মার্জনা, উদারতা-দানশীলতা, ধৈর্য, বিনয়-ন¤্রতা, মহানুভুবতা, সভ্যতা, সাধুপন্থা, অখন্ডতা, একত্রতা, পূর্ণতা, সর্বোপরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হওয়াকে বুঝায়। এক কথায় মানবিক গুণাবলীর সঠিক বিকাশ ও উৎকর্ষতা সাধনই নৈতিকতা। আর এটিই সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। যে সমাজের মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ যতটা বেশি হবে, ওই সমাজের মানুষ ততটাই শান্তি ও নিরাপত্তা উপভোগ করবে। মানুষ চাইলে তার নিজের ভেতরটাকে নৈতিকতার বিচিত্র গুণে গড়ে তুলতে পারে। নিজের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও বিশ^াসে যদি তার গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আধুনিক গবেষণাতেও দেখা গেছে জ্ঞানী-গুণীরা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ধর্মীয় আচার-আচরণ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও বিশ^াসের সাথে মানুষের মনোদৈহিক সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মে এমন সব হুকুম-আহকাম বিধিবিধান এবং নীতিমালা রয়েছে, যেগুলো মানুষের আত্মার প্রশান্তি নিশ্চিত করে এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখে। তেমনিভাবে নৈতিক গুণাবলি ব্যক্তির ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও সৌভাগ্য নির্ধারণে অবদান রাখতে পারে। নৈতিক গুণাবলীর গুরুত্ব এতো বেশি যে, একজন মানুষ যদি সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করে এমনকি প্রকৃতির সকল শক্তির উপর নিজের আধিপত্য বিস্তারও করে তাতে কোনো লাভ নেই, যদি না সে নিজের ভেতরের শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নিজের নফসের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে অক্ষম হলে প্রকৃত উন্নতি ও সৌভাগ্য অর্জন লাভে বঞ্চিত হবে। সমাজ জীবনে বসবাসরত প্রত্যেক মানুষের মাঝে দেখা দেয় প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি আর স্নেহ-মমতা। এ সবের উন্মেষ ঘটে তখনই, যখন মানুষের মাঝে নৈতিকতাবোধ থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, আজ আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা লোপ পেয়েছে। বিলুপ্তি ঘটছে ন্যায়পরায়ণতার। আর নৈতিকতা বর্জিত সমাজে দেখা দেয় পারিবারিক ব্যক্তিগত, দলগত বা জাতীয় জীবনে সংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, গীবত, পরনিন্দা ও পরশ্রীকাতরতা। একে-অপরের মাঝে সৃষ্টি হয় পর্যুদস্ত করার বাসনা। ফলে সৃষ্টি হয় নৈতিকতার অবক্ষয়।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনই শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। এ জন্য মহান আল্লাহ বিশ^ মানবতার জন্য প্রথম যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা হল শিক্ষা। আল্লাহ বলেন, ‘‘পড়ুন! আপনার রবের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন’’।
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন প্রাণী যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনই শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যে জাতি যতবেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। এ জন্য মহান আল্লাহ বিশ^ মানবতার জন্য প্রথম যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা হল শিক্ষা। আল্লাহ বলেন, ‘‘পড়ুন! আপনার রবের নামে, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন’’।
এ মর্মে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অমীয় বাণী, “প্রত্যেক নর নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা ফরয”। অতএব, শিক্ষাই শক্তি, যার মাধ্যমে মানুষ সবকিছু জানতে পারে, বুঝতে পারে এবং তদনুযায়ী কার্যে পরিণত করতে পারে। প্রকৃতার্থে জ্ঞান অর্জন দ্বারা মানুষ সত্য-মিথ্যার, ন্যায়-অন্যায়ের এবং হক্ব-বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে যারা এর বিপরীত, তারা অপরাধ জগতের সাথে মিশে যায় এবং তাদের মাধ্যমে নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়।
মানুষের মাঝে নৈতিকতার বিকাশ ঘটাতে ইসলামি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনন্য। কেননা ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহর নিকট মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম”। সর্বকালের সকল মানবের জন্য যুগোপযোগী একটি জীবন বিধান। কর্মহীন শিক্ষা যেমন অবাস্তব, ধর্মহীন শিক্ষাও ঠিক তেমনই ফলদায়ক নয়। কেবল ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ নির্দেশনা। ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকোচন করে কখনো নৈতিক শিক্ষা আশা করা যায় না। সঠিক সময়ে সমাজে সকলকে ধর্মীয় শিক্ষা না দেয়া গেলে তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি এবং নীতিবোধ নৈতিকতা জাগ্রত করা যায় না। তাই ধর্মীয় শিক্ষার অভাবকে নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ নির্ধারণ করা হয়। এ জন্যে রাসুল মানব সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় উদগ্রীব করার জন্য মানবকুলের কাছে তিনটি শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার কথা বলেছেন, যেগুলো মানবের নৈতিক জীবনের মৌলিক বিষয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানগণকে তিনটি (আদব) শিষ্টাচার শিক্ষা দাওঃ ১. তোমাদের নবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসা, ২. নবি দ. এর আহলে বায়তের (পরিবার বর্গ) ভালোবাসা এবং ৩. কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত।” [ফাওয়ায়েদ কৃত, আবু নসর আব্দুল করিম সিরাজী, জামিউস সগীর ৩১১ কৃত, আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ূতী, দায়লামী এবং ইবনে নাজ্জার।]
যুব সমাজ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, কারণ তাদের মাঝে এই ধর্মীয় শিক্ষাগুলো নেই বললে চলে। এই বিষয়গুলো যাদের আমলে থাকবে তারা কোনো দিন নৈতিকতার বিপরীত কোনো অসঙ্গতিপূর্ণ কাজে জড়াতে পারবে না। কেননা তার মাঝে ইসলামি শিক্ষা ও (আদব) শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিকতার পরশে তাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত। এজন্যই বলা যায় মানব চরিত্রের অলংকার হলো নৈতিকতা।
মানব জীবনে নৈতিকতার গুরুত্ব কোথায়? এরকম প্রশ্ন মানব মনে জাগতেই পারে। এর উত্তর হলো মানুষের ভেতরে ভালো এবং মন্দের লড়াই নিরন্তর চলতে থাকে। মনের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে মন্দ শক্তি সবসময় চেষ্টা করে মানুষকে বিপথে টেনে নিতে। সে সময় নীতি-নৈতিকতার চিন্তা সুবোধ হয়ে সারাক্ষণ মন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। এভাবেই নৈতিক গুণগুলো মানুষকে প্রবৃত্তির বিপরীত শ্রোত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। মানুষকে কখনো বিপথগামী হতে দেখলে নৈতিকতা বিশেষ সংকেত হিসেবে সতর্ক করে তোলে। মূলত এই শক্তিশালী নৈতিকতাই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ঈমান। আর এ ঈমান মানেই হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি বিশ^াস, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আরেকটু খোলাসা করলে বুঝা যায় আল্লাহর ভালোবাসা মানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালোবাসা, যা নৈতিকতার মূল চাবিকাঠি। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন, “হে মাহবুব আপনি বলুন! হে মানবকুল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও।” [সুরা আল ইমরান ৩/৩১]
কেবল এই ঈমানই পারে মানব গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে এবং মানব অস্তিত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। অপরদিকে নৈতিকতার পূর্ণতা তখনই বিশ^াসযোগ্য বা দৃঢ়তা লাভ করে, যখন তা অর্জিত হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দ্বন্দ্বহীন ঈমানের ভিত্তিতে।
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা যেমন ঈমান বা নৈতিকতা, তেমনিভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়া বা বিরূপ মন্তব্য পোষণ করা ঈমান বা নৈতিকতার বিপরীত। যার হৃদয়ে নৈতিকতার আমল থাকবে তার জন্য দুজাহানে শান্তি অবধারিত। অথবা তার বিপরীত আমল পরিলক্ষিত হবে তার জন্য অভিসম্পাত (লানত) এবং লাঞ্ছনাময় শাস্তি অবধারিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখেরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্চনার শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [ সুরা আহযাব ৩৩/৫৭]
আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা যেমন ঈমান বা নৈতিকতা, তেমনিভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়া বা বিরূপ মন্তব্য পোষণ করা ঈমান বা নৈতিকতার বিপরীত। যার হৃদয়ে নৈতিকতার আমল থাকবে তার জন্য দুজাহানে শান্তি অবধারিত। অথবা তার বিপরীত আমল পরিলক্ষিত হবে তার জন্য অভিসম্পাত (লানত) এবং লাঞ্ছনাময় শাস্তি অবধারিত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “নিশ্চয় যারা কষ্ট দেয় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখেরাতে এবং আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্চনার শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।” [ সুরা আহযাব ৩৩/৫৭]
ইসলামে নৈতিকতার ভিত্তি একেবারেই তাওহিদ ও রিসালাতে বিশ^াসের উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ এ নৈতিকতা গড়ে উঠবে আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত পালনের মাধ্যমে। বলা বাহুল্য যে, সাহাবা কেরামের মৌলিকতম শিক্ষাই ছিল আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান এবং তাঁর ইবাদাত করা এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও তাঁর সুন্নাত পালন করা। আমাদের জীবনেও নৈতিকতা সেই তাগাদা ও শিক্ষা নিয়ে আসে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন