শানে রিসালাত


 অতুলনীয় খুশবু

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান
----------------

হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপম ও আশ্চর্যজনক গুণাবলীর মধ্যে একটি হচ্ছে হুযূর-ই আকরামের পবিত্র ও মনোরম খুশবু। এটা তাঁর স্বত্তাগত ছিলো- কোনরূপ বাহ্যিক খুশবু ব্যবহার করা ব্যতিরেকেই। দুনিয়ার কোন খুশ্বুই হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র খুশ্বুর মতো হতে পারতোনা। সাইয়্যেদুনা হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করছেন- আমি সব ধরনের খুশ্বু, যেমন- মিশক ও আম্বর ইত্যাদির ঘ্রাণ নিয়েছি; কিন্তু নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খুশ্বুর চেয়ে বেশী কিংবা সেটার মতো কোনটাই ছিলোনা।
হযরত ওত্বাহ্ ইবনে ফারক্বাদ সুলামী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্ত্রী হযরত উম্মে ‘আ-সিম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেছেন-আমরা চার স্ত্রী হযরত ওতবার বিবাহাধীন। আর আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে এ চেষ্টা করতাম যেন অধিক থেকে অধিকতর খুশ্বু মেখে স্বামী ওতবাহর সান্নিধ্যে যাই। এ প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অধিক পরিমাণে খুশ্বু ব্যবহার করতাম; কিন্তু আমাদের মধ্যে কারো খুশ্বু ওতবাহর খুশ্বুর ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারতোনা; অথচ ওতবাহ্ শুধু এতটুকু খুশ্বু ব্যবহার করতেন যে, সামান্য তেল হাতে লাগিয়ে তা তাঁর দাঁড়িতে মালিশ করতেন; কিন্তু তাঁর খুশ্বু আমাদের প্রত্যেকের খুশ্বু অপেক্ষা বেশী (মনোরম) ছিলো। আর যখন ওতবাহ্ বাইরে যেতেন, তখন (আমাদের আশ-পাশের) লোকেরা বলতো যে, আমরা খুশ্বু ব্যবহার করেছি; কিন্তু কোন খুশবুই ওতবাহর খুশ্বুর মতো তত তীব্র ছিলো না।
হযরত উম্মে আ-সিম বললেন, আমি একদিন ওতবাহকে বললাম, ‘‘আমরা সবাই (আপনার সব স্ত্রী) খুশ্বু ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাই; কিন্তু তা আপনার খুশ্বুর ধারে কাছেও পৌঁছতে পারে না। এর কারণ কি?’’ তদুত্তরে তিনি (হযরত ওতবাহ্) বললেন, ‘‘রসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জীবদ্দশায় একবার আমার শরীরে ঘামাচি প্রচূর পরিমাণে দানা বেঁধেছিলো। (এ কারণে আমার মনে হতো যেন আমার সারা শরীরে আগুনের কয়লা জ্বলে ওঠেছে। তখন আমি হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে গিয়ে আমার এ রোগের কথা আরয করলাম, যাতে তিনি এর চিকিৎসা করে দেন। এরপর হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করলেন, ‘‘তোমার শরীর থেকে (অতিরিক্ত) কাপড় খুলে নাও। তখন আমি কাপড় খুলে হুযূর-ই আক্রামের সামনে বসে গেলাম। অতঃপর তিনি আপন বরকতময় হাত (আমার শরীরে) মালিশ করে দিলেন। তখনই আমার পিঠে ও পেটে এ খুশ্বু সৃষ্টি হয়ে গেছে।’’ এ হাদীস শরীফ ইমাম তাবরানী ‘মু’জামে সগীর’-এ বর্ণনা করেছেন।
এক ব্যক্তি তার কন্যাকে তার স্বামীর ঘরে পাঠানোর জন্য খুশ্বু তালাশ করলেন; কিন্তু পাওয়া যায়নি। লোকটি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে হাযির হয়ে তাঁর প্রয়োজনের কথা জানিয়ে কিছু খুশ্বুর জন্য দরখাস্ত করলেন; কিন্তু সেখানে তখন কোন খুশ্বু মওজূদ ছিলোনা। হুযূর-ই আকরাম একটি শিশি তলব করলেন, যাতে তাতে খুশ্বু পুরে দেওয়া যায়। একটি শিশি আনা হলো। হুযূর-ই আক্রাম আপন শরীর মুবারক থেকে ঘাম নিয়ে ওই শিশিতে পুরে দিলেন। আর এরশাদ করলেন, ‘‘যাও এটা তোমার কন্যার শরীরে মালিশ করতে বলো। যখন তা তার শরীরে মালিশ করা হলো, তখন সমগ্র মদীনা মুনাওয়ারায় সেটার খুশ্বু প্রবাহিত হলো। এরপর থেকে ওই ঘরের নামও হয়ে গেলো, ‘বায়তুল মুত্বাইয়্যাবীন’ (খুশ্বুদারদের ঘর)।
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, একদিন হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের ঘরে তাশরীফ আনলেন। আর দুপুরের সময় ‘ক্বায়লূলাহ্’ (শয়ন) করলেন। যেহেতু হুযূর-ই আক্রামের নিদ্রার সময় তাঁর শরীর মুবারক থেকে খুববেশী ঘাম বের হতো, সেহেতু আমার আম্মা, যাঁর নাম উম্মে সুলায়ম’, শিশি নিয়ে হুযূর-ই আক্রামের ঘাম মুবারক ওই শিশিতে সংরক্ষণ করতে লাগলেন।
ইত্যবসরে হুযূর-ই আক্রামের চোখ খুললো। আর এরশাদ করলেন, ‘‘হে উম্মে সুলায়ম এ কি করছো? তিনি আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহর রসূল! আপনার ঘাম মুবারক সংগ্রহ করছি, যাতে আমি তা খুশ্বু হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। কেননা, এর খুশ্বু সর্বাপেক্ষা উত্তম।’’ [মুসলিশ শরীফ]
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে এও বর্ণিত যে, যখন কোন সাহাবী হাযিরা দেওয়ার জন্য হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র দরবারে হাযির হতেন এবং তাঁকে পবিত্র দরবারে না পেতেন, তখন তিনি বের হয়ে রাস্তায় হুযূর-ই আক্রামের ওই খুশ্বুর ঘ্রাণ নিতে থাকতেন; যা তিনি ওই পথে তাশরীফ নিয়ে যাবার ফলে প্রবাহিত হতো। মদীনা মুনাওয়ারার যে যে পথে (অলিতে-গলিতে) হুযূর-ই আক্রাম তাশরীফ নিয়ে যেতেন, ওই রাস্তা ও গলিতে হুযূর-ই আক্রামের খুশ্বু প্রবাহিত হতো। সেটা অনুসরণ করলে সাহাবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম হুযূর-ই আক্রামের সাক্ষাথ পেয়ে যেতেন।
আজও মদীনা মুনাওয়ারার বাড়ী ঘর ও প্রাচীরগুলো থেকে হুযূর-ই আক্রামের প্রাণ সজীবকারী খুশ্বু প্রবাহিত হচ্ছে, যা দ্বারা আশিক্ব-ই রসূলগণের ভালবাসাপূর্ণ শির ও মগজ সুবাসিত হয়ে যায়। হযরত শুবায়লী বলেন, মদীনা তৈয়্যবার পবিত্র মাটিতেও বিশেষ ধরনের খুশ্বু আছে, যা মিশক ও আম্বরের মধ্যে পাওয়া যায় না। আবূ নু‘আইমের বর্ণনায় হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত হাদীস শরীফে তিনি বলেছেন, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা-ই আন্ওয়ারের উপর ঘাম মুবারকের ফোঁটাগুলো মুক্তার মতো দেখায়। এর খুশ্বু মুশ্ক অপেক্ষাও বেশী।
হাত মুবারকের খুশবু
হযরত জাবির ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন, একদা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার চেহারার উপর আপন হাত মুবারক বুলিয়ে নিয়েছিলেন। তখন আমি এমন ঠান্ডা ও খুশ্বু অনুভব করেছিলাম যেন তিনি তাঁর পবিত্র হাত আতরের পাত্র থেকে বের করে এনেছিলেন। যে কেউ হুযূর-ই আক্রামের সাথে করমর্দন করতেন, তিনি হাতে খুশ্বু পেতেন। তিনি যেই শিশুর মাথায় স্নেহ ভরে হাত বুলিয়ে দিতেন, সে তাঁর খুশ্বুর কারণে অন্য সব শিশু থেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রসিদ্ধ হয়ে যেতো।

জৈবিক চাহিদা (শৌচকর্ম) পূরণের সময় যমীন চিরে যেতো
যখন হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ক্বাযা-ই হাজত (জৈবিক চাহিদা পূরণ অর্থাথ শৌচকর্ম সম্পাদন)-এর ইচ্ছা করতেন, তখন যমীন চিরে (ফাঁক হয়ে) যেতো। যমীন হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র পায়খানা ও প্রস্রাব নিজের মধ্যে গিলে ফেলতো আর ওই জায়গা থেকে খুশ্বু প্রবাহিত হতো। কেউই তাঁর পবিত্র পায়খানা দেখেনি। সাইয়্যেদাতুনা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করছেন, হুযূর-ই আনওয়ার ‘বায়তুল খালা’ (শৌচাগার) থেকে তাশরীফ আনার পর আমি গিয়ে দেখতাম। সেখানে আমি পায়খানা জাতীয় কিছু দেখতাম না। একদিন হুযূর-ই আক্রাম বলেছেন, হে আয়েশা! তুমি জান না, সম্মানিত নবীগণের পবিত্র উদর থেকে যা কিছু বের হয়, যমীন তা গিলে ফেলে। সুতরাং তা দেখা যায় না।

এক সাহাবী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি এক সফরে হুযূর-ই আক্রামের সাথে ছিলাম। তিনি হাজত পূরণের জন্য দূরে এক জায়গায় তাশরীফ নিয়ে গেলেন। যখন তিনি ক্বাযায়ে হাজতের পর সেখান থেকে তাশরীফ নিয়ে এলেন, তখন আমি ওই জায়গায়, যেখানে হুযূর-ই আকরাম শৌচকর্ম সম্পাদন করেছিলেন, গেলাম, দেখলাম। সেখানে পবিত্র পায়খানা-প্র¯্রাবের চিহ্ণ পর্যন্ত ছিলোনা। অবশ্য কয়েকটা ঢিলা সেখানে পড়ে ছিলো। আমি সেগুলো তুলে নিয়ে দেখলাম সেগুলো থেকে অতি মনোরম ও স্নিগ্ধ খুশবু আসছে।
কাযী আয়ায মালেকী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর শেফা শরীফে বর্ণনা করেছেন, হুযূর-ই আক্রামের আদত শরীফ ছিলো যে, তিনি প্রায়শঃ শৌচকর্ম সম্পাদনের পর ওযূ করতেন। ইমাম শাফে‘ঈ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একথা বলেছেন মর্মে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন।
প্রস্রাব মুবারক
বাকী রইলো, প্রস্রাব মুবারকের অবস্থা। এ সম্পর্কে বহু ঘটনা সাহাবা-ই কেরাম প্রত্যক্ষ করেছেন। হযরত উম্মে আয়মান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, যিনি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খিদমত আনজাম দিতেন ঘরে। তাঁর থেকে বর্ণিত আছে যে, রাতের বেলায় হুযূর-ই আক্রামের তখত (চৌকি শরীফ)-এর নিচে পাত্র রেখে দেওয়া হতো, যেন রাতে প্রয়োজনে তিনি তাতে প্র¯্রাব মুবারক করতে পারেন। সুতরাং তিনি এক রাতে তাতে প্র¯্রাব মুবারক করলেন। সকালে হুযূর-ই আক্রাম উম্মে আয়মানকে বললেন, ‘‘ওই তখতের নিচে একটি পাত্র আছে সেটি বাইরে যমীনে রেখে দিয়ে এসো।’’ উম্মে আয়মান আরয কররেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ! রাতে আমার পিপাসা অনুভূত হয়েছিলো। আমি তা পান করে ফেলেছিলাম।’’ একথা শুনে হুযূর-ই আক্রাম মুচকি হাসলেন। তিনি উম্মে আয়মানকে না মুখ ধুয়ে ফেলতে বলেছেন, না আগামীতে এমনটি করতে নিষেধ করেছেন; বরং তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এখন থেকে তোমার পেটে কখনো ব্যথা হবে না।’’
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে- অন্য এক মহিলা, যার নাম বারাকাহ্ ছিলো, তিনিও হুযূর-ই আক্রামের ঘরের খিদমত করতেন। তিনিও একবার হুযূর-ই আক্রামের প্রস্রাব মুবারক পান করে ফেলেছিলেন। তখন হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করেছিলেন, ‘‘হে উম্মে ইয়ূসুফ! (বারাকার কুনিয়াথ) তুমি সব সময়ের জন্য সুস্থ হয়ে গিয়েছো। কখনো তুমি অসুস্থ হবে না। সুতরাং মহিলাটি জীবনে কখনো অসুস্থ হননি; ওই রোগ ব্যতীত, যা’তে তিনি এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে- এক ব্যক্তি হুযূর-ই আক্রামের প্রস্রাব মুবারক পান করে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাঁর শরীর থেকে খুশবু প্রবাহিত হতে থাকে; এমনকি তাঁর সন্তানদের কয়েক বংশ পর্যন্ত এ খুশ্বু প্রবহমান ছিলো।
এভাবে হুযূর-ই আক্রামের রক্ত মুবারকও পাক পবিত্র ছিলো এবং তা থেকেও মনোরম খুশবু প্রবাহিত হতো। ‘মাদারিজুন্নুবূয়ত’-এ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। অন্যান্য নির্ভরযোগ্য কিতাবাদিতেও এতদ্ সম্পর্কিত বহু বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ নিবন্ধে কলেবর বৃদ্ধি এড়ানোর জন্য সেগুলোর অনেকটাই বর্ণনা করা গেলো না। তবুও এসব বর্ণনা থেকে আমাদের আক্বা, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অতুলনীয় শান অতি উত্তমরূপে প্রতিভাত হয়। তাছাড়া, হুযূর-ই আকরাম তো আপন সত্ত্বার দিক দিয়ে সুবাসিত ছিলেন, উম্মতকেও সুবাসিত থাকার জন্য উথসাহিত করেছেন। তাই আতর খুশ্বু ব্যবহার করা সুন্নাত হিসেবে বিবেচিত । পুরুষগণ সব, সময় আর নারীরা তাদের স্বামীর সান্নিধ্যে থাকাকালে আতর-খুশ্বু ব্যবহার করবেন। তাঁরা গায়র মুহরিমদেরকে তাদের খুশ্বু অনুভব করতেও সুযোগ দেবেন না।

লেখক: মহাপরিচালক
আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।


http://www.anjumantrust.org

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন