নূরনবী ﷺ

অষ্টম অধ্যায়ঃ জশনে জুলুস:

প্রসঙ্গঃ     ঈদে     মীলাদুন্নবী     [ﷺ]    উদযাপন     উপলক্ষ্যে  জুলুস বা মিছিল বের করা
=========
নবী করীম [ﷺ]  যখন ভূমিষ্ঠ হন, তখন এমন কতিপয় আশ্চর্যজনক  ঘটনা ঘটেছিল,   যা সচরাচর   দেখা যায়  না।  প্রথম  ঘটনাটি  স্বয়ং বিবি  আমেনা  (رضي الله عنها) বর্ণনা করেছেন এভাবে-

”যখন  আমার  প্রসব   ব্যথা  শুরু  হয়,  তখন  ঘরে  আমি  প্রায় একা ছিলাম এবং আমার শশুর আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন     কা'বা      ঘরের     তাওয়াফরত।      আমি      দেখতে পেলাম,     একটি  সাদা  পাখির  ডানা   আমার  কলিজায় কী যেন মালিশ  করে  দিচ্ছে। এতে আমার ভয়ভীতি ও ব্যথা-বেদনা দূরীভূত হয়ে গেল। এরপর দেখতে পেলাম একগ্লাস   শ্বেতশুভ্র   শরবত   আমার   সামনে।   আমি   ঐ  শরবতটুকু     পান     করে     ফেললাম।      অতঃপর      একটি উর্ধগামী    নূর   আমাকে   আচ্ছাদিত   করে   ফেললো।  এ অবস্থায়     দেখতে     পেলাম,     আব্দে     মনাফ     (কুরাইশ)  বংশের  মহিলাদের  চেহারাবিশিষ্ট  এবং  খেজুর  বৃক্ষের  ন্যায়   দীর্ঘাঙ্গিনী   অনেক   মহিলা   আমাকে   বেষ্টন   করে  বসে  আছেন।    আমি   সাহায্যের  জন্য   'ওয়া  গাওয়াছা'  বলে  তাঁদের  উদ্দেশ্যে  বললাম,  আপনারা  কোথা  হতে  আমার বিষয়ে  অবগত হলেন? উত্তরে তাঁদের একজন বললেনঃ        আমি        ফেরাউনের        স্ত্রী       বিবি       আছিয়া। আরেকজন      বললেনঃ      আমি      ইমরান       তনয়া       বিবি মরিয়ম    এবং   আমাদের   সঙ্গিনীগণ    হচ্ছেন   বেহেশতী হুর। আমি  আরো দেখতে  পেলাম,   অনেক  পুরুষবেশী লোক     শূন্যে   দণ্ডায়মান    রয়েছেন।     তাঁদের   প্রত্যেকের হাতে     রয়েছে    রূপার     পাত্র।    আরো    দেখতে    পেলাম, একদল  পাখি    আমার  ঘরের   কোঠা   ঢেকে  ফেলেছে।   আল্লাহ   তায়ালা   আমার  চোখের  সামনের  সকল   পর্দা অপসারণ           করে         দিলেন         এবং         আমি          পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম      সব       দেখতে      পেলাম।      আরো       দেখতে   পেলাম,    তিনটি    পতাকা।    একটি    পৃথিবীর    পূর্বপ্রান্তে  স্থাপিত, দ্বিতীয়টি   পশ্চিমপ্রান্তে  এবং তৃতীয়টি স্থাপিত কা'বাঘরের  ছাদে।  এমতাবস্থায়  প্রসব  বেদনার  চূড়ান্ত  পর্যায়ে আমার প্রিয় সন্তান হযরত মুহাম্মদ [ﷺ] ভূমিষ্ঠ হলেন।”
(হযরত ইবনে আব্বাস সূত্রে মাওয়াহেবে লাদুনিয়া)।

খাছায়েছে        কুবরা        ও         তারীখুল       খামীস        গ্রন্থদ্বয়ে যথাক্রমে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী ও আল্লামা আবু বিকর   দিয়ারবিকরী  (رحمة   الله   عليهما)  বিবি  আমেনা  (رضي     الله     عنها)'র     একটি     বর্ণনা     এভাবে     লিপিবদ্ধ  করেছেনঃ

বিবি  আমেনা  বলেনঃ  ”যখন  আমার  প্রিয়  পুত্র  ভূমিষ্ঠ  হলেন,    তখন   আমি   দেখতে   পেলাম,    তিনি    সেজদায় পড়ে  আছেন।   তারপর   মাথা   উর্ধগামী  করে  শাহাদাৎ   অঙ্গুলি   দ্বারা  ইশারা  করে  বিশুদ্ধ  আরবি  ভাষায়  পাঠ  করছেন,أشهد أن لا اله   الا الله  وأنى  رسول الله 'আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্নী রাসূলুল্লাহ'।” (যিকরে জামীল সূত্রে)।

উপরোক্ত বর্ণনায় কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হলোঃ
(১)  নবী    করীম   [ﷺ]-এঁর    পবিত্র  বেলাদত  উপলক্ষ্যে  বেহেশত       ও       আকাশ       হতে       পবিত্র       নারী       ও       হুর  ফেরেশতাগণ   জুলুস     করে    বিবি     আমেনা   (رضي   الله عنها)'এঁর  কুটিরে  আগমন  করেছিলেন  এবং  নবীজী'র  সম্মানার্থে   দণ্ডায়মান  হয়ে  কিয়াম   করেছিলেন।     আর ফেরেশতাদের    হয়ে   এই    জুলুস   ছিল   আকাশ     ছোঁয়া জুলুস।  তাই  আমরাও  নবীজী'র  সম্মানে  কিয়াম  করি  ও জুলুস করি।

(২) নবী করীম [ﷺ]-এঁর নূরের আলোতে বিবি আমেনা (رضي     الله     عنها)     পৃথিবীর     পূর্ব-পশ্চিম     প্রান্ত       পর্যন্ত অবলোকন করেছিলেন।  যাদের   অন্তরে নবীজী'র নূর  বিদ্যমান,   সেসব    অলোগণেরও   দিব্যদৃষ্টি    খুলে     যায়। তাঁরা        লাওহে        মাহফুযও        দেখতে       পান।       (মসনবী শরীফ)।

(৩)     নবী      করীম      [ﷺ]-এঁর      জন্ম     উপলক্ষ্যে     বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান, আলো ও পতাকা দ্বারা সুসজ্জিত করা উত্তম। এটা আল্লাহ ও ফেরেশতাদের সুন্নত।

(৪) কোরআন   নাযিলের  ৪০ বৎসর  পূর্বেই  নবী করীম [ﷺ]  কোরআনের   গুরুত্বপূর্ণ  দুটি  আদর্শ  'কালেমা'  ও  'নামায' বাস্তবায়ন   করেছিলেন।  মূলতঃ থিওরেটিকাল কোরআন      নাযিলের      পূর্বেই     প্র্যাক্টিক্যাল      কোরআন (নবী)    নাযিল     হয়েছিলেন।    কোরআন   হলো   হাদিয়া। আর  নবী হলেন সেই হাদিয়ার মালিক। হাদিয়া ও তার মালিকের মধ্যে যে সম্পর্ক, তা সর্বজনবিদিত।

(৫) পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী [ﷺ] উপলক্ষে  জুলুছ এবং শুকরিয়ার   আনন্দমিছিল   বের   করা     ফেরেশতাদেরই অনুকরণ           (আনওয়ারে              আফতাবে           সাদাকাত)। মাওয়াহেব   গ্রন্থের  বর্ণনায়   আকাশ  হতে  জমীন  পর্যন্ত ফেরেশতাদের         জুলুছ         বা         মিছিল         পরিষ্কারভাবে  প্রমাণিত        হয়েছে।          আল্লাহপাক         বলেন-        “তোমরা আল্লাহর      ফযল       ও      রহমত      স্বরূপ       নবীকে       পেয়ে   আনন্দ-উল্লাস  করো।” (সূরা  ইউনুছ  ৫৮ নং আয়াতের তাফসীর দেখুন- রুহুল মায়ানীতে)। জালাল্দ্দুীন সুয়ুতি তাঁর          ’আল        হাভী        লিল        ফাতাওয়া’         গ্রন্থে         ঈদে মীলাদুন্নবীর  দিনে আল্লাহ’র  নির্দেশে   সব রকমের বৈধ আনন্দ-উল্লাসকে বৈধ বলে উল্লেখ করেছেন।

পূর্ব যুগের জুলুছঃ
৬০৪   হিজরীতে   ইরাকের   মুসিল    শহরে  বাদশাহ  আবু সাঈদ মুজাফফার উদ্দীন রাজকীয়  ভাব   ধারার  সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে    ঈদে    মীলাদুন্নাবী   পালন   করেছেন।  প্রাচীনকালে        ১০৯৫-১১২১        খৃষ্টাব্দে        মিশরে        ঈদে  মীলাদুন্নবী     [ﷺ]    উপলক্ষে      ধর্মীয়    জুলুছ    বের     করা হতো।   গণ্যমান্য  ব্যক্তিবর্গ  এতে  অংশ    নিতেন।   উযির  আফযলের যুগে এ আনন্দমিছিল  বের  করা  হতো।  এ  সময়    রাজপথসমূহ     লোকে     লোকারণ্য    হয়ে    যেতো। পরবর্তীতে এ উৎসবের প্রসার ঘটে আফ্রিকার অন্যান্য শহরে,            ইউরোপের            স্পেনে            এবং            ভারতবর্ষে।  (মাকরিজী, ইবনে খাল্লেকান)।

সুতরাং   যারা   জশনে  জুলুছকে   নূতন  প্রথা,   শিরক  ও বিদআত   বলে-  তারা অতীত ইতিহাস সম্পর্কে  সম্পূর্ণ  অজ্ঞ   এবং   ইসলামী   জ্ঞানের   ক্ষেত্রে   মুর্খ।   নবীবিদ্বেষ  তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছে।

(বিস্তারিত     ইতিহাস    জানার    জন্যে    দৈনিক       জনকণ্ঠ ৩০শে  আগস্ট ’৯৬  ‘মিলাদের ইতিকথা পড়ুন)। জশনে  জুলুছ বের করা কোরআনী আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত।


উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর 'শিয়া পরিচিতি' থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন