নূরনবী ﷺ

সাতাশতম অধ্যায়ঃ হিজরত ও হিজরী সনঃ

বিভিন্ন  মো’জেযা প্রদর্শন-  পাহাড়, জমিন  ও  বেহেস্তের উপর নবীজীর কর্তৃত্ব
=========
ইসলামের ইতিহাসে হিজরত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাহ্যিক      দৃষ্টিতে      কোরাইশদের      প্রাধান্য      লক্ষ্য      করা  গেলেও   আল্লাহর   পরিকল্পনা  অনুযায়ী হুযুর [ﷺ]-এঁর দেশত্যাগ      বা      হিজরত      ছিল      বিশ্বব্যাপী      ইসলামের  প্রাধান্য  বিস্তারের  প্রথম  সোপান। কোরাইশদের পতন   প্রকৃতপক্ষে       হিজরতের       ঘটনা       থেকেই       শুরু       হয়।  হিজরতের  সময়  ২০/২১  বছরের  যুবক  হযরত  আলী  (رضي  الله  عنه)-কে   আপন  বিছানায়  শুইয়ে  একদিকে  সাক্ষাৎ     মৃত্যুর    জন্য    তৈরী     করা,    পরক্ষণেই    আবার আমানতের মালামাল ফেরত দেয়ার জিম্মাদারী প্রদান করার  মধ্য দিয়ে হযরত   আলীর  দীর্ঘ হায়াতের   ইঙ্গিত  প্রদান করা হয়।

একশত       ঘেরাওকারীর      চোখে      ধূলা      নিক্ষেপ       করে নিরাপদে   ঘর    থেকে     তাদের   সামনে    দিয়ে   বের    হয়ে  যাওয়া,  হযরত   আবু  বকর  (رضي  الله   عنه)-এঁর  কাঁধে  চড়ে  ওজনশূন্য   হওয়া,   ছাওর গুহায় মাকড়সার জাল বুনানী,     কবুতরের     ডিম     পাড়া,     গুহার     মুখে     বৃক্ষের  ছত্রছায়া   প্রদান,  গুহার  ভিতরে   আবু  বকর  (رضي  الله عنه)-কে      সর্পে      দংশন,     হুযুর     [ﷺ]-এঁর       পবিত্র     থুথু  মোবারক     দিয়ে      সর্পবিষ     নিবারন,      পিপাসার্ত      আবু বকরের     জন্য    বেহেস্ত     হতে     পানির     নহর     পৃথিবীতে  আনয়ন, শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য কুদরতি গোপন   রাস্তা   তৈরী   এবং   সাগরকূলে   কুদরতি   নৌকা  প্রস্তুত          থাকা,           পশ্চাদধাবনকারী          সুরাকা           ইবনে মালেকের  ঘোড়ার পা সাতবার জমিনে ঢুকে যাওয়া ও জমিন      কর্তৃক     গ্রাস      করানোর     ক্ষমতা      নবী     করীম [ﷺ]-কে      প্রদান    করা    –     ইত্যাদি    মো’জেযা      প্রদর্শন  নবীপ্রেমিক      ঈমানদারদের        জন্য      এক       শিক্ষামূলক বিষয়। পাঠকদের পিপাসা  নিবারণের লক্ষ্যে  এক এক করে নিম্নে সেসবের বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো।

হিজরতের পটভূমিকাঃ
মি’রাজ     থেকে      প্রত্যাবর্তন     করার     পর      নবী      করীম [ﷺ]-এঁর  উপর কোরাইশদের অত্যাচার আরেক মাত্রা  বৃদ্ধি     পেল।    ঐ      বছরই    (দ্বাদশ      বর্ষ)    হজ্ব    উপলক্ষে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে  লোকেরা  হজ্বে আগমন করলো। ইয়াছরিব (মদীনা) থেকে ৭০ জন পুরুষ এবং ২  জন  মহিলা  মোট  ৭২  জনের  একটি  কাফেলা  হজ্বে  আগমন   করলো।   এর   পূর্বেও   একাদশ    বর্ষে  ১২   জন ১০ম  বর্ষে  ৬  জন   করে দুটি  দল বিগত   দু’বৎসরে হজ্ব মৌসুমে     এসে     ইসলাম      গ্রহণ      করে     মদীনায়       ফিরে গিয়েছিলেন।

এবারের (দ্বাদশ বর্ষ)  ৭২ জনের তৃতীয়   দলটি মিনাতে  রাতের    অন্ধকারে অতি গোপনে    নবী করীম [ﷺ]-এঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ  করলেন এবং নবী করীম [ﷺ]-কে  মদীনায়    চলে    যেতে    আমন্ত্রণ    জানালেন।    জান-মাল  দিয়ে          তাঁরা          নবী           করীম         [ﷺ]          ও         মোহাজির মুসলমানদেরকে রক্ষা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। নবুয়তের    দ্বাদশ    বর্ষের   জিলহজ্ব     মাসের   প্রারম্ভে    এ চুক্তি   হয়।    এই   বায়আতকে   বাইআতে   আকাবা    বলা হয়।      রাজনৈতিক    দৃষ্টিকোণ    থেকে    এর    গুরুত্ব    ছিল অপরিসীম।    কেননা,     এই    বায়আতের   মাধ্যমেই    নবী করীম          [ﷺ]          এবং          মক্কার          সাহাবাগণের          জন্য  বিদেশভূমিতে বিকল্প বাসস্থান  ও রাষ্ট্র নির্ধারিত  হলো। নবী করীম [ﷺ] সাহাবাগণকে মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ  দিলেন। সাহাবাগণ পরবর্তী ২ মাসে একা একা ও দলে দলে মদীনায় গমন করতে লাগলেন।

মদীনায়    ইসলামের   প্রসার    দেখে    আবু    জাহল   প্রমুখ কোরেশগন  তেলে-বেগুনে  জ্বলে   উঠলো।   নবী   করীম [ﷺ] জিলহজ্ব  চাঁদের শেষ  তারিখে হযরত আবু বকর  (رضي   الله  عنه)-কে  ডেকে   ইঙ্গিতে   বললেন-   “হে   আবু বকর,  তুমি  হিজরতের  জন্য  প্রস্তুত  থাকবে।  যে  কোন  মুহুর্তে আল্লাহর পক্ষ হতে মক্কাভূমি ত্যাগ করার নির্দেশ আসতে   পারে।”   আবু   বকর   সিদ্দিক   (رضي   الله   عنه)  খুশীতে      বলে    উঠলেন-    ”ইয়া    রাসুলাল্লাহ,    আমি    কি আপনার সঙ্গী হবো?” নবী করীম [ﷺ]  বললেন,  “তুমি আমার     জীবনের    সাথী,      হিজরতের     সাথী,     কবরের সাথী,    হাশরের   সাথী   এবং   বেহেস্তেরও   সাথী।    আমি প্রথম,    তুমি    দ্বিতীয়।”    এটাই      হুযুরের     ইলমে     গায়েব আতায়ীর প্রমাণ।

হুযুর  [ﷺ]-এঁর  একথা  অক্ষরে  অক্ষরে  সত্যে  পরিণত  হয়েছে এবং হবে। এই গোপন ইঙ্গিত পেয়ে হযরত আবু বকর   (رضي الله عنه) পরদিন  পহেলা  মহররম তারিখে ওকাজ বাজার   থেকে আটশত দেরহাম দিয়ে  দুটি  উট ক্রয়      করে      নবী         করীম      [ﷺ]-এঁর      খেদমতে        পেশ করলেন।    একটির    নাম    রাখা     হলো     কাস্ওয়া    এবং অপরটির  নাম  রাখা   হলো   আদ্বা।  হাশরের   দিনে  নবী করীম      [ﷺ]       কাস্ওয়ায়       আরোহণ        করে      হাশরের ময়দানে    যাবেন    এবং    আদ্বায়    আরোহণ    করে    বিবি  ফাতিমা    (رضي   الله    عنها)     হাশরের   ময়দানে    উঠবেন  (রুহুল বয়ান)।

প্রিয় নবীর দরবারে  যে দান কবুল হয়- তাই শ্রেষ্ঠ  দান। নবী করীম [ﷺ] উক্ত কাস্ওয়া নামক উটে জীবদ্দশায় আরোহণ    করতেন।    হুযুরের    ইনতিকালের    পর    উক্ত  কাস্ওয়া শোকে অল্পদিনের মধ্যেই একটি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে       ইনতিকাল     করে।     দ্বিতীয়      উট     আদ্বা     হযরত ওমরের   খিলাফতকালে   ইন্তিকাল     করে।    হুযুর    পাক [ﷺ]-এঁর       ব্যবহৃত      যাবতীয়      বস্তুর      বিশদ       তালিকা আল-বেদায়া      ওয়ান-নেহায়া      এবং     মাওয়াহিব     গ্রন্থে উল্লেখিত রয়েছে।

দুটি        উট       খরিদের         মাধ্যমে        হিজরতের       প্রাথমিক প্রস্তুতিপর্ব       শুরু     হয়।     সেজন্যই      মুহররমের       পহেলা তারিখ  (হিজরতের   প্রস্তুতি    দিবস)   থেকে  হিজরী  সন গণনা    শুরু   করা   হয়।   হযরত    আবু    বকর   (رضي   الله عنه)-এঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এরূপ করা হয়েছে। সুতরাং    যতদিন   হিজরী    সন    থাকবে   –   হযরত   আবু বকরের স্মৃতিও ততদিন অটুট থাক্বে।

মুহররম          ও          সফর          মাসে          কোরাইশ          সর্দারগণ  মুসলমানদের ব্যাপক   হারে  মদীনায়   যেতে দেখে  নানা চিন্তা-ভাবনা       করে         অবশেষে      সফর      মাসের       শেষ শনিবারে     দারুন    নাদ্ওয়া    নামক    মিলনায়তনে     এক পরামর্শ     সভা    আহবান     করে।     কোরাইশদের    বিভিন্ন গোত্র         ছাড়াও        অন্যান্য        গোত্রের         সর্দারগণ        উক্ত মিলনায়তনে     বা     পরামর্শগৃহে     একত্রিত     হলো।     নবী  করীম    [ﷺ]-এঁর   এই     ইসলামী    মিশনের    বিরুদ্ধে    কি ব্যবস্থা  নেয়া যায়, সে সম্পর্কে তিনটি প্রস্তাব  উত্থাপিত হলো। একটি হলো- হুযুর  [ﷺ]-কে  আটক করে রাখা। দ্বিতীয়  প্রস্তাব   হলো-   দেশ   থেকে   বহিষ্কার   করা   এবং তৃতীয়  প্রস্তাব     হলো-  জীবনে    শেষ   করে  দেয়া।  এমন  সময়  শয়তান  নজদ    দেশের  এক  বৃদ্ধের   সুরত    ধারণ করে    উক্ত    সভায়   হাযির   হলো।   একারণে   শয়তানের এক উপাধী হয় শেখে নজদী।

নজদ        দেশ       থেকেই      পরবর্তীকালে      মুহাম্মদ      ইবনে আবদুল   ওহাব   নজদী  ওহাবী    আন্দোলন  শুরু   করে। পরবর্তীকালে      তার        বংশধরগণ      ইংরেজদের       সাথে আঁতাত করে ১৯২৪  ইং সালে মক্কা ও মদীনাসহ গোটা আরবে       ওহাবী        রাজতন্ত্র        প্রতিষ্ঠা        করে।       বর্তমান শাসকগণ   ওহাবী শাসক। তারা    আরবের সমস্ত ধর্মীয় স্মৃতি ও মাযার  ধ্বংস  করে  ফেলেছে। বিবি  খাদিজার  মাযার,    বিবি    ফাতিমার      মাযার     ও     ইমাম      হাসানের মাযারসহ     জান্নাতুল     বাকী     ও     জান্নাতুল     মোয়াল্লার  সমস্ত   মাযার  ও     গম্বুজ  নিশ্চিহ্ন   করে   ফেলেছে।  এরা  সারা     পৃথিবীতে    ওহাবী     মতবাদ     চালু     করার    লক্ষ্যে ‘রাবেতা    আলমে    ইসলাম’     নামে     একটি     প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে        বিভিন্ন      মুসলিম       দেশে      ইবনেসিনা,       ইবনে তাইমিয়া,      কিং      খালেদ,      বাদশাহ     ফয়সল-     ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে এবং এগুলোর মাধ্যমে মানুষকে ওহাবী মতবাদে দীক্ষিত করছে। যেসব সংগঠন ওহাবী ও      মউদুদী      মতবাদ        প্রচার       করে,       উক্ত      প্রতিষ্ঠান  তাদেরকে    প্রচুর     আর্থিক    সাহায্য     দিয়ে    থাকে।    নবী করীম    [ﷺ]    চৌদ্দশত     বৎসর    পূর্বেই       এই     শয়তানী  ওহাবী  ফিৎনার    ইঙ্গিত   দিয়ে  গেছেন।  আল্লামা    ইবনে আবেদীন   তাঁর   ফতোয়া     শামী    গ্রন্থে   ওহাবী   ফিৎনার বিশদ    আলোচনা     করেছেন।    [দ্রষ্টব্যঃ   মিশকাত   শেষ খণ্ড,   ইয়েমেন   ও   শামের    বর্ণনার   অধ্যায়,   হাদিস   নং  ৬০১৩, বুখারী শরীফ -২/১০৫১]

নবী    করীম     [ﷺ]-এঁর     খেদমতে    জনৈক     সাহাবী     ঐ  শনিবার   সম্পর্কে   জিজ্ঞাসা   করলে      নবী   করীম   [ﷺ] এরশাদ করলেনঃ
يوم مكر وخديعة ان قريشا ارادوا ان يمكروا فيه -
অর্থাৎ “শনিবার হচ্ছে  মক্কর ও ধোকাবাজীর দিন। এই দিনে       কুরাইশগণ       (আমার       বিরুদ্ধে)       ষড়যন্ত্রমূলক  পরিকল্পনা তৈরী করেছে।” (নিহায়া)।

যাক, শয়তান শেখে নজদীর সুরতে সভায়  হাযির  হয়ে আবু      জাহলকে     লক্ষ্য      করে      বললো-     “আবুজাহেল কর্তক  শেষ  প্রস্তাব-  অর্থাৎ  নবীকে  জীবনে  শেষ  করে  দেয়াই  মঙ্গলজনক  এবং  বুদ্ধিমানের  কাজ  হবে।  তবে  প্রত্যেক   গোত্রকেই   একাজে   অংশ   নিতে   হবে।”   আবু  জাহিলসহ     উপস্থিত     সবাই     শেখে     নজদীর     পরামর্শ  মোতাবেক      ঐ      রাত্রেই        নবী     করীম     [ﷺ]-এঁর      গৃহে অভিযান পরিচালনা করার প্রস্তাব পাশ করে সভা ভঙ্গ করলো।    কোরআন  মজিদের  সুরা  আনফালে   তাদের এই কু-পরামর্শের কথা এভাবে উল্লেখিত হয়েছেঃ
واذ      يمكر       بك      الذين       كفروا        ليثبتوك       أو      يقتلوك      أو  يخرجوك-ويمكرون ويمكر الله والله خير الماكرين

অর্থঃ “হে রাসূল! ঐ সময়ের  কথা  স্মরণ   করুন, যখন কাফেররা আপনার ব্যাপারে   এই  দূরভিসন্ধি এঁটেছিল  যে,     হয়     আপনাকে     বন্দী     করে     রাখা     হবে,     অথবা  আপনাকে শহীদ করা হবে অথবা আপনাকে দেশান্তর  করে দেয়া  হবে। তারা  একদিকে দূরভিসন্ধি  আঁটছিল, অপর   দিকে   আল্লাহ   তায়ালা   কৌশলপূর্ণ   পরিকল্পনা  করছিলেন।     আল্লাহই     (দূরভিসন্ধির     বিরুদ্ধে)     উত্তম  পরিকল্পনাকারী।” (আনফালঃ ৩০)।

দারুন       নাদ্ওয়া      আজও      কাফেরদের      দূরভিসন্ধির   এসেম্বলী ও শয়তানের    আস্তানার  প্রতীকরূপে  চিহ্নিত হয়ে   আছে।       লাখনো   শহরে   ওহাবীদের   নাদ্ওয়াতুল  উলামা       নামক       মাদরাসাটি       আবুজাহেলের        দারুন  নাদওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

দারুন   নাদ্ওয়ার   সভা   ভঙ্গ     হওয়ার   পরপরই   হযরত জিব্রাইল  (عليه  السلام)   নবী  করীম [ﷺ]-এঁর খেদমতে কোরাইশদের       দূরভিসন্ধি       ও       পরিকল্পনার       সংবাদ  দিলেন   এবং   বললেন-   আজ   আপনি   নিজ   বিছানায়  শুবেন না- অর্থাৎ হিজরত করুন।
নবী করীম  [ﷺ] হযরত আলীকে    ডেকে   এনে  নিজের বিছানায় শুয়ে পড়তে বললেন এবং নিজের চাদরখানা গায়ে        চড়িয়ে     দিলেন।     হযরত      আলী     নির্ঘাত     মৃত্যু  জেনেও     বিনাদ্বিধায়    হুযুর    [ﷺ]-এঁর     বিছানায়     শুয়ে পড়লেন      এবং      গায়ের     উপর     চাদর      টেনে      দিলেন। পরক্ষণেই   নবী    করীম    [ﷺ]   বললেন  -  আমার  কাছে  মানুষের    গচ্ছিত    আমানতের    মাল      তিনদিনের    মধ্যে ফেরত  দিয়ে  তুমি  মদীনাতে চলে   যাবে। আমি এক্ষণই বের    হয়ে    যাচ্ছি।       কেননা     কোরাইশদের    একশজন, মতান্তরে সত্তরজন যুবক নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে আমার ঘর ঘেরাও করে রেখেছে- নিদ্রা যাওয়া মাত্র তারা ঘরে ঢুকে     আমাকে     শহীদ    করে     ফেলার    ফন্দি     এঁটেছে।  হযরত    আলী   (رضي   الله   عنه)   একদিকে    মৃত্যুর   জন্য প্রস্তুত-  অপরদিকে    নবী  করীম  [ﷺ]-এঁর ইঙ্গিতে বুঝে নিলেন, আপাততঃ আজ তিনি শহীদ হবেন না। কেননা আমানতের মাল  ফেরত দেয়ার   মধ্যে তিনদিনের  জন্য তাঁর বেঁচে থাকার ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল।

নবী করীম [ﷺ] এবার এরশাদ করলেনঃ
يا   علي   أنك   لن   تموت  حتى  احمرت  لحيتك   البياض  بالدم (البداية والنهاية)
“হে   আলী,   তুমি     সাধারণভাবে     মৃত্যুবরণ    করবে   না-  যতক্ষণ  না তোমার সাদা   দাঁড়ি রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে (বেদায়া)।”

দেখা    গেছে-     হযরত    আলী    ৬৩    বৎসর      বয়সে    এক খারেজী মুসলমানের (?) হাতে  কুফার জামে মসজিদে ফজরের নামাযে গমনের পথে শহীদ হন। হযরত আলী বৃদ্ধ    হয়ে   শহীদ   হবেন-     এ   সংবাদ     নবী    করীম   [ﷺ] আল্লাহ  প্রদত্ত  ইলমে  গায়েবের  মাধ্যমেই  দিয়েছিলেন।  কে কখন মারা   যাবে, নবী  করীম   [ﷺ]  পূর্বেই তা বলে গেছেন।                   আল্লাহ                   প্রদত্ত                   ইলমে                   গায়েব  অস্বীকারকারীদের   এ    ঘটনা   থেকে  শিক্ষা  গ্রহণ   করা উচিত।  কিন্তু    তারা  তাদের  মুরুব্বীদের   কথার  উপরই অটুট। তারা বলেছে, নবীজী গায়েব  জানেন না। অথচ ইলমে গায়েব জানা নবুয়তের জন্য শর্ত।

গৃহত্যাগ ও ছাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ:-
এবার   হযরত  আবু   বকর  সিদ্দিক (رضي الله  عنه)-এঁর ঈমানের  পরীক্ষা  শুরু  হলো।  নবী  করীম  [ﷺ]  হযরত  আলীকে  বিছানায়  শুইয়ে  এক   মুষ্টি    ধুলা    হাতে  নিয়ে  সূরায়ে   ইয়াসীনের   ৯    নং      আয়াতটি     (وَجَعَلْنَا   مِن   بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ  سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ  فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ  -) তিলাওয়াত  করে  তাতে    ফুঁক  দিয়ে  শত্রুদের   উদ্দেশ্যে ঘর থেকে নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকটি শত্রুর মাথায় ও চোখে সে ধুলা পৌঁছিয়ে দিলেন। তাঁরা চক্ষু     রগড়াতে  লাগলো।   এ  সুযোগে  নবী   করীম   [ﷺ] তাদের   সামনে  দিয়েই  বের হয়ে গেলেন-  অথচ তাদের কেউই নবী করীম  [ﷺ]-কে    দেখতে  পেলোনা। আল্লাহ রাখে   তো     মারে    কে?   নবীজির    কাজে   স্বয়ং   আল্লাহ শরীক   হয়ে    গেলেন।   নিজ   ঘর   থেকে    বের    হয়ে   নবী করীম      [ﷺ]    সোজা     হযরত     আবু     বকর    (رضي    الله عنه)-এর বাড়ীতে  গিয়ে দরজায়  কড়া নাড়লেন।   সঙ্গে   সঙ্গে   ”লাব্বাইকা   ওয়া    ছা'দাইকা”    বলে   হযরত   আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) দরজা খুলে দিলেন। নবী করীম  [ﷺ]  বললেন,  ”তুমি  কি  নিদ্রা   যাওনি  হে   আবু বকর?”    হযরত   আবু   বকর   সিদ্দীক    (رضي    الله   عنه) আরয করলেনঃ-

”ইয়া    রাসূলাল্লাহ!      যে    দিন     আপনি    আমাকে    প্রস্তুত থাকতে   ইঙ্গিত করেছিলেন,   সেদিন থেকেই  প্রতিরাত্রে আমি আপনার এন্তেজারে দরজায় দন্ডায়মান ছিলাম। একদিনের      জন্যও       আমি      রাত্রিতে      বিছানায়       পিঠ  লাগাইনি।”

অন্তরে মহব্বতের আগুন একবার জ্বলে  উঠলে  এমনি ভাবেই     চোখের       ঘুম       হারাম     হয়ে       যায়।     অন্ধকারে প্রয়োজনীয় টাকা   পয়সা ও প্রয়োজনীয় পাথেয়   তৈরি  করে দিচ্ছিলেন হযরত আবু   বকর (رضي الله  عنه)-এর দুই  মেয়ে হযরত  আসমা ও আয়েশা (رضي  الله عنهما)। হযরত আসমা (رضي  الله عنها)  নিজের দোপাট্টা  ছিড়ে এক অংশ দিয়ে  বোঝা  বেঁধে    দিলেন।   তাঁর এই ত্যাগে মুগ্ধ হয়ে   নবী   করীম [ﷺ] তাকে   ”জাতুন নাতাকাইন”  বা  দোপাট্টার  অধিকারিনী উপাধীতে  ভূষিত করলেন।  হযরত      আয়েশা      (رضي      الله      عنها)      পরবর্তী      সময়ে  ”সিদ্দীকা”   উপাধীতে    ভূষিত    হয়েছিলেন-    যখন   তাঁর পবিত্র  চরিত্রের   আয়াত  নাযিল  হয়েছিল।  একই   ঘরে   পিতা   সিদ্দীকে   আকবর,    এক   মেয়ে    হলেন   সিদ্দীকা এবং   অন্য  মেয়ে   আসমা  হলেন  ”জাতুন  নাতাকাইন।” হযরত আবু বকরের (رضي الله عنه) বংশের চার পূরুষ সাহাবী ছিলেন। এই গৌরব অন্য কোন সাহাবীর নসীব হয়নি।     হযরত       আবু      বকর     (رضي      الله      عنه),     তাঁর  পিতা-মাতা,    ছেলে-মেয়ে      এবং     জামাই    যোবাইর     ও নাতী       আব্দুল্লাহ      ইবনে      যোবাইর      সকলেই      সাহাবী  হওয়ার     গৌরব     অর্জন     করেছিলেন।     সাহাবী     ইবনে  সাহাবী ইবনে  সাহাবী  ইবনে  সাহাবী- অর্থাৎ  আব্দুল্লাহ ইবনে  আসমা  বিনতে আবু বকর ইবনে  আবু কোহাফা (رضي  الله   عنهم)   সকলেই  সাহাবী   ছিলেন।  এই    দুর্লভ সৌভাগ্য     হযরত    ইব্রাহীম     (عليه    السلام)-এর     বংশের কথা    স্মরণ    করিয়ে    দেয়।    নবী    করীম    [ﷺ]    যখনই  হযরত  হযরত   ইউসূফ  (عليه  السلام)-এর  কথা   উল্লেখ করতেন,      তখনই      বলতেন,      ইউসূফু      নবীউন,      ইবনু  নাবীয়্যিন, ইবনে নাবীয়্যিন, ইবনে  নবীয়্যিন – অর্থাৎঃ- ”ইউসূফ  ইবনে  ইয়াকুব  ইবনে  ইসহাক   ইবনে    ইব্রাহীম  আলাইহিমুস সালাম।”

রাত্রির   ঘন   অন্ধকার   ভেদ   করে   নবী   করীম   [ﷺ]   ও  হযরত আবু বকর (رضي الله عنه) মক্কা শহর ত্যাগ করে দক্ষিণে      অবস্থিত      ছাওর      পর্বতের      উদ্দেশ্যে      রওনা  দিলেন।  নবী  করীম  [ﷺ]  পায়ের  আঙ্গুলের  উপর  ভর  দিয়ে  পথ  চলছিলেন- যেন   পাছে  পদচিহ্ন বিশেষজ্ঞরা চিনে না  ফেলে।  কিছুদূর যাওয়ার পর কদম  মোবারক পাথরের  আঘাতে  ক্ষত  বিক্ষত  হয়ে   রক্ত   ঝরে  পড়তে লাগলো। এ অবস্থা দেখে হযরত আবু বকর (رضي الله  عنه)   নবী   করীম    [ﷺ]-কে   কাঁধে   তুলে   নিলেন।    কিন্তু তিনি   কোন    ওজন   অনুভব   করলেন   না।   নবী   করীম  [ﷺ]     একটু  মুচকি  হাসি  দিয়ে  বললেন,   ”আবু   বকর! নূরের কোন ওজন হয়না।” সুবহানাল্লাহ!

(চলবে)

++++++++++++
 উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি এর "  নূরনবী ﷺ" থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন