ছাব্বিশতম অধ্যায়:
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
----------------------
১। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলোঃ আল্লাহ তায়ালার পূর্ব পরিকল্পনা মোবাবেকই হযরত মুছা (عليه السلام) ৬ষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল- তাঁর প্রিয় হাবীব বারবার তাঁর দরবারে ফিরে যাক এবং বারবার তাঁর সাথে হাবীবের দীদার নসিব হোক। (তাফসীরে সাভী)
২। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হচ্ছেঃ ষষ্ঠ আকাশ থেকে আল্লাহর দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছেঃ যেভাবে বোরাকে নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবে ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বায়ান তাফসীরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বায়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর তিন আয়াত-এঁর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
والنجم -إذا هوى -ما ضل صاحبكم وما غوى -
অর্থঃ-“নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ [ﷺ] কখনও পথ ভুলেননি বা প্রথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।”
তাফসীরকারক বলেন- উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (رضي الله عنه)-এঁর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-কেই বুঝান হয়েছে। কেননা হুযুর [ﷺ]-এঁর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম।” আর هوى অর্থঃ- নিন্মগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় - “আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর শপথ।” আর ‘পথ ভুলেননি বা টের বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যর অর্থঃ যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।”
বোরাক বা রফরফের মাধ্যেমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হত না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ থেকে আসা কালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন- এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বায়ান-সুরা আন নাজম)। শুধু বাইতুল মোক্কাদাছে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারছী গ্রন্থ “রিয়াজুন নাসিহীন”- এ ইমাম জা’ফর সাদেক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- “মি’রাজ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ বোরাক বা ফেরেশতা- কিছুই সাথে ছিলো না”।
৩। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব হলোঃ একজন নবী ইনতিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও অন্যের উপকার করতে পারেন, যেমন উপকার করেছিলেন মুছা (عليه السلام) উম্মতে মুহাম্মদীকে। এভাবে আল্লাহ’র নবী এবং অলীদের উসিলায় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়। এ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ ও দলীল বিদ্যমানে আছে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় - হযরত মুছা (عليه السلام) আমাদের উপকারের জন্য ৬ষ্ঠ আকাশে দাঁড়িয়ে থেকে নবী করীম [ﷺ]-কে বারবার যাতায়াত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহীত ছিল। তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, তূর পর্বতে হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে বেহুঁশ হওয়ার কারণে আল্লাহকে দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজ রাত্রীতে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী বয়ে নিয়ে এসেছিলেন- তা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام)-এর তূর পর্বতের সাধ পূনরায় জেগে উঠে। তাই আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর বাহানায় নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর দরবারে বারবার ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। আমাদের জন্য সুপারিশ করা ছিল উপলক্ষ মাত্র। সুবহানাল্লাহ্! (তাফসীরে সাভী ২য় খন্ড ৮১৯ পৃঃ) একটি কাজে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উভয়বিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে উম্মতের কল্যাণ ও খোদা দর্শনে কোন বিরোধ নেই।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা (رضي الله عنه) বলেন-
کس کو دیکھا یھ موسی سے پوچھے کوی -
آنکھ والوں کی ھمت یھ لا کھون سلام -مصطفٰے -
অর্থঃ- “মুছা (عليه السلام) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মধ্যেমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন- তা মুছা (عليه السلام) কেই জিজ্ঞেস করো।” দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকেদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।” (হাদায়েকে বখশিষ- আলা হযরত)। রাসুলে খোদা [ﷺ] হলেন আল্লাহর দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)।
مصطفے آءنھ ظل خدا است -منعکس دورے ھمھ خوئے خداست -
আল্লাহর দীদার সম্ভব কিনা?
হাবীবে খোদা [ﷺ] স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখেছেন। আল্লাহর দীদার বা দর্শন সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলে কিভাবে এবং কোথায় সম্ভব? এ প্রসঙ্গটি এর সাথে সম্পৃক্ত বলে এ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
প্রথমতঃ নীতিগত ভাবে আল্লাহর দর্শন লাভ করা সম্ভব। নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করে জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করেছিলেন। চক্ষু মোবারক দিয়ে এবং হৃদয় দিয়েও তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর চোখ এবং কলব উভয়ের দর্শনই সমান গুরুত্ববহ। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- “তিনি চোখে যা দেখেছেন- হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।” (সুরা নাজমঃ ১১)
হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহর নূরের তাজাল্লী এই চোখে সহ্য করতে পারেন নি বলেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। বুঝা গেল- সহ্য করতে পারলে তিনি আল্লাহকে দেখতে পেতেন। দুনিয়ার চোখে আল্লাহকে দেখার আরয করার কারণে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন لن تراني অর্থাৎ- এই চোখে কখনো দেখতে পাবে না।
কিন্তু নবী করীম [ﷺ]-কে স্বচক্ষে দর্শন দিয়েছেন মি’রাজে। একবার নয়- দশবার। আর ৩৩ বার দর্শন দিয়েছেন দুনিয়াতে স্বপ্নে। (বোখারীর হাশিয়া- আহম্মদ আলী সাহরানপুরী - নামায দ্রষ্পব্য, রু’ইয়াতুল্লাহি, দারাকুতনী, হাদীস নং ২২৭, পৃ. ৩০৯)। মহিউদ্দিন আরবী (رضي الله عنه) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম [ﷺ]-এর মি’রাজ হয়েছিল ৩৪ বার। তন্মধ্যে ১ বার জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সচক্ষে এবং ৩৩ বার হয়েছিল স্বপ্নযোগে এবং রূহানীভাবে। সে সময় তিনি মদীনায় বিবি আয়েশা (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করেছিলেন। ঐ স্বপ্নের মি’রাজের ব্যাপারেই হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) বলেছেন যে , “আমি মি’রাজ রাত্রে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারককে আমার বিছানা হতে হারিয়ে ফেলিনি- বরং তিনি আমার বিছানায় শুয়েই মি’রাজ করেছেন”- অর্থাৎ স্বপ্নে আল্লাকে দেখেছেন। বাতিলপন্থীরা এই হাদীসকে মক্কার মি’রাজের সাথে একত্রিত করে বলেছে - হুজুরের স্বশরীরে মি’রাজ হয়নি। হাদীসের প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে বুঝতে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক!
আল্লাহ তায়ালা মদীনায় ৩৩ বার রূহানী সাক্ষাৎ দিয়েছেন নবীজির সাথে। স্বশরীরের মি’রাজ হয়েছিল মক্কা শরীফ থেকে, যে সময় হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) স্বামীগৃহে গমনই করেন নি। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) কর্তৃক হুযুর [ﷺ]-এঁর সশরীরে মি’রাজ অস্বীকৃতিসূচক বর্ণনা বা হাদিসখানা মদীনায় সংগঠিত রূহানী মি’রাজের সাথে সম্পর্কিত। মক্কা হতে মিরাজ গমনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, সলফে সালেহীন ও সাহাবায়ে কেরামের মত।
আউলিয়ায়ে কেরামগণ স্বপ্নে বা মোশাহাদার মাধ্যেমে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন বলে আক্বায়েদের কিতাবে উল্লেখ আছে। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه), ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمه الله عليه), এবং ক্বেরাতের সপ্ত ইমামের অন্যতম ইমাম হযরত ক্বারী হামযা (رحمه الله عليه) প্রমুখ অলীগণের আল্লাহ দর্শন এই শ্রেণীভূক্ত। আর পরকালে যখন মু’মিনই আল্লাহকে চাক্ষুস দেখতে পাবে বলে ২৩ জন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত মোতাওয়াতের হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়। (নিবরাছ)
কিন্তু কিছু কিছু জ্ঞানপাপী আলেম- যারা নিজেকে বড় আলেম বা শাইখুল হাদীস বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে- তারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করাকে অবাস্তব বলে এক ফতোয়ায় উল্লেখ করেছে। তারা এমনও দাবী করেছে যে, কোন সাহাবী- এমনকি নবী করীম [ﷺ] ও স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করার দাবী করেন নি। বাস্তবে বা স্বপ্নে আল্লাহর দীদারের ঘটনা নাকি গাজাখুরী কথা। হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) রচিত সিররুল আসরার কিতাবে বর্ণিত এ সম্পর্কীত হাদীসকে এই পাপীরা সনদবিহীন হাদীস বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
অধম লেখক (আব্দুল জলিল) ১৯৯৩ইং সনে ২৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী এক ফতোয়ায় তাঁদের দাবীকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ্, তাদেরই দেওবন্দ মাদ্রাসার কিতাব ”তালিকুছ ছবিহ্” ও ”ফয়যুল বারী শরহে বোখারী” দিয়ে এবং হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত তাদের কিতাব ”তানজিমুল আশতাত ফি হাল্লিল মিশকাত” থেকে সনদসহ হাদীস পেশ করে। এছাড়াও মোল্লা আলী ক্বারীর ”মিরকাত” গ্রন্থের মধ্যেও উক্ত হাদীসখানা লিপিবদ্ধ আছে। নবী করীম [ﷺ] উক্ত হাদীসে এরশাদ করেছেন, “আমি আমার প্রভূ আল্লাহ তায়ালাকে গোফবিহীন যুবকের ন্যায় (নিখুঁত) দেখেছি।” এই হাদীসখানা মোতাশাবিহি বা দুর্বোধ্য- যার প্রকৃত অবস্থা রহস্যাবৃত। কেননা, হানাফী মাযহাব মতে আল্লাহ’র কোন আকৃতি নেই। তাই বলে এ হাদীস সনদ বিহীন নয়। আমার উক্ত ফতোয়ায় সনদ উল্লেখ করেছি।
মোদ্দাকথা হলো- আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। হাশরের ময়দানে মু’মিনগণ দেখবে রহমানী অবস্থায়, আর কাফেররা দেখবে গযবী ও কাহহারী অবস্থায়। নবী করীম [ﷺ] ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ স্বচক্ষে দেখেনি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল হযরত ইবনে আব্বাছ (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে, “নবী করীম [ﷺ] আল্লাহ তায়ালাকে স্বচক্ষে দেখেছেন।” এভাবে বার বার বলতে বলতে তার (ইবনে হাম্বল) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে, হিজরতের সাত মাস পূর্বে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা যে-সব এলেম দান করেছেন, তা উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের এলেমের সমষ্টি বা ইলমে মুহীত। আরবী এবারত দেখুনঃ
صار علمه عليه السلام محيطا لجميع المعلومات الغيبية الملكوتية -
অর্থাৎঃ “হুযুর [ﷺ]-এঁর এলেম উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের বেষ্টনকারী।”
সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর “ইলমে গায়েব মুহীত” অস্বীকারকারীদের দাবী মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ওহাবী সম্প্রদায় ইলমে গায়েব মূহীত অস্বীকার করে। ইমামে রাব্বানী (رحمة الله عليه) বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা তাঁর খাছ ইলমে গায়ব বিশেষ বিশেষ নবীগণকে দান করেছেন। মকতুব নং ৩১০ প্রথম খন্ড। (আল্লাহর খাছ এলেম পাঁচটি। যথাঃ (১) কিয়ামতের বিষয় (২) বৃষ্টি বর্ষণ (৩) মাতৃগর্ভের সন্তান ছেলে-না মেয়ে (৪) আগামীদিনের রিযিক (৫) কোথায় কে মৃত্যু বরণ করবে। এগুলোর ইলম বিশেষ বিশেষ নবীকে দান করেছেন। (মকতুবাত শরীফ প্রথমখন্ড মকতুব নং ৩১০)। বুঝা যাচ্ছে-পঞ্চ গায়েবের এলেমও আল্লাহপাক তাঁকে দান করেছেন।
মি’রাজের রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-কে যেভাবে সম্মানিত করেছেন, তাতেই বুঝা যায়- তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অতিমানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু মৌলভি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মওদুদীর মতবাদ গ্রহণ করে নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর ‘দাস’ বলে বিভিন্ন মাহফিলে তাফসীরের নামে অপপ্রচার চালিয়েছেন। তিনি বলতে চান- عبده শব্দের অর্থ আল্লাহর দাস। নাউযুবিল্লাহ! আমরা বলতে চাই- তার দাবী অনুযায়ী-দাসের জন্য কি এত অভ্যর্থনা ও শাহী এন্তেজাম করা হয়? দাস হলো নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক। হিন্দুদের মধ্যে দাশ হলো চতুর্থ শ্রেণীর বা সর্বনিম্ন শ্রেণীর শুদ্র জাত। ”দাস” শব্দটি ২৭টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- “যার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় হয় এবং যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ প্রতীক্ষমান।”
আল্লামা ইকবাল عبده শব্দটির তাৎপর্য্য সুন্দরভাবে তার কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে-
عبد دیگر عبدہ چیزے دیکر -اوسر آپا انتظار این منتظ -
অর্থ্যাৎ- ‘আবদ’ এক জিনিস, আর ‘আবদুহু’ অন্য জিনিস। আব্দ অর্থ আল্লাহর জন্য এন্তেজারকারী এবং আবদুহু অর্থঃ- যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ্ এন্তেজারী করেন।
মি’রাজ থেকে নবী করীম [ﷺ] ফিরে এসে দেখতে পেলেন - বিছানা তখনও গরম রয়েছে। ভোরে তিনি কাবাগৃহে তশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বললেন। আবু জাহল প্রমুখ কোরাইশ দলপতিরা একথা শুনে পরীক্ষার ছলে বাইতুল মোকাদ্দাসের দরজা-জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা জানতো যে, নবী করীম [ﷺ] কোনদিন বাইতুল মোকাদ্দাস যান নি। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সাথে সাথে জিব্রাইলের মারফতে বাইতুল মোকাদ্দাসের পূর্ণ ছবি তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরলেন- যেন বর্ণনা দিতে হুযুরের তকলীফ না হয়। নবী করীম [ﷺ] দেখে দেখে সব বলে দিলেন। এতেও তারা ক্ষান্ত হলনা। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো- আপনি কি আমাদের কোন বাণিজ্য কাফেলা দেখেছেন? নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হাঁ, তারা মক্কার অতি নিকটে পৌঁছেছে এবং বুধবার সূর্য উঠার পূর্বেই তারা মক্কায় প্রবেশ করবে।” (বেদায়া)।
আবু জাহল প্রমুখ ঐদিন খুব ভোরে ঘরের ছাদে উঠে কাফেলার আগমন পরীক্ষা করতে লাগলো। এদিকে সূর্য উঠে উঠে অবস্থা-অথচ কাফেলা তখনো দৃষ্টি গোচর হচ্ছিলো না। আবু জাহল বললো- এবার পরীক্ষা হয়ে গেছে- নবীর মি’রাজ মিথ্যা। কেননা, তিনি বলেছেন- বুধবার সূর্য উঠার পূর্বে কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করবে- অথচ আমরা আমাদের দৃষ্টি পথে কাফেলার কোন চিহ্নই দেখছিনা। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর কথা ও সম্মান ঠিক রাখার জন্য সেদিন রাত্রিকে আরও দীর্ঘায়িত করে দিলেন – সূর্যের গতি থামিয়ে দিয়ে। পরে দেখা গেল, সূর্য উঠার পূর্বেই কাফেলা মক্কায় পৌঁছে গেছে। সুবহানাল্লাহ! (বেদয়া নেহায়া)।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর মি’রাজের ঘটনা সত্য প্রমাণিত করলেন। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। আবু জাহল নবীজীর মি’রাজ গমনকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করার জন্য হৈ চৈ শুরু করে দিল। সে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-কে বাড়ী হতে আসতে দেখে মি’রাজ বিষয়ে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলো। তার কথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) জিজ্ঞাসা করলেন, একথা কে বলেছেন? আবু জাহল উপহাস করে বললো, কে আর বলবে? তুমি যাঁর পিছনে এতদিন ঘুরছো, তিনি ছাড়া এমন অসম্ভব কথা আর কে বলতে পারে? তখন আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- “নবী করীম [ﷺ] বলে থাকলে সত্যই বলেছেন।” এ কথা শুনে আবু জাহল দমে গেল। আবু বকর (رضي الله عنه) নবীজীর খেদমতে গিয়ে মি’রাজ ঘটনার প্রকৃত অবস্থা জানতে চাইলেন। নবী করীম [ﷺ] ঘটনা স্বীকার করে এরশাদ করলেন, তুমি কিভাবে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে? আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- এটা বিশ্বাস করা তো অতি সহজ। এর চেয়ে কঠিন বিষয় ছিল আল্লাহ্কে না দেখে বিশ্বাস করা- এখন তাঁর কাছে যাওয়া তো অতি সহজ ব্যাপার। আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর উত্তর শুনে নবী করীম [ﷺ] এত প্রীত হলেন যে, ‘সিদ্দিকে আকবর’ খেতাবে তাঁকে ভূষিত করলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সব কথা এভাবে বিশ্বাস করা সিদ্দিকগণেরই পরিচায়ক।
সেযুগে বিজ্ঞানের জ্ঞান এত প্রসারিত ছিলো না। তাই তারা সময়ের সংকোচন এবং স্থানের সংকোচন সম্পর্কে ছিল সন্দিহান। গতিবেগ সম্পর্কেও তখনকার দিনে ধারনা ছিলো না। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এবং চাঁদের দেশে মানুষের গমনের ফলে মি’রাজের ঘটনা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আল্লাহর অসীম কুদরতের কোন সীমা নেই। তিনি আপন কুদরতে এবং নিজ ব্যবস্থাপনায় নবী করীম [ﷺ]-কে উর্দ্ধজগতে এবং লা-মাকানে নিয়ে তাঁর কুদরতের নিদর্শনাবলী, তাঁর যাত ও সিফাত দর্শন এবং তাঁর গোপন রহস্যরাজী সম্পর্কে অবহিত করেছেন- ঈমানদারদের জন্য নবীজীর কথাই সত্যতার মূলভিত্তি। এটাই মুমিনদের জন্য যথেষ্ঠ। “আল্লাহ সর্ববিষয়ে আপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বশক্তিমান” (ছুরা বাক্বারা)।
হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্বঃ
পবিত্র মি’রাজ প্রসঙ্গে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা দরকার। হুযুর পাক [ﷺ] নিজেকে ‘খোদার নূর হতে সৃষ্ট নূর’ বলে হাদীসে এরশাদ করেছেন। মানুষের প্রয়োজনেই তাঁকে মানবাকৃতি দান করা হয়েছে। আকৃতিতে বশর হলেও গুণাবলী এবং প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন ফেরেশতাদের চেয়েও অনেক উর্দ্ধে। তাঁর চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা, স্বভাব ও চরিত্র ছিল অনুকরণীয়। আমরা হলাম অনুসরণকারী মাত্র। তাঁর হুবহু অনুকরণকারী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা অনুকরণ বলা হয় সর্ববিষয়ে হুবহু সামঞ্জস্য রক্ষা করে অনুসরণ করাকে। এটা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হুযুর [ﷺ]-এঁর নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এবং দুনিয়াবী কাজ-কর্মের গুণাগুণ এবং আমাদের নামায-রোযার গুণাগুণ এক হতে পারে না।
আমাদের শরীরে মশা-মাছি বসে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর পবিত্র বদনে কোনদিন নাপাক মশা-মাছি বসেনি। আমাদের শরীরের ছায়া আছে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর ছায়া ছিলো না। কেননা তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর (কাজী আয়ায-শেফা শরীফ)। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত-এঁর আকিদা- যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
আম্বিয়াগণের দেহ মোবারক সম্পর্কে নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ
نحن معاشر الأنبياء اجسادنا كالجسد الملائكة -
অর্থাৎ “আমরা আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ মোবারক ফেরেশতাদের দেহের ন্যায় সূক্ষ্ম, অর্থাৎ নূরানী ও সুক্ষ্মতায় আমরা ফেরেশতাদের ন্যায়।” এরপরও কেহ হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহ মাটি বা সাদা মাটি দ্বারা গঠিত বলে অপপ্রচার চালালে এটাকে হাদীসের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।
হুযুর [ﷺ]-এঁর সুরত বা হাল তিনটি। সুরতে বশরী, সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কী। মি’রাজের রাত্রে তাঁর সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এটা বিশ্বাসের বিষয়, দেখার বিষয় নয়। মৌলভী ফজলুল করীম তার ‘নূরে মুহাম্মদীর হাকিকত’ বইয়ে একটি মৌযু হাদীস দ্বারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক মাটির তৈরী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ইবনে জওযীর মতে উক্ত হাদিসটি বানোয়াট ও জাল বলে বাংলা মাআরিফুল কোরআন ৮৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। শুধু বশরী ছুরত স্বীকার করলে বাকী ২টি সুরতকে অস্বীকার করা হয়।
বিঃ দ্রঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর তিন সুরতের অর্থঃ মানুষের কাছে মানুষের মত, ফেরেশতাদের কাছে ফেরেশতার মত এবং আল্লাহর কাছে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত অবস্থা।
১। সুরতে বাশারীর প্রমাণঃ قل انما انا بشر مثلكم “আমি শুধু সুরতে বা আকৃতিতে তোমাদের মত মানুষ।”
২। সুরতে মালাকীর প্রমাণঃ لي مع الله وقت لا يسعني فيه نبي مرسل ولا ملك مقرب
“আল্লাহর সাথে আমার এমন ঘনিষ্ট সময় আসে - যেখানে কোন প্রেরীত নবী অথবা নিকটবর্তী কোন ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।”
৩। সুরতে হাক্কী সম্পর্কে হাদীসে বর্নিত হয়েছঃ من رآني فقد راي الحق
“যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে, সে হক্ক-কেই দেখেছে।”
++++++++++++++
উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি এর " নূরনবী ﷺ" থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
----------------------
১। প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলোঃ আল্লাহ তায়ালার পূর্ব পরিকল্পনা মোবাবেকই হযরত মুছা (عليه السلام) ৬ষ্ঠ আকাশে অপেক্ষমাণ ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল- তাঁর প্রিয় হাবীব বারবার তাঁর দরবারে ফিরে যাক এবং বারবার তাঁর সাথে হাবীবের দীদার নসিব হোক। (তাফসীরে সাভী)
২। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব হচ্ছেঃ ষষ্ঠ আকাশ থেকে আল্লাহর দরবারে যাতায়াতের ক্ষেত্রে বা দুনিয়াতে ফেরত আসার ক্ষেত্রে রফরফ বা বোরাক ব্যবহারের উল্লেখ হাদিসের কিতাবে সরাসরি পাওয়া যায় না। তাফসীরে রুহুল মাআনীতে বলা হয়েছেঃ যেভাবে বোরাকে নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করেছেন, সেভাবে ফেরত এসেছেন। এটাই স্বাভাবিক ধারণা। তাফসীরে রুহুল বায়ান তাফসীরে রুহুল মাআনীরও পূর্বে রচিত- তাই এর মতামত অধিক শক্তিশালী। উক্ত তাফসীরে রুহুল বায়ানের গ্রন্থকার সুরা নাজম-এর তিন আয়াত-এঁর ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ
والنجم -إذا هوى -ما ضل صاحبكم وما غوى -
অর্থঃ-“নিম্নগামী তারকার শপথ! তোমাদের সাথী মুহাম্মদ [ﷺ] কখনও পথ ভুলেননি বা প্রথভ্রষ্ট হননি এবং টেরা বাঁকাও হননি।”
তাফসীরকারক বলেন- উক্ত আয়াত মি’রাজের ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত। সাধারণ অর্থে অস্তমিত তারকা হলেও ইমাম জাফর সাদেক (رضي الله عنه)-এঁর মতে ‘নাজম দ্বারা উক্ত আয়াতে নবী করীম [ﷺ]-কেই বুঝান হয়েছে। কেননা হুযুর [ﷺ]-এঁর এক হাজার নামের মধ্যে আন-নাজম একটি নাম।” আর هوى অর্থঃ- নিন্মগামী। তাহলে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় - “আল্লাহর দরবার থেকে নিম্নগামী তারকা মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর শপথ।” আর ‘পথ ভুলেননি বা টের বাঁকা হননি’- এই মন্তব্যর অর্থঃ যে পথে তিনি এসেছিলেন, সেপথেই ফিরত গিয়েছেন।”
বোরাক বা রফরফের মাধ্যেমে প্রত্যাবর্তন করলে একথার প্রয়োজন হত না। কেননা, তখন তো বোরাক বা রফরফই তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতো। সুতরাং নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ থেকে আসা কালীন সময়ে আল্লাহর কুদরতে একা একা যাতায়াত করেছেন- এটাই সুস্পষ্ট। কেননা, তিনি তো নূর। নূর ও আলো সব কিছু ভেদ করে সোজা গতিতে ধাবিত হয়, এটাই বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত (তাফসীরে ইবনে আব্বাস রুহুল বায়ান-সুরা আন নাজম)। শুধু বাইতুল মোক্কাদাছে এসে বোরাকে আরোহণ করে তিনি মক্কায় পৌছেন। ৭০০ বৎসর পূর্বের ফারছী গ্রন্থ “রিয়াজুন নাসিহীন”- এ ইমাম জা’ফর সাদেক (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করা হয়েছে- “মি’রাজ হতে ফিরে আসার পথে রফরফ বোরাক বা ফেরেশতা- কিছুই সাথে ছিলো না”।
৩। তৃতীয় প্রশ্নের জবাব হলোঃ একজন নবী ইনতিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরও অন্যের উপকার করতে পারেন, যেমন উপকার করেছিলেন মুছা (عليه السلام) উম্মতে মুহাম্মদীকে। এভাবে আল্লাহ’র নবী এবং অলীদের উসিলায় সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হয়। এ সম্পর্কে অসংখ্য প্রমাণ ও দলীল বিদ্যমানে আছে।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় - হযরত মুছা (عليه السلام) আমাদের উপকারের জন্য ৬ষ্ঠ আকাশে দাঁড়িয়ে থেকে নবী করীম [ﷺ]-কে বারবার যাতায়াত করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্যও এর মধ্যে নিহীত ছিল। তাফসীরে সাভীতে উল্লেখ আছে, তূর পর্বতে হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহ্ পাকের নূরের তাজাল্লীতে বেহুঁশ হওয়ার কারণে আল্লাহকে দর্শন করতে পারেননি। কিন্তু মি’রাজ রাত্রীতে নবী করীম [ﷺ] আল্লাহর সান্নিধ্যে ফানা হয়ে আল্লাহর যে তাজাল্লী বয়ে নিয়ে এসেছিলেন- তা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام)-এর তূর পর্বতের সাধ পূনরায় জেগে উঠে। তাই আল্লাহর তাজাল্লী দর্শনের জন্যই উম্মতে মুহাম্মদীর বাহানায় নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর দরবারে বারবার ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। আমাদের জন্য সুপারিশ করা ছিল উপলক্ষ মাত্র। সুবহানাল্লাহ্! (তাফসীরে সাভী ২য় খন্ড ৮১৯ পৃঃ) একটি কাজে কয়েকটি উদ্দেশ্য থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুতরাং উভয়বিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে উম্মতের কল্যাণ ও খোদা দর্শনে কোন বিরোধ নেই।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা (رضي الله عنه) বলেন-
کس کو دیکھا یھ موسی سے پوچھے کوی -
آنکھ والوں کی ھمت یھ لا کھون سلام -مصطفٰے -
অর্থঃ- “মুছা (عليه السلام) সেদিন কাকে দেখেছিলেন এবং তাঁর মধ্যেমে কার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন- তা মুছা (عليه السلام) কেই জিজ্ঞেস করো।” দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন লোকেদের দিব্য জ্ঞানের উপর শত সহস্র ছালাম।” (হাদায়েকে বখশিষ- আলা হযরত)। রাসুলে খোদা [ﷺ] হলেন আল্লাহর দর্শনের আয়না স্বরূপ (মসনবী)।
مصطفے آءنھ ظل خدا است -منعکس دورے ھمھ خوئے خداست -
আল্লাহর দীদার সম্ভব কিনা?
হাবীবে খোদা [ﷺ] স্বচক্ষে আল্লাহকে দেখেছেন। আল্লাহর দীদার বা দর্শন সম্ভব কিনা এবং সম্ভব হলে কিভাবে এবং কোথায় সম্ভব? এ প্রসঙ্গটি এর সাথে সম্পৃক্ত বলে এ সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করতে চাই।
প্রথমতঃ নীতিগত ভাবে আল্লাহর দর্শন লাভ করা সম্ভব। নবী করীম [ﷺ] মি’রাজ গমন করে জাগ্রত অবস্থায় স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ করেছিলেন। চক্ষু মোবারক দিয়ে এবং হৃদয় দিয়েও তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর চোখ এবং কলব উভয়ের দর্শনই সমান গুরুত্ববহ। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন- “তিনি চোখে যা দেখেছেন- হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।” (সুরা নাজমঃ ১১)
হযরত মুছা (عليه السلام) আল্লাহর নূরের তাজাল্লী এই চোখে সহ্য করতে পারেন নি বলেই বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। বুঝা গেল- সহ্য করতে পারলে তিনি আল্লাহকে দেখতে পেতেন। দুনিয়ার চোখে আল্লাহকে দেখার আরয করার কারণে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন لن تراني অর্থাৎ- এই চোখে কখনো দেখতে পাবে না।
কিন্তু নবী করীম [ﷺ]-কে স্বচক্ষে দর্শন দিয়েছেন মি’রাজে। একবার নয়- দশবার। আর ৩৩ বার দর্শন দিয়েছেন দুনিয়াতে স্বপ্নে। (বোখারীর হাশিয়া- আহম্মদ আলী সাহরানপুরী - নামায দ্রষ্পব্য, রু’ইয়াতুল্লাহি, দারাকুতনী, হাদীস নং ২২৭, পৃ. ৩০৯)। মহিউদ্দিন আরবী (رضي الله عنه) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন যে, নবী করীম [ﷺ]-এর মি’রাজ হয়েছিল ৩৪ বার। তন্মধ্যে ১ বার জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে ও সচক্ষে এবং ৩৩ বার হয়েছিল স্বপ্নযোগে এবং রূহানীভাবে। সে সময় তিনি মদীনায় বিবি আয়েশা (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করেছিলেন। ঐ স্বপ্নের মি’রাজের ব্যাপারেই হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (رضي الله عنها) বলেছেন যে , “আমি মি’রাজ রাত্রে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারককে আমার বিছানা হতে হারিয়ে ফেলিনি- বরং তিনি আমার বিছানায় শুয়েই মি’রাজ করেছেন”- অর্থাৎ স্বপ্নে আল্লাকে দেখেছেন। বাতিলপন্থীরা এই হাদীসকে মক্কার মি’রাজের সাথে একত্রিত করে বলেছে - হুজুরের স্বশরীরে মি’রাজ হয়নি। হাদীসের প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে বুঝতে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক!
আল্লাহ তায়ালা মদীনায় ৩৩ বার রূহানী সাক্ষাৎ দিয়েছেন নবীজির সাথে। স্বশরীরের মি’রাজ হয়েছিল মক্কা শরীফ থেকে, যে সময় হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) স্বামীগৃহে গমনই করেন নি। হযরত আয়েশা (رضي الله عنها) কর্তৃক হুযুর [ﷺ]-এঁর সশরীরে মি’রাজ অস্বীকৃতিসূচক বর্ণনা বা হাদিসখানা মদীনায় সংগঠিত রূহানী মি’রাজের সাথে সম্পর্কিত। মক্কা হতে মিরাজ গমনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, সলফে সালেহীন ও সাহাবায়ে কেরামের মত।
আউলিয়ায়ে কেরামগণ স্বপ্নে বা মোশাহাদার মাধ্যেমে আল্লাহর দিদার লাভ করেছেন বলে আক্বায়েদের কিতাবে উল্লেখ আছে। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه), ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (رحمه الله عليه), এবং ক্বেরাতের সপ্ত ইমামের অন্যতম ইমাম হযরত ক্বারী হামযা (رحمه الله عليه) প্রমুখ অলীগণের আল্লাহ দর্শন এই শ্রেণীভূক্ত। আর পরকালে যখন মু’মিনই আল্লাহকে চাক্ষুস দেখতে পাবে বলে ২৩ জন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত মোতাওয়াতের হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়। (নিবরাছ)
কিন্তু কিছু কিছু জ্ঞানপাপী আলেম- যারা নিজেকে বড় আলেম বা শাইখুল হাদীস বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে- তারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করাকে অবাস্তব বলে এক ফতোয়ায় উল্লেখ করেছে। তারা এমনও দাবী করেছে যে, কোন সাহাবী- এমনকি নবী করীম [ﷺ] ও স্বপ্নে আল্লাহর দীদার লাভ করার দাবী করেন নি। বাস্তবে বা স্বপ্নে আল্লাহর দীদারের ঘটনা নাকি গাজাখুরী কথা। হযরত বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (رضي الله عنه) রচিত সিররুল আসরার কিতাবে বর্ণিত এ সম্পর্কীত হাদীসকে এই পাপীরা সনদবিহীন হাদীস বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
অধম লেখক (আব্দুল জলিল) ১৯৯৩ইং সনে ২৭ পৃষ্ঠা ব্যাপী এক ফতোয়ায় তাঁদের দাবীকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ্, তাদেরই দেওবন্দ মাদ্রাসার কিতাব ”তালিকুছ ছবিহ্” ও ”ফয়যুল বারী শরহে বোখারী” দিয়ে এবং হাটহাজারী থেকে প্রকাশিত তাদের কিতাব ”তানজিমুল আশতাত ফি হাল্লিল মিশকাত” থেকে সনদসহ হাদীস পেশ করে। এছাড়াও মোল্লা আলী ক্বারীর ”মিরকাত” গ্রন্থের মধ্যেও উক্ত হাদীসখানা লিপিবদ্ধ আছে। নবী করীম [ﷺ] উক্ত হাদীসে এরশাদ করেছেন, “আমি আমার প্রভূ আল্লাহ তায়ালাকে গোফবিহীন যুবকের ন্যায় (নিখুঁত) দেখেছি।” এই হাদীসখানা মোতাশাবিহি বা দুর্বোধ্য- যার প্রকৃত অবস্থা রহস্যাবৃত। কেননা, হানাফী মাযহাব মতে আল্লাহ’র কোন আকৃতি নেই। তাই বলে এ হাদীস সনদ বিহীন নয়। আমার উক্ত ফতোয়ায় সনদ উল্লেখ করেছি।
মোদ্দাকথা হলো- আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন অবস্থায় নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। হাশরের ময়দানে মু’মিনগণ দেখবে রহমানী অবস্থায়, আর কাফেররা দেখবে গযবী ও কাহহারী অবস্থায়। নবী করীম [ﷺ] ছাড়া অন্য কোন সৃষ্টি আল্লাহকে প্রত্যক্ষ স্বচক্ষে দেখেনি। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল হযরত ইবনে আব্বাছ (رضي الله عنه)-এঁর বর্ণিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে জোর দিয়ে বলেছেন যে, “নবী করীম [ﷺ] আল্লাহ তায়ালাকে স্বচক্ষে দেখেছেন।” এভাবে বার বার বলতে বলতে তার (ইবনে হাম্বল) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল।
তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে, হিজরতের সাত মাস পূর্বে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহ তায়ালা যে-সব এলেম দান করেছেন, তা উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের এলেমের সমষ্টি বা ইলমে মুহীত। আরবী এবারত দেখুনঃ
صار علمه عليه السلام محيطا لجميع المعلومات الغيبية الملكوتية -
অর্থাৎঃ “হুযুর [ﷺ]-এঁর এলেম উর্দ্ধজগতের যাবতীয় গায়েবী বিষয়ের বেষ্টনকারী।”
সুতরাং নবী করীম [ﷺ]-এঁর “ইলমে গায়েব মুহীত” অস্বীকারকারীদের দাবী মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ওহাবী সম্প্রদায় ইলমে গায়েব মূহীত অস্বীকার করে। ইমামে রাব্বানী (رحمة الله عليه) বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা তাঁর খাছ ইলমে গায়ব বিশেষ বিশেষ নবীগণকে দান করেছেন। মকতুব নং ৩১০ প্রথম খন্ড। (আল্লাহর খাছ এলেম পাঁচটি। যথাঃ (১) কিয়ামতের বিষয় (২) বৃষ্টি বর্ষণ (৩) মাতৃগর্ভের সন্তান ছেলে-না মেয়ে (৪) আগামীদিনের রিযিক (৫) কোথায় কে মৃত্যু বরণ করবে। এগুলোর ইলম বিশেষ বিশেষ নবীকে দান করেছেন। (মকতুবাত শরীফ প্রথমখন্ড মকতুব নং ৩১০)। বুঝা যাচ্ছে-পঞ্চ গায়েবের এলেমও আল্লাহপাক তাঁকে দান করেছেন।
মি’রাজের রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-কে যেভাবে সম্মানিত করেছেন, তাতেই বুঝা যায়- তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, অতিমানব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু মৌলভি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মওদুদীর মতবাদ গ্রহণ করে নবী করীম [ﷺ]-কে আল্লাহর ‘দাস’ বলে বিভিন্ন মাহফিলে তাফসীরের নামে অপপ্রচার চালিয়েছেন। তিনি বলতে চান- عبده শব্দের অর্থ আল্লাহর দাস। নাউযুবিল্লাহ! আমরা বলতে চাই- তার দাবী অনুযায়ী-দাসের জন্য কি এত অভ্যর্থনা ও শাহী এন্তেজাম করা হয়? দাস হলো নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোক। হিন্দুদের মধ্যে দাশ হলো চতুর্থ শ্রেণীর বা সর্বনিম্ন শ্রেণীর শুদ্র জাত। ”দাস” শব্দটি ২৭টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে- “যার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় হয় এবং যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ প্রতীক্ষমান।”
আল্লামা ইকবাল عبده শব্দটির তাৎপর্য্য সুন্দরভাবে তার কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে-
عبد دیگر عبدہ چیزے دیکر -اوسر آپا انتظار این منتظ -
অর্থ্যাৎ- ‘আবদ’ এক জিনিস, আর ‘আবদুহু’ অন্য জিনিস। আব্দ অর্থ আল্লাহর জন্য এন্তেজারকারী এবং আবদুহু অর্থঃ- যার জন্য স্বয়ং আল্লাহ্ এন্তেজারী করেন।
মি’রাজ থেকে নবী করীম [ﷺ] ফিরে এসে দেখতে পেলেন - বিছানা তখনও গরম রয়েছে। ভোরে তিনি কাবাগৃহে তশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বললেন। আবু জাহল প্রমুখ কোরাইশ দলপতিরা একথা শুনে পরীক্ষার ছলে বাইতুল মোকাদ্দাসের দরজা-জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল। তারা জানতো যে, নবী করীম [ﷺ] কোনদিন বাইতুল মোকাদ্দাস যান নি। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সাথে সাথে জিব্রাইলের মারফতে বাইতুল মোকাদ্দাসের পূর্ণ ছবি তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরলেন- যেন বর্ণনা দিতে হুযুরের তকলীফ না হয়। নবী করীম [ﷺ] দেখে দেখে সব বলে দিলেন। এতেও তারা ক্ষান্ত হলনা। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো- আপনি কি আমাদের কোন বাণিজ্য কাফেলা দেখেছেন? নবী করীম [ﷺ] বললেন- “হাঁ, তারা মক্কার অতি নিকটে পৌঁছেছে এবং বুধবার সূর্য উঠার পূর্বেই তারা মক্কায় প্রবেশ করবে।” (বেদায়া)।
আবু জাহল প্রমুখ ঐদিন খুব ভোরে ঘরের ছাদে উঠে কাফেলার আগমন পরীক্ষা করতে লাগলো। এদিকে সূর্য উঠে উঠে অবস্থা-অথচ কাফেলা তখনো দৃষ্টি গোচর হচ্ছিলো না। আবু জাহল বললো- এবার পরীক্ষা হয়ে গেছে- নবীর মি’রাজ মিথ্যা। কেননা, তিনি বলেছেন- বুধবার সূর্য উঠার পূর্বে কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করবে- অথচ আমরা আমাদের দৃষ্টি পথে কাফেলার কোন চিহ্নই দেখছিনা। আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর কথা ও সম্মান ঠিক রাখার জন্য সেদিন রাত্রিকে আরও দীর্ঘায়িত করে দিলেন – সূর্যের গতি থামিয়ে দিয়ে। পরে দেখা গেল, সূর্য উঠার পূর্বেই কাফেলা মক্কায় পৌঁছে গেছে। সুবহানাল্লাহ! (বেদয়া নেহায়া)।
এভাবে আল্লাহ তায়ালা নবী করীম [ﷺ]-এঁর মি’রাজের ঘটনা সত্য প্রমাণিত করলেন। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। আবু জাহল নবীজীর মি’রাজ গমনকে অসম্ভব বলে প্রমাণ করার জন্য হৈ চৈ শুরু করে দিল। সে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-কে বাড়ী হতে আসতে দেখে মি’রাজ বিষয়ে ধোকা দেয়ার চেষ্টা করলো। তার কথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) জিজ্ঞাসা করলেন, একথা কে বলেছেন? আবু জাহল উপহাস করে বললো, কে আর বলবে? তুমি যাঁর পিছনে এতদিন ঘুরছো, তিনি ছাড়া এমন অসম্ভব কথা আর কে বলতে পারে? তখন আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- “নবী করীম [ﷺ] বলে থাকলে সত্যই বলেছেন।” এ কথা শুনে আবু জাহল দমে গেল। আবু বকর (رضي الله عنه) নবীজীর খেদমতে গিয়ে মি’রাজ ঘটনার প্রকৃত অবস্থা জানতে চাইলেন। নবী করীম [ﷺ] ঘটনা স্বীকার করে এরশাদ করলেন, তুমি কিভাবে অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে? আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه) বললেন- এটা বিশ্বাস করা তো অতি সহজ। এর চেয়ে কঠিন বিষয় ছিল আল্লাহ্কে না দেখে বিশ্বাস করা- এখন তাঁর কাছে যাওয়া তো অতি সহজ ব্যাপার। আবু বকর (رضي الله عنه)-এঁর উত্তর শুনে নবী করীম [ﷺ] এত প্রীত হলেন যে, ‘সিদ্দিকে আকবর’ খেতাবে তাঁকে ভূষিত করলেন। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সব কথা এভাবে বিশ্বাস করা সিদ্দিকগণেরই পরিচায়ক।
সেযুগে বিজ্ঞানের জ্ঞান এত প্রসারিত ছিলো না। তাই তারা সময়ের সংকোচন এবং স্থানের সংকোচন সম্পর্কে ছিল সন্দিহান। গতিবেগ সম্পর্কেও তখনকার দিনে ধারনা ছিলো না। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এবং চাঁদের দেশে মানুষের গমনের ফলে মি’রাজের ঘটনা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আল্লাহর অসীম কুদরতের কোন সীমা নেই। তিনি আপন কুদরতে এবং নিজ ব্যবস্থাপনায় নবী করীম [ﷺ]-কে উর্দ্ধজগতে এবং লা-মাকানে নিয়ে তাঁর কুদরতের নিদর্শনাবলী, তাঁর যাত ও সিফাত দর্শন এবং তাঁর গোপন রহস্যরাজী সম্পর্কে অবহিত করেছেন- ঈমানদারদের জন্য নবীজীর কথাই সত্যতার মূলভিত্তি। এটাই মুমিনদের জন্য যথেষ্ঠ। “আল্লাহ সর্ববিষয়ে আপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বশক্তিমান” (ছুরা বাক্বারা)।
হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্বঃ
পবিত্র মি’রাজ প্রসঙ্গে নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহতত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা দরকার। হুযুর পাক [ﷺ] নিজেকে ‘খোদার নূর হতে সৃষ্ট নূর’ বলে হাদীসে এরশাদ করেছেন। মানুষের প্রয়োজনেই তাঁকে মানবাকৃতি দান করা হয়েছে। আকৃতিতে বশর হলেও গুণাবলী এবং প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন ফেরেশতাদের চেয়েও অনেক উর্দ্ধে। তাঁর চালচলন, খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা, স্বভাব ও চরিত্র ছিল অনুকরণীয়। আমরা হলাম অনুসরণকারী মাত্র। তাঁর হুবহু অনুকরণকারী হওয়া সম্ভব নয়। কেননা অনুকরণ বলা হয় সর্ববিষয়ে হুবহু সামঞ্জস্য রক্ষা করে অনুসরণ করাকে। এটা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। হুযুর [ﷺ]-এঁর নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী এবং দুনিয়াবী কাজ-কর্মের গুণাগুণ এবং আমাদের নামায-রোযার গুণাগুণ এক হতে পারে না।
আমাদের শরীরে মশা-মাছি বসে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর পবিত্র বদনে কোনদিন নাপাক মশা-মাছি বসেনি। আমাদের শরীরের ছায়া আছে- কিন্তু হুযুর [ﷺ]-এঁর ছায়া ছিলো না। কেননা তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নূর (কাজী আয়ায-শেফা শরীফ)। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত-এঁর আকিদা- যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
আম্বিয়াগণের দেহ মোবারক সম্পর্কে নবী করীম [ﷺ] এরশাদ করেছেনঃ
نحن معاشر الأنبياء اجسادنا كالجسد الملائكة -
অর্থাৎ “আমরা আম্বিয়ায়ে কেরামের দেহ মোবারক ফেরেশতাদের দেহের ন্যায় সূক্ষ্ম, অর্থাৎ নূরানী ও সুক্ষ্মতায় আমরা ফেরেশতাদের ন্যায়।” এরপরও কেহ হুযুর [ﷺ]-এঁর দেহ মাটি বা সাদা মাটি দ্বারা গঠিত বলে অপপ্রচার চালালে এটাকে হাদীসের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না।
হুযুর [ﷺ]-এঁর সুরত বা হাল তিনটি। সুরতে বশরী, সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কী। মি’রাজের রাত্রে তাঁর সুরতে মালাকী ও সুরতে হাক্কীর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এটা বিশ্বাসের বিষয়, দেখার বিষয় নয়। মৌলভী ফজলুল করীম তার ‘নূরে মুহাম্মদীর হাকিকত’ বইয়ে একটি মৌযু হাদীস দ্বারা নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক মাটির তৈরী বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ইবনে জওযীর মতে উক্ত হাদিসটি বানোয়াট ও জাল বলে বাংলা মাআরিফুল কোরআন ৮৫৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। শুধু বশরী ছুরত স্বীকার করলে বাকী ২টি সুরতকে অস্বীকার করা হয়।
বিঃ দ্রঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর তিন সুরতের অর্থঃ মানুষের কাছে মানুষের মত, ফেরেশতাদের কাছে ফেরেশতার মত এবং আল্লাহর কাছে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত অবস্থা।
১। সুরতে বাশারীর প্রমাণঃ قل انما انا بشر مثلكم “আমি শুধু সুরতে বা আকৃতিতে তোমাদের মত মানুষ।”
২। সুরতে মালাকীর প্রমাণঃ لي مع الله وقت لا يسعني فيه نبي مرسل ولا ملك مقرب
“আল্লাহর সাথে আমার এমন ঘনিষ্ট সময় আসে - যেখানে কোন প্রেরীত নবী অথবা নিকটবর্তী কোন ফেরেশতাও আমার সমকক্ষ হতে পারে না।”
৩। সুরতে হাক্কী সম্পর্কে হাদীসে বর্নিত হয়েছঃ من رآني فقد راي الحق
“যে ব্যক্তি আমাকে দেখেছে, সে হক্ক-কেই দেখেছে।”
++++++++++++++
উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি এর " নূরনবী ﷺ" থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন