নূরনবী ﷺ

তেত্রিশতম অধ্যায়ঃ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনঃ
প্রসঙ্গঃ মদীনায় আগমনের পর প্রাথমিক কাজ
===========
নবী        করীম         [ﷺ]        হিজরত       করে       মদীনা       শরীফ আগেমনের    পর   মুসলমানদের   জন্য     মক্কায়   অবস্থান করা     নিষিদ্ধ    এবং    হিজরত     করা     ফরয    হয়ে     যায়। কেবলমাত্র      রোগী,      বৃদ্ধ,      স্বামী        গৃহে       আবদ্ধা      স্ত্রী,  মনিবগৃহে    আবদ্ধ    গোলামগণের    জন্য    সময়    সুযোগ  দেয়া    হয়।     মক্কা    শরীফে    আল্লাহর     ঘর    এবং    পবিত্র স্থানসমূহ   বর্তমান   থাকা   সত্ত্বেও   তথায়   বসবাস   করা  নিষিদ্ধ     হয়ে      যায়।       কেননা,      নবী      করীম     [ﷺ]-এঁর  হিজরত করার পর সেখানে বিনা কারণে অবস্থান করা মুসলমানদের  জন্য    বৈধ  থাকতে  পারে  না।  স্বাভাবিক কারণেই মদীনায়  মুহাজির  মুসলমানদের  ভীড় জমতে লাগলো। মদীনার আনসারগণ তুলনামূলকভাবে গরীব ছিলেন।           প্রধানতঃ          কৃষি            কাজ           ছিল           তাঁদের রুজী-রোজগারের  প্রধান  উৎস।  ব্যবসা-বাণিজ্য  ছিল  ইয়াহুদীদের                  হাতে                  কুক্ষিগত।                  এমতাবস্থায়  মুহাজিরগণের        আগমন         আর্থিক          সংকটের        সৃষ্টি  করলো।       হিজরতের      ৫ম      মাসে      নবী      করীম      [ﷺ]   আনসারদের     সাথে      মুহাজিরগণের      ভ্রাতৃত্ব       বন্ধনের কাজ     সমাধা      করেন।      মুহাজিরগণকে     আনসারদের মধ্যে বন্টন করে বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসিত করলেন।

আনসারগণ   আনন্দচিত্তে    এই    ব্যবস্থা   মেনে   নিলেন।    তাঁরা      মুহাজির    ভাইদেরকে     আপন     ভাইয়ের    মর্যাদা দিয়ে সম্পত্তিতে সম-অংশীদার করে নিলেন। এমন কি দুই    বিবি   থাকলে   তাঁরা   এক    বিবিকে     তালাক    দিয়ে  মোহাজির      ভাইয়ের      সাথে      বিবাহ      দিলেন।      অভাব  অনটন সত্ত্বেও  তাঁরা  নিজেরা উপবাসী থেকে কৌশলে মুহাজির   ভাইকে   খানা    খাওয়াতেন।    রাত্রে    একসাথে খানা   খেতে    বসে    চেরাগবাতি    নিভিয়ে     দিয়ে   প্লেটের  খানা       মুহাজির      ভাইকে       খাইয়ে         নিজেরা      উপবাস করতেন।  আনসারগণের এই ত্যাগ-তিতীক্ষার  প্রশংসা করে স্বয়ং আল্লাহ عَزَّوَجَلّ কোরআনের আয়াত নাযিল করেন।   সুরা  হাশরের ৯  নং  আয়াতে  আল্লাহ্ তা'য়ালা  ইরশাদ     করেন-      وَيَؤْثِرُوْنَ     علَى    اَنْفُسِهِمْ     وَلَوْ      كَانَ    بِهِمْ خَصَاضَةٌ

অর্থ-         “আনসারগণ           নিজেরা         অভাবগ্রস্ত          হয়েও মোহাজির ভাইদেরকে অগ্রাধিকার দান করে।”

দেশী    আর প্রবাসীর  প্রশ্ন  ওখানে ছিল   না, নবী করীম  [ﷺ]-এঁর           সান্নিধ্যে          তাঁরা          দুধে           পানিতে          মিশে গিয়েছিলেন।          আজকাল        মুহাজির        সমস্যা        নিয়ে  মুসলমানদের  মধ্যে  রক্তাক্ত  দাঙ্গা  বেঁধে  যেতেও    দেখা যায়।      রাজনৈতিক      ব্যক্তিত্ব       ও       প্রজ্ঞাহীন      নেতৃত্বের কারণেই এসব সমস্যা দেখা যায়। নবী করীম [ﷺ]-এঁর সুশিক্ষা থেকে আমরা আজ কত দূরে!

মদীনার             সনদঃ             ইতিহাসে             সর্বপ্রথম             লিখিত  'আর্ন্তজাতিক সনদ'
বিভিন্ন   গোত্র, গোষ্ঠী  বা জাতির  মধ্যে শান্তি  স্থাপন  ও   পরস্পর    নিরাপত্তার    যে    অঙ্গীকার    করা    হয়,    তাকে  আরবীতে     মোয়াহাদা     বা     চুক্তি    বলা     হয়।    আধুনিক বিশ্বের  সর্বপ্রথম  লিখিত  সনদকে  'ম্যাগনা  কার্টা'  বলা  হয়ে   থাকে।   তারই   পথ    ধরে    আজ   জাতিসংঘ     সনদ রচিত    হয়েছে।  কিন্তু   ম্যাগনাকার্টা  সনদের  বহু  পূর্বেই, এখন     থেকে     ১৪০০     বৎসরের     অধিক     পূর্বে,     প্রথম  হিজরী সালে মদীনায় সর্বপ্রথম লিখিত সনদ সম্পাদন করেছিলেন   নবী  করীম   [ﷺ]।  মদীনায়  হিজরত  করে তিনি    দেখতে    পেলেন,     সেখানে     ইয়াহুদীদের     তিনটি গোত্র,   যথাক্রমে-    বনু   কাইনুকা,   বনু      কোরায়যা,   বনু নযির এবং আদি মদীনাবাসীদের দুটি গোত্র, আউছ ও খাযরাজ  বসবাস  করছে।  তদুপরি   মক্কা   হতে  নবাগত মুহাজিরগণের একটি দল  মদীনায়  এসে বসতি  স্থাপন শুরু          করেছেন।          এমতাবস্থায়          পরস্পরের          মধ্যে  সহাবস্থান,   শান্তি  ও  নিরাপত্তার    পরিবেশ   সৃষ্টি   করার একান্ত প্রয়োজন ছিল। তাই নবী করীম [ﷺ] সকলকে নিয়ে একটি সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করলেন। এতে উল্লেখ ছিলঃ-

“বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের লোক নিজ নিজ ধর্মমতে অটল থেকে নিজেদের মধ্যে সহনশীলতা ও সহাবস্থান বজায় রাখবে         এবং         বহিরাক্রমণ        থেকে        সম্মিলিতভাবে  মদীনাকে  রক্ষা  করবে। পরস্পরের মধ্যে  কোন  বিষয়ে মতানৈক্য    বা  মতবিরোধ    দেখা  দিলে   সে  ক্ষেত্রে   নবী  করীম  [ﷺ]-এঁর ফয়সালা  চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।” এভাবে  আন্তঃধর্মীয়  ও  মাল্টি  কালচার  বিশিষ্ট  একটি  রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হলো।

এই  সনদ   বা  দলীলকে   'মদীনার সনদ' বলা হয়। এরই সূত্র    ধরে    আজ     জাতিসংঘ     গঠিত    হয়েছে।     সুতরাং বিশ্বশান্তি     নির্মাতা      হিসাবে        নবী     করীম      [ﷺ]     বিশ্ব সভ্যতার পথপ্রদর্শক।

নবী করীম [ﷺ] উক্ত চুক্তিনামা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও ইয়াহুদী গোত্রদ্বয় এবং মোনাফিকরা চুক্তিভঙ্গ করতে     থাকে।      তারা       গোপনে     মক্কাবাসীদের      সাথে যোগাযোগ    করে    তাদেরকে     মদীনা    আক্রমণ    করার  আমন্ত্রণ     জানায়   এবং   সহেযোগিতার   আশ্বাস   প্রদান করে।     এই     ষড়যন্ত্রের      ফলে     মক্কাবাসী       কোরাইশরা  ভিতরে ভিতরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। তারা        অস্ত্রশস্ত্র        সংগ্রহ        করার        উদ্দেশ্যে        বাণিজ্য  কাফেলার       ছত্রছায়ায়        সিরিয়ার       খৃষ্টানদের        সাথে  আঁতাত গড়ে তোলে। এই কাফেলার নেতৃত্ব দিতে থাকে আবু     সুফিয়ান।     তিনি    আট    বৎসর    পর্যন্ত     এভাবেই  মুসলমান   ও হুযুর আকরাম [ﷺ]-এঁর  বিরুদ্ধে   ষড়যন্ত্র করতে           থাকেন।            ইসলামের           যথেষ্ট          ক্ষতিসাধন করেছিলেন       তিনি।      অবশেষে     ৮ম     হিজরীতে       মক্কা বিজয়ের সময়ে তিনি স্ববংশ ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী করীম     [ﷺ]     অতীতের     সবকিছু     ভুলে     গিয়ে     তাঁকে  বিশিষ্ট সাহাবীর মর্যাদা দান করেন।

মদীনা          সনদের        বরখেলাফমূলক         ইহুদি        ষড়যন্ত্র,  মক্কাবাসী  কোরাইশদের  চক্রান্ত   এবং  সিরিয়ার  খৃষ্টান  জগতের   শত্রুতাই    যুদ্ধ   বিগ্রহের    সূত্রপাত   করে।   নবী করীম  [ﷺ]  একান্ত  বাধ্য    হয়ে  তাদের  বিরুদ্ধে  বিভিন্ন  যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।   আল্লাহর  অনুগ্রহে  নবীজির শত্রুরা পর্যূদস্ত হয় এবং মদীনা শত্রুমুক্ত হয়। চুক্তি  ভঙ্গ করার দায়ে    মদীনার    ইয়াহুদিরা    মদীনা    হতে    উৎখাত    হয়ে  যায়।      মক্কার     ১৩      বছর       নির্যাতন     সহ্য      করার     পর  মুসলমানদেরকে     প্রকাশ্য     জিহাদের      অনুমতি      দেয়া  হয়।”
আল্লাহ   পাক    ইরশাদ  করেন-   اَذِنَ   لِلَّذِيْنَ   يُقَاتِلُوْنَ   بِاَنَّهُمْ ظُلِمُوْا
অর্থ:  “  মুসলমানদেরকে   যুদ্ধের    অনুমতি   দেয়া  হলো, কেননা       তাঁদের       উপর       যথেষ্ট        অত্যাচার        চালানো হয়েছে।” (সুরা হজ্ব, ৩৯ নং আয়াত)

মদীনার       দশ      বৎসর      জিন্দেগীর       মধ্যে      ২৭টি      বড় আকারের  যুদ্ধ   এবং  ৪৭টি  ছোট  আকারের  অভিযান  পরিচালিত        হয়।       মোট        ৭৪টি       ছোট-বড়       যুদ্ধ       ও অভিযানের মধ্যে ২৭টিতে  নবী  করীম [ﷺ] অংশগ্রহণ করেন    এবং    এর    মধ্যে    ৯টি    যুদ্ধ     তিনি     [ﷺ]    নিজে পরিচালনা করেন। বদর, ওহুদ, খন্দক, বনু কোরায়যা, মোরাইছি,  খায়বর, ফতহে  মক্কা,    হুনাইন ও তায়েফের যুদ্ধ স্বয়ং নবী করীম [ﷺ] পরিচালনা করেন  এবং সব ক’টিতেই বিজয় লাভ করেন। কেবলমাত্র ওহুদের যুদ্ধে তিনি     [ﷺ]     প্রথমে      জয়লাভ     করা     সত্ত্বেও      মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী কর্তৃক গণিমতের মাল সংগ্রহ  করার লক্ষ্যে       নিজ       ঘাঁটি       ত্যাগ       করার       ফলে       পরাজিত  কোরাইশ বাহিনী গুপ্ত হামলা করে মুসলমানদের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন   করে।   পরে   অবশ্য   তারা   পলায়ন   করতে  বাধ্য    হয়।    নবী   করীম   [ﷺ]-এঁর   একটি   কড়া   নির্দেশ ভুলক্রমে    উপেক্ষা     করার    ফলেই    এই    দূঘর্টনা     ঘটে। নির্দেশটি ছিল “তোমরা জয়-পরাজয় কোন অবস্থাতেই নিজ   ঘাঁটি ত্যাগ করবে   না,   যে পর্যন্ত না  আমি নির্দেশ করি।”(মাওয়াহেব)  নেতার   হুকুম  অমান্য  করলে   তার পরিণতি ভাল হয় না।

+++++++++++
 উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি এর "  নূরনবী ﷺ" থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন