দরসে হাদীস

মসজিদুল হারাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মসজিদ

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
------------------
عن ابى ذر رضى الله عنه قال سألت رسول الله صلى الله عليه وسلم عن اوّل مسجد وضع فى الارض قال المسجد الحرام قلت اىّ قال المسجد الاقصى قلت كم بينهما قال اربعون عامًا – (رواه البخارى)
অনুবাদ: হযরত আবুজর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলাম, ভূপৃষ্ঠে নির্মিত প্রথম মসজিদ কোনটি? নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন মসজিদুল হারাম। অতঃপর বললাম, তারপর কোনটি? তিনি এরশাদ করেন, মসজিদুল আকসা, জিজ্ঞেস করলাম এ দুয়ের মধ্যে ব্যবধান কত? নবীজি এরশাদ করলেন চল্লিশ বছর। [বোখারী শরীফ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মসজিদের ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। খানায়ে কা’বা বায়তুল্লাহ্ শরীফ সংশ্লিষ্ঠ ভূপৃষ্ঠে সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদের নাম মসজিদুল হারাম হচ্ছে বিশ্ব মুসলিমের প্রধান মসজিদ ও কেন্দ্রীয় মসজিদ। গুণ ও মান বিবেচনায় প্রথম হওয়াটা ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে। যেমন সমগ্র সৃষ্টিকূলের মধ্যে ¯্রষ্টার সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। এটাও নবীজির শ্রেষ্ঠত্বের দলীল।
মসজিদুল হারাম ঈমান ইসলামের কেন্দ্রস্থল
পবিত্র মক্কা নগরী যে পূণ্যময় ভূমিতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল ক্বোরআন করীম অবতীর্ণ হয়েছে। যে পবিত্র ভূমিতে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীর পদার্পণ ঘটেছে। যে মুকাদ্দাস জমীনে আল্লাহর পবিত্র ঘর খানায়ে কা’বা নির্মিত হয়েছে। যে পবিত্র ঘরকে মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর রাসূলের মনোবাসনা পূরনার্থে বিশ্ব মুসলমানদের জন্য কিবলা ঘোষণা করেছেন। যে ক্বিবলার দিকে মুখ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমার নামায, ঈদুল ফিতর-ঈদুল আযহা, সালাতুল জানাযা সহ সর্বপ্রকার নামায আদায় করে থাকে, সেই বায়তুল্লাহ্ শরীফ মসজিদুল হারাম, যেখান থেকে ইমামুল আম্বিয়া, সৈয়্যদুল মুরসালীন রাহমাতুল্লিল আলামীন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ২৭ রজব দিবাগত রজনী সোমবারে পবিত্র মিরাজুন্নবী তথা উর্ধ্বজগত ভ্রমণ করেছিলেন। প্রথম আসমান হতে সপ্ত আসমান, সিদরাতুল মুনতাহা আরশ মুয়াল্লাহ্, মকীন-লামকান পরিভ্রমণ করেছেন, জান্নাত-দোজখ পরিদর্শন করেছেন। রাব্বুল আলামীনের সাথে দিদারে এলাহীর নূরানিয়্যাতের মহাসমুদ্র অবগাহণে ধন্য হয়েছেন, সেই ঐতিহাসিক বরকমন্ডিত স্মৃতির স্মারক মসজিদুল হারাম। যে মসজিদুল হারামের কথা মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনে বিঘোষিত হয়েছে এরশাদ হয়েছে- سبحان الذى اسرى بعبده ليلا من المسجد الحرام الى المسجد الاقصى
অর্থ: মহামহিম পবিত্র সত্তা যিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে ভ্রমণ করিয়েছেন রাত্রের কিয়দাংশে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদ আকসা পর্যন্ত। [সূরা বনী ইসরাঈল:আয়াত ১]
মসজিদুল হারামের চতুর্দিকে রয়েছে অসংখ্য বরকত ও আল্লাহ্র কুদরতের নিদর্শনাদি
দুনিয়া সৃষ্টির পর থেকে বায়তুল্লাহ্ শরীফে ও হেরেম শরীফে নামায আদায় করার জন্য আল্লাহর অসংখ্য সম্মানিত নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য সম্মানিত সাহাবাগণ, তাবেঈনগণ, তবে-তাবেঈন মুজতাহিদ ইমামগণ, আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা সালেহীন ও আউলিয়ায়ে কামেলীন পৃথিবীর দূর-দূরান্ত হতে পদব্রজে, উষ্টারোহী হয়ে বিভিন্ন বাহনযোগে কষ্ট সাধ্য সফর করে এ পবিত্র ঘরের তাওয়াফ করেছেন, নামায আদায় করেছেন, নিজেদের অন্তরাত্মা খোদায়ী নূরের তজল্লীতে উদ্ভাসিত করেছেন- মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভে ধন্য হয়েছেন। সেই বায়তুল্লাহ্ শরীফ হেরম শরীফ অনন্তকাল যুগযুগান্তরে কাল-কালান্তরে বিশ্বাবাসীকে হেদায়তের আলো ও নূর বিতরণ করে যাবে। যে মসজিদের বরকময় স্পর্শ ও ছোঁয়ায় লাখো কোটি মানুষের তাকদীর পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে। কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সৌভাগ্যবান বান্দারা যে বরকতময় স্থানে গিয়ে নিজেদের ঈমান ও ইসলামের শূন্যতা পূরণ ও আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সন্তুষ্টি অর্জনের যুযোগ পাবে।
এ পবিত্র মসজিদের চতুর্দিকে রয়েছে তিনশত সম্মানিত নবীগণের পবিত্র কবর শরীফ। রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যখানের স্থান রয়েছে সত্তরজন সম্মানিত নবী রাসূলের কবর শরীফ। হাতীমে ক্বা’বা যেই বায়তুল্লাহ্ শরীফের অংশ বিশেষ এতে মিযাবে রহমতের নীচে হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর মহিয়সী আম্মাজান হযরত মা হাজেরা আলায়হিস্ সালাম’র কবর শরীফ রয়েছে। এ ছাড়াও মক্কা শরীফের প্রসিদ্ধ কবরস্থান জান্নাতুল মুয়াল্লা থেকে কিয়ামত দিবসে এমন সত্তর হাজার নেক্কার বান্দাকে উঠানো হবে। যাঁরা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এদের প্রত্যেকে সত্তর হাজার গুনাহগার বান্দাকে সুপারিশ করার অনুমতি প্রাপ্ত হবে। [তারিখে মক্কা: ১খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৮, আনোয়ারুল বয়ান: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৭৯] মসজিদে হারামে এক লক্ষ রাকাত ও মসজিদে নববীতে পঞ্চাশ হাজার রাকাতের সওয়াব
মসজিদুল হারামে ও মসজিদে নববীতে নামায আদায়ের ফজিলত প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে-
وصلوة فى مسجدى خمسين الف صلوة وصلوة فى المسجد الحرام بمئة الف صلوة- (رواه ابن ماجه)
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াল্লাম এরশাদ করেছেন, মসজিদে নববী আমার মসজিদে এক রাকাতে পঞ্চাশ হাজার রাকাতের সওয়াব, মসজিদুল হারামে এক রাকাতে এক লক্ষ রাকাতের সওয়াব।  [ইবনে মাযাহ: ১খন্ড, পৃষ্ঠা১০২]
বায়তুল্লাহ্ শরীফের দিকে থাকানো ইবাদত
উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-النظر الى الكعبة عبادة- ক্বা‘বা শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করা ইবাদত।[কানযুল উম্মাল: ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৫৮]
ক্বা‘বা শরীফে দৈনিক একশত বিশটি রহমত অবতীর্ণ হয়
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন খানায়ে ক্বা‘বা বায়তুল্লাহ্ শরীফে দৈনিক একশত বিশটি রহমত অবতীর্ণ হয়। এরশাদ হয়েছে- ستون للطائفين واربعون للمصلّين وعشرون للناظرين- বায়তুল্লাহ্ শরীফে তাওয়াফকারীদের জন্য ৬০টি রহমত, হেরেম শরীফে নামায আদায়কারীদের জন্য ৪০টি রহমত বায়তুল্লাহ্ শরীফের দিকে তাজীম ও মহব্বতের সাথে দৃষ্টিপাতকারী মুসলমানদের জন্য বিশটি রহমত অবতীর্ণ হয়। [বায়হাকী শরীফ: পৃষ্ঠা ১০৫]
বায়তুল্লাহকে আল্লাহ্ হারাম ঘোষণা করেছে
পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-جعل الله الكعبة البيت الحرام قيامًا- (المائد: ৯৭)
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বা‘বাকে ‘‘হারাম’’ তথা সম্মানিত ঘর এবং মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারণ করেছেন।
[সূরা মায়িদা: আয়াত ৯৭]
বণির্ত আয়াতের ব্যাপারে বলা হয়েছে-
اى قيامًا لمعاش الناس ومكاسبهم لما يحصل لهم فى زيارتها من الثمارة وانواع البركة مجمع البيان طبرى –২/২০২)
অর্থ: ক্বা‘বা মানুষের জীবন ধারণ ও জীবিকার্জনের ক্ষেত্রে টিকে থাকার অবলম্বন। কেননা ক্বা‘বা শরীফ জিয়ারতে গেলে তারা উপকৃত হয়। আর নানাবিধ রবকত কল্যাণ ও সমৃদ্ধি তাদের অর্জিত হয়। [তাফসীরে মাজমাউল বয়ান:২০২/২]
ক্বা‘বা শরীফে ইবাদত
পবিত্র ক্বোরআনুল মজীদে এরশাদ হয়েছে-
انما امرت ان اعبد ربّ هذه البلدة حرّمها وله كُلّ شيئٍ وامرت ان اكون من المسلمين- (نمل- ৯১)
অর্থ: আমাকে এ নগরীর প্রতিপালকের ইবাদত করতে হুকুম দেয়া হয়েছে। যেটিকে তিনি সম্মানিত করেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বস্তুত: তাঁরই জন্য সবকিছু। আর আমাকে আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে নির্দেশ করা হয়েছে। [সূরা নমল: আয়াত ৯১] আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
قوله حرّمها لاسيفك فيها دم ولا يظلم فيها احد ولايهاج صيدها ولايختلى خلاها وتحصيص مكة بهذه الاوصاف تشريف لها وتعظيم لشاتها- – (البخارى ২১৬)
অর্থাৎ- আয়াতে বর্ণিত আল্লাহ্র বাণী ‘হারামাহা’ নিষিদ্ধ করেছে এর তাৎপর্য হলো, এ শহরে রক্তপাত করা যাবে না। ওখানে অবস্থানকারী প্রাণীকুলকে উৎপীড়ন করা যাবে না, ওখানকার ঘাস কাটা যাবে না, এসব বিষয়ে মক্কা শরীফের বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাকে সম্মানিত করার জন্য এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্য। [বোখারী শরীফ: ২১৬/১]
হেরম শরীফে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষেধ
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
ان مكّة حرمها الله فلم يحرمها الناس لايحل لامرء يؤمن بالله واليوم الاخر ان يسفك بها دمًا-
অর্থ: নিশ্চয়ই মক্কা শরীফে আল্লাহ্ তা‘আলা নিষিদ্ধ করেছেন এটা কোন মানুষের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়নি, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী তার জন্য মক্কা নগরীতে রক্তপাত বৈধ হবে না। [বোখারী শরীফ: ৬১৫/২] হেরমে শরীফের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা মুসলিম উম্মাহর পবিত্র দায়িত্ব। আরো এরশাদ হয়েছে-
لايحل لاحدكم ان يحمل بمكة السلاح-
অর্থ: তোমাদের কারোর জ্য মক্কায় অস্ত্র বহন করে চলা বৈধ হবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহকে হেরমের ফয়ুজাত বরকত নসীব করুন। আ-মী-ন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন