মনোনীত জন – মহানবী (ﷺ)-এর মওলিদ
পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদের কথা উল্লেখিত হয়েছে; এসব ঘটনার বিবরণ প্রদানকারী হলেন স্বয়ং আল্লাহতা’লা। কুরআন মজীদ কর্তৃক পয়গম্বর (عليه السلام)-মণ্ডলীর বেলাদত তথা ধরণীতলে শুভাগমনকে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ প্রদান, আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মো’জেযা তথা অলৌকিকত্ব ও আশীর্বাদের বর্ণনা দান এবং তাঁদের প্রতি বর্ষিত আল্লাহর নেয়ামতের উল্লেখকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে, এটা আল্লাহতা’লারই সুন্নাহ; আর এসব আয়াত বারংবার তেলাওয়াত করার পক্ষেই আল-কুরআনের (দৃঢ়) অবস্থান। হয়তো এ প্রশ্ন উঠতে পারে যে আল-কুরআনে অন্যান্য আম্বিয়া (عليه السلام)-মণ্ডলীর মওলিদের উল্লেখ করা হয়েছে সত্য, কিন্তু আমাদের মহানবী (ﷺ)-এর মওলিদসম্পর্কে কি কোনো উল্লেখ এতে রয়েছে? এর উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ-সূচক: সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের আশীর্বাদপূর্ণ মওলিদের উল্লেখ কুরআন মজীদে বিধৃত হয়েছে।
কুরআন পাকের গভীর অধ্যয়নে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠবে যে পয়গম্বর (عليه السلام)-বৃন্দের বেলাদতের উল্লেখ দ্বারা আল্লাহতা’লা তাঁদের মান-মর্যাদাকে সুখ্যাতি দিয়েছেন। কেউ যদি কুরআনকে নিয়ে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করেন, তাহলে তিনি দেখতে পাবেন যে অন্যান্য আম্বিয়া (عليه السلام)-বৃন্দের মওলিদ স্রেফ তাঁদের বেলাদতকে ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনারই বর্ণনামাত্র। অথচ অপরদিকে, মহানবী (ﷺ)-এর মর্যাদা বিশেষভাবে পৃথক করা হয়েছে – আল্লাহতা’লা শুধু তাঁর বেলাদতের শহরের (মানে মক্কার) শপথ-ই নেননি, বরঞ্চ তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের নামেও কসম করেছেন। এরশাদ হয়েছে:
“আমায় এ শহরের শপথ, যেহেতু হে মাহবূব! আপনি এ শহরে তাশরীফ রাখছেন, এবং আপনার পিতা (পিতৃপুরুষ) ইব্রাহীমের শপথ এবং তার বংশধরের, অর্থাৎ আপনি-ই।” [আল-কুরআন, ৯০:১-৩]
মক্কায় অবস্থিত রয়েছে আল্লাহর ঘর, হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর), তাওয়াফ করার স্থান, মুলতাযাম, মাক্বা’ম-এ-ইবরাহীম, যমযম কূপ, আল-সা’ফা ও আল-মারওয়া; কিন্তু আল্লাহতা’লা এগুলোর কোনোটারই কসম কাটেননি। বরঞ্চ তিনি মক্কা শহরের শপথ করেছেন, কেননা এতে তাঁর মাহবূব (ﷺ)-এর বসতিস্থান রয়েছে। অতঃপর আল্লাহতা’লা প্রিয়নবী (ﷺ)-এর পিতৃপুরুষদের শপথ করেছেন। এখানে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, আল্লাহতা’লা কারোরই বেলাদতের ক্ষেত্রে শপথ নেননি, ব্যতিক্রম শুধু মহানবী (ﷺ)-এর বেলাদতের বেলায়।
মহানবী (ﷺ)-এর প্রেরণ সম্পর্কে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
“যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসূল তোমাদের মধ্য থেকে, যিনি তোমাদের প্রতি আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে (অর্থাৎ, তোমাদের অন্তর ও একগুঁয়ে নফসকে) পবিত্র করেন এবং কিতাব ও পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই (আধ্যাত্মিক ও ঐশী) জ্ঞান শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিল না।” [আল-কুরআন, ২:১৫১]
“নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের প্রতি যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের প্রতি তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদেরকে পবিত্র করেন, আর তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো।” [আল-কুরআন, ৩:১৬৪]
“হে মানবজাতি! তোমাদের কাছে এ রাসূল সত্য সহকারে তোমাদেরই রব্বের কাছ থেকে শুভাগমন করেছেন; সুতরাং ঈমান আনো তোমাদের কল্যাণার্থে।” [আল-কুরআন, ৪:১৭০]
“হে কিতাবীরা! নিশ্চয় তোমাদের কাছে আমার এ রাসূল তাশরীফ এনেছেন, যিনি তোমাদের কাছে প্রকাশ করেন ওইসব বস্তু থেকে এমন অনেক কিছু, যেগুলো তোমরা কিতাবের মধ্যে গোপন করে ফেলেছিলে এবং অনেক কিছু (তিনি) ক্ষমা করে থাকেন। নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ‘নূর’ এসেছে এবং স্পষ্ট কিতাব।” [আল-কুরআন, ৫:১৫]
“হে কিতাবীরা! নিঃসন্দেহে তোমাদের কাছে আমার এ রাসূল তাশরীফ এনেছেন, যিনি তোমাদের কাছে আমার বিধি-বিধান সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, এরপর যে, রাসূলবৃন্দের আগমন বহুদিন বন্ধ ছিলো, যাতে কখনো একথা না বলতে পারো যে ‘আমাদের কাছে কোনো সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী আসেননি।’ সুতরাং এ সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন এবং আল্লাহর কাছেই রয়েছে চূড়ান্ত ক্ষমতা।” [আল-কুরঅান, ৫:১৯]
“নিশ্চয় তোমাদের কাছে তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য হতে ওই রাসূল, যাঁর কাছে তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা (দর্শন) কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় (যিনি) কামনাকারী, মুসলমানদের প্রতি পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।” [আল-কুরআন, ৯:১২৮]
“এবং আমি আপনাকে সমগ্র জগতের জন্যে রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।” [আল-কুরআন, ২১:১০৭]
“তিনি-ই (আল্লাহ), যিনি উম্মী মানুষদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেন যেন তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাদেরকে পবিত্র করেন (বাইরে ও অভ্যন্তরে) এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমতের জ্ঞান দান করেন, আর অবশ্যঅবশ্য তারা ইতিপূর্বে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলো।” [আল-কুরআন, ৬২:২]
“নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি একজন রাসূল প্রেরণ করেছি।” [আল-কুরআন, ৭৩:১৫]
ওপরের আয়াতগুলোতে মহানবী (ﷺ)-এর শুভাগমন সম্পর্কে উল্লেখ আছে, আর এটা মূলতঃ তাঁর আশীর্বাদপূর্ণ বেলাদতেরই যিকর-তাযকেরা (স্মরণ)। কেউ যদি গভীরভাবে এসব আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করেন, তাহলে বোঝা যাবে যে আল্লাহতা’লা তাঁর মাহবূব (ﷺ)-এর বেলাদতের কথা উল্লেখ করেছেন গোটা মানবতাকে উদ্দেশ্যে করেই; ঈমানদারদের পাশাপাশি আহলে কেতাব (ইহুদী/খৃষ্টান), অবিশ্বাসী ও মুশরিকদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেককেই সচেতন করা হয়েছে যে আল্লাহর মাহবূব (ﷺ) শুভাগমন করতে যাচ্ছেন; তাঁর এই শুভাগমনকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্যে (আল্লাহর) করুণা ও আশীর্বাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক তাঁর মাহবূব (ﷺ)-এর আবির্ভাবের যিকর তথা স্মরণকে এতো উচ্চমর্যাদা দিয়েছেন যে কেউই আর এটাকে হাল্কা ব্যাপার হিসেবে নিতে পারবে না।
আল্লাহতা’লা এসব আয়াতে করীমার মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদীকে শিক্ষা দিয়েছেন যে মহানবী (ﷺ)-এর আশীর্বাদপূর্ণ বেলাদতের স্মরণ অনাগত প্রজন্মগুলোর জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরই আলোকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বেলাদতের যিকর-তাযকেরার প্রয়োজনীয়তাকে যে মানসিকতা হেয় প্রতিপন্ন করে, তাকে আম্বিয়া (عليه السلام)-এর মওলিদের উল্লেখকারী ডজনকে ডজন আয়াতের প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। আমরা যখন মহানবী (ﷺ)-কে তাঁর মওলিদের পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণ করি, তখন আমরা আল্লাহরই সুন্নাহকে অনুকরণ-অনুসরণ করে থাকি এবং ফলশ্রুতিতে তাঁরই আদেশ মেনে চলি। এসব আয়াত, যেগুলোতে আল্লাহর আশীর্বাদধন্য বান্দাদের বেলাদতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো কেউ সযত্নে অধ্যয়ন করলে জানা যাবে যে সেসব ঘটনায় কোনো বিশেষ শিক্ষা বা পথপ্রদর্শনমূলক বার্তা নিহিত নেই (যা আমাদের জীবনে সরাসরি বাস্তবায়ন করা যায়); বরঞ্চ সেগুলো বিবরণ মাত্র, যার উদ্দেশ্য হলো (স্রেফ) আম্বিয়া (عليه السلام)-এর মওলিদকেই স্মরণ করা।
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন