কঙ্কর নিক্ষেপ প্রথা: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর সুন্নাহ
হাজ্বী সাহেবান (হজ্জ্বের অংশ হিসেবে) তিন দিন মিনা’তে অবস্থান করেন এবং তাঁরা সেখানে ‘জামারা’ত’ নামে পরিচিত স্তম্ভগুলোতে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। এই আমলটি পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর স্মৃতি রক্ষার্থে পালিত হয়।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান: হযরত জিবরীল আমীন (عليه السلام) পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-কে ‘জামরা আল-’আক্বাবা’য় নিয়ে গেলে সেখানে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) সাতটি কঙ্কর তার দিকে ছুঁড়ে মারেন, যার দরুন শয়তান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) ‘জামরা আল-উসতা’য় অগ্রসর হলে শয়তান আবারো (দ্বিতীয়বার) আবির্ভূত হয়। তিনি তার দিকে (পুনরায়) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলে শয়তান পুনরায় মাটিতে পড়ে যায়। অতঃপর পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় অগ্রসর হলে শয়তান আবারো (তৃতীয়বারের মতো) আবির্ভূত হয়। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) পুনরায় সাতটি কঙ্কর তার দিকে নিক্ষেপ করেন, যার ফলে শয়তান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। [আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:৩০৬; আল-হা’কিম কৃত ‘আল-মোসতাদরাক’, ১:৬৩৮ #১৭১৩; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৫৩ #৯৪৭৫; আল-মাক্বদাসী লিখিত ‘আল-আহা’দীস আল-মুখতা’রা’, ১০:২৮৩ #২৯৬; আল-মুনযিরী রচিত ‘আল-তারগীব ওয়াল-তারহীব মিনাল-হাদীস আল-শরীফ’, ২:১৩৪ #১৮০৭; এবং আল-হায়সামী কৃত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৩:২৫৯]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) স্বয়ং বলেন: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-কে হজ্জ্বের রীতিনীতি পালনের আদেশ দেয়া হলে পরে হযরত জিবরীল (عليه السلام) তাঁকে ‘জামরা আল-আক্বাবা’য় নিয়ে যান। সেখানে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) তার দিকে (একে একে) সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন যতোক্ষণ না সে পালিয়ে যায়। ‘জামরা আল-’উসতা’য়ও সে আবার দেখা দেয়, আর ইবরাহীম (عليه السلام) তার দিকে আবার সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। [অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহূ একটি ক্বুরআ’নের আয়াত তেলাওয়াত করেন যা ঘোষণা করে, “এবং পিতা ইবরাহীম পুত্র ইসমাঈলকে মাথার ওপর ভর করে শায়িত করলো” (আল-ক্বুরআ’ন, ৩৭:১০৩)]। পয়গম্বর ইসমাঈল (عليه السلام) একটি সাদা রংয়ের জামা পরেছিলেন। তিনি বলেন, ‘বাবা, কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহারের জন্যে আমার তো কোনো কাপড় নেই। অতএব, অনুগ্রহ করে এই জামাটি আমার শরীর থেকে অপসারণ করুন, যাতে আপনি এটা দিয়ে আমাকে দাফন-কাফন করতে পারেন।’ হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) যেই তা সরাতে যাবেন, অমনি তিনি এক গায়েবী কণ্ঠস্বর শুনতে পান যা ঘোষণা করে, “হে ইবরাহীম! নিশ্চয় তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে” [প্রাগুক্ত আল-ক্বুরআ’ন, ৩৭:১০৪-১০৫]। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) ঘুরে তাকিয়ে দেখেন একটি সুন্দর, বড় চোখবিশিষ্ট সাদা মদ্দা ভেড়া দাঁড়িয়ে আছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) (প্রসঙ্গতঃ) বলেন, “আমরা এ ধরনের ভেড়া/দুম্বা একই জায়গায় বিক্রি করতাম।” অতঃপর তিনি আরো বলেন, “হযরত জিবরীল ফেরেশতা (عليه السلام) পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-কে ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলে সেখানে শয়তান আবির্ভূত হয়। হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) তার দিকে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলে সে পালিয়ে যায়। [আহমদ ইবনে হাম্বল রচিত ‘আল-মুসনাদ’, ১:২৯৭; আল-তাবারা’নী কৃত ‘আল-মু’জাম আল-কবীর’, ১০:২৬৮ #১০,৬২৮; আল-বায়হাক্বী প্রণীত ‘আল-সুনান আল-কুবরা’, ৫:১৫৩-১৫৪; আল-হায়সামী লিখিত ‘মজমা’ আল-যাওয়া’ঈদ ওয়া মানবা’ আল-ফাওয়া’ঈদ’, ৩:২৫৯; আল-তাবারী রচিত ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ২৩:৮০; এবং ইবনে কাসীর কৃত ‘আল-তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন আল-’আযীম’, ৪:১৬]
হযরত ইবরাহীম (عليه السلام) শয়তানের দিকে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপের সময় যুগপৎভাবে আল্লাহর ‘তাকবীর’ (শ্রেষ্ঠত্ব) পাঠ করেছিলেন। এর প্রমাণস্বরূপ হযরত মুজাহিদ ইবনে যুবায়র (বেসাল: ১০৪ হিজরী) বলেন: পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام) হযরত জিবরীল ফেরেশতা (عليه السلام)-এর সাথে অগ্রসর হন। ‘জামরা আল-’আক্বাবা’ অতিক্রমকালে শয়তানের আবির্ভাব ঘটে। হযরত জিবরীল (عليه السلام) বলেন, ‘আপনি তাকবীর পাঠ করে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ শয়তান আবারো ‘জামরা আল-ক্বুসওয়া’য় দেখা দিলে জিবরীল ফেরেশতা (عليه السلام) আবারো পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-কে বলেন, ‘তাকবীর পাঠ করে তাকে পাথর নিক্ষেপ করুন।’ [আল-আযরাক্বী প্রণীত ‘আখবা’র মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আ’সার’, ১:৬৮]
শয়তানের দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করা শুধু পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এরই সুন্নাত নয়, বরঞ্চ এটা পয়গম্বর আদম (عليه السلام)-এরও সুন্নাত। ইমাম আল-কালবী লেখেন: জিমা’র (কঙ্কর যে স্থানটিতে নিক্ষেপ করা হয়) নামকরণ হয়েছে, কেননা পয়গম্বর আদম (عليه السلام) ইবলীস শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতেন যখনই সে তাঁর সামনে থেকে পালাতে থাকতো। [আল-আযরাক্বী রচিত প্রাগুক্ত ‘আখবার মক্কা ওয়া মা’ জা’য়া ফীহা’ মিন আল-আসা’র’, ২: ১৮১]
সর্বশক্তিমান আল্লাহতা’লার প্রিয় বান্দার হাতে হাজার হাজার বছর আগে সংঘটিত এই কাজটি মহাপ্রভুর কাছে এতোই সন্তুষ্টির ছিল যে তিনি এই উম্মতের প্রতি (হজ্জ্বের রীতি হিসেবে) তা আবারো পালনের আদেশ জারি করেন। এটা হজ্জ্বের প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে যায়; যা ব্যতিরেকে হজ্জ্ব অসম্পূর্ণ রবে।
এই আমল উদ্দেশ্য ও অর্থহীন নয়। কেননা, এটা আমাদেরকে তিনটি বিষয় শিক্ষা দেয়:
(১) আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামের সুন্নাতের ধারাবাহিকতা;
(২) এ কাজের অনুকরণের ফলে আম্বিয়া (عليه السلام)-এর প্রতি মহব্বত ও আনুগত্য প্রকাশ হয়;
(৩) শয়তানের প্রতিনিধিত্বকারী স্তম্ভের দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করে মুসলমানবৃন্দ শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন।
এই পুরো আলোচনার সারমর্ম হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করে আবেগের বহিঃপ্রকাশ কেবল শরীয়তে জায়েয-ই নয়, বরং এটা মহান আল্লাহতা’লার আরোপিত একটি রীতি-ও। এরই আলোকে মুসলমান সর্বসাধারণ যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের ধরাধামে শুভাগমন উপলক্ষে খুশি প্রকাশার্থে ধর্মীয় সভা-সমাবেশ/মাহফিলের আয়োজন করেন, তাহলে তা সম্পূর্ণ জায়েয বা বৈধ হবে।
এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন মহানবী (ﷺ)-এর সাথে আমাদের আত্মিক বন্ধন সৃদৃঢ় করে থাকে এবং তাঁর প্রতি আমাদের এশক্ব-মহব্বত ও বিশ্বাস-ও বৃদ্ধি করে বটে। প্রেমাস্পদকে স্মরণ করা এবং তাঁর মহব্বতে বিলীন হওয়া এমনই সব আহওয়াল (আধ্যাত্মিক অবস্থা) যা আল্লাহর দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যায়িত একটি বিষয়। খালেস নিয়্যতে তথা সৎ উদ্দেশ্যে পবিত্র কা’বায় হজ্জ্বে গমন পয়গম্বর ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রতি আমাদের স্মৃতি জাগরূক রাখে, আর এরই ফলে মহান আল্লাহতা’লা আমাদের ছোট-বড় সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেন [হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহূ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের বাণী উদ্ধৃত করেন, যিনি বলেন, ‘যে কেউ হজ্জ্ব পালন করলে, এবং কোনো অশোভনীয় আচরণ বা অপরাধ না করলে, সে তার মায়ে তাকে জন্ম দেয়ার দিনের মতোই নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ এই হাদীসটি রওয়ায়াত করেছেন আল-বুখারী নিজ ‘আল-সহীহ: কিতা’ব আল-হজ্জ্ব’, ‘ক্ববূল হজ্জ্বের গুণাবলী’ শীর্ষক অধ্যায়, ২: ৫৫৩ #১৪৪৯ গ্রন্থে; ইবনে আল-জা’আদ তাঁর ‘আল-মুসনাদ’, পৃষ্ঠা ১৪১ #৮৯৬ পুস্তকে; ইবনে মুনদাহ আপন ‘আল-ঈমান’, পৃষ্ঠা ৩৯২ #২৩০ বইয়ে; আল-মাক্বদিসী তাঁর ‘ফাদা’য়েল আল-আ’মাল’, পৃষ্ঠা ৮১ #৩৪৭ কিতাবে; এবং আল-তাবারী নিজ ‘জামে’ আল-বয়া’ন ফী তাফসীর আল-ক্বুরআ’ন’, ২:২৭৭ পুস্তকে]। সে তুলনায় মওলিদুন্নবী (ﷺ) উদযাপনের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের প্রতি যে মুসলমান-ব্যক্তি সালাত-সালাম পেশ করেন এবং হুযূরে পূর নূর (ﷺ)-এর সাথে নিজ আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় করেন, তাঁর জন্যে কী (ঐশী) পুরস্কার মঞ্জুর হতে পারে? বস্তুতঃ রাসূল-প্রেম ঈমানের সার তথা নির্যাস নয় কি?
__________________
মওলিদুন্নবী (ﷺ)-এর উদযাপন ও অনুমতি (১ম খণ্ড)
মূল: শায়খুল ইসলাম ড: মুহাম্মদ তাহিরুল কাদেরী
অনুবাদ: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan]
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন