গুনাহ কয়েক রকমের আছে, যেমন র্শিক, কবীরা ও সগীরা। সগীরা গুনাহ দু’ধরনের হয়ে থাকে- কতেকগুলো হচ্ছে ক্ষতিকর ও জিলতীপূর্ণ, যেমন- চুরি, ওজনে কম দেয়া ইত্যাদি, আর কতেকগুলো এ রকম নয়। আবার এ সব গুনাহের দুটি পদ্ধতি রয়েছে; কতেকগুলো ইচ্ছাকৃত করা হয় আর কতেকগুলো ভুলবশতঃ করা হয়। আম্বীয়া কিরামের জন্যও দুটি অবস্থা রয়েছে- একটি হচ্ছে নবুয়তের আগেরও অপরটি হচ্ছে নবুয়তের পরবর্তী অবস্থা। খোদার মেহেরবাণীতে নবীগণ সব সময় র্শিক কুফরী, বদআকীদাপূর্ণ ও গর্হিত আচরণ থেকে পবিত্র। তাঁরা নবুয়তের আগে বা পরে, ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশতঃ এক মুহূর্তের জন্যও বদআকীদা পোষণ করতে পারেন না। কেননা তাঁর জন্মগতভাবেই আরিফ উল্লাহ (আল্লাহকে সনাক্তকারী) হয়ে থাকেন।
❏ ‘মদারেজ ও মওয়াহেব’ গ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে হযরত আদম (عليه السلام) সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথেই আরশের নীচে লিখা অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন-
لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ
এর থেকে আদম (عليه السلام)কে জন্মগতভাবে আরিফ উল্লাহ বলা যায়। ৫৩৬
ওস্তাদ ছাড়া লিখা পড়া জানা এবং জন্মের সাথে সাথে লিখা পড়তে পারা তা-ই প্রমাণ করে।
❏ হযরত ঈসা (عليه السلام) জন্ম হওয়া মাত্রই বলেছিলেন-
قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا
আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে কিতাব প্রদান করেছেন এবং নবী মনোনীত করেছেন।’’ ৫৩৭
➥537. সূরা মারিয়ম, আয়াত নং-৩০
❏ তিনি আরও বলেছেন-
وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا (৩১) وَبَرًّا بِوَالِدَتِي
আমাকে আমরণ নামায ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন এবং আমি নিজের মায়ের সাথে সৎ আচরণকারী।’’৫৩৮
➥538.সূরা মরিয়ম, আয়াত নং-৩১
এ আয়াত থেকে বোঝা গেল হযরত মসীহ (عليه السلام) জন্ম গ্রহণের সাথে সাথে খোদার খোদায়িত্ব, নিজের নবুয়াত লাভ ও ইঞ্জিল কিতাব প্রদানের কথা জানতেন। তিনি কর্মকৌশল, স্বভাব চরিত্র ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কেও সম্যক অবগত ছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) শৈশবে নিজের কাফির কউমের কাছে তাওহিদের এমন মজবুত দলীল পেশ করেছিলেন, যা অখণ্ডনীয় ছিল। তিনি চাঁদ সূর্য ও তারকারাজীর অস্ত যাওয়া ও অবস্থার পরিবর্তন হওয়া থেকে ওগুলোকে মখলুক (সৃষ্ট) বলে প্রমাণিত করেছেন।
❏ তিনি তারকারাজী দেখে বলেছিলেন قَالَ هَذَا رَبِّي (ওহে কাফির, এগুলো কি আমার রব হতে পারে? (সূরা আনআম, আয়াত, ৭৮)
❏ এবং ডুবে যেতে দেখে বলেছিলেন,
قَالَ لَا أُحِبُّ الْآفِلِينَ
(ডুবন্ত জিনিসকে আমি পছন্দ করি না। সূরা আন‘আম, আয়াত নং-৭৬)
তার শৈশবের এ পবিত্র কথাবার্তা বু-আলী সিনা ও ফরাবীর সমস্ত যুক্তি বিদ্যাকেও হার মানিয়েছে। তার এ কথাবার্তাকে আজকালকার যুক্তিবাদীরা সাজিয়ে গুছিয়ে এভাবে বলেন-
العالم متغير وكل متغير حادث
অর্থাৎ পৃথিবী পরিবর্তনশীল এবং প্রত্যেক পরিবর্তননীয় বিষয় ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং العالم حادث পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী। অতঃপর বলেন-
العالم حادث ولا شيئ من الحادث بمعبود فالعالم ليس بمعبود
-‘‘পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী এবং কোন ক্ষণস্থায়ী জিনিস খোদা হতে পারে না। অতএব পৃথিবী খোদা নয়।’’
❏ এ ধরনের বিশ্লেষণকে স্বীকৃতি প্রদান পূর্বক আল্লাহ তাআলা ইরশাদ ফরমান-
وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ
-‘‘এ আমার যুক্তি প্রমাণ যা ইব্রাহীম (عليه السلام)কে দিয়েছিলাম তাঁর কউমের মুকাবিলায়।’’ ৫৩৯
➥539.সূরা আনআম, আয়াত নং- ৮৩
হুযূর সৈয়্যদুল আম্বিয়া (ﷺ) জন্ম লাভ করার সাথে সাথে সিজ্দাতে গিয়ে উম্মতের জন্য সুপারিশ করেছেন। (মাদারেজুন নবুয়ত ও মাওয়াহেবুল ল্লাদুন্নিয়া গ্রন্থ দ্রষ্টব্য) এতে বোঝা যায়, তিনি (ﷺ) আল্লাহ তা’আলা সম্পর্কে, নিজের অবস্থান ও পদমর্যাদা এবং উম্মতের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়েই জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কালে ছেলেরা তাঁকে খেলাধুলার প্রতি অনুপ্রাণিত করতে চাইলে তিনি তাদেরকে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা এরিষ্টটল ও প্লেটোর সমস্ত দর্শনকেও হার মানায়। সেই উত্তরটা ছিল মানব জাতির জিন্দেগীর মূল উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন-
مَا خَلَقْنَا لهذا
-আমাদেরকে এ জন্য সৃষ্টি করা হয়নি।’’
❏ আল্লাহ তা’আলা একে প্রত্যায়ন করে বলেন-
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
-‘‘আমি জ্বীন ও মানুষকে ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’’ ৫৪০
➥540. সূরা জারিয়াহ, আয়াত নং-৫৬।
❏ নবী করীম (ﷺ) বলেন-
كُنْتُ نَبِيًّا وَآدَمُ بَيْنَ الْمَاءِ
আমি ওই সময় নবী ছিলাম, যখন হযরত আদম (عليه السلام) মাটি পানিতে বিলীন ছিলেন।’’ ৫৪১
➥541. এ হাদিসটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত “প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন” ১ম খণ্ডের ........ পৃৃষ্ঠায় দেখুন।
❏ তাফসিরাতে আহমদিয়্যাহ গ্রন্থে কোরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াত-
لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-
انهم معصومون عن الكفر قبل الوحى وبعده باجماع
অর্থাৎ নবীগণ ওহী প্রাপ্তির আগে ও পরে কুফরী থেকে পূতঃপবিত্র থাকেন।’’ ৫৪২
➥542. আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৩৪।
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে বোঝা গেল যে, নবীগণ জন্মগতভাবেই আল্লাওয়ালা হয়ে থাকেন। তাদের পবিত্র সত্তা কখনও গুমরাহীর অপবাদে কলঙ্কিত হতে পারে না। জেনে শুনে তারা নবুয়তের আগে ও পরে কখনও গুনাহে কবীরায় (গুরুপাপ) লিপ্ত হননি, তবে হ্যাঁ ভুল বশতঃ গুনাহ প্রকাশ পেতে পারে, কিন্তু এতে অটল থাকতেন না। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হতো। নবুয়তের আগে বা পরে সে ধরনের সগীরা গুনাহ (লঘু পাপ) তাঁদের থেকে কখনও প্রকাশ পেতে পারে না, যেগুলো গর্হিত ও জিলতীপূর্ণ। অবশ্য সগীরা গুনাহের মধ্যে যে গুলো এ ধরনের নয়, তা প্রকাশ পেতে পারে। উল্লেখ্য যে এ বিশ্লেষণ সেসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে গুলো তবলীগে দ্বীনের সাথে জড়িত নয়। কেননা, তবলীগি আহ্কামের ক্ষেত্রে কমবেশী বা গোপন করা থেকে নবীগণ সব সময় নিষ্পাপ। এক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশতঃ কখনও কোন প্রকারের পাপ হতে পারে না। গুনাহের এ বিশ্লেষণ অন্যান্য নবীদের জন্য করা হয়েছে, কেননা তাদের থেকে মাঝে মধ্যে গুনাহ প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু সৈয়্যদুল আম্বিয়া হুযূর (ﷺ) থেকে কখনও কোন প্রকারের গুনাহ প্রকাশ পায়নি। এ ব্যাপারে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে যে নবুয়তের আগে ও পরে সগীরা-কবীরা কোন প্রকারের গুনাহ ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি।
❏ যেমন তাফসিরাতে আহমদিয়্যাহ গ্রন্থে কোরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াত-
لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ
এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-
لا خلاف لاحد فى ان نبينا عليه السلام لم يرتكب صغيرة ولا كبيرة طرفة عين قبل الوحى وبعده كما ذكره ابو حنيفة فى الفقه الاكبر
-‘‘এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, আমাদের নবী (ﷺ) নবুয়াতের আগে বা পরে এক মুহূর্তের জন্যও সগীরা বা কবীরা কোন প্রকারের গুনাহে লিপ্ত হননি, যেমন ইমাম আবু হানিফা (رضي الله عنه) ফিক্হে আকবরে উল্লেখ করেছেন।’’ ৫৪৩
➥543. আল্লামা মোল্লা জিওন, তাফসিরে আহমদিয়্যাহ, পৃষ্ঠা-৩৪।
❏ তফসীরে রূহুল বয়ানে সূরা আশ-শূরার ৫২ নং আয়াত
مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ
এর তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখিত আছে-
ويدل عليه انه عليه السلام قيل له هل عبدت وثناقط قال لا قيل هل شربت خمرا قط قال لا وما زلت اعرف ان الذين هم عليه كفر
-‘‘হুযূর (ﷺ)কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল আপনি কখনও মূর্তি পূজা করেছিলেন? তিনি ইরশাদ ফরমান- ‘না’। “আপনি কখনও শরাব পান করেছিলেন?” ফরমালেন- ‘না, আমিতো সবসময় জানতাম যে, আরববাসীর এ আচরণ কুফরী’।’’ ৫৪৪
➥544. আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী, তাফসিরে রুহুল বায়ান, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-৩৪৭।
_________________
জা’আল হক (দ্বিতীয়াংশ)
মূল: হযরত হাকীমুল উম্মত মুফ্তী আহমদ ইয়ার খান নঈমী (رحمة الله)
অনুবাদ: অধ্যাপক মুহাম্মাদ লুৎফুর রহমান
সূত্রঃ 🌍 ইসলামী বিশ্বকোষ এপ্স।
https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islamboi.rizwan
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন