পবিত্র ক্বুরআন ও তার বাণীবাহক


মুহাম্মদ ওহীদুল আলম

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল। প্রসিদ্ধ এক বর্ণনামতে পৃথিবীতে ১ লক্ষ ২৪ হাজার পয়গম্বর এসেছিলেন। তন্মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল। সকল নবীর মর্যাদাকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন। তিনি তাঁদের সবার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার জন্য মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো নবীকে অমর্যাদা করা ঈমানের দাবির সাথে সাংঘর্ষিক। তিনি সকল নবীর পবিত্রতার সাক্ষী। তাঁকে গ্রহণ করা মানে সকল নবীকে গ্রহণ করা। তিনি সকল মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন একটি বিশেষ কালে ও দেশে; কিন্তু তিনি সকল কালের ও সকল দেশের মানুষের জন্য রেখে গেছেন পালনীয় আদর্শ। তাঁর মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে আল্লাহর অভিপ্রায়। তাঁকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহর অভিপ্রায়কে প্রত্যাখ্যান করা। যে আল্লাহর অভিপ্রায়কে প্রত্যাখ্যান করে তার আর গ্রহণ করার কিছু থাকে না। সবকিছু থাকার পরও সে সর্বহারা।
তিনি নিজ থেকে কোনো কিছু বলেননি; তিনি যা বলেন সব ওহীই। মানুষ বহন করতে পারে না এমন কোনো বোঝাও তিনি মানুষকে বহন করতে বলেননি। অতীতের সকল নবী রাসূলের শিক্ষার সারাংসই তিনি পেশ করেছেন। তিনি মানুষকে তার রবের সন্ধান দিয়েছেন। তিনি তাই প্রচার করেছেন যা তাঁর কাছে ওহী হিসেবে নাযিল হয়েছে। মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণ্ ীএ ‘ওহী’র কাছেই মানুষের বুদ্ধি হোঁচট খেয়েছে। মানুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেই ভালোবেসেছে। সে চর্চা করেছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের। সে চোখে যা দেখেছে তাকেই সুন্দর বা কুৎসিত বলেছে। যা স্পর্শ করেছে তাকেই বলেছে শক্ত বা নরম, ঠান্ডা বা গরম। জিহ্বা দিয়ে যার স্বাদ গ্রহণ করেছে, তাকে বলেছে মজাদার বা বিস্বাদ। কানে যা শুনেছে তাকেই বিবেচনা করেছে মধুর অথবা কর্কশ। নাকে যার ঘ্রাণ নিয়েছে তাকেই বলেছে খুশবু কিংবা বদবু। কিন্তু মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয় সব সময় তাকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে না। সে সব সময় দেখেছে ও দেখছে আকাশের সর্বশেষ প্রান্ত দূরদিগন্তে মাটির সাথে মিশে আছে; কিন্তু তা কখনো মাটির সাথে মিশে নেই, তা স্থাপিত আছে ঊর্ধ্বে কোনো স্তম্ভ ছাড়াই। জন্ডিসাক্রান্ত চোখে সে সব রংকে হলুদ দেখেছে, অন্ধকারে দড়িতে পা দিয়ে তাকে সাপ ভেবেছে, আলোআঁধারিতে কলাগাছের পাতার দোলানিকে ভূতের আন্দোলন ভেবেছে, অনেক সময় আলো কে আলেয়া, আলেয়াকে আলো ভেবেছে, জরাক্রান্ত অবস্থায় মিষ্টিকে তার জিহ্বায় তিতা ঠেকেছে, নিদ্রিতাবস্থায় দরজায় করাঘাতকে ঘন্টাধ্বনি মনে করেছে, স্বপ্নে বাঘের তাড়া খেয়ে নিজেকে বিপদগ্রস্ত ভেবেছে। সর্দি অবস্থায় নাসিকা তাকে ঘ্রাণের সত্যিকারের স্বরূপ বুঝতে দেয়নি।
অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে হয়তো ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাদ্যের খোঁজ পেয়েছে, কিন্তু কোন খাদ্য তার জন্য উপকারী কিংবা অপকারী, সিদ্ধ না নিষিদ্ধ তা সে বুঝতে পারেনি। মাটি ফেটে বীজের অঙ্কুরোদগম সে দেখেছে কিন্তু জীবনের রহস্য নির্ণয়ে সমর্থ হয়নি। পঞ্চেন্দ্রিয়ের জ্ঞান তাকে এ কথার সন্ধান দিতে পারেনি যে কোথা হতে তার আগমন ঘটেছে, কোথায় তার নির্গমন ঘটে, কী তার শেষ পরিণতি। এ কথাও সে বুঝতে পারেনি জীবন কী, কী-ইবা এর উদ্দেশ্য।
সে জানতে পারেনি প্রাণ কী, জীবনের সূত্রপাত কিভাবে। ওহীলব্ধ জ্ঞান মানুষকে এ বিষয়ে সাহায্য করেছে। তাতেই মানুষ জানতে পেরেছে তার সৃষ্টির রহস্য, উদ্দেশ্য। ওহীর মাধ্যমেই সে পেয়েছে তার কর্তব্য-নির্দেশ। সে জানতে পেরেছে তাঁর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তার বিবর্তন ঘটান। একদিন তাকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হয়। তার জীবন কোনো উদ্দেশ্যহীন নয়। তার প্রতিটি কর্মের হিসাব দিতে হবে তাঁর প্রভুর দরবারে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সেই মহান প্রভুর ইবাদত করার জন্য। আর সকল সৃষ্টিকে অস্তিত্বে আনা হয়েছে মানুষেরই প্রয়োজনে।
এখানে মানুষের বুদ্ধির সাথে ওহীলব্ধ জ্ঞানের ঘোরতর বিবাদও লেগেছে। অনেক মানুষ এ জ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করেছে ও করে চলেছে। ওহীলব্ধ জ্ঞান মানুষের এ অহমিকাকে তিরস্কার করেছে, তাদের বুদ্ধির ঘাটতিকে প্রকাশ্যে এনেছে, হুঁশিয়ার করেছে এবং সংযম দেখিয়ে বলেছে, দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। কেন নেই? কারণ মিথ্যা থেকে সত্য পৃথক হয়ে গেছে। যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে তার দায় দায়িত্ব তাদের নিজেদের। কেউ যেন মনে না করে যে, সত্য দ্বীনকে গ্রহণ করা বা না করা একই সমান অর্থ বহন করে। সত্য গ্রহণে মুক্তি অস্বীকৃতিতে অবধারিত শাস্তি। কারণ এ সত্য এসেছে মহান আল্লাহর তরফ হতে।
মানুষের জন্য এ বিষয়টি একবারে খোলাসা করে দিয়েছেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কিভাবে? তাঁর নিজের জীবনের সামগ্রিক ও সকল কাজকর্ম দিয়ে, ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে, মানুষকে হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে, প্রচার করে এবং সর্বোপরি ক্বুরআন উপহার দিয়ে। তাঁর জীবন তেমন দীর্ঘ ছিল না; কিন্তু তাঁর জীবনের সকল খুঁটিনাটি ক্বুরআন, হাদীস ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। তিনি দিনে যা করেছেন রাতে তা লিপিবদ্ধ হয়েছে, রাতে যা করেছেন দিনে তা লিপিবদ্ধ হয়েছে। কখনো সাথে সাথে। পৃথিবীর শুরু থেকে এ পর্যন্ত এমন কোনো মনীষীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি যাঁর সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে সকাল, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল বিবরণ মানুষের কাছে মজুদ আছে। যাদের মধ্যে তিনি জীবনযাপন করেছিলেন তারাই তাঁকে স্বতস্ফূর্তভাবে ‘আল আমীন’ অর্থাৎ ‘পরম সত্যবাদী’ উপাধি দিয়েছিল। এমন গুরুত্বপূর্ণ উপাধি আর কোনো মানুষের ভাগ্যে জুটেছিল বলে ইতিহাসে কোনো নজির নেই। পার্থিব বিষয়ে যিনি কারো সাথে কখনো মিথ্যাচার করেননি তাহলে দ্বীন যা জীবন বিধান, আখিরাত যা মৃত্যু পরবর্তী জীবন- সে সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন বা দিয়েছেন সবই চরম সত্য। কারণ আল্লাহর এ বাণীর প্রচার তাঁর জন্য কোনো জীবিকা অবলম্বনের উপায় হিসেবে ছিল না। আল্লাহর বাণী প্রচার করে তিনি কোনো পার্থিব স্বার্থ কিংবা সম্পদ আহরণ করেননি। পবিত্র কুরআন ছাড়া তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণী যা হাদিস শরিফ নামে খ্যাত সে সবের মাঝে ছড়িয়ে আছে সুস্থ, সুষ্ঠু, সৎ ও মহৎ জীবন গঠনের উপাদান ও নির্দেশ এবং জ্ঞানের অপূর্ব মণিমুক্তা। পৃথিবীর অনেক জ্ঞানী গুণী তাঁদের জ্ঞানগর্ভ ভাষণের বিনিময় মূল্য গ্রহণ করে যশস্বী ও ঐশ্বর্যশালী হয়েছেন ও হচ্ছেন। অথচ তাঁদের জ্ঞানগর্ভ ভাষণ ইহকালে হয়তো মানুষের তৃপ্তি মেটায়, পরকালের মুক্তিতে সে সব ভাষণের অবদান শূন্য; যদিনা সে ভাষণে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো হয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় মু’জিযা হচ্ছে পবিত্র ক্বুরআন। ক্বুরআনের প্রতিটি বাণীর মর্ম ও অর্থের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তিনি আপন জীবন যাপন ও জীবনাচরণে। তিনি ছিলেন প্র্যাকটিকাল ক্বুরআন। অথচ তিনি সে ক্বুরআনের রচয়িতা ছিলেন না, ছিলেন বাণীবাহক, প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাকারী। আরবের অনেক বুদ্ধিবাদী মানুষ অপবাদ দিয়েছে তিনি নাকি নিজে এটা রচনা করেছেন। তাই তারা আরো বুদ্ধি খরচ করে বলেছে মানুষের রচিত কোনো গ্রন্থের নির্দেশ মানতে তারা বাধ্য নয়! বস্তুত আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে গেলে প্রবৃত্তির প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকতে হবে এটাকেই তারা কঠিন ভেবেছে। তাদের পূর্ব সব সংস্কার পরিত্যাগ করাও তাদের জন্য সহজ ছিল না। কেউ কেউ বলেছে তারা তাদের বাপ দাদাকে যা করতে দেখেছে তাই করে যাবে। কিন্তু তারা বিবেক খাটিয়ে দেখেনি তাদের বাপদাদারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল নাকি মিথ্যাকে আঁকড়ে ছিল।
তাদের মধ্যে আবার অনেকে ক্বুরআনের ভাষাশৈলী, ভাবগাম্ভীর্য ও এর অতুলনীয় বক্তব্যের প্রশংসা করেছেন; কিন্তু ক্বুরআনকে বিশ্বাস ও গ্রহণ করে তারা আল্লাহর অভিপ্রায়ের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেনি। ক্বুরআন শুরু থেকে মানুষ ও জ্বীন জাতিকে আহ্বান জানিয়েছে যদি তাই হয় তাহলে তারা যেন নিজেরা একক বা যৌথভাবে ক্বুরআনের মত কোন গ্রন্থ কিংবা এর একটি সূরা, নাহলে নিদেনপক্ষে একটা আয়াত রচনা করে দেখাক। ক্বুরআনের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস ক্বুরআন নাযিলের ১৫০০ বছর পরও কোনো আদম সন্তানের হয়নি। যদিও সৃষ্টিশীল লেখকদের মধ্যে অনেক কবি সাহিত্যিক রয়েছেন। ১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত (২০১৭ সাল) ১১৩ জন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে ১৪ জন মহিলাও রয়েছেন। এটা পৃথিবীতে প্রচলিত পুরস্কারের মধ্যে শীর্ষতম মর্যাদার অধিকারী। এ পুরস্কার প্রাপ্তদেরও কারো পক্ষেই তো ক্বুরআনের সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ক্বুরআন যে পদ্ধতিতে বিন্যস্ত ও এর অভ্যন্তরীণ গাণিতিক শৃঙ্খলা যে রকম সুনিপুন কাঠামোতে সুসংবদ্ধ সে রকম একটি গ্রন্থ কোনো মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব কিনা তা কম্পিউটারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। কম্পিউটারের জবাব ছিল ২৬ সেপ্টেলিয়ন বার চেষ্টা করা হলে এ রকম একটা গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব হলেও হতে পারে। ২৬ (ছাব্বিশ) এর পর ২৩ (তেইশ)টা শূন্য বসালে সেপ্টেলিয়ন হয়। অঙ্কে লিখলে সংখ্যাটি দাঁড়ায়, ২৬০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০। কৌতুহলী পাঠক-পাঠিকা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে প্রখ্যাত বাগ্মী ও লেখক আহমদ দীদাত-এর অষ ছঁৎ’ধহ ঃযব ঁষঃরসধঃব সরৎধপষব বইটা পড়ে দেখতে পারেন। (কম্পিউটারে এ ধরনের জবাব বস্তুত: আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এমন ক্বোরআন রচনা করা অসম্ভব, সেদিকেই স্পষ্ট হচ্ছে)
এ এমন এক গ্রন্থ যা সব সময় এর বাণী সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার জন্য জ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কুরআনের অধিকার আছে তাবৎ জ্ঞানীদের গভীর মনোযোগ লাভ করার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ জ্ঞানীরাই বিশেষত এ গ্রন্থের দাবির প্রতি উদাসীন। বস্তুবাদ ও সেকুলারিজম তাদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বস্তুকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বস্তুর ¯্রষ্টাকে ভুলে থাকা মূর্খতা। বহুদিন মানুষ ফিতরতের চর্চা করেছে এখন সময় এসেছে ফিতরতের পাশাপাশি কুদরত চর্চার। কারণ ফিতরতের ¯্রষ্টা ও নিয়ন্তা হচ্ছে (খোদায়ী) কুদরত। মানুষকে মুক্তি পেতে হলে সেই কুদরতের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাহলেই ফিতরতের ওপর কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও প্রভুত্ব করা তার জন্য শোভনীয় ও সম্ভব হবে।
মহানবী এ কুদরতের অভিপ্রায়কেই মানুষের কাছে উন্মুক্ত করেছেন। তিনিই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবাদী। বস্তুবাদীরা জীবনকে মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর কালের ভেতর সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে;। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে শিখিয়েছেন জীবনের (রূহ) শুরু আছে শেষ নেই। এটা অনন্তকাল পর্যন্ত স্থায়ী। একদিন মৃত্যুরও মৃত্যু হবে। কিন্তু মানুষের প্রাণশক্তি (রূহ) অনন্ত কাল পর্যন্ত টিকে থাকবে। কারণ আল্লাহই আদমের দেহে রূহ ফুৎকার করেছেন। এ রূহ অমর। মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের রূহের স্থানান্তর ঘটে মাত্র। কবর সে অমর জীবনের দুয়ার।
ক্বুরআন সে অমর জীবনের ছবি এঁকেছেন। ক্বুরআনের জানালা দিয়ে আখিরাত দেখা যায়। ঈমানকে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে তারা সে জানালাপথে তাকাতে ভয় পায়। ক্বুরআনকে প্রত্যাখ্যান করে তারা সে ভীতি থেকে নিরাপদ থাকতে চেয়েছে। কারণ ঈমান গ্রহণ না করার পরিণতির বাস্তব বর্ণনা রয়েছে ক্বুরআনে। ক্বুরআনকে বিশ্বাস না করেই তারা পরিণতির হাত থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছে। দুনিয়াতে মানুষের সকল অপকর্মের মূল কারণ আখিরাতের জীবনে অবিশ্বাস।
জ্ঞানীরা যদি কিতাব হিসেবে ক্বুরআন ও এর রূপকার হিসেবে হযরত রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গ্রহণ করতো তাহলে মানুষ মানুষের জন্য আজকের দুনিয়ায় যে সকল দুর্দশা ও উপদ্রব সৃষ্টি করেছে তা লোপ পেয়ে যেত। পৃথিবীর সকল সমস্যার সৃষ্টি তথাকথিত ‘সুপার পাওয়ারের’ মাধ্যমে ঘটেছে। সুপার পাওয়ারের অনুসরণে দুনিয়াব্যাপী আরও শত শত ক্ষুদ্র ‘শক্তি বলয়’ সৃষ্টি হয়েছে। ‘শক্তি’কে সব কিছুর নিয়ামক করে তুলে মানুষ দুনিয়াতে জুলুমের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। তারা সুদকে প্রাণিত করেছে, অস্ত্রকে শাণিত করেছে, সম্পদকে পুঞ্জিভূত করেছে, দারিদ্র্যকে বিস্তৃত করেছে, দুর্বল মানুষদের জন্য দাসত্বকে অনিবার্য করে তুলেছে। তারা সৃষ্টি করেছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের রাজনীতি, শোষণমূলক অর্থনীতি, ঋণভিত্তিক বাণিজ্যনীতি, দুর্নীতিমূলক প্রশাসন পদ্ধতি, নিবর্তনমূলক বিচার পদ্ধতি, প্রতারণামূলক মৈত্রী পদ্ধতি, এবং সর্বোপরি সুপার পাওয়ারের আরাধনা পদ্ধতি। মানুষ যদি ক্বুরআনকে গ্রহণ করতো তাহলে তারা সুপার পাওয়ারের পরিবর্তে সুপ্রিম পাওয়ারের কাছে আত্মসমর্পণের শিক্ষা লাভ করতো। কারণ ক্বুরআন হচ্ছে একত্ববাদের উদ্বোধক, নাস্তিকতার কবর রচয়িতা, সুদকে জবাই করার হাতিয়ার, পুঁজিবাদের মৃত্যু পরোয়ানা, জুলুমের অবসানকারী, সা¤্রাজ্যবাদের উৎখাতকারী, সম্পদের সুষম বন্টনকারী, নৈতিকতার উদ্বোধক এবং মানবতার উদ্ধারকর্তা।
পবিত্র ক্বুরআনের পাতায় আল্লাহর পরিচয় অনন্তকালের জন্য অক্ষয় হয়ে আছে। এর ১১২ নম্বর সূরায় বলা হয়েছে: বল, তিনিই আল্লাহ, একক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, (সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী)। তিনি কাউকে জন্ম দেননি। তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।
আল্লাহর এ সংজ্ঞার বাইরে যারা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রভুর তালাশ করে তারা প্রকৃত সত্য থেকে লক্ষ যোজন দুরে।
কুরআনের উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে বুঝা যায় আল্লাহর কোনো শরীক নেই। ৩৬০ দেবতার পূজারী মক্কাবাসী ও অন্যদের এ কথাটুকু হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ২৩ বছর বুঝিয়েছেন। এ ২৩ বছর তাঁর ও তাঁর মুষ্টিমেয় সাহাবীদের নানা বিদ্রুপ, নির্যাতন, নিপীড়ন, ষড়যন্ত্র ও মৃত্যুর মুখোমুখী হতে হয়েছিল। তওহীদ মানুষের জন্য আদি সত্য। এ সত্যের বাণী মানুষের অন্তরে পুঁতে দিতে তাই সর্বাধিক পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার, ঘাম ও রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। এ তওহীদ ও রিসালতের কারণেই সারা দুনিয়ার মুসলমান আজ সকল বিরুদ্ধবাদী মানুষের অভিন্ন শত্রুতে পরিণত হয়েছে। নতুবা তারা কারো পাকা ধানে মই দেয়নি, বাড়াভাতেও দেয়নি ছাই। সংশ্লিষ্ট আয়াত থেকে আরোও বুঝা যায় সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর মুখাপেক্ষী। তাঁর এক দৃষ্টিতে সৃষ্টি জীবিত হয়, আর এক দৃষ্টিতে সৃষ্টি বিলুপ্ত হয়। কারণ তিনিই সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি। তাই তাঁর কোন সন্তান থাকতে পারে না। যারা বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন তারা চরম মিথ্যাবাদী এবং বিভ্রান্ত। তাঁর সাথে তুলনা করার কিছু বা কেউ নেই। অতএব তাঁর কোন মূর্তিও নেই। যারা মূর্তিকে সুপারিশকর্তা মনে করে তারা ভেবে দেখে না যে সেসব মূর্তি একটা মাছিও সৃষ্টি করতে পারে না। শুধু তাই নয় এদের সামনে অর্ঘ্য স্বরূপ প্রদত্ত মিষ্টিদ্রব্যের কিছু অংশ যদি মাছি নিয়ে যায় সে মাছি থেকে মিষ্টির অংশ টুকু কেড়ে নেয়ার শক্তিও এগুলোর নেই। এ কথা হাতে কলমে মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তি যুক্তিতে পরাজিত হয়েও শক্তির দম্ভে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে অনল কুন্ডে নিক্ষেপ করেছিল বর্বর নির্মমতায়। আগুনের ফিতরত (সহজাত স্বভাব)সেদিন কাজ করেনি। সেদিন কুদরত সেখানে হস্তক্ষেপ করেছিল। আল্লাহ আগুনকে আদেশ দিয়েছিলেন, ‘হে অগ্নি, তুমি ইবরাহিমের ওপর শীতল ও আরামদায়ক হয়ে যাও।’ যে অগ্নি হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জন্য শীতল ও আরামদায়ক হয়ে পড়েছিল সে আগুনই তার প্রজ্জ্বলনকারী নমরুদ ও তার সভাসদদের পোড়ানোর জন্য শতগুণ দহন শক্তি নিয়ে ফিরে আসবে। রোহিংগা মুসলমানদের জন্য অগ্নি প্রজ্জ্বলনকারী সন্ত্রাসী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্বরতার কথা স্মরণ করুন। আজ দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্রশক্তিই ইসলাম ও মুসলমানদের চরম ও পরম শত্রুরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
মানুষ হযরত মরিয়ম আলাইহিস সালামকে অনেক অপবাদ দিয়েছে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ঘটনা নিয়ে নানা কল্পনার জাল বিস্তার করেছে। তাঁরা নিজেদের জীবদ্দশায় এ অপবাদ সয়ে গেছেন। ৫০০ বছর পর কুরআন এসে তাঁদের ওপর আরোপিত সকল কলঙ্ক মুছে দিয়েছে। ক্বুরআন সাক্ষ্য দিচ্ছেন, হযরত মরিয়ম আলাইহিস সালাম ছিলেন অনুপম চরিত্রের এক পূত পবিত্র নারী। আল্লাহ বলেছেন হযরত ঈসা (আলায়হিস্ সালাম)’র দৃষ্টান্ত আদমের মত। তিনি এ ঘোষণার সত্যতা সূক্ষèভাবে কুরআনের মাঝেই রেখে দিয়েছেন। ক্বুরআনে হযরত আদম (আলায়হিস্ সালাম)’র নাম উচ্চারিত হয়েছে ২৪ বার, ঈসা (আলায়হিস্ সালাম)’র নামও ২৪ বার। তাঁরা তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন, তওহীদের প্রচার প্রসার ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁরা মুসলমানই ছিলেন। তাই ক্বুরআনে মুসলমান শব্দও এসেছে ২৪ বার। সকল নবী রাসূলের জীবন ছিল জ্বিহাদী জীবন। বাতিল শক্তির মোকাবিলায় তাঁদেরকে সবসময় নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হয়েছে। তাই ক্বুরআনে জ্বিহাদ শব্দও এসেছে ২৪ বার।
ক্বুরআনের আরেক কৃতিত্ব এই যে, অতীতের সকল নবীকে, কারো কারো নাম উল্লেখ করে,কারো নাম উল্লেখ না করে, একেবারে জীবন্ত করে রেখেছেন। তাই অতীতের সকল নবীর অনুসারীদের উচিত কুরআনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। ক্বুরআন সমগ্র মানব জাতির জন্য নাযিল হয়েছে। কেউ একে প্রত্যাখ্যান করলেও সে ক্বুরআনের আইন ও উচ্চারণের আওতার বাইরে যেতে পারবে না। ক্বুরআনের মহান বাহক বলেছেন রোজ হাশরের মাঠে প্রতিটি আদম সন্তানের পক্ষে ৫টি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক পদও সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না: ১.জীবন কিভাবে কাটিয়েছ? ২. অর্জিত জ্ঞান কী কাজে লাগিয়েছ? ৩. সম্পদ কিভাবে আহরণ করেছ? ৪. সে সম্পদ কিভাবে ব্যয় করেছ? ৫. যৌবন কিভাবে কাটিয়েছ?
সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া আজ মানুষের জীবন কাটছে জুলুম করে কিংবা জুলুম সহ্য করে, জ্ঞান ব্যয় হচ্ছে শুধুমাত্র পার্থিব স্বার্থ হাসিলে, সম্পদ আহরিত হচ্ছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে, ব্যয়িত হচ্ছে যথেচ্ছ ভোগ বিলাস ও অশ্লীলতায়, যৌবন কাটছে নিতান্ত হেলাফেলায় কিংবা নিষিদ্ধ পন্থায়।
আমরা মহান আল্লাহর দরবারে সকল ধরনের অন্যায় অবিচার পাপ পঙ্কিলতা থেকে পানাহ চাই।
মুসলিম অমুসলিম কোনো মানুষই কি বলতে পারবে তারা আদম সন্তান নয়? তাই সবাইকে উক্ত প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই জীবন, জ্ঞান, সম্পদ ও যৌবনের যথাযথ ব্যবহার পদ্ধতিই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলে দিয়েছেন, তিনি সকল মানুষের নবী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন তাঁকে বিশ্ব জগতের জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন।
আল্লাহর নবী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন: সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি যাঁর হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, এ যমানার ইহুদি অথবা খ্রিস্টান যেই হোকনা কেন, যে আমার কথা শুনবে অথচ আমি যে বাণী নিয়ে এসেছি তাতে বিশ্বাস না করে মারা যাবে সে অবশ্যই দোযখে প্রবেশ করবে। (সূত্র:সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায় ভল্যুম ১, হাদিস নম্বর ১৫৩) : বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু।
মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে কুরআন ও এর বাণী বাহকের সকল শিক্ষা ও আদর্শ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সমাজে যে যে অবস্থানে আছে সে অবস্থান থেকে সাধ্যমত চেষ্টা করে যাওয়া। কারণ বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছিলেন যারা উপস্থিত আছে তারা যেন অনুপস্থিতদের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দেয়। কারণ এমনও হতে পারে উপস্থিতদের চাইতে অনুপস্থিতরাই তাঁর বাণী থেকে বেশি উপকৃত হবে।
ইসলাম কল্যাণের ধর্ম। মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্যই ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন