নূরনবী ﷺ

চতুর্দশ          অধ্যয়ঃ 

      পিতৃব্য       খাজা       আবু       তালিবের প্রতিপালনে
প্রসঙ্গ নবুয়ত প্রকাশের পূর্বাভাস-ব্যবসা শুরু
========
খাজা আবদুল  মুত্তালিব তাঁর মৃত্যুকালে  বড় পুত্র  আবু তালেবকে ডেকে নবী করীম [ﷺ]-এঁর লালন-পালনের দায়িত্ব   তাঁর   হাতে   অর্পণ   করেন।   সেসময়   থেকে   ২৫  বৎসর     বয়সকাল  পর্যন্ত  নবী   করীম  [ﷺ]    ১৭  বৎসর আপন চাচার সরাসরি তত্বাবধানে থাকেন।   এ সময়ের মধ্যেই      নবী   করীম   [ﷺ]-এঁর     মানবীয়    ও   সামাজিক গুণাবলী    প্রকাশ    পেতে    শুরু    করে    এবং    সামাজিক  কর্মকান্ডের    মধ্য    দিয়ে     তিনি    সততা,    ন্যায়পরতা     ও আমানতদারীর   গুণাবলী প্রদর্শন  করে  ”আল-আমীন” খেতাব  ভূষিত  হন।   আবু    তালেব    আপন   ভাতিজাকে নিজের সন্তানের চেয়ে বেশী স্নেহ করতেন। নবী করীম [ﷺ]-কে      ছাড়া     তিনি      কখনও      আহার      করতেননা।  সকালের   নাস্তা   করার   জন্য   আবু   তালেবের   অন্যান্য  সন্তানগণসহ   একত্রে   নাস্তা   করতে   বসলে   বালকদের  স্বভাব-সুলভ  খানা  নিয়ে কাড়াকাড়ি করার ঘটনা  ঘটে যেত।      নবী      করীম      [ﷺ]      তখন      হাত      ঘুটিয়ে      বসে  থাকতেন।  কাড়াকাড়িতে  অংশ   নিতেন   না।   এই   ছিল নবী  করীম [ﷺ]-এঁর আদর্শ  আচরণ।  এ অবস্থা  দেখে  চাচা  তাঁর  নাস্তা  পৃথক  করে  দিতেন।  নবী  করীম  [ﷺ]  যখন   তাদের   সাথে  খানা  খেতেন,  তখন  সকলেই  তৃপ্ত হতেন। এটা  ছিল নবী করীম [ﷺ]-এঁর কিশোরকালের বরকত।

যখন নবী করীম [ﷺ]-এঁর বয়স ১২/১৪ বৎসর - তখন তিনি পিতৃব্য  আবু  তালেবের   সাথে সিরিয়ার   উদ্দেশ্যে বাণিজ্য  কাফেলায়   শরিক  হওয়ার  ইচ্ছে   ব্যক্ত  করলে খাজা     আবু     তালেব     তাঁকে      সফরসঙ্গী      করে       নেন। পথিমধ্যে  বোছরা  নামক   স্থানে    বোহায়রা  নামক  এক  খৃষ্টান    পাদ্রীর   গির্জার   নিকট    দিয়ে  বাণিজ্য  কাফেলা গমনকালে      উক্ত      পাদ্রী      কিছু      আশ্চর্যজনক      ঘটনা  প্রত্যক্ষ     করে       এবং     ওই     কাফেলার     সকলকে     তাঁর গির্জায়   দাওয়াত    করেন।   তাদের    জন্য   তিনি   খানাও তৈরি   করেন।   সবাই   উক্ত   যিয়াফতে   যোগদান   করে।  কিন্তু    নবী    করীম    [ﷺ]-কে    মাল    সামানার    পাহারায়  রেখে  যাওয়া হয়।  বোহায়রা পাদ্রী  রাসূলুল্লাহ [ﷺ]-কে উক্ত   খানার      মজলিসে    শামিল    করতে   নির্দেশ    দিলে হুযুরকে  আনা  হলো। উক্ত পাদ্রী    নবী  করীম [ﷺ]-এঁর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন - ”লাত  ওজজার কসম   নিয়ে   আমি  আপনাকে  কিছু  প্রশ্ন  করতে   চাই  - সঠিক উত্তর দেবেন।”

নবী       করীম     [ﷺ]       প্রতিবাদ     করে      বললেন     -     লাত উজজার শপথ করে  আমাকে  কিছু  জিজ্ঞেস  করবেন  না।  তখন  বোহায়রা   পাদ্রী   আল্লাহর   শপথ   দিয়ে  নবী  করীম [ﷺ]-এঁর নিদ্রা, দৈনন্দিন কার্যাদি সম্পর্কে  কিছু প্রশ্ন     করেন।     নবী    করীম      [ﷺ]    নিজ      অবস্থা    বর্ণনা করেন।   তখন    বোহায়রা   পাদ্রী    নবী    করীম   [ﷺ]-এঁর হাত   ধরে   বলে   উঠলেন,   ”ইনি   সাইয়েদুল   ‘আলামীন,  রহমাতুল্লীল ‘আলামীন” (বায়হাকী)।

তাঁর এই মন্তব্যের কারণ সম্পর্কে কোরেশগণ জিজ্ঞেস করলে পাদ্রী    বললেন, ”আপনারা  যখন  গিরিপথ পার হয়ে আসছিলেন, তখন আমি দেখতে পেলাম - প্রতিটি পাথর    ও     বৃক্ষ    এই     বালককে    সম্মানসূচক       সিজদা করছে। নবী ব্যতীত  অন্য  কাউকে পাথর ও  বৃক্ষরাজি  সিজদা      করে      না।      আমি      আরও      লক্ষ্য      করেছি      -  আপনাদের   কাফেলার   উপর    একখণ্ড   মেঘমালা    এই বালকের     মাথার      উপর    ছায়া    দিচ্ছে।     এতেই     আমি প্রমাণ     পেয়েছি    যে,     ইনিই     শেষ    যুগের    নবী।”     আবু তালেবকে   লক্ষ্য  করে  পাদ্রী  বললেন,   ”আপনি  এখান থেকেই     বেচাকেনা     সেরে     আপন     ভাতিজাকে     নিয়ে  মক্কায় ফিরে   যান। কেননা,  সামনে ইহুদী শত্রুরা তাঁকে শহীদ করে দিতে পারে- (বেদায়া ও নেহায়া)।  এভাবেই নবুয়তের পূর্বাভাস প্রকাশ পেতে শুরু করলো। এটাকে ইরহাছাত বা পূর্বাভাস বলা হয়।

ফিজার যুদ্দে যোগদান ও হিলফুল ফুযুল গঠন
ইবনে    হিশামের   বর্ণনামতে,    চৌদ্দ   বছর    এবং    ইবনে  ইসহাকের   বর্ণনামতে    বিশ    বছর     বয়সের    সময়   নবী করীম      [ﷺ]     আপন     চাচাদের      সাথে     ফিজার     যুদ্ধে অংশগ্রহণ      করেছিলেন।      এই       যুদ্ধে      অনেক       লোক হতাহত হয়। অনেক নারী বিধবা হয় এবং অনেক শিশু ইয়াতিম   হয়ে   পড়ে।    দেশে   এক   ভয়াবহ   অরাজকতা  দেখা  দেয়। তখন নবী করীম  [ﷺ] সামান্য  কিছু লোক নিয়ে      মযলুমের    সাহায্যার্থে     একটি    সেবাসংঘ    গঠন  করেন।   এই  সেবা  সংঘঠনের   নাম  রাখা  হয়  ”হিলফুল ফুযুল” বা ফযলদের সংঘ। ফযল, ফুযাইল ও আফযল নামে   তিনজন  লোক   এই  সংঘঠনের    ব্যাপারে  বিশেষ অবদান    রাখার     কারণে   তাদের    নামে   এই    নামকরণ করা হয় (বেদায়া  ও  নেহায়)।  এই সংঘের মাধ্যমে  নবী করীম  [ﷺ]    সমাজ  সেবার  এক   মহান    আদর্শ   স্থাপন করেন।

যুদ্ধে  ক্ষতিগ্রস্ত  পরিবারের বিধবা, শিশু ও   নিরাশ্রয়ের   পুনর্বাসনে  হিলফুল ফুযুলের   মাধ্যমে  নবী  করীম  [ﷺ] সমাজসেবার       এক        উত্তম       আদর্শ       স্থাপন       করেন।  অন্যায়ের    প্রতিরোধ     করা    ছিল    এই     সংঘের     লক্ষ্য। সততা   ও মানবসেবায়  অল্পদিনের মধ্যেই  এই সংগঠন গোটা    আরবে  পরিচিতি   লাভ  করে   এবং  সাংঘঠনিক কার্যক্রমের   মাধ্যমে   নবী   করীম   [ﷺ]   মানুষের   কাছে  অতি প্রিয়  হয়ে  উঠেন। এভাবে  হাবীবে কিবরিয়া [ﷺ]  যুবকদের    জন্য  এক  মহান    আদর্শ   স্থাপন  করেন-    যা বর্তমানে রেড  ক্রিসেন্ট নামে পৃথিবীময় আদর্শ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।


 উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি এর "  নূরনবী ﷺ" থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন