দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ হুযুরের দেহতত্ত্বঃ
***********
প্রসঙ্গঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক নূর - নাকি মাটি?
===========
আমরা প্রথম সৃষ্টিতে প্রমাণ পেলাম - আল্লাহর যাত হতে, অর্থাৎ যাতি নূরের জ্যোতি হতে রাসূল [ﷺ] পয়দা হয়েছেন। সাহাবী জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত মারফু হাদীস- অর্থাৎ স্বয়ং নবী করীম [ﷺ]-এঁর জবানে বর্ণিত হাদিস দ্বারা হুযূর [ﷺ] নূরের সৃষ্টি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাটি, পানি আগুন, বায়ু এই উপাদান চতুষ্টয় যখন পয়দাই হয়নি তখন আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] পয়দা হয়েছেন। সুতরাং তিনি যে মাটির সৃষ্টি নন এবং মাটি সৃষ্টির পূর্বেই পয়দা -একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো।
কিন্তু আলমে নাছুত - অর্থাৎ পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশের সময় যে বশরী সূরত বা মানব শরীর ধারণ করেছেন, তা কিসের তৈরী- এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। যেমন- তাবেয়ী হযরত কা'ব আহবার (رحمة الله عليه) এবং সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত কথিত দুটি হাদীস বা রেওয়ায়েতে দেখা যায় যে, নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক মদীনা শরীফের রওযা মোবারকের খামিরা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ দু'খানা রেওয়ায়েতকে পুঁজি করে একদল ওলামা বলেন- হুযূর [ﷺ] মাটির তৈরী। বাতিলপন্থী কোন কোন আলেম আবার ঠাট্টা করে বলেন- তিনি তো সাদা মাটির তৈরী (নাউযুবিল্লাহ)। মাওলানা মুহাম্মদ ফজলুল করীম রচিত 'তাওহীদ রিসালাত ও নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি রহস্য' নামক বইখানা দ্রষ্টব্য। উক্ত বইয়ে আল্লাহকেও নূর বলে অস্বীকার করা হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)।
আবার সহীহ রেওয়ায়েতে দেখা যায় যে, হুযূর [ﷺ] নূর হয়েই আদম (عليه السلام)-এঁর সাথে জগতে তশরীফ এনেছেন এবং আল্লাহর কুদরতে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঐ নূর এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হতে হতে অবশেষে হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه)-এঁর পৃষ্ঠ হতে ঐ পবিত্র নূর সরাসরি হযরত আমেনা (رضي الله عنها)-এঁর গর্ভে স্থান লাভ করেছেন এবং যথাসময়ে নূরের দেহ ধারণ করে মানব আকৃতি নিয়ে দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন।
পর্যালোচনাঃ উক্ত দুই মতবাদের মধ্যে কোনটি সঠিক তা যাচাই-বাছাই করলে দেখা যাবে যে, ইলমে হাদীসের নীতিমালার আলোকে দ্বিতীয় মতবাদটি সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। তাই প্রথমে মাটির রেওয়ায়েত দুটি উসূলে হাদীসের নীতিমালার আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত কথিত হাদীসখানা নিন্মরূপঃ
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه-قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما من مولود إلا وفي سرته من تربته التي خلق منها حتى يدفن فيها وانا وابوبكر وعمر خلقنا من تربة واحدة وفيها ندفن. (تفسير مظهري وخطيب بغدادي المتفق والمفترق)
”হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এঁর রেওয়ায়েতে রাসূলাল্লাহ [ﷺ] বলেন- 'নবজাতক প্রত্যেক শিশুর নাভিতে মাটির একটি অংশ রাখা হয়। সেখানেই সে সমাধিস্থ হয়।' তিনি আরো বলেন- ”আমি, আবু বকর ও ওমর একই মাটি হতে সৃজিত হয়েছি এবং সেখানেই সমাধিস্থ হবো।” (তাফসীরে মাযহাবী ও খতীবে বাগদাদীর 'আল মুত্তাফিক ওয়াল মুফতারিক)
উক্ত হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মোহাদ্দিসগণের মতামতঃ
খতীবে বাগদাদী (رحمة الله عليه) এই রেওয়ায়েতটি তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করে বলেন- 'হাদিসটি গরীব।' 'গরীব হাদিস' বলা হয় প্রতি যুগে মাত্র একজন বর্ণনাকারীই উক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন- দ্বিতীয় কোন বর্ণনাকারী নেই। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে গরীব হাদীস দ্বারা কোন আইনী বিষয় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। [উসূলে হাদীস দ্রষ্টব্য।]
হাদীস শাস্ত্র বিশারদ আল্লামা ইবনে জওযী বলেন- 'এই হাদিসটি মওযু ও বানোয়াট। এই দুটি মতামত স্বয়ং তাফসীরে মারেফুল কোরআন-এর বাংলা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, সৌদি আরবে ছাপা, পৃষ্ঠা- ৮৫৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে। রেওয়ায়েত হিসাবে প্রত্যেক লেখকের কিতাবেই এটি পাওয়া যায়। কিন্তু এর নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেন হাদীসের 'জোরাহ ও তাদীল' বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। ইবনে জওযী'র মতামতের গুরুত্ব প্রত্যেক হাদীস বিশারদের নিকটই স্বীকৃত।
সুতরাং একটি গরীব, জাল, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট রেওয়ায়েতের উপর নির্ভর করে রাসূলে পাক [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারককে মাটির দেহ বলা অসঙ্গত। জাল হাদীস তৈরীতে রাফেযী ও বাতিল ফেরকাগুলি ঐ যুগে তৎপর ছিল। তারা সাহাবী ও তাবেয়ীগণের নাম ব্যবহার করে ভিত্তিহীন হাদীস তৈরী করতো।
কা'ব আহবারের রেওয়ায়েত বিশ্লেষণঃ
عن كعب الاحبار قال لما اراد الله تعالى ان يخلق محمدا صلى الله عليه وسلم امر جبريل ان يأتيه بالطينة التي هى قلب الارض وبهاؤها ونورها قال فهبط جبريل في ملائكة الفردوس وملائكة الرقيع الاعلى. فقبض قبضة رسول الله صلى الله عليه وسلم من موضع قبره الشريف وهي بيضاء منبرة فعجنت بماء التسنيم في معين انهار الجنة حتى صارت كالدرة البيضاء لها شعاع عظيم ثم طافت بها الملائكة حول العرش والكرسي والكرسي وفي السموات والارض والجبال والبحار. فعرفت الملائكة وجميع الخلق سيدنا محمد وفضله قبل ان تعرف آدم عليه السلام (المواهب اللدنية)
অর্থঃ হযরত কা'ব আহবার (তাবেয়ী) বলেন, ”যখন আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-কে (দেহকে) সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি জিব্রাইল (عليه السلام) কে এমন একটি খামিরা নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ করলেন- যা ছিল পৃথিবীর ”কলব, আলো ও নূর” (মাটি নয়)। এই নির্দেশ পেয়ে জিব্রাইল (عليه السلام) জান্নাতুল ফেরদাউস এবং সর্বোচ্চ আসমানের ফেরেশতাদের নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করলেন অতঃপর রাসূলে পাকের রওযা শরীফের স্থান থেকে এক মুষ্টি খামিরা নিয়ে নিলেন। তা ছিল সাদা আলোময় নূর। পরে উক্ত খামিরাকে বেহেশতে প্রবাহিত নহরসমূহের মধ্যে 'তাছনীম' নামক নহরের পানি দিয়ে গোলানোর ফলে সেটি এমন একটি শুভ্র মুক্তার আকার ধারণ করলো, যার মধ্যে ছিল বিরাট আলোশিখা। অতঃপর ফেরেশতারা প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে উক্ত মুক্তা আকৃতির আলোময় খামিরা নিয়ে আরশ-কুরছি, আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত ও সাগর-মহাসাগরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করলেন। এভাবে ফেরেশতাকূল ও অন্যান্য সকল মাখলুক হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর পরিচয় পাওয়ার পূর্বেই আমাদের সর্দার ও মুনিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর ফযীলত সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করলো। (মাওয়াহেবে লাদুনিয়া)
হাদীসখানার পর্যালোচনাঃ
উপরোক্ত কা'ব আহবার (رحمة الله عليه)-এর রেওয়ায়েতখানার বিচার বিশ্লেষণ করলে নীচের জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো বের হয়ে আসে। যথাঃ-
(১) কা'ব আহবার (رحمة الله عليه) পূর্বে একজন বড় ইহুদী পন্ডিত ছিলেন। রাসূল [ﷺ]-এঁর যুগে তিনি মুসলমান হন নি। সুতরাং সাহাবী নন। তিনি হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এঁর খেলাফতকালে মুসলমান হয়ে তাবেয়ীনদের মধ্যে গণ্য হন। সাহাবী'র বর্ণিত হাদীস রাসূলের জবান থেকে শ্রুত হলে তাকে মারফু মুত্তাসিল বলা হয়। আর রাসূলের সূত্র উল্লেখ না থাকলে সাহাবী'র বর্ণিত হাদিসকে মাওকুফ বলা হয়। তাবেয়ী'র বর্ণিত হাদীস, যার মধ্যে সাহাবী ও রাসূলের সূত্র উল্লেখ নেই, তাকে বলা হয় মাকতু। উক্ত হাদীসখানা তাঁর নিজস্ব ভাষ্য। সাহাবী বা রাসূল বর্ণিত হাদীস নয়।
হাদীসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীই এই সূত্র ভালভাবে জানেন যে, তাবেয়ী'র মাকতু হাদীস যদি রাসূলের বর্ণিত মারফু হাদীসের সাথে গরমিল বা বিপরীত হয়, তাহলে রাসূলের বর্ণিত মারফু হাদীসই গ্রহণযোগ্য হবে। কা'ব আহবারের খামিরার হাদীসখানা তাঁর নিজস্ব ভাষ্য এবং তৃতীয় পর্যায়ের। পূর্বে হযরত জাবের বর্ণিত নূরের হাদীসখানা ১ম পর্যায়ের। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ১ম পর্যায়ের হাদীসই অগ্রগণ্য। সুতরাং উসূলের বিচারে কা'ব আহবারের হাদীসখানা দূর্বল ও মুরসাল এবং সহীহ সনদেরও খেলাফ। সোজা কথায় - তাবেয়ী'র বর্ণিত 'মাকতু হাদীস' রাসূলর বর্ণিত 'মারফু হাদীস' এর সমকক্ষ হতে পারে না।
(২) আল্লামা যারকানী বলেন- কা'ব আহবার পূর্বে ইহুদী পন্ডিত ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থে ইসরাইলী বা ইহুদী বর্ণনার মাধ্যমে এই তথ্য পেয়ে থাকবেন। এই সম্ভাবনার কারণে ইসরাইলী বা ইহুদী বর্ণনা আমাদের শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে না - যদি তা অন্য হাদীসের বিপরীত হয়। কা'ব আহবারের বর্ণিত হাদীসটি হযরত জাবেরের হাদীসের পরিপন্থী। তাই এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
(৩) তদুপরি ”ত্বিনাত” (طينة) শব্দটির অর্থ মাটি নয় - বরং খামিরা। এই খামিরার ব্যাখ্যা করা হয়েছে قلب الارض بهاء الارض نور الارض দ্বারা অর্থাৎ- উক্ত খামিরা ছিল পৃথিবীর ক্বলব, আলো ও নূর - তথা নূরে মুহাম্মদী [ﷺ] (যারকানী)। সুতরাং জিব্রাইলের সংগৃহীত খামিরাটি মাটি ছিল না, বরং রওযা'র মাটিতে রক্ষিত নূরে মুহাম্মদীর খামিরা (যারকানী)। খামিরা সূরতের এই নূরে মুহাম্মদীকেই পরে বেহেশতেরর 'তাছনীম' ঝরনার পানি দিয়ে গুলিয়ে এটাকে আরো অণু-পরমাণুতে পরিণত করা হয়েছিল। যেমন পানি হতে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়, তাই বলে বিদ্যুৎকে পানি বলা যাবে না। নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক ছিল সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম। এ মর্মে একখানা হাদীস 'মিলাদে মুহাম্মদী' ও হাক্বীকতে আহমদী' নামক বাংলা গ্রন্থে উল্লেখ আছে। বইখানার লেখক ফুরফুরার খলিফা মেদিনীপুরের মরহুম মাওলানা বাশারাত আলী সাহেব।
হাদীসখানা হচ্ছেঃ-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم نحن معاشر الانبياء. أجسادنا كأجساد الملائكة
অর্থঃ ”আমরা নবীগণের শরীর হলো ফিরিশতাদের শরীরের মত নূরানী ও অতিসূক্ষ্ম।”
তাইতো নবী করীম [ﷺ] সূক্ষ্মতম শরীর ধারণ পূর্বক আকাশ ও ফেরেশতা জগত এমনকি আলমে আমর তথা আরশ-কুরছি ভেদ করে নিরাকারের দরবারে কাবা কাওছাইনে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাটির দেহ ভারী এবং তা লক্ষ্যভেদী নয়। মাটির শরীর হলে ভস্ম হয়ে যেত।
মোদ্দা কথা উপরের দু’খানা হাদীস পর্যালোচনা করলে ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত প্রথম হাদীসখানা জাল এবং কা'ব আহবারের ভাষ্যটি ইসরাইলী ও ইহুদী সূত্রে প্রাপ্ত যা সরাসরি হাদিসে মারফু’র খেলাফ। তদুপরি- কা’ব আহবারের হাদীসখানায় বিভিন্ন তাবিল বা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রয়েছে। এটা মোহ্কাম বা সংবিধিববদ্ধ নয়। সুতরাং হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এর মারফু হাদীস ত্যাগ করে কাবে আহবারের বর্ণিত মাকতু রেওয়াত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার নূর ও মাটির সমন্বিত রূপও বলা যাবে না। যেমন বলেছেন অনেক জ্ঞানপাপী মুফতী। হাদীসের বিশ্লেষণ না জানার কারণেই তারা এরূপ ফতোয়া দিয়েছেন। কা’ব আহবার বর্ণিত খামিরাটি ছিল নূরে মুহাম্মদীর ঐ অংশ- যা দ্বারা দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঐ অংশই রওজা মোবারকের স্থানে রক্ষিত ছিল-(যারকানী দেখুন)।
উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর 'শিয়া পরিচিতি' থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।
***********
প্রসঙ্গঃ নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক নূর - নাকি মাটি?
===========
আমরা প্রথম সৃষ্টিতে প্রমাণ পেলাম - আল্লাহর যাত হতে, অর্থাৎ যাতি নূরের জ্যোতি হতে রাসূল [ﷺ] পয়দা হয়েছেন। সাহাবী জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত মারফু হাদীস- অর্থাৎ স্বয়ং নবী করীম [ﷺ]-এঁর জবানে বর্ণিত হাদিস দ্বারা হুযূর [ﷺ] নূরের সৃষ্টি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাটি, পানি আগুন, বায়ু এই উপাদান চতুষ্টয় যখন পয়দাই হয়নি তখন আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] পয়দা হয়েছেন। সুতরাং তিনি যে মাটির সৃষ্টি নন এবং মাটি সৃষ্টির পূর্বেই পয়দা -একথা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো।
কিন্তু আলমে নাছুত - অর্থাৎ পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশের সময় যে বশরী সূরত বা মানব শরীর ধারণ করেছেন, তা কিসের তৈরী- এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায়। যেমন- তাবেয়ী হযরত কা'ব আহবার (رحمة الله عليه) এবং সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত কথিত দুটি হাদীস বা রেওয়ায়েতে দেখা যায় যে, নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক মদীনা শরীফের রওযা মোবারকের খামিরা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
এ দু'খানা রেওয়ায়েতকে পুঁজি করে একদল ওলামা বলেন- হুযূর [ﷺ] মাটির তৈরী। বাতিলপন্থী কোন কোন আলেম আবার ঠাট্টা করে বলেন- তিনি তো সাদা মাটির তৈরী (নাউযুবিল্লাহ)। মাওলানা মুহাম্মদ ফজলুল করীম রচিত 'তাওহীদ রিসালাত ও নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি রহস্য' নামক বইখানা দ্রষ্টব্য। উক্ত বইয়ে আল্লাহকেও নূর বলে অস্বীকার করা হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)।
আবার সহীহ রেওয়ায়েতে দেখা যায় যে, হুযূর [ﷺ] নূর হয়েই আদম (عليه السلام)-এঁর সাথে জগতে তশরীফ এনেছেন এবং আল্লাহর কুদরতে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঐ নূর এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরিত হতে হতে অবশেষে হযরত আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه)-এঁর পৃষ্ঠ হতে ঐ পবিত্র নূর সরাসরি হযরত আমেনা (رضي الله عنها)-এঁর গর্ভে স্থান লাভ করেছেন এবং যথাসময়ে নূরের দেহ ধারণ করে মানব আকৃতি নিয়ে দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন।
পর্যালোচনাঃ উক্ত দুই মতবাদের মধ্যে কোনটি সঠিক তা যাচাই-বাছাই করলে দেখা যাবে যে, ইলমে হাদীসের নীতিমালার আলোকে দ্বিতীয় মতবাদটি সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। তাই প্রথমে মাটির রেওয়ায়েত দুটি উসূলে হাদীসের নীতিমালার আলোকে পর্যালোচনা করা দরকার। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত কথিত হাদীসখানা নিন্মরূপঃ
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه-قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ما من مولود إلا وفي سرته من تربته التي خلق منها حتى يدفن فيها وانا وابوبكر وعمر خلقنا من تربة واحدة وفيها ندفن. (تفسير مظهري وخطيب بغدادي المتفق والمفترق)
”হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه)-এঁর রেওয়ায়েতে রাসূলাল্লাহ [ﷺ] বলেন- 'নবজাতক প্রত্যেক শিশুর নাভিতে মাটির একটি অংশ রাখা হয়। সেখানেই সে সমাধিস্থ হয়।' তিনি আরো বলেন- ”আমি, আবু বকর ও ওমর একই মাটি হতে সৃজিত হয়েছি এবং সেখানেই সমাধিস্থ হবো।” (তাফসীরে মাযহাবী ও খতীবে বাগদাদীর 'আল মুত্তাফিক ওয়াল মুফতারিক)
উক্ত হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মোহাদ্দিসগণের মতামতঃ
খতীবে বাগদাদী (رحمة الله عليه) এই রেওয়ায়েতটি তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করে বলেন- 'হাদিসটি গরীব।' 'গরীব হাদিস' বলা হয় প্রতি যুগে মাত্র একজন বর্ণনাকারীই উক্ত রেওয়ায়েতটি বর্ণনা করেছেন- দ্বিতীয় কোন বর্ণনাকারী নেই। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে গরীব হাদীস দ্বারা কোন আইনী বিষয় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। [উসূলে হাদীস দ্রষ্টব্য।]
হাদীস শাস্ত্র বিশারদ আল্লামা ইবনে জওযী বলেন- 'এই হাদিসটি মওযু ও বানোয়াট। এই দুটি মতামত স্বয়ং তাফসীরে মারেফুল কোরআন-এর বাংলা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, সৌদি আরবে ছাপা, পৃষ্ঠা- ৮৫৬ এ উল্লেখ করা হয়েছে। রেওয়ায়েত হিসাবে প্রত্যেক লেখকের কিতাবেই এটি পাওয়া যায়। কিন্তু এর নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করেন হাদীসের 'জোরাহ ও তাদীল' বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। ইবনে জওযী'র মতামতের গুরুত্ব প্রত্যেক হাদীস বিশারদের নিকটই স্বীকৃত।
সুতরাং একটি গরীব, জাল, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট রেওয়ায়েতের উপর নির্ভর করে রাসূলে পাক [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারককে মাটির দেহ বলা অসঙ্গত। জাল হাদীস তৈরীতে রাফেযী ও বাতিল ফেরকাগুলি ঐ যুগে তৎপর ছিল। তারা সাহাবী ও তাবেয়ীগণের নাম ব্যবহার করে ভিত্তিহীন হাদীস তৈরী করতো।
কা'ব আহবারের রেওয়ায়েত বিশ্লেষণঃ
عن كعب الاحبار قال لما اراد الله تعالى ان يخلق محمدا صلى الله عليه وسلم امر جبريل ان يأتيه بالطينة التي هى قلب الارض وبهاؤها ونورها قال فهبط جبريل في ملائكة الفردوس وملائكة الرقيع الاعلى. فقبض قبضة رسول الله صلى الله عليه وسلم من موضع قبره الشريف وهي بيضاء منبرة فعجنت بماء التسنيم في معين انهار الجنة حتى صارت كالدرة البيضاء لها شعاع عظيم ثم طافت بها الملائكة حول العرش والكرسي والكرسي وفي السموات والارض والجبال والبحار. فعرفت الملائكة وجميع الخلق سيدنا محمد وفضله قبل ان تعرف آدم عليه السلام (المواهب اللدنية)
অর্থঃ হযরত কা'ব আহবার (তাবেয়ী) বলেন, ”যখন আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-কে (দেহকে) সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন। তখন তিনি জিব্রাইল (عليه السلام) কে এমন একটি খামিরা নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ করলেন- যা ছিল পৃথিবীর ”কলব, আলো ও নূর” (মাটি নয়)। এই নির্দেশ পেয়ে জিব্রাইল (عليه السلام) জান্নাতুল ফেরদাউস এবং সর্বোচ্চ আসমানের ফেরেশতাদের নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করলেন অতঃপর রাসূলে পাকের রওযা শরীফের স্থান থেকে এক মুষ্টি খামিরা নিয়ে নিলেন। তা ছিল সাদা আলোময় নূর। পরে উক্ত খামিরাকে বেহেশতে প্রবাহিত নহরসমূহের মধ্যে 'তাছনীম' নামক নহরের পানি দিয়ে গোলানোর ফলে সেটি এমন একটি শুভ্র মুক্তার আকার ধারণ করলো, যার মধ্যে ছিল বিরাট আলোশিখা। অতঃপর ফেরেশতারা প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে উক্ত মুক্তা আকৃতির আলোময় খামিরা নিয়ে আরশ-কুরছি, আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত ও সাগর-মহাসাগরের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করলেন। এভাবে ফেরেশতাকূল ও অন্যান্য সকল মাখলুক হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর পরিচয় পাওয়ার পূর্বেই আমাদের সর্দার ও মুনিব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা [ﷺ]-এঁর ফযীলত সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করলো। (মাওয়াহেবে লাদুনিয়া)
হাদীসখানার পর্যালোচনাঃ
উপরোক্ত কা'ব আহবার (رحمة الله عليه)-এর রেওয়ায়েতখানার বিচার বিশ্লেষণ করলে নীচের জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো বের হয়ে আসে। যথাঃ-
(১) কা'ব আহবার (رحمة الله عليه) পূর্বে একজন বড় ইহুদী পন্ডিত ছিলেন। রাসূল [ﷺ]-এঁর যুগে তিনি মুসলমান হন নি। সুতরাং সাহাবী নন। তিনি হযরত ওমর (رضي الله عنه)-এঁর খেলাফতকালে মুসলমান হয়ে তাবেয়ীনদের মধ্যে গণ্য হন। সাহাবী'র বর্ণিত হাদীস রাসূলের জবান থেকে শ্রুত হলে তাকে মারফু মুত্তাসিল বলা হয়। আর রাসূলের সূত্র উল্লেখ না থাকলে সাহাবী'র বর্ণিত হাদিসকে মাওকুফ বলা হয়। তাবেয়ী'র বর্ণিত হাদীস, যার মধ্যে সাহাবী ও রাসূলের সূত্র উল্লেখ নেই, তাকে বলা হয় মাকতু। উক্ত হাদীসখানা তাঁর নিজস্ব ভাষ্য। সাহাবী বা রাসূল বর্ণিত হাদীস নয়।
হাদীসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীই এই সূত্র ভালভাবে জানেন যে, তাবেয়ী'র মাকতু হাদীস যদি রাসূলের বর্ণিত মারফু হাদীসের সাথে গরমিল বা বিপরীত হয়, তাহলে রাসূলের বর্ণিত মারফু হাদীসই গ্রহণযোগ্য হবে। কা'ব আহবারের খামিরার হাদীসখানা তাঁর নিজস্ব ভাষ্য এবং তৃতীয় পর্যায়ের। পূর্বে হযরত জাবের বর্ণিত নূরের হাদীসখানা ১ম পর্যায়ের। গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ১ম পর্যায়ের হাদীসই অগ্রগণ্য। সুতরাং উসূলের বিচারে কা'ব আহবারের হাদীসখানা দূর্বল ও মুরসাল এবং সহীহ সনদেরও খেলাফ। সোজা কথায় - তাবেয়ী'র বর্ণিত 'মাকতু হাদীস' রাসূলর বর্ণিত 'মারফু হাদীস' এর সমকক্ষ হতে পারে না।
(২) আল্লামা যারকানী বলেন- কা'ব আহবার পূর্বে ইহুদী পন্ডিত ছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থে ইসরাইলী বা ইহুদী বর্ণনার মাধ্যমে এই তথ্য পেয়ে থাকবেন। এই সম্ভাবনার কারণে ইসরাইলী বা ইহুদী বর্ণনা আমাদের শরীয়তে গ্রহণযোগ্য হবে না - যদি তা অন্য হাদীসের বিপরীত হয়। কা'ব আহবারের বর্ণিত হাদীসটি হযরত জাবেরের হাদীসের পরিপন্থী। তাই এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
(৩) তদুপরি ”ত্বিনাত” (طينة) শব্দটির অর্থ মাটি নয় - বরং খামিরা। এই খামিরার ব্যাখ্যা করা হয়েছে قلب الارض بهاء الارض نور الارض দ্বারা অর্থাৎ- উক্ত খামিরা ছিল পৃথিবীর ক্বলব, আলো ও নূর - তথা নূরে মুহাম্মদী [ﷺ] (যারকানী)। সুতরাং জিব্রাইলের সংগৃহীত খামিরাটি মাটি ছিল না, বরং রওযা'র মাটিতে রক্ষিত নূরে মুহাম্মদীর খামিরা (যারকানী)। খামিরা সূরতের এই নূরে মুহাম্মদীকেই পরে বেহেশতেরর 'তাছনীম' ঝরনার পানি দিয়ে গুলিয়ে এটাকে আরো অণু-পরমাণুতে পরিণত করা হয়েছিল। যেমন পানি হতে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়, তাই বলে বিদ্যুৎকে পানি বলা যাবে না। নবী করীম [ﷺ]-এঁর দেহ মোবারক ছিল সৃষ্টিজগতের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্মতম। এ মর্মে একখানা হাদীস 'মিলাদে মুহাম্মদী' ও হাক্বীকতে আহমদী' নামক বাংলা গ্রন্থে উল্লেখ আছে। বইখানার লেখক ফুরফুরার খলিফা মেদিনীপুরের মরহুম মাওলানা বাশারাত আলী সাহেব।
হাদীসখানা হচ্ছেঃ-
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم نحن معاشر الانبياء. أجسادنا كأجساد الملائكة
অর্থঃ ”আমরা নবীগণের শরীর হলো ফিরিশতাদের শরীরের মত নূরানী ও অতিসূক্ষ্ম।”
তাইতো নবী করীম [ﷺ] সূক্ষ্মতম শরীর ধারণ পূর্বক আকাশ ও ফেরেশতা জগত এমনকি আলমে আমর তথা আরশ-কুরছি ভেদ করে নিরাকারের দরবারে কাবা কাওছাইনে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাটির দেহ ভারী এবং তা লক্ষ্যভেদী নয়। মাটির শরীর হলে ভস্ম হয়ে যেত।
মোদ্দা কথা উপরের দু’খানা হাদীস পর্যালোচনা করলে ইবনে মাসউদ (رضي الله عنه) বর্ণিত প্রথম হাদীসখানা জাল এবং কা'ব আহবারের ভাষ্যটি ইসরাইলী ও ইহুদী সূত্রে প্রাপ্ত যা সরাসরি হাদিসে মারফু’র খেলাফ। তদুপরি- কা’ব আহবারের হাদীসখানায় বিভিন্ন তাবিল বা ব্যাখ্যা করার অবকাশ রয়েছে। এটা মোহ্কাম বা সংবিধিববদ্ধ নয়। সুতরাং হযরত জাবের (رضي الله عنه)-এর মারফু হাদীস ত্যাগ করে কাবে আহবারের বর্ণিত মাকতু রেওয়াত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার নূর ও মাটির সমন্বিত রূপও বলা যাবে না। যেমন বলেছেন অনেক জ্ঞানপাপী মুফতী। হাদীসের বিশ্লেষণ না জানার কারণেই তারা এরূপ ফতোয়া দিয়েছেন। কা’ব আহবার বর্ণিত খামিরাটি ছিল নূরে মুহাম্মদীর ঐ অংশ- যা দ্বারা দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ঐ অংশই রওজা মোবারকের স্থানে রক্ষিত ছিল-(যারকানী দেখুন)।
উস্তাজুল উলামা আল্লামা আবদুল জলীল রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর 'শিয়া পরিচিতি' থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন